লাখ টাকার টিন ও একটি অনিয়মের ময়নাতদন্ত

টপ নিউজ

নুরুল আমিন ও জিয়া চৌধুরী
09 September, 2019, 09:30 pm
Last modified: 09 September, 2019, 11:01 pm
টিনের চলতি বাজারমূল্যের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণের বেশি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে!  অথবা এভাবে বলা যেতে পারে: “একটি টিনের দামই যখন লাখ টাকার বেশি।”

কাজ শুরুর ২০ দিনের মধ্যে পুরোটি সম্পন্ন দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয় বাজেটের ৭১ লাখ টাকা। অথচ মেরামত কমিটির সদস্য সচিবের দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থেকে জানা যায়, চার মাসে মাত্র ১৫ ভাগ কাজ হয়েছে। আরও চমকপ্রদ তথ্য হল, মেরামতকাজে মাত্র দুই বান টিন লাগিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে ১৪ লাখ টাকা!

সে হিসেবে টিনের চলতি বাজারমূল্যের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণের বেশি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে!  অথবা এভাবে বলা যেতে পারে: “একটি টিনের দামই যখন লাখ টাকার বেশি।”

খাগড়াছড়ির ৬-আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন)-এর কিছু মেরামতকাজের ক্ষেত্রে এমন ঘটনার কথাই জানা গেছে। 

যেভাবে হল অনিয়ম

ঠিকাদারি কাজের কার্যাদেশ  ‍সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১ মার্চ ৪৬ লাখ টাকার ৭টি সংস্কার দরপত্রের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এতে সাড়ে ১১ লাখ টাকার দুটি মডিউল টেন্ট এবং ১৪ লাখ টাকার ড্রেন নির্মাণের কাজও ছিল।

এভাবে ৭টি মেরামত ও সংস্কারের কাজ, ২টি মডিউল টেন্টসহ ১০টি কাজের জন্য বরাদ্দকৃত ছিল মোট ৭১ লাখ টাকা। ঠিকাদারি কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয় মিশু এন্টারপ্রাইজকে।

এর মধ্যে খাগড়ছড়ির মহালছড়ি ৬-এপিবিএন’র সহঅধিনায়কের বাংলো, ফোর্সের রেশন স্টোর, ফোর্সের ২টির ব্যারাক (আধা-পাকা), ২টি পরিদর্শক কোয়ার্টার এবং ফোর্সের ১৫ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল (আধা-পাকা) মেরামতের কাজ ছিল।

শুরুর মাত্র ২২ দিন পর শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে মর্মে প্রত্যায়ন করেন ৬-এপিবিএন-এর তৎকালীন অধিনায়ক মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন। কাজের পুরো ৪৬ লাখ টাকাও তুলে ফেলা হয়।

অথচ এর চার মাস পর সংস্কারকাজ প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজ মাত্র ১৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পরের মাসে আরেক প্রতিবেদনে মাত্র ২৫ শতাংশ সম্পন্ন হবার কথা বলা হয়।

সূত্র জানায়, ৭টি সংস্কারকাজের কোনোটি ঠিকমতো শেষ হয়নি। বিশেষ করে ফোর্সের ব্যারাকের জন্য ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও মাত্র দুই বান টিন লাগিয়ে দায়িত্ব শেষ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

ওদিকে, ২টি মডিউল টেন্টের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১ লাখ টাকা। সেখানে কিছু কাজ করা হলেও পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো এসিগুলো লাগানো হয়নি। সেগুলো এখনও এমআই স্টোর রুমে পড়ে রয়েছে। তাছাড়া, ২৪ ইঞ্চি ড্রেন নির্মাণের জন্য ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু মাত্র ৬ ইঞ্চি ড্রেন বানিয়ে কাজ সমাপ্ত করা হয়।

কমিটি গঠন অনিয়মের অভিযোগ যাচাই যেভাবে

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাহবুব হোসেনের পোস্টিং হয় ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি)। কিন্তু তিনি ২০ সেপ্টম্বর খাগড়াছড়ি এপিবিএন থেকে বিদায় নেন। ১ অক্টোবর সেখানে পোস্টিং হয় উপঅধিনায়ক শাহনেওয়াজ খালেদের। তিনিই সংস্কারকাজের দুর্নীতির বিষয়টির প্রমাণ পান।

