মিরাজ ‘মিরাকলে’ বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য জয়

খেলা

04 December, 2022, 07:45 pm
Last modified: 05 December, 2022, 12:26 am
অনবদ্য, অসাধারণ কিংবা অবিশ্বাস্য। ত্রাতা, কাণ্ডারী কিংবা নেতা। কোনো শব্দই কি তার জন্য যথেষ্ট? তাহলে মিরাকল? মেহেদী হাসান মিরাজের নামের পাশে হয়তো এই শব্দটাই কেবল যথার্থ হবে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখি হয়ে উড়াল দিয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশকে অবিশ্বাস্য এক জয় উপহার দিলেন বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার।

অনবদ্য, অসাধারণ কিংবা অবিশ্বাস্য। ত্রাতা, কাণ্ডারী কিংবা নেতা। কোনো শব্দই কি তার জন্য যথেষ্ট? তাহলে মিরাকল? মেহেদী হাসান মিরাজের নামের পাশে হয়তো এই শব্দটাই কেবল যথার্থ হবে। বর্ণনায় বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মিরাজের কীর্তি দেখলে এসব বর্ণনা যে কারও কাছে তুচ্ছ মনে হতে বাধ্য। একেবারে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স হয়ে উড়াল দিয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশকে অবিশ্বাস্য এক জয় উপহার দিলেন বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার।

বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলা অথবা ঘোর লাগা অবস্থা; মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হাজির হওয়া কিংবা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা দর্শকদের মতো অবস্থা হয়তো বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুলদেরও হয়েছিল। দৃষ্টি রাখলেই জয় দেখতে পাচ্ছিলেন তারা, আর সেটা প্রায় নিশ্চিতই। সেখান থেকে হাল ধরে আলোক বর্তিকা হাতে ছুটে মিরাজ পৌঁছে গেলেন আলোর ঠিকানায়, বাংলাদেশ পেলে মহাকাব্যিক এক জয়। 
 
রোববার তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ভারতকে ১ উইকেটে হারানোর রোমাঞ্চকর মিশনে মিরাজের সহযোদ্ধা ছিলেন যিনি, তিনিও জয়ের অন্যতম কাণ্ডারী। তবে তিনি ব্যাটসম্যান নন, পেসার। হ্যাঁ, বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। দলের দুঃসময়ে তার ব্যাটও হয়ে ওঠে নির্ভরতার প্রতীক, মিরাজের সুরে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের এই পেসারও হয়ে ওঠেন হার না মান একজন। শেষ উইকেটে দুজনে মিলে ৩৯ বলে ৫১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে লেখেন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। তাতে সাত বছর পর ওয়ানডেতে ভারতকে হারানোর স্বাদ পায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ভারতকে হারিয়েছিল তারা।

সুযোগ পেয়েও সম্প্রতি শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের ইতিহাসের সেরা সাফল্য বাগিয়ে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্তম ফরম্যাটে সেই চিরচেনা হামাগুঁড়ি পথচলাই ছিল তাদের। সেই দলটিই ঘরের মাঠে প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডে পেয়েই বদলে যায়, অন্তত ভারতের ব্যাটিংয়ের পর সেটাই মনে হয়েছিল। ছোট লক্ষ্য মেলায় হয়তো সহজ জয়েই চোখ ছিল ঘরের মাঠের দলটির। কিন্তু চরম হতাশার ব্যাটিংয়ে সহজ পথ কঠিন করে হারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। তখনই দেখা দেয় মিরাজ-মুস্তাফিজ দুর্বার জুটি।

শেষ মুহূর্তের চোটে সিরিজ থেকে ছিটকে গেছেন নিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবাল। যা বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপের গভীরতা কমিয়েছে। একই কারণে প্রথম ওয়ানডেতে বিশ্রামে ছিলেন পেস আক্রমণের সেরা অস্ত্র তাসকিন আহমেদ। তাকে ছাড়া পেস বোলিং বিভাগও শক্তি হারায় কিছুটা। কিন্তু কোনো বিভাগেই এসবের তেমন প্রভাব পড়েনি।
 
এই সিরিজে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব পাওয়া লিটন কুমার দাস টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আগে ব্যাটিং করা ভারতকে একাই দিক ভুলিয়ে দেন সাকিব আল হাসান। তার জাদুকরী বোলিংয়ের সঙ্গে ছিল এবাদত হোসেনের তোপ, তাতে ৪১.২ ওভারে ১৮৬ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত। জবাবে ১৩৬ রানে ৯ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে পথ দেখিয়ে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান ম্যাচসেরা মিরাজ ও মুস্তাফিজ, তখনও হাতে ছিল ২৪ বল। 

