‘অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে বুট কিনেছে মারিয়া মান্দা’

খেলা

নোমান মোহাম্মদ
24 September, 2022, 06:50 pm
Last modified: 24 September, 2022, 06:51 pm
সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, তহুরা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার ও শিউলি আজিম। তাদের সবারই ফুটবলে হাতেখড়ি কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিনের মাধ্যমে। কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্য ছুঁয়ে গেছে তাকেও। মেয়েদের ফুটবলে নিয়ে আসার সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের গল্পই বললেন মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন।

গারো পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক জনপদ। কলসিন্দুর। বাংলাদেশের নারী ফুটবলের আঁতুড়ঘর। এই যে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতল বাংলাদেশ, সেই জাতীয় দলের আট জন মেয়ে এখানকার।

সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, তহুরা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার ও শিউলি আজিম। তাদের সবারই ফুটবলে হাতেখড়ি কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিনের মাধ্যমে। বছর পাঁচেক হলো সে স্কুলে নেই তিনি। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রণসিংহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু কলসিন্দুরের মেয়েদের সাফল্য ছুঁয়ে গেছে তাকেও। ডয়েচে ভেলের মুখোমুখি হয়ে মেয়েদের ফুটবলে নিয়ে আসার সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের গল্পই বললেন মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নোমান মোহাম্মদ।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ তো সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে। সে দলে কলসিন্দুরের আট জন। আপনার কতোটা ভালো লাগছে?

মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন: আমাদের এই মেয়েরা অনেক কিছুই উপহার দিয়েছে। সেই সব উপহার ছিল বয়সভিত্তিক দলে। এই প্রথম বাংলাদেশ নারী জাতীয় দল সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এটা অবশ্যই গর্বের এবং আনন্দের। এই দলে আমার হাতে গড়া আটজন ফুটবলার আছে। এজন্য আমার গর্বটা আরও বেশি। আনন্দটাও একটু বেশি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ এই ট্রফি জয়ের পর কি মেয়েদের কারও সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?

মফিজ উদ্দিন: না, সরাসরি কথা হয়নি। ফেসবুকে মত বিনিময় হয়েছে। তবে নেপাল যাবার সময় বিমানে বসে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি শুভ কামনা জানিয়েছি। দেশে ফিরলে আবার কথা হবে।

প্রশ্ন: যাবার সময় কী কথা হয়েছিল?

মফিজ উদ্দিন: সানজিদার ফেসবুক স্ট্যাটাস হয়তো আপনি দেখেছেন। ওদের সঙ্গে আমার কথা ছিল একটাই। তোমরা এখন শুধু কলসিন্দুরের খেলোয়াড় না, তোমরা বাংলাদেশের খেলোয়াড়। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ তোমাদের দিকে চেয়ে থাকবে। সবসময় মাথায় রাখবে যেন দেশের সুনাম বয়ে আনতে পারো। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা খচিত জার্সি তোমাদের কাছে থাকবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমরা। ওদের সঙ্গে এটাই ছিল আমার কথা।

বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের প্রথম সাফ বিজয়। ছবি: মীর ফরিদ

প্রশ্ন: আপনি সানজিদার কথা বলছিলেন। ফাইনালের আগে তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাস সবার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। এই সানজিদাকে কিভাবে আপনি ফুটবলে নিয়ে এলেন, সেটা যদি একটু বলেন।

মফিজ উদ্দিন: আমি একেবারে শুরুর কথা বলি। ২০১০ সালে ছেলেদের স্কুল ফুটবলের ফাইনালে পুরষ্কার বিতরণীর সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, পরের বছর থেকে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হবে। ওই সময় আমার মাথায় আসে যে, মেয়েদের নিয়ে ফুটবল টিম করব। আমি তখন কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। মেয়েদের এক ক্লাসের সঙ্গে আরেক ক্লাস, এক সেকশনের সঙ্গে আরেক সেকশনের ফুটবল খেলার মাধ্যমে বেশ কিছু খেলোয়াড় বাছাই করি। তো প্রথম অবস্থায় এই এলাকার পরিবেশ, লোকজনের চালচালন কিংবা ধর্মীয় বোধ, সেটি একেবারে সহযোগিতা করছিল না। নানা বাধা-বিপত্তি ছিল। মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে খেলছে কেন, এমন কথার প্রেক্ষিতে সালোয়ার-কামিজ পরে খেলতে হত। মেয়েদের আবার কিসের ফুটবল খেলা---এমন কথাও ছিল। এসব অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমরা খেলাটা শুরু করেছিলাম।

প্রশ্ন: এটা তো প্রতিকূল পরিবেশে মেয়েদের ফুটবল শুরুর কথা বললেন। যদি নির্দিষ্ট করে সানজিদা কথা জানতে চাই...

মফিজ উদ্দিন: ওই যে বললাম, স্কুলের মেয়েদের মধ্য থেকে বাছাই করেছিলাম। সেখানে সানজিদা টিকেছিল। মেয়ের ফুটবল খেলার ব্যাপারে ওর মায়ের একটু আপত্তি ছিল। ওর দুলাভাইয়েরও আপত্তি ছিল। তবে বাবার সহযোগিতার কারণে সানজিদা ফুটবলে আগ্রহী হয়েছে।

প্রশ্ন: সানজিদার বাবা-মা কী করেন?

মফিজ উদ্দিন: সানