শেষ দেখে ফেললেন পর্তুগিজ মহানায়ক
বয়স চলছে ৩৭, পরের বিশ্বকাপের হিসাব কষলে বয়স গিয়ে দাঁড়ায় ৪১। একজন ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকারের জন্য এই বয়সে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলে যাওয়া কতোটা চ্যালেঞ্জের? অনেকেই বলবেন খুব কঠিন, কেউ হয়তো বললেন সম্ভব না। আর বিশ্বকাপ খেলতে চাইলে? সবাই হয়তো বলবেন 'অসম্ভব।' এই হিসাব মেলালেই বোঝা যাচ্ছে বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন পর্তুগাল ফুটবল দলের মহাতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। যদিও এখনও কোনো ঘোষণা দেননি তিনি।
কাতার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে গেছে পর্তুগালের মিশন। শনিবার আল থুমামা স্টেডিয়ামে ১-০ গোলের জয়ে পর্তুগালকে স্তব্ধ করে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে উঠেছে মরক্কো। আফ্রিকা অঞ্চলেরই প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের শেষ চারে উঠেছে তারা। আরব বসন্তের উত্থানে থেমেছে পর্তুগাল, আর বিশ্বমঞ্চে অলিখিত ইতি টানা হয়ে গেছে রোনালদোর। তাতে পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলেও সোনালী শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে না পারার অপূর্ণতা থেকেই গেলো তার।
ফর্ম নিয়ে আলোচনা থাকলেও পর্তুগালের প্রাণ ভোমরা রোনালদোকেই ধরা হচ্ছিল। যদিও কয়েক ম্যাচ পরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শেষ ষোলোতে শুরুর একাদশ থেকে তাকে বাদ দেন কোচ ফার্নান্দো সান্তোস। দ্বিতীয়ার্ধে বদলি হিসেবে নামানো হয় রোনালদোকে। কোয়ার্টার ফাইনালেও সিআরসেভেনকে ছাড়াই পর্তুগালের শুরুর একাদশ সাজানো হয়। এই ম্যাচেও দ্বিতীয়ার্ধে নামেন রোনালদো। আগের ম্যাচের মতো সেমি-ফাইনালে ওঠার দৌড়েও অনুজ্জ্বল থেকে যান পাঁচবারের ব্যালন ডি'অর জয়ী।
সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপটা মনে রাখার মতো হয়নি রোনালদোর। যা মনে থাকবে, সেটাও ভুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার। মহাতারকা হয়ে বেঞ্চে বসে থাকার স্মৃতি সহজে ভোলেন কীভাবে তিনি! এর মাঝেও অবশ্য কয়েকটি কীর্তি গড়েছেন দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহু রেকর্ড গড়া রোনালদো। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই পেনাল্টি থেকে গোল বিশ্বকাপে এমন এক কীর্তি গড়েন তিনি, যা আর কারও নেই। প্রথম ফুটবলার হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড গড়েন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ড।
বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার ম্যাচে আরেক মাইলফলক ছুঁয়েছেন রোনালদো। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড আগে থেকেই দখলে রাখা পর্তুগিজ সুপার স্টার সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডেও নাম লিখিয়েছেন। কোয়ার্টার-ফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে ৫১তম মিনিটে বদলি হিসেবে নেমে ছুঁয়ে ফেলেন কুয়েতের ফরোয়ার্ড বাদের আল-মুতাওয়ার সর্বোচ্চ ১৯৬ ম্যাচের রেকর্ড। দেশের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড এখন এ দুজনের।
পর্তুগালের জার্সিতে পাঁচটি বিশ্বকাপে মোট ২২টি ম্যাচ খেলেছেন রোনালদো, যা পঞ্চম সর্বোচ্চ। বিশ্বকাপের দীর্ঘ এই পথচলায় তিনি গোল করেছেন ৮টি, পর্তুগালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এটি। ৯ গোল করে সবার ওপরে দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার ইউসেবিও। পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১৯৬ ম্যাচে রোনালদো গোল করেছেন ১১৮টি। যা পর্তুগাল এবং যেকোনো দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রোনালদোর বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। ২১ বছর বয়সে খেলা সেই বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে এক গোল করেন তিনি। ২০১০ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে নিজে এক গোল করার পাশাপাশি সতীর্থকে দিয়ে করান আরেকটি। ২০১৪ বিশ্বকাপে ৩ ম্যাচে একটি গোল করা রোনালদো আরেকটি গোলে যোগান দেন। ২০১৮ বিশ্বকাপটা সবচেয়ে ভালো গেছে তার, ৪ ম্যাচে করেন চার গোল। বিশ্বকাপ মঞ্চে শেষবারের মিশনে এবার একটি গোলের দেখা পেয়েছেন রোনালদো।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে দেশ ও ক্লাবের হয়ে অনেক কীর্তিই গড়েছেন রোনালদো। তার পায়ে লুটোপুটি খেয়েছে কতোশতো রেকর্ড। কিন্তু একজন ফুটবলারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার বাসনাই পূর্ণ হলো না পর্তুগিজ কিংবদন্তির। প্রতিবারের মতো এবারও রাজ্যের হতাশা নিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ করতে হলো তাকে। বিদায় বেলায় চোখ ভিজে উঠলো রোনালদোর, মুখ ঢেকে রাখলেন অনেকক্ষণ। আগের কয়েকটি বিশ্বকাপ থেকে বিদায়েও কেঁদেছেন তিনি। সেই কান্না ছিলে ওই আসর থেকে বিদায়ের, কিন্তু এবারের কান্না একেবারে বিদায়ের, শিরোপা ছুঁয়ে না দেখতে পারার।