৫০ ওভারের ম্যাচে ১৮৭ রানের লক্ষ্য আর এমন কী! কিন্তু এলোমেলো ব্যাটিংয়ে এটাই এক সময় হয়ে ওঠে দূরের লক্ষ্য। ১৩৬ রানেই পড়ে যায় ৯ উইকেট। জয়ের জন্য তখনও ৬৩ বলে ৫১ রান দরকার। কিন্তু হাতে কেবল এক উইকেট। যেখানে মিরাজের ওপর ভরসা রাখা গেলেও ছিল না ম্যাচ জয়ের আশা। মুস্তাফিজ ছিলেন চিন্তার কারণ। যদি আউট হয়ে যান এই পেসার, তখন তো টিকে থেকেও মিরাজের কিছু করার থাকবে না!
 
হাসান মাহমুদের সঙ্গে মাত্র চার বলের জুটি হয় আট নম্বরে নামা মিরাজের। এরপর উইকেটে যান মুস্তাফিজ। শুরুতেই বাঁহাতি পেসারকে বুঝিয়ে দেন তার কাজটা কী হবে, এরপর শুরু মিশন জয়ের। মোহাম্মদ সিরাজ, অভিষিক্ত কুলদীপ সেন, শার্দুল ঠাকুররা ছিলেন বাধা। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে উইকেটে নামা মিরাজ প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের দিকে তাকাননি, ভাবেননি দলের খারাপ সময় নিয়েও। বুক চিতিয়ে লড়ে বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার চার-ছক্কায় এগিয়ে নিতে থাকেন দলের রান। 

কিন্তু এর মাঝে স্ট্রাইক পেয়েছেন মুস্তাফিজও, তাতে দুশ্চিন্তা বেড়েছে বাংলাদেশ শিবিরে। কিন্তু বাঁহাতি এই পেসারও খেই হারাননি। মিরাজের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে একই ছন্দে পা ফেলেন তিনি। ১১ বলে ২টি চারে তার করা অপরাজিত ১০ রান তাই ম্যাচজয়ী ইনিংসই বাংলাদেশের জন্য। চাপের বোঝা মাথায় নিয়েও অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে দলকে জয় এনে দেওয়া মিরাজ ৩৯ বলে ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় অপরাজিত থাকেন ৩৮ রানে। রান তাড়ায় মিরাজ-মুস্তাফিজের ৫১ রান দশম উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি।

এর আগের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বাংলাদেশের হয়ে ৬৩ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় সর্বোচ্চ ৪১ রানের ইনিংস খেলেন অধিনায়ক লিটন দাস। ২৯ বলে ১৪ রান করেন এনামুল হক বিজয়। সাকিবের ব্যাট থেকে আসে ৩৮ বলে ২৯ রান। এ ছাড়া মুশফিকুর রহিম ১৮, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ১৪ ও আফিফ হোসেন ধ্রুব ৬ রান করেন। ওপেনার নাজমুল হোসেন শান্তর মতো রানের খাতা খুলতে ব্যর্থ হন এবাদত হোসেন ও হাসান মাহমুদ। ভারতের মোহাম্মদ সিরাজ ৩টি এবং কুলদীপ সেন ও ওয়াশিংটন সুন্দর ২টি করে উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান দীপক চাহার ও শার্দুল ঠাকুর। 

এর আগে ব্যাটিং করা ভারতও আরও বড় পরীক্ষা দেয়। সফরকারীদের ইনিংসে মিরাজ প্রথম আঘাত হানার পর জাদুর বাক্স খুলে বসেন সাকিব। এক ওভারেই ফিরিয়ে দেন রোহিত ও কোহলি। পরে আরেক ওভারে নেন জোড়া উইকেট। সঙ্গে পেস আগুনে ভারতীয়দের চেপে ধরেন এবাদত। চরম বিপর্যয়ের মাঝেও এক পাশ আগলে ৭০ বলে ৫টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৭০ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন লোকেশ রাহুল। এ ছাড়া রোহিত ২৭, শ্রেয়াস ২৪ ও ওয়াশিংটন ১৯ রান করেন। বাকি ব্যাটসম্যানদের কেউই দুই অঙ্কের রান করতে পারেননি, কোহলি করেন ৯ রান। 

১০ ওভারে ৩৬ রানে ৫ উইকেট নেন সাকিব। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট পেলেন বাঁহাতি এই স্পিনার। সাকিবই বিশ্বের প্রথম বাঁহাতি স্পিনার, যিনি ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেট নিলেন। এটা ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে তৃতীয় সেরা বোলিং, সাকিবের ক্যারিয়ারেরও তৃতীয় সেরা। এবাদত ৪৭ রানে নেন ৪ উইকেট, যা তার ক্যারিয়ার সেরা। বাকি উইকেটটি নেন মিরাজ।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.