চামড়া শিল্পে ধ্বস: প্রকৃতির প্রতিশোধ!

টপ নিউজ

20 August, 2019, 06:25 pm
Last modified: 04 January, 2021, 05:06 pm
ট্যানারি শিল্পের এ ধ্বসকে অবস্থাপনা ও পরিবেশ ক্ষতির প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৯৫৩ সালে হাজারিবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপনের পর থেকেই এর বিষাক্ত তরল বর্জে প্রকৃত রং নষ্ট হয়ে কালোবর্ণ ধারণ করেছে ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা। নতুন করে ক্ষতির মুখে পড়েছে পাশ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীও।

নন কমপ্লায়েন্সের কারণে উচ্ছিষ্ট ও কেমিক্যালে পরিবেশ দূষিত হয়ে নানা রোগের হুমকিতে কারখানা সংলগ্ন এলাকার মানুষ। কারখানায় নিয়মিত কাজ করা ১২-১৫ হাজার শ্রমিক নানা রোগে ভুগছেন বলে উঠে এসেছে নানা গবেষণায়।

প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার কিউবিক তরল বর্জ অবাধে পরিবেশে প্রবেশ হাজারীবাগকে বিশ্বের ৬ষ্ঠ শীর্ষ দূষিত স্থানে পরিণত করেছে বলে উঠে এসেছে বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্রিন ক্রস ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে।

এসব কারণে বহু আগেই বর্জ শোধনাগার স্থাপন ও কমপ্লায়েন্সের তাগিদ দিয়ে আসছে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। দীর্ঘ প্রচেষ্টা শর্তেও কার্যকর ব্যবস্থা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তারা। ফলে গত দুই বছরেই রফতানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপ ও আমেরিকান বায়ার হারিয়ে গত দুই বছর ধরে চামড়ার বড় অংশ কারখানাতেই মজুদ রাখতে হচ্ছে ট্যানারি মালিকদের। ফলে লোকসান গুনছে ট্যানারি মালিকরা। এবারের কুরবানি ঈদে চামড়া না কেনা ও শিল্পের ধ্বস এরই অংশ বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

যদিও ট্যানারি শিল্পের এ ধ্বসকে অবস্থাপনা ও পরিবেশ ক্ষতির প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, ''চামড়া শিল্পের বর্তমান অবস্থার জন্য পরিবেশ ক্ষতির পাশাপাশি সরকারি অব্যবস্থাপনা দায়ী। বৈশ্বিক ক্রেতারা পরিবেশ ইস্যুকে গুরুত্ব দিলেও আমাদের সরকার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।''

তিনি বলেন, ''আমরা নানা গবেষণায় দেখেছি ট্যানারি থেকে টুকরো চামড়া, গরুর হাড়, চর্বি ও দাঁত পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়ংকর দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। তরল বর্জে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্যানারিতে ব্যবহৃত ক্রোমিয়ামসহ বিভিন্ন এসিড শ্রমিকদের ক্যান্সারসহ মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করছে।''

''বর্জ শোধানাগার (ইটিপি) স্থাপন করাসহ হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেয়ার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি। শেষ পর্যন্ত হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর হলেও পরিবেশের ক্ষতি থেকেই গেছে'' বলছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে ট্যানারি পণ্য নেয়া সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান জনস্টোন এন্ড মারফি। দেশের ট্যানারি শিল্প পরিবেশের ক্ষতি করছে জানিয়ে বারবারই বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে তারা। ২০১০ সালেও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ট্যানারি পণ্য নিলেও কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে গত বছর শূন্যে নেমে গেছে এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাংলাদেশী পণ্য ক্রয়।

বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ট্যানারি ক্রয় করা আরেক বৃহৎ ইউরোপিয়ান প্রতিষ্ঠান জনস্টোন কোম্পানিও গত দুই বছর থেকে ক্রয়াদেশ বন্ধ করেছে বাংলাদেশ থেকে। 

 

চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ট্যানারি শিল্পের বর্জ নদী ও পরিবেশের ক্ষতি এবং কারখানায় কমপ্লায়েন্স ঘাটতির কথা জানিয়ে বিকল্প বাজার হিসেবে ভারত ও চীন থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কিনছে এসব প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মাযাকাত হারুন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, ''গত তিন বছর ধরে ইউরোপের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় প্রতিবছর সংগৃহীত চামড়ার ৪০-৫০ শতাংশ মজুদ রাখতে হচ্ছে ট্যানারি মালিকদের। বিকল্প বাজার হিসেবে আমরা চীনকে বেছে নিলেও চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছে তারা।''

জানা গেছে, বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশবাদীদের দাবির কারণে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করে পরিবেশসম্মত শিল্প নগরী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে শেষ করার ঘোষণাও দেয়া হয়। যদিও তা এখনো অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে।

১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সাভারে শিল্পনগরী গড়ে উঠলেও সরকারি অব্যবস্থাপনা এবং ট্যানারি মালিকদের স্বদিচ্ছার অভাবে ২০১৭ সাল পর্যন্তও হাজারীবাগেই ছিল শতভাগ ট্যানারি। হাইকোর্টের আদেশে ওই বছরই হাজারীবাগে সব কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালিকরা। এরপর সাভারে কারখানা স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখন পর্যন্ত উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে ১২৩টি প্রতিষ্ঠান।

আদালতের নির্দেশে ট্যানারি মালিকরা উৎপাদনে গেলেও এখন পর্যন্ত বর্জ শোধানাগারের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। ২০১২ সালে চীনের জিংসু লিংঝি এনভার্নমেন্টাল প্রোটেকশন লিমিটেডকে চামড়া শিল্পনগরীতে সেন্ট্রাল এপালুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে এখনো পর্যন্ত ইটিপির কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় আন্তর্জাতিক মান সনদ পাচ্ছে না দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ কারণেই বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিদেশী ক্রেতারা।

চামড়া শিল্পের অস্থিরতার পেছনে পরিবেশ ইস্যু কাজ করেছে বলে স্বীকার করছে সরকারও। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মফিজুল ইসলাম বলেন, "চামড়া শিল্পনগরী স্থাপনে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অব্যবস্থাপনার দায় আছে। ২০০৩ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েও এখনো ইটিপি স্থাপন শেষ না হওয়া দু:খজনক।"

তবে চামড়া শিল্পনগরীর সমস্যা শিগগিরিই সমাধান হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিসিক। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান বলেন, "আমরা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সিইটিপির কাজ সম্পন্ন করবো। এর আগেই ট্যানারি মালিকদের জমি বুঝিয়ে দেয়াসহ সব সমস্যার সমাধান হবে।"

জানা গেছে, কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে বর্তমানে বিটিএর সদস্যভুক্ত ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৮৮টি। এর মধ্যে সাভারে এখন পর্যন্ত কারখানা স্থাপন করেছে ১২৩টি। কমপ্লায়েন্স না থাকায় অ্যাপেক্স ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক মান সনদ নেই। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) মান সনদ পাওয়ার পূর্ব শর্তই হলো ইটিপি স্থাপন।

এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে জুতা উৎপাদন করতে হয় স্থানীয় ফুটওয়্যার রফতানিকারদের। সর্বশেষ অর্থবছরে ৯৪৫ কোটি টাকার চামড়া আমদানি হয়। ফলে রফতানি ধ্বসের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও বিক্রি কমেছে বাংলাদেশের ট্যানারি মালিকদের।

চামড়া শিল্পে দেশের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক এম এ মাজেদ দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "তিন বছর আগেও বড় কারখানাগুলো দেশি চামড়ার তৈরি পণ্য ইউরোপে রফতানি করতো। স্থানীয়দের ইটিপি সনদ না থাকায় এখন বিদেশী চামড়ায় পণ্য তৈরি করে রফতানি করতে হয়।" 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.