কিন্তু এ নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুললে তাকে বাদ দিয়ে ২৭ ডিসেম্বর নতুন তদারক কমিটি গঠন করেন বর্তমান অধিনায়ক আবদুর রহিম। এই কমিটির প্রধান বানানো হয় সাবেক অধিনায়ক মাহবুব হোসেনকেই। তবে উপঅধিনায়ক শাহনেওয়াজ খালেদকেও সদস্য সচিব হিসেবে কমিটিতে রাখা হয়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্তি প্রতিবেদনে সাক্ষর করতে তদন্ত প্রতিবেদনটি শাহনেওয়াজ খালেদের নতুন কর্মস্থলে পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে শাহনেওয়াজ বদলি হয়ে যান। তবে আগের কর্মস্থলের অনিয়ম তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে সেটিতে তার সাক্ষর দরকার ছিল। কিন্তু খালেদ সাক্ষর না দিয়ে অনিয়মের উল্লেখ করে ১০ ডিসেম্বর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করেন।

বদলি হয়ে আসার আগেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিশু এন্টারপ্রাইজের অনিয়মের জন্য এটিকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন শাহনেওয়াজ।

১০ ডিসেম্বর দেওয়া এইা‘নোট অব ডিসেন্টে’ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ উল্লেখ করেন: “তদারক কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে ১ জুন, ৪ জুলাই ও ৮ জুলাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনটি প্রতিবেদন দিয়েছিলাম (ভিডিও ও স্থিরচিত্র সংযুক্ত)। কাজে নানা অনিয়ম (ভিডিও ও স্থিরচিত্র থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে) থাকায় সমাপ্তি প্রতিবেদনে সাক্ষর করা সম্ভব নয়।“

অভিযোগ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে

অভিযোগে প্রকাশ, এপিবিএন-এর হিসাবরক্ষক রতন ৪৬ লাখ টাকা তুলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স মিশু এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার জসিম ও ৬-এপিবিএন-এর অধিনায়ক মাহবুব হোসেনের কাছে দেন। তখন তারা দুজন একটি কক্ষে ছিলেন। ওই টাকা থেকে ঠিকাদার জসিম মাহবুব হোসেনকে ১৫ লাখ টাকা দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেসার্স তাপস এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স মিশু এন্টারপ্রাইজ এসব সংস্কারসহ অন্য দুটি কাজের দায়িত্ব নেয়। মিশু এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার মোহাম্মদ জসিম। ভিন্ন নামে হলেও তাপস এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটিও মূলত চলে জসিমেরই কর্তৃত্বে।

কাজের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জসিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন,”আমাকে যেভাবে কাজ করতে বলেছেন, আমি সেভাবেই করেছি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট না করতে অনুরোধ করেন।

বর্তমান অধিনায়ক যা বলছেন

অভিযোগ রয়েছে, বিশেষ সুবিধা নিয়ে মিশু এন্টারপ্রাইজকে কালো তালিকাভুক্ত করেননি বর্তমান অধিনায়ক আবদুর রহিম। বরং চলতি অর্থবছরের কাজও করছে ওই প্রতিষ্ঠান।

এ প্রসঙ্গে ৬-এপিবিএন-এর বর্তমান অধিনায়ক পুলিশ সুপার আবদুর রহিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “সদস্য সচিব শাহনেওয়াজ খালেদ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা দাবি করেছিলেন। না পেয়ে তিনি বিষয়টি নিয়ে নানা জায়গায় অভিযোগ করছেন।”

তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে কিছু বলেননি তিনি।

সাবেক অধিনায়ক অস্বীকার করলেন সব

যার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ সেই তিনি হলেন ৬-এপিবিএন-এর সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে মাদারীপুর জেলার এসপি মোহাম্মদ মাহবুব হাসান। সংস্কারকাজের কথিত দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে  দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, “অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি টিম সরেজমিন ঘুরে এসেছে সেখান থেকে।”

তিনি বরং কমিটির সাবেক সদস্য সচিব শাহনেওয়াজ খালেদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার অনুরোধ জানালেন এই প্রতিবেদককে।

সবশেষ

প্রকল্পের কাজ নিয়ে ওঠা অনিয়মের বিষয়টির তদন্ত নিয়ে পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.