বোনো বীরত্বে স্পেনকে হারিয়ে মরক্কোর ইতিহাস
নির্ধারিত ৯০ মিনিট লড়াই হলো সমানে সমান। কখনও স্পেন তো কখনও মরক্কো, আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চললো পুরো ম্যাচজুড়ে। কিন্তু কোনো দলই পেল না জালের ঠিকানা। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এই ৩০ মিনিটে দুই দলের মধ্যেই বাড়তি তাড়া দেখা গেল, মুহূর্মুহু আক্রমণে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগ কাঁপিয়ে দিতে থাকলো দুই দলই।
তবুও গোলের দেখা নেই, শেষমেষ তাই টাইব্রেকার। যেখানে মরক্কোর গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো রূপকথার গল্প লিখলেন। স্পেনের নেওয়া তিন পেনাল্টি শটের দুটি ফিরিয়ে দলকে এনে দিলেন ঐতিহাসিক এক জয়। স্পেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো আফ্রিকা-আরব অঞ্চলের দেশ মরক্কো। তাদের জয়ে কাতার বিশ্বকাপে বেঁচে থাকলো আরব বসন্ত।
মঙ্গলবার কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে উত্তেজনায় ঠাসা শেষ ষোলোর ম্যাচে পেনাল্টি শুট আউটে স্পেনকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে মরক্কো। আফ্রিকার চতুর্থ দল হিসেবে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো তারা। এর আগে বিশ্বকাপে শেষ আটে খেলেছে ক্যামেরুন, সেনেগাল ও ঘানা। এর আগে একবার বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে খেলেছে মরক্কো। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে শেষ ষোলোয় জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে হারে তারা।
অন্যদিকে বিশ্বকাপে টাইব্রেকার আক্ষেপের অধ্যায় হয়েই থেকে গেল স্পেনের জন্য। এ নিয়ে বিশ্বকাপে পাঁচ টাইব্রেকারের চারটিতেই হারলো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। যা বিশ্বকাপের ইতিহাসের দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১০ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা দলটি এ নিয়ে টানা বিশ্বকাপে শেষ ষোলো পেরোতে ব্যর্থ হলো। ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব ও ২০১৮ বিশ্বকাপে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেয় তারা। আরও একটি টাইব্রেকার হতাশার পাশাপাশি মরক্কোর বিপক্ষে প্রথম হারলো স্পেন, আগের তিন ম্যাচেই জিতেছিল তারা।
বোনো যেন ডাইডালুস পুত্র ইকারুস হয়ে উঠেছিলেন। গ্রিক পুরাণের সেই ইকারুস, যিনি বাবার তৈরি করা মোমের ডানা পরে ক্রিট শহর থেকে উড়াল দিয়েছিলেন। স্পেনের বিপক্ষে যেন ইকারুসের সেই ডানা পরেই মাঠে নেমেছিলেন মরক্কো গোলরক্ষক। স্পেনের নেওয়া তিনটি শটের দুটি ফিরিয়ে দেন তিনি, একটি লাগে পোস্টে। আর মরক্কো তিনবার বল জালে পাঠালে মিলে যায় স্বপ্নের জয়। অর্থাৎ, বোনোর হাত ফাঁকি দিয়ে একবারও বল জালে জড়ায়নি, টাইব্রেকারে কোনো গোলই দিতে পারেনি স্পেন।
