‘এটাই সর্বোচ্চ জয়’
ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড সব সময়ই অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বের সব দলকেই নাকানি-চোবানি খাওয়ায় তারা। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা ভারত; কোনো দলই সেখানে নিরাপদ নয়। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের আগে কিউইরা ঘরের মাঠে সর্বশেষ ম্যাচে হারে ২০১৭ সালে। এশিয়ার কোনো দেশ সেখানে সর্বশেষ টেস্ট জেতে ২০১১ সালে।
সেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতেই বাংলাদেশ উড়িয়েছে বিজয় কেতন। কিউইদের ঘরের মাঠে অফরাজেয় থাকার দম্ভ মাটিতে লুটিয়ে মুমিনুল হকের দল তুলে নিয়েছে ৮ উইকেটের বড় জয়। ম্যাচের পর মুমিনুল জানান, এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জয়। পরের দিন মাশরাফি বিন মুর্তজাও বললেন একই কথা। দীর্ঘদিন পর মাঠে ফিরে বাংলাদেশের জয়, পেসারদের সফলতা, মুমিনুলের অধিনায়কত্ব, ক্রিকেটারদের সুবিধা-অসুবিধা, নিজের বিপিএল পরিকল্পনাসহ অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন ওয়ানডের সফলতম অধিনায়ক।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) ওয়ানডে টুর্নামেন্টে খেলার কথা আপনার। কোন দলে খেলবেন, কীভাবে ফিরতে চান; এসব নিয়ে যদি একটু বলতেন।
মাশরাফি বিন মুর্তজা: বিসিএল খেলব কিনা, সেটা এখনও নিশ্চিত নই। খানিকটা ব্যাক পেইন আছে। আজকে অনেক দিন পর এসেছি। একটু সময় লাগবে হয়তো। সামনে বিপিএল আছে, আস্তে আস্তে শুরু করছি। ব্যাক পেইনের কী অবস্থা হয়, এটার ওপর নির্ভর করছে। বিসিএলে খেলার কথা বলেছে। তবে প্রস্তুতি পুরোপুরি না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত নয়।
প্রশ্ন: দীর্ঘ সময় পর অনুশীলনে এলেন, বোলিং করলেন। কী মনে হলো?
মাশরাফি: বোলিং সে রকমভাবে করিনি। ব্যাক পেইন আছে। শর্ট রান আপে দেখছিলাম যে কী অবস্থা। এখনও ফুল রান আপে করিনি, মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এখন যেটা হচ্ছে, একটা পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আছি। ব্যথা কিছুটা কমেছে। পরের সপ্তাহে গিয়ে ফুল রান আপে করতে পারলে হয়তো বুঝতে পারব। তবে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন অনুভব করিনি। পেইনের দিক থেকে নয়। যেহেতু রিদম ঠিক আছে, আমার কাছে মনে হয় না ক্যাচ করতে বেশি সময় লাগবে। যত তাড়াতাড়ি ফুল রান আপে করতে পারব, তত ভালো।'
প্রশ্ন: নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। এটাকে বলা হচ্ছে ঐতিহাসিক জয়। আপনার দৃষ্টি জয়টা কতো বড়?
মাশরাফি: দারুণ। বাংলাদেশের সেরাগুলোর একটি না বলে বলা উচিত যে এটাই সর্বোচ্চ জয়। টেস্ট ক্রিকেটে তো অবশ্যই। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে, তারা বর্তমান টেস্ট চ্যাম্পিয়ন, এটা দারুণ ব্যাপার। বিশেষ করে অনেকগুলো ক্রিকেটার নেই, সেখান থেকে ভাবলে এতবড় একটা জয়, দারুণ ব্যাপার।
প্রশ্ন: দলের কারও সঙ্গে কথা হয়েছে?
