নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে মালেয়শিয়া যাওয়া মিজানের শিল্পপতি হয়ে ওঠার গল্প

প্রবাস

আশরাফুল মামুন
17 September, 2022, 07:05 pm
Last modified: 17 September, 2022, 07:26 pm
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তেমন না থাকলেও কঠোর পরিশ্রম, সততা আর লেগে থাকার জেদের গুণেই একের পর এক চমক দেখাতে শুরু করেন। তার কর্মদক্ষতা আর নিষ্ঠার জন্য পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৫ সালে পান সম্মানসূচক দাতু উপাধি। বাংলাদেশের হাতে গোণা ক'জনই এ উপাধি পেয়েছেন।

আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে সুদিনের আশায় নিজের ভাগ্যের চাকা নিজে বদলে দেওয়ার ব্রত নিয়ে প্রায় খালি হাতেই বাড়ি ছেড়েছিলেন চালচুলোহীন মিজান। ঢাকায় এসে হতাশ হওয়া ঠাকুরগাঁওয়ের এ যুবক  নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে মালেয়শিয়ায় পাড়ি জমান, ভাগ্যের চাকা বদলাতে পেরেছিলেন, এখন প্রথম শ্রেণির শিল্পপতি তিনি। 

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তেমন না থাকলেও কঠোর পরিশ্রম, সততা আর লেগে থাকার জেদের গুণেই একের পর এক চমক দেখাতে শুরু করেন। তার কর্মদক্ষতা আর নিষ্ঠার জন্য পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৫ সালে পান সম্মানসূচক দাতু উপাধি। বাংলাদেশের হাতে গোণা ক'জনই এ উপাধি পেয়েছেন। তার এই উত্থানের গল্প সিনেমার গল্পকে হার মানায় এমনটাও মনে হতে পারে। 

ধীরে ধীরে দাতু মিজান দেশটির সেরা নির্মাণ শিল্পের কর্নধারের পরিচিতি পেয়ে যান। নাম হয় মিজান গ্রান্ড ইন্টারট্রেডার্স এসডিএন বিএইচডি। মিজানের ওপর নজর পড়ে দেশটির সরকারের। একজন বাংলাদেশি দাতু মিজানের হাতে দেশটিতে গড়ে উঠে বিশাল অট্টালিকা, বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট। 

দেশটির সরকার তার কর্ম দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে একের পর এক শত শত কোটি টাকার প্রকল্পের চুক্তি করে। সর্বশেষ সম্প্রতি মিজান গ্রান্ড এর অধীনে  কেলান্টন কোতাবারু প্রদেশের সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস (এপিএম) হেডকোয়ার্টার্স নির্মাণ কাজের উদ্ভোধন করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুবের কার্যালয়ের সিনিয়র মন্ত্রী দাতু আবদূল লতিফ বিন আহমদ। 

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারের সাথে মিজান গ্রান্ড এর সরাসরি  চুক্তি হয় ১২৫ কোটি টাকার। এরকম সারাদেশে সরকারের ৫টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মিজান গ্রান্ড এর সাথে প্রায় ৫০০ কোটিরও বেশি চুক্তি হয়েছে।  চুক্তিগুলো কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তার কোম্পানির সাথে করা হয়েছে যা মালয়েশিয়ায় বিরল। 

বর্তমানে একসাথে ৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে তার। সিভিল ডিফেন্স নির্মাণ কাজে নিজ হাতে ইস্কাভেটর চালিয়ে উদ্বোধন করার সময় মন্ত্রী বলেছিলেন 'আমরা সময়ের সেরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি মিজান গ্রান্ড ইন্টার ট্রেডার্সকে দায়িত্ব দিয়েছি।'

সিভিল ডিফেন্সের প্রাদেশিক প্রধান উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'আমরা এমন এক সেরা কোম্পানিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছি, ৩ বছর মেয়াদের কাজ টি মাত্র ২ বছরেই শেষ করতে সক্ষম তারা।' 

মিজানের একজন অভিবাসী নির্মাণ শ্রমিক থেকে শিল্পপতি বনে যাওয়ার কাহিনী ১০ লাখ প্রবাসীর কাছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার অধীনে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশির কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তার কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিতে আরো ২ হাজার শ্রমিক প্রয়োজন। শতাধিক মালয়েশিয়ান নাগরিকও তার কোম্পানিতে কাজ করে। 

মূলত দাতু মিজান নির্মাণ শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ বিপ্লব ঘটিয়েছেন। শত কোটি টাকার শতাধিক ইস্কাভেটর,  টাওয়ার ক্রেন,  পেলোডার, লরি,  ড্রাম ট্রাক ব্যবহার করে কম সময়ে মানুষের পরিশ্রম কমিয়ে স্বয়ংক্রিয় কাজের মাধ্যমে রাতারাতি সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন।

দাতু মিজানের এই আকাশ ছোঁয়া সাফল্যের রহস্যের মধ্যে আছে কঠোর পরিশ্রম, সততার সাথে শ্রমিকের বেতন ভাতা পরিশোধ, ভিসা পারমিট করার কাজ নিজ হাতে সামলানো, সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ আদায় সহজ করা, শ্রমিকের বিপদ-আপদে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে পাশে থাকা। এমন একাধিক শ্রমিকবান্ধব কর্মকান্ড তার সাফল্যের চূড়ায় ওঠার সিড়ি হিসেবে কাজ করেছে। 

মালয়েশিয়ায় অসংখ্য নির্মাণ কোম্পানির বিরুদ্ধে শ্রমিক নির্যাতনসহ সঠিক সময় বেতন না দেওয়া এবং তাদের ন্যায়সংগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ আছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা বাধ্য হয় কাজ ছেড়ে যেতে। কিন্তু দাতু মিজানের কোম্পানিতে যোগ দিলে শ্রমিকরা কখনো কাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করেন না বলে মনে করে কোম্পানিটি। 

এ বিষয়ে পাবনার মোঃ হারুন মিয়া বলেন, '২৬ বছর আগে দাতুর সাথে যোগ দেই, আজ আমি মালয়েশিয়ার নাগরিক,  এখানে বিয়ে করে বাড়ি গাড়ি সংসার করছি,  এসব সম্ভব হয়েছে দাতু মিজানের কারণে।'

শুন্য থেকে মালয়েশিয়ায় শিল্পপতি হওয়ার মূলমন্ত্র কী এ বিষয়ে দাতু মিজানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা খুবই সহজ এবং সুলভ,  আমার কাছে কোনো যাদুমন্ত্র নেই, 'আপনি যে কাজই করেন না কেন, কঠোর পরিশ্রম করতেই হবে। আর, কেউ মূল্যায়ন করুক বা না করুক সেটা কোন বিষয় না,  কাজে ফাঁকি বা প্রতারণা করা চলবে না, সব সময় মাথায় রাখুন বৈধ পন্থায় আপনাকে আরো বড় হতেই হবে যে কোন মূল্যে'।  

'অর্পিত দায়িত্ব পালনে অধীনস্তদের প্রতি অন্যায় আচরণ, বেতন মেরে দেওয়া ও তাদের মনে কষ্ট দিয়ে আপনি কখনোই সামনে অগ্রসর হতে পারবেন না কারণ এটা ভয়ংকর অভিশাপ। নানা কৌশলে শ্রমিকদের খুশি রাখতে পারলে আপনার কোম্পানির অগ্রগতি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না। এই গুণাবলি ধারণ করে এগিয়ে যান সাফল্য আসবেই', যোগ করেন তিনি। 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.