ম্যাচের পরিসংখ্যানে তাকালে এই হারের পর স্পেনকে দুঃখী মনে হতে পারে। মরক্কো চোখে চোখ রেখে লড়াই করলেও পুরো ম্যাচে দাপট দেখায় স্পেনই। তিকি তাকার ছন্দ ধরে রেখে ১ হাজার ১৯ পাসে ৭৭ শতাংশ সময় বল নিজেদের পায়ে রাখে স্প্যানিশরা। গোলমুখে তারা শট নেয় ১৩টি, এর মধ্য মাত্র একটি ছিল লক্ষ্যে। অনেক সহজ সুযোগ হাতছাড়া করে দলটি। ইতিহাস গড়া মরক্কোর গোলমুখে নেওয়া ৬টি শটের ২টি লক্ষ্যে ছিল।
নির্ধারিত সময় ও অতিরিক্ত সময়ে কোনো গোল না হলেও দুই দলই দারুণ কিছু আক্রমণ সাজিয়েছিল, কিন্তু কেউ-ই তা গোলে রূপান্তর করতে পারেনি। একাদশতম মিনিটে বক্সের বাইরে ফ্রি-কিক পায় মরক্কো। কিন্তু আশরাফ হাকিমির শট ক্রসবারের ওপর দিয়ে চলে যায়। ২৫তম মিনিটে নিজেদের ভুলে বিপদে পড়তে বসেছিল মরক্কো। তাদের দুর্বল পাসে বল পেয়ে যায় স্পেন। বক্সে দানি ওলমোর শট গোলরক্ষকের হাত ছুঁয়ে ক্রসবারে লাগে। যদিও রেফারি অফসাইডের বাঁশি বাজান।
দুই মিনিট পর আক্রমণে যায় স্পেন। জর্দি আলবার ক্রস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কোণা থেকে শট নেন মার্কো আসেনসিও, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৩৩তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে মরক্কোর মাসাওয়ির নেওয়া জোরালো শট ফিরিয়ে দেন স্পেনের গোলরক্ষক উনাই সিমোন। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে সোফিয়ান বুফালের ক্রসে হেড নেন নায়েফ আগের্দে, তবে তা উড়ে যায় ক্রসবারের ওপর দিয়ে।
দ্বিতীয়ার্ধে দলে পরিবর্তন আনে স্পেন। ৬৩তম মিনিটে আসেনসিওর জায়গায় আলভারো মোরাতা ও গাভির জায়গায় কার্লোস সলেরকে মাঠে নামান লুইস এনরিকে। কিছুক্ষণ পর ফেরান তোরেসকেও তুলে নেন তিনি, মাঠে নামান নিকো উইলিয়ামসকে। বদলি হিসেবে নে, ৮০তম মিনিটে ডান দিক থেকে তিনি দারুণ ক্রস বাড়ান ডি-বক্সে, কিন্তু মরক্কোর প্রতিরোধে সুযোগ তৈরি হয়নি।
৮৬তম মিনিটে দারুণ আক্রমণ সাজায় মরক্কো। ডান দিক থেকে হাকিম জিয়াশ ক্রস দেন ডি-বক্সে, কিন্তু ওয়ালিদ ছেদদিরার দুর্বল শট জাল খুঁজে নিতে পারেনি। যোগ করা সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে গোলের দেখা প্রায় পেয়েই গিয়েছিল স্পেন। কিন্তু গোলমুখে থাকা ওলমোর ফ্রি-কিক ঝাঁপিয়ে ফেরান বোনো। এরপর ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের শেষ দিকে অসাধারণ আক্রমণ সাজায় মরক্কো। কিন্তু ছেদদিরার সোজাসুজি শট পা দিয়ে ফিরিয়ে দেন সিমোন।
১১৫তম মিনিটে আরেকটি সুযোগ পান ছেদদিরা। বল নিয়ে অনেকটা দৌড়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি, কিন্তু স্পেনের রক্ষণ ভেদ করতে পারেননি তিনি। দুই মিনিট পর পাল্টা আক্রমণে যায় স্পেন। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে গিয়ে ডি-বক্সে আনসু ফাতির উদ্দেশ্যে বাড়ান মোরাতা, কিন্তু বল বাইরে চলে যায়। শেষ বাঁশি বাজার আগ মুহূর্তে কপাল পোড়ে স্পেনের। সতীর্থের বাড়ানো ক্রস থেকে নেওয়া পাবলো সারাবিয়ার ভলি পোস্টে লাগে।