কেন অধিনায়কত্ব ছাড়াই ছিল ‘কোণঠাসা’ কোহলির একমাত্র পথ?

খেলা

সুরেশ মেনন
17 January, 2022, 06:30 pm
Last modified: 17 January, 2022, 09:16 pm
দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে যেকোনো একটা অজুহাতে কোহলিকে অবশ্যই ছেঁটে ফেলা হতো। র‍্যাংকিংয়ে তাদের নিচে থাকা একটি দলের কাছে ১-২ ব্যবধানে হারের ফলে বোর্ডের জন্য কাজটি আরও সহজ হয়ে যায়।

ভারতীয় পুরুষ টেস্ট দলের অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বিরাট কোহলি। ভারতকে তিনি রেকর্ড ৬৮টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জিতেছেন ৪০টি ম্যাচ, যা ক্রিকেট ইতিহাসের টেস্ট অধিনায়কদের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। 

আসলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার আগে কোহলি নিজেই ঝাঁপটি দিয়েছেন। অনেকেই হয়তো শনিবার তার সরে দাঁড়ানোর সংবাদটি শুনে অবাক হয়েছেন। কিন্তু তিনি যে এমন কিছু করবেন, সে ইঙ্গিত ভারত দল দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগেই পাওয়া গিয়েছিল। 

কোহলি যেভাবে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)-এর সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছেন, অতীতে খুব কম অধিনায়ককেই তা করতে দেখা গেছে। তিনি তো কার্যত বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলীকে মিথ্যাবাদীও বলেছেন, যখন টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্ব ছাড়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি গাঙ্গুলীর বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কথা বলেছেন। 

নিশ্চিতভাবেই বোর্ড কর্মকর্তারা এত সহজে ভুলে যাননি এ ব্যাপারটি। তাছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় সাফল্যের খোঁজে কোহলি নিজেও নিজের উপর অনেক বেশি চাপ নিয়ে নিয়েছিলেন। 

অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সহজেই বোঝা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে যেকোনো একটা অজুহাতে কোহলিকে অবশ্যই ছেঁটে ফেলা হতো। র‍্যাংকিংয়ে তাদের নিচে থাকা একটি দলের কাছে ১-২ ব্যবধানে হারের ফলে বোর্ডের জন্য কাজটি আরও সহজ হয়ে যায়। কেননা কোহলি নিজেকে টেনে নিয়েছিলেন খাদের কিনারে। 

অথচ খুব বেশিদিন আগেকার কথা কিন্তু নয়, যখন টেস্ট ম্যাচে একটি ড্র-ই ভারতীয় ক্রিকেটে বিবেচিত হতো জয়ের সমান সাফল্য হিসেবে। কেননা বিকল্পটি ছিল সাধারণত হার। 

কিন্তু এখন সময় বদলেছে। ভারতের কাছে আশা করা হয় তারা সবকিছুই জিতবে। একজন অধিনায়ক হিসেবে এই মনস্তাত্ত্বিক পটপরিবর্তনে কোহলির উপরও বর্তেছিল বিশাল দায়িত্ব। 

৬৮ টেস্টে ৪০ জয়ের মাধ্যমে (ঘরের মাঠে ২৪টি, বিদেশে ১৬টি) তিনি ভারতের সবচেয়ে সফল দলনেতা। তাই সমসাময়িকরা তার উপর যতটাই নারাজ হোক, ইতিহাস তাকে ঠিকই মনে রাখবে। 

কোহলি হয়ে উঠেছেন মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী ভারতের পোস্টার বয়। ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য যে ব্যক্তি সবসময় নিজের জীবনকে রেখেছেন গণমানুষের চোখের সামনে, এবং নিজের তীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশে কখনো কুণ্ঠিত হননি, তার প্রতিটি কাজের যে অতিব্যাখ্যা করা হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! সহজ-সরল বিষয়গুলো থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখার প্রবণতার ফলে, তার প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে প্রায়ই অস্বীকার করা হয়েছে। 

যখন কোহলি একজন অতি-আক্রমণাত্মক, আত্মকেন্দ্রিক টিনেজার ছিলেন, তখন জনপ্রিয় অভিমত এই ছিল যে, মেজাজ আরেকটু নরম না করলে ভারতের হয়ে খেলার কোনো সম্ভাবনাই তার নেই। তখন লোকে এ সত্যটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল যে তিনি কেবলই নিজের বয়সোচিত আচরণ করছেন। 

তবে কোহলি লোকের এসব কথায় কান দেননি। নিজেকে জাতীয় দলের জন্য উপযুক্ত করে তোলার বদলে, তিনি গোটা জাতীয় দলের সংস্কৃতিই বদলে দিয়েছেন যেন সেটি তার নিজস্ব দর্শনের সঙ্গে মানানসই হয়। 

মাত্র একটি প্রজন্মের মধ্যেই, ভারতীয় দল হয়ে উঠেছে আগ্রাসী, আত্মবিশ্বাসী। তাদের মনে এখন বাজে কেবলই জয়ের মন্ত্র। তারা পেয়েছে এমন একদল খেলোয়াড়, যারা নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিতে সবসময় প্রস্তুত। একচুলও ছাড় দিতে রাজি নয়। আর ভক্তরাও ক্রিকেটের উপর্যুপরি সাফল্যে খুব সহজেই ভুলে থাকতে পেরেছে অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের দেশের ব্যর্থতা। 

দায়িত্ব ত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার সময় কোহলি বলেছেন, তিনি তার খেলায় কখনো কোনো অপূর্ণতার জায়গা রাখেননি। ব্যক্তিগতভাবেও তিনি কখনো নিজেকে অবদমিত রাখেননি। তাকে আমরা যেমন দেখেছি, তিনি বাস্তবেও ছিলেন তেমনই - দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আত্মবিশ্বাসী, অনুপ্রেরণাদায়ী। 