মাশরাফি: টাইমিংয়ের পার্থক্য আছে। মুমিনুল ফোন দিয়েছিল, কিন্তু সময়ের পার্থ্যকের কারণে কথা হয়নি। আজ চেষ্টা করব কথা বলার। ম্যাসেজে দুই-এক জনের সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল ব্যাপার হলো, ওরা খেলছে, উপভোগ করছে এবং এত বড় জয় এসেছে এটা আমাদের জন্য, বাংলাদেশের সবার জন্য বিরাট একটা মুহূর্ত।
প্রশ্ন: তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানরা দলে নেই। তাদের ছাড়াই এমন পারফরম্যান্স করে জেতার পেছনে কোন ব্যাপারগুলো সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন?
মাশরাফি: প্রথমত, ওরা দল হিসেবে খেলতে পেরেছে। ব্যাটিং গ্রুপ ভালো ব্যাট করেছে, বোলিং গ্রুপ ভালো বোলিং। দারুণ কিছু ক্যাচ নিয়েছে। ম্যাচ জিততে গেলে এসবই মূল জিনিস। আর দল যে অবস্থায় ছিল, প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো, মুমিনুল আছে, সুজন ভাই গিয়েছেন, আরও যারা আছেন, তারা হয়তো দলকে উজ্জীবিত করতে পেরেছেন যে, হারানোর কিছু নেই। এ রকম অনেক কিছু থাকে দলের ভেতর, যেটা ওখানে না থাকলে বলা মুশকিল। তবে সব মিলিয়ে নিজেদের ওপর দারুণ এক বার্তা তৈরি করতে পেরেছে যে, কে আছে কে নেই এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, নিজেদের আত্মবিশ্বাস থাকলে যেকোনো জায়গায় যেকোনো কন্ডিশনে ম্যাচ জেতা সম্ভব। এটা দারুণ এক বার্তা নিজেদের জন্য।
প্রশ্ন: একজন অভিজ্ঞ পেসার হিসেবে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে বাংলাদেশের পেসারদের বোলিং কেমন দেখলেন?
মাশরাফি: পেস বোলারদের নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তবে পেস বোলাররাই ভালো বোলিং করে আসছে। টি-টোয়েন্টিতে পেসাররাই ভালো করে আসছে। তাসকিন ভালো করেছে। টেস্টে একটা জায়গা ছিল, অন্যান্য দেশের মতো প্রভাব আমাদের পেসাররা রাখতে পারেনি। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডেতে পেসাররা কখনও এতটা খারাপ করেনি। টেস্টে আরও কাজ করার সুযোগ আছে। কাজ করলে ফলও আসছে। তাসকিনের দিকে তাকান, এবাদত ভালো করছে।
এবাদত কিন্তু হঠাৎ করে ভালো করেনি। ও লম্বা সময় ধরে খেলছে এবং ওকে টেস্টে বিবেচনা করা হয়েছে। তাকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে, 'তুমি টেস্ট খেলছো।' সে জানে এটা আমার ক্যারিয়ার, আমার ভবিষ্যৎ। এখানে সার্ভিসটা দিতে হবে। একটা খেলোয়াড়ের সেট হতেও সময় লাগে। ও আস্তে আস্তে সেট হয়েছে। রাহি অনেক দিন ধরে সার্ভিস দিচ্ছে। ওরা যখন এই জায়গাটা পাবে যে, একটা ফরম্যাটে আমাকে লম্বা সময় দেখা হবে, তখন আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং আস্তে আস্তে ফল মেলে।
যখন জায়গাটা পায় তখন ফলাফল আসে। গত বিপিএল থেকে এবাদত দারুণ বোলিং করছে। টেস্টে হয়তো অনেক সময় উইকেট পক্ষে ছিল না। বাংলাদেশে খেলা হলে স্পিনাররাই বেশি বোলিং করে। তবে মিরপুরের উইকেটে পেসারদের ভালো করার সুযোগ থাকে, কারণ বল ওঠা-নামা করে। পেসারদের ওপর আপনার আস্থা কতটুকু আছে, এটার ওপরও কিন্তু নির্ভর করে। সেই আস্থা না থাকলে পেসারদেরও নিজেদের ওপর আস্থা কমে আসে। এটা দারুণ ব্যাপার যে পেসাররা মাচ জিতিয়েছে।
