লুইস রুবিয়ালেসের চুমু-কাণ্ডে স্পেনের সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় বইছে
সিডনিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নারী বিশ্বকাপ ফাইনালে স্পেনের জয়ের পর স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি লুইস রুবিয়ালেসের নারীর দলের ফরোয়ার্ড জেনি হেরমোসোর ঠোঁটে চুমু দেওয়ার ঘটনায় উত্তাল স্পেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত এক সপ্তাহ ধরে স্পেনের ক্রীড়াঙ্গনে যে ঝড় বয়ে চলেছে এবং সমাজে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, তার উপর আলোকপাত করেছেন বিবিসি স্পোর্টসের স্প্যানিশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ গিলেম বালাগে।
এটা স্প্যানিশ 'মিটু আন্দোলন'।
ফুটবলে নারীদের কেমন দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের মতো অভিজাত একটি সংস্থার প্রতি সাধারণের যে হতাশা- তা উপলব্ধি করার এটাই সুযোগ।
জেনি হেরমোসোকে শুধু যে নারী খেলোয়াড়রাই সমর্থন দিচ্ছেন তা নয়, পুরুষ খেলোয়াড়রাও তার পাশে দাঁড়িয়েছেন, যদিও যতটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল তাদের দিক থেকে ততটা জোরাল সমর্থন পাওয়া যায়নি।
জেনি হেরমোসোর এই ঘটনা স্পেনের ফুটবল অঙ্গনে যে ঝড় সৃষ্টি করেছে তা স্পেনের সর্বত্র এক ঝড়ে পরিণত হয়েছে। এই মুহূর্তে আপনি স্পেনের যেখানেই যাবেন, দেখা যাবে সবাই এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করছে।
এটা লুইস রুবিয়ালেস নামের এক ব্যক্তির গল্প- যাকে দেখে মনে হয় তিনি সম্পূর্ণ বাস্তবতার বাইরের এক জগতে রয়েছেন, যার প্রচুর অনুসারী রয়েছে এবং আপাতদৃষ্টিতে অভিন্নমতের এক সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে তার।
কিন্তু এখন রুবিয়ালেসের এই সমর্থক গোষ্ঠীই হয়ে উঠেছে সংখ্যালঘু। হেরমোসোর ইস্যুতে তাদের ঔদ্ধত্য বহু মানুষকে হতবাক করেছে এবং এখন মনে হচ্ছে স্পেনে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে।
স্পেনের নারী ফুটবল দলের কোচিং স্টাফরা ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু দলটির ম্যানেজার হোর্হে ভিলদা কিন্তু পদত্যাগ করেননি। বরং গতকাল যখন রুবিয়ালেস কথা বলছিলেন তখন স্প্যানিশ ফুটবলের আরও অনেক সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিয়ে তিনিও হাততালি দিচ্ছিলেন। ভিলদার এই আচরণও স্পেনের জনসাধারণের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
বলে রাখা ভালো, খেলোয়াড়রা শুধু রুবিয়ালেসের পদত্যাগই চাইছেন না, তারা ফেডারেশনের অন্যান্য সদস্যদেরও পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন। যে নারীরা স্পেনের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন, নিজেদের অবিচল সম্মান ও সমতা অর্জনের পথে তারা যাদেরকেই বাধা মনে করছেন তাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন।
অনেকের কাছেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে নারীদের বিরুদ্ধে কিভাবে বৈষম্য করা হয়। এটা শুধুমাত্র একজন মানুষের দ্বারা হচ্ছে না, এর জন্য দায়ী গোটা একটা সিস্টেম।
আর স্পেনে রুবিয়ালেসের 'চুমু কাণ্ডের' পর স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে এবং তাদের মধ্যে মতবিরোধের মূল কারণ কী সেটিও বোধগম্য।
স্প্যানিশ প্রেসিডেন্ট পেদ্রো সানচেজ নিজেকে নারীবাদী বলে দাবি করতে ভয় পান না। যেসব স্প্যানিশ ক্রীড়া গোষ্ঠীগুলোতে আমি ঘুরাফেরা করি, তারা মনে করে যে তাদের হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন এবং বিতর্কিত এ ঘটনায় পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।
কিন্তু এর বাইরেও অনেকেই মনে করেন, স্পেনের উচিত এই ঘটনার সুযোগ নেওয়া যা খুব দ্রুত তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে এবং বিশ্বজুড়ে খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগেও স্পেন ছিল নারী ফুটবল দলের ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মশগুল; কিন্তু শীঘ্রই সেই আনন্দ তিক্ততায় রূপ নিয়েছে বলে অনেকের ভাষ্য। সফলতার আনন্দ এবং অন্যায় আচরণ ও চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য প্রদর্শন দেখে অভিযোগ, সব মিলিয়ে একটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় কাটাচ্ছেন ফুটবলাররা।
কিন্তু একটা বিষয়ে হয়তো সবাই একমত হবেন যে, স্মরণকালে স্পেনের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সপ্তাহ ছিল এটি।
অনেকের কাছে, এটা ভালো কোনো স্থানে সরে যাওয়ারও একটা সুযোগ বটে। আবার অন্যদের জন্য এটা রেকর্ড গড়ার একটা সুযোগ।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গতকাল (২৬ আগস্ট) লুইস রুবিয়ালেসকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। এক বিবৃতিতে শনিবার বিষয়টি জানায় বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
৯০ দিনের এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবল-সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন স্পেনের ফুটবল প্রধান।
কিন্তু গত সপ্তাহেই হেরমোসো জানিয়েছেন, রুবিয়ালেসের চুমুতে তার সম্মতি ছিল না এবং এ ঘটনায় ৮১ জন খেলোয়াড় জানিয়ে দিয়েছেন যে রুবিয়ালেসকে পদচ্যুত না করা হলে তারা খেলবেন না।
রুবিয়ালেস কতটা প্রভাবশালী ছিলেন তা অতিরঞ্জিত করে বলা কঠিন। কিন্তু তার ঔদ্ধত্য প্রমাণ করে যে, তিনি হয়তো সেই প্রভাব বলয়ের মধ্যে এখনও বেশ সুরক্ষিতই বোধ করছেন।
কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখন শুধু একজন নয়, অনেক মানুষ আওয়াজ তুলেছেন, যার শুরুটা হয়েছে জেনি এরমোসো এবং তার সতীর্থ খেলোয়াড়দের নিয়ে; তারপর সেখানে যুক্ত হয়েছেন তাদের কোচিং স্টাফরা এবং তারপর পুরুষ খেলোয়াড়রা এবং সেখান থেকে উঠে এসেছে সংবাদপত্রে। আর এখন এটাই স্পেনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়; দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ফিরছে এই আলোচনা।
তাই রুবিয়ালেস হয়তো এখন আর অতটা সুরক্ষিত বোধ করছেন না।