তার এমন যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে সাদরে গ্রহণ করেছে তথাকথিত 'নিউ ইন্ডিয়া'-ও। শচীন টেন্ডুলকার যদি হয়ে থাকেন অর্থনৈতিকভাবে আত্মবিশ্বাসী ভারতের পোস্টার বয়, তাহলে কোহলি হয়ে উঠেছিলেন এক মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী ভারতের পোস্টার বয়। 

এখন অধিনায়ক কোহলির সময় ফুরিয়েছে। কিন্তু ব্যাটসম্যান কোহলি এখনো রয়েছেন। এবং সম্ভবত অধিনায়কত্বের দায়ভার মাথা থেকে সরার ফলে একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আমরা তার পুনরুত্থানের সাক্ষী হবো। গত দুই বছর ধরে তিনি কোনো আন্তর্জাতিক শতকের দেখা পাননি, এবং নিঃসন্দেহে সেটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোহলির। কেননা তিনি নিজেই যে নিজের সবচেয়ে বড় ও নির্মম সমালোচক। 

ভারতীয় জাতীয় দলের সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছেন কোহলি। ছবি: সংগৃহীত

কোহলির অব্যাহতির পর বাতাসে এখন দুটি প্রশ্ন উড়ছে। এর মধ্যে একটির জবাব হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু অন্যটির উত্তর যত শীঘ্রই সম্ভব দেওয়া দরকার। 

প্রথম প্রশ্নটি হলো কোহলির লিগ্যাসি নিয়ে। ভারতীয় দল তার অধীনে যে ধরনের অদম্য মানসিকতা ও শক্তিমত্তা নিয়ে খেলেছে, অন্য কারো অধীনেও কি তারা একই ধরনের খেলাই চালিয়ে যাবে?

কেপ টাউনে, অধিনায়ক হিসেবে নিজের শেষ টেস্টে দেখা গেছে, কোহলি এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তিনি স্টাম্প মাইক্রোফোনের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন, এবং মাঠের বাইরে থেকে রিভিউ সিস্টেমের মাধ্যমে নেওয়া একটি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজের হতাশা প্রকাশ করেছেন। 

এমন আচরণ ছিল শিশুতোষ, বিরক্তিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এমন আচরণের জন্য তার শাস্তি প্রাপ্য। তার এই কাজ আরও দুজন খেলোয়াড়কেও উৎসাহিত করেছে ব্রডকাস্টারদের অপমান করতে, অভিযোগ তুলতে যে তারা নাকি হোম টিমের হয়ে খেলছেন। 

এ ধরনের লিগ্যাসি ভারত বয়ে বেড়াতে চাইবে না। এর কোনো দরকারও নেই। 

কিন্তু তারপরও, ইতিবাচক অনেক কিছুই বলা সম্ভব। যেমন কোহলির অধীনে দলের আত্মবিশ্বাস, আগ্রাসন, একতাবদ্ধতা, নিজেদেরকে উজাড় করে দেওয়ার স্পৃহা। কোহলি রেখে যাচ্ছেন ফাস্ট বোলিংয়ের লিগ্যাসিও। এখন ভারতের ফাস্ট বোলিংকে হয়তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার মনে হয়, কিন্তু সেটি সম্ভব হয়েছে জাসপ্রিত বুমরাহসহ আরও একঝাঁক বিশ্বমানের বোলার তৈরিতে কোহলির অসামান্য অবদানের ফলে। 

মজার ব্যাপার হলো, প্রথম টেস্টের পর যখন কোহলি ফিরে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়া থেকে, তখন ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক অজিঙ্কা রাহানের দলটিকে অনেক বেশি শান্ত মনে হয়েছিল। আত্মবিশ্বাস অনেকসময় আত্মবিধ্বংসী ঔদ্ধত্যের কারণ হতে পারে, এবং সম্ভবত সেখানে অধিনায়কের ব্যক্তিত্বের অনেক বড় ভূমিকা থাকে। 

তবে ফিটনেসের উপর কোহলি যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা এখন থেকে ভারতীয় দলের নিয়মিত অনুষঙ্গ হয়ে থাকা উচিত। তাছাড়া যেভাবে তিনি টেস্ট ক্রিকেটকে অন্য সব ফরম্যাটের চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন, সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না। 

সাম্প্রতিক সময়ে রানখরা চলছে কোহলির ব্যাটে। ছবি: সংগৃহীত

এবার যাওয়া যাক অন্য প্রশ্নটিতে, যেটির উত্তর অতিসত্বর প্রয়োজন। কে হবেন কোহলির উত্তরসূরী? রোহিত শর্মা হয়তো বয়োজ্যেষ্ঠ, কিন্তু তিনি কোনো দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নন। তবে অদূর ভবিষ্যতে তিনিই পরিষ্কারভাবে সেরা পছন্দ (নিছক ইনজুরিপ্রবণ বলেই ভারত তার যোগ্যতাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না)। 

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো সহ-অধিনায়কের। ঋষভ পন্তের বয়স কম, এবং সব ফরম্যাটেঈ তার জায়গা নিশ্চিত। তাই সহ-অধিনায়ক হিসেবেও তার নির্বাচন প্রায় অবধারিত। রোহিত শর্মার সহ-অধিনায়ক হিসেবে মেয়াদকাল তার জন্য, এবং সামগ্রিকভাবে ভারতীয় দলের জন্য, মঙ্গলজনক হবে। 

স্বস্তির বিষয়, কোহলির ছেলেরা কোহলিকেও তাদের পাশে পাবেন। 


  • লেখক: উইজডেন ইন্ডিয়া অ্যালমানাকের সম্পাদক। 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.