হ্যাঁ, ব্যাটসম্যানরা রান করেছে। তবে এবাদত ওই সময়ে উইকেট না নিলে হয়তো আমরা জিততাম না। ড্র হতে পারত। এটা খুব ভালো হয়েছে যে পেস বোলার ম্যাচ জিতিয়েছে এবং দুই দিকটাই বললাম যে, এই টেস্ট ম্যাচ এমন নয় যে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। এটা যদি কেউ মনে করে, এতদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, এটার উত্তর এই টেস্টে দিয়ে দিলাম, সেটা কিন্তু নয়।
বরং এখান থেকে শিক্ষাটা নেওয়া যায় যে সুযোগ-সুবিধা দিলে, ওদেরকে এই সুযোগ তৈরি করে দিলে, এরা ম্যাচ জেতাতে পারবে। কিন্তু এটা যদি মনে করেন যে এতদিনের সমালোচনার জবাব দেব, তাহলে কে জানে, পরের ৫ ম্যাচ যদি না জেতেন, ওই একই জায়গায় চলে আসবেন। তাই আশা করি, সবাই যেন শিক্ষা নিতে পারে, ক্রিকেটাররা, ক্রিকেট বোর্ড, বিভিন্ন বিভাগ যারা আছেন, উনারা সবাই যদি এসব দেখেন, তাহলে আমার বিশ্বাস যে আমাদের ফল আসতে থাকবে।
প্রশ্ন: টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুল হককে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই জয়টা অধিনায়ক মুমিনুলকে কতোটা সাহস যোগাবে বলে মনে করেন?
মাশরাফি: হ্যাটস অফ টু হিম! সিরিয়াসলি। কারণ যখন তাকে অধিনায়ক করা হলো, মুশফিককে সরিয়ে সাকিবকে আনা হয়েছিল, এরপর সাকিব ছিল না দুর্ভাগ্যজনকভাবে (নিষেধাজ্ঞায়), তখন মুমিনুলকে করা হলো। আমি নিশ্চিত নই, মুমিনুলও তখন প্রস্তুত ছিল কিনা, হুট করে। তারপর এত সমালোচনা এত কিছু, ওখান থেকে দলটাকে গুছিয়ে এনে ও এত বড় একটা জয় এনে দিয়েছে। পরে কী হবে সেটা পরের ব্যাপার। এত বড় জয়ের কৃতিত্ব তার যতটুকু, ততটুকু দিতেই হবে। এখন দলে যারা আছে, বাইরে থেকে যারা দেখি, মনে করি যে সাকিব-তামিম নেই মানে অর্ধেক নেই বা অর্ধেকেরও বেশি। সেই জায়গা থেকে দল নিয়ে গিয়ে উজ্জীবিত করেছে, জিতেছে, এটা দারুণ ব্যাপার। মুশফিকও ওকে সহায়তা করছে। সব মিলিয়ে পুরো কৃতিত্ব মুমিনুলকে দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: বিপিএলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তামিম ইকবাল এবং আপনি একই দলে খেলবেন। পুরনো দিনের মতো একটা আবহ তৈরি হবে, রোমাঞ্চকর হবে কিনা?
মাশরাফি: ওরা তো খেলার ভেতরে থাকে। ওদের ব্যাপারটা ভিন্ন। ওরা পেশাদার খেলোয়াড়। আমিও পেশাদার, কিন্তু এখন তো দলের সাথে নেই। আমার বিষয়টা ভিন্ন। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্যই ভালো অনুভূতি। কিন্তু দিন শেষে ম্যাচ খেলতে নামলে সবাই জয়, নিজ নিজ প্রক্রিয়া নিয়ে ভাববে। খুব ভালো লাগবে যে অনেক দিন পর ড্রেসিংরুম শেয়ার করব, একসাথে হোটেলে থাকব। ভালো একটা সময় পার হবে বলে আশা করছি।