আত্মাহুতি দেওয়াই পছন্দ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের!

খেলা

শান্ত মাহমুদ, চট্টগ্রাম থেকে
02 April, 2024, 08:40 pm
Last modified: 02 April, 2024, 10:01 pm
দেড়শ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ৪২০ রানের বেশি তাড়া করে জেতার রেকর্ড নেই একটিও, সর্বোচ্চ রান তাড়া ৪১৮। সেখানে পাঁচ ম্যাচ পর এবং এই সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ২০০ রান পেরোনো দল বোলারদের ব্যাটে রূপকথার গল্প লিখবে, এতোটা বাড়িয়ে ভাবার দুঃসাহস কেউ-ই বা দেখাবেন! 

রান তোলার তাড়া নেই, লক্ষ্য যে পাহাড়সম। ৫১১ রান পাড়ি দেওয়া মানে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া। না জেনেও বলা যায়, বাংলাদেশের লক্ষ্য সেটা নয়। উইকেটে টিকে থাকাই হওয়া উচিত তাদের একমাত্র কৌশল। স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে মনে হবে সব ব্যাটসম্যান সেটাই করতে চেয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগই শেষমেশ মেজাজ হারিয়েছেন এবং বিলিয়ে দিয়েছেন উইকেট। মানসিকতার ধারাবাহিকতা বলে, আত্মাহুতি দেওয়াই পছন্দ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের! 

বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে ক্রমেই পথ অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার কথা। অবশ্য এটাও বলা যায়, আত্মাহুতির মিছিলে যোগ দেওয়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ইতোমধ্যে দলকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বিশাল লক্ষ্য তাড়ায় দ্বিতীয় ইনিংসে অদ্ভূতুরে সব শটে হতাশা আরও বাড়িয়েছেন তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ৭ উইকেটে ২৬৮ রান তুলে চতুর্থ দিনের খেলা শেষ করেছে।

পঞ্চম দিনে খেলা গড়িয়েছে, সেটাই এক রকমের বিস্ময়। কারণ, চতুর্থ দিনের শেষ বিকেলেই বাংলাদেশের সঙ্গী হতে পারতো আরেকটি বড় হার, এমন সব সম্ভাবনাই বেঁচে ছিল। বাংলাদেশের হাতে তিনটি উইকেট আছে, জিততে রান লাগবে আরও ২৪৩। এই রান পাড়ি দেওয়ার মিশনে বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যাটসম্যানকে পাবে না বাংলাদেশ। মেহেদী হাসান মিরাজ ৪৪ ও তাইজুল ইসলাম ১০ রানে অপরাজিত আছেন। বাকি দুজনই বোলার; খালেদ আহমেদ ও হাসান মাহমুদ। 

বাংলাদেশ এই রান পাড়ি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে জিতবে, এভাবে কেউ-ই ভাবছেন না। ভাবলেও সেটা হবে অলীক। দেড়শ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ৪২০ রানের বেশি তাড়া করে জেতার রেকর্ড নেই একটিও, সর্বোচ্চ রান তাড়া ৪১৮। সেখানে পাঁচ ম্যাচ পর এবং এই সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ২০০ রান পেরোনো দল বোলারদের ব্যাটে রূপকথার গল্প লিখবে, এতোটা বাড়িয়ে ভাবার দুঃসাহস কেউ-ই বা দেখাবেন! 

জেতার স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে আরও আগেই, আপাতত বাংলাদেশের সঙ্গী কেবলই হতাশা। শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে সাতটি ক্যাচ ছেড়ে রান চাপায় পড়া দলটি ২০০ রানের আগেই অলআউট হয়। এরপর বিশাল লক্ষ্য মেলার পর হতাশা আরও প্রবলভাবে জেকে ধরে বাংলাদেশকে। যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে দিক হারান ব্যাটসম্যানরা, চরম দৃষ্টিকটুভাবে নিজের উইকেট বিসর্জন দিয়ে নিজেদের টেস্ট মানসিকতাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন তারা। 

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের উইকেটগুলোকে কেন আত্মাহুতি বলা হচ্ছে, সেটা আউটের ধরনের বর্ণনাতেই স্পষ্ট হবে। কিংবা টিভিতে দেখে থাকলে বর্ণনা শোনার প্রয়োজনও হবে না। বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানই বেশ কিছু বল খেলে উইকেটে থিতু হওয়ার পর আউট হয়েছেন বাজে শট খেলে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের ৯ ব্যাটসম্যানের মধ্যে অপরাজিত থাকা তাইজুল ছাড়া সবাই ৩০ বলের বেশি খেলেছেন, কিন্তু হাফ সেঞ্চুরি করেছেন কেবল মুমিনুল হক। 

টিকে থাকা যে সম্ভব, শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি জহুর আহমেদের উইকেটে নিজেদের কাটানো সময়ও হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য ঘুম ভাঙানোর দাওয়াই। কারণ, কেবল বাজে শটেই যে উইকেট হারাতে হয়েছে, এটা কোনো ব্যাটসম্যানকে বলে দিতে হচ্ছে না। চতুর্থ দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসা মুমিনুল হকও জানালেন, দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট তুলনামূলক ভালো ছিল। ভাঙনের সুর বেজে গেলেও ৫৬ বলে ৮টি চার ও একটি ছক্কায় ৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি। 

৫৬ বলে ৫০ রান, টেস্টে এটা আক্রমণাত্মক ব্যাটিং-ই। এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই উইকেটের প্রসঙ্গ টানলেন মুমিনুল, 'আমার কাছে মনে হয় না যে অ্যাগ্রেসিভ। কারণ, দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট বেটার ছিল। আর অ্যাগ্রেসিভ নয়, স্বাভাবিক ক্রিকেটই খেলতে চেয়েছি। যদি শুধু ব্লক খেলি, বোলারের জন্য জায়গা তৈরি হয়ে যায়। পেস বলে আমি কোনো তাড়াহুড়ো শট খেলিনি। স্পিনে যেসব আমার জোন, সেসব জায়গায় আমি হিসেবি ঝুঁকি নিয়েছি। ডানহাতি স্পিনারকে যদি এগিয়ে গিয়ে মারতাম, তাহলে মনে হতো অ্যাগ্রেসিভ। আমি যেটা নিয়েছি, হিসেবি ঝুঁকি।'

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের জন্য উইকেট ভালো ছিল, এ বিষয়ে মুমিনুলের বক্তব্য পরিষ্কার। তার ব্যাটিংও সেই সাক্ষ্য দেয়। উইকেটে সময় কাটিয়ে দলের বাকি ব্যাটসম্যানরা সেটা বুঝলেও নিজের উইকেটের মূল্য দেননি, দায়িত্বহীনভাবে ব্যাট চালিয়ে দিয়েছেন নিজের উইকেটের জলাঞ্জলি। মাহমুদুল হাসান জয়কে দিয়ে শুরু, লঙ্কান পেসার প্রবাথ জয়সুরিয়ার করা স্টাম্প বরাবর বল পেছনে সরে কাট করতে গিয়ে বোল্ট হন ৩২ বলে ২৪ রান করা ডানহাতি এই ওপেনার। 

৩৯ বলে ১৯ রান করা আরেক ওপেনার জাকির হাসানের উইকেটটিও হতাশা জাগানো। বিশ্ব ফার্নান্দোর বাইরের দিকে করা ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে স্লিপে ধরা পড়েন তিনি। নিজের ছায়া হয়ে ওঠা অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত সেটআপের শিকার হন, লাহিরু কুমারার ব্যাক অব লেংথের দুর্দান্ত ডেলিভারিতে লাইন মিস করে বোল্ড হন তিনি। আগে কয়েকটি শর্ট অব লেংথের বল করে শান্তকে বোকা বানান লাহিরু। পরের বলটি কোনাকুনিভাবে ফেলে সেটাকে বের করে অফ স্টাম্পে আঘাত করান লঙ্কান পেসার। চেষ্টা করেও ফেরাতে পারেননি ৫৫ বলে ২০ রান করা শান্ত। 

শাসন করে খেলা মুমিনুল উইকেট বুঝলেও সময়ের কথা মাথায় রাখেননি। দ্বিতীয় সেশনের শেষ ওভারে অফ স্টাম্পের বাইরের বল সুইপ করতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরি করা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। কামিন্দু মেন্ডিসের প্রথম টেস্ট উইকেটে পরিণত হওয়া সাকিব আল হাসানও নিজের উইকেট ছুঁড়ে আসেন। অফ স্পিনার কামিন্দুর বাঁক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে খোঁচা দিয়ে স্লিপে ধরা পড়েন ৫৩ বলে ৩৬ রান করা অভিজ্ঞ এই ওপেনার। 

আগের ইনিংসে দ্বিধায় ব্যাট চালিয়ে স্লিপে আউট হওয়া লিটন কুমার দাস এই ইনিংসে আরও দৃষ্টিকটুভাবে আউট হন। বিশ্ব ফার্নান্দোর স্লোয়ার শর্ট ডেলিভারি পুল করতে গিয়ে লাহিরুর হাতে ধরা পড়েন ৭২ বলে ৩৮ রান করা উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যান। সিলেট টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও অহেতুক শট খেলে আউট হন লিটন, যা নিয়ে চরম সমালোচনা হয়। দ্বিতীয় টেস্টেও তার আউটের ধরনে খুব বেশি পার্থক্য দেখা গেল না। সর্বশেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়া শাহাদাত হোসেন দিপু বল বুঝতে না পেরে এলবিডব্লিউ হন। টেস্টে প্রথমবারের মতো বোলিং করা কামিন্দুর দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ৩৪ বলে ১৫ রান করেন তিনি।

অবস্থা বিবেচনায় সাকিব-শান্তদের দৃষ্টিতে কেবল হারের দৃশ্যই ধরা দেওয়ার কথা। লক্ষ্য তাড়ায় শেষ দিনে ব্যাটিং করা সবচেয়ে কঠিন, সেখানে বাংলাদেশের হাতে আছে মাত্র ৩ উইকেট। তাই বাস্তবতাটা আগেই জানিয়ে রাখতে চাইলেন মুমিনুল, 'এখন ব্যাটিং করা খুবই কঠিন। পুরো দিনে আমরা যদি চার উইকেটেও এই রান করতে পারতাম, তাহলে হয়তো কাল জিনিসটা একটু ভিন্ন হতো। প্রায় সবাই সেট হয়ে আউট হয়েছে। এমনকি আমিও, সবারই দায় আছে। এখন এই অবস্থায় ব্যাটিং করা কঠিন। কঠিন মানে অনেক কঠিন। আমি আশাবাদী থাকলেও বলা কঠিন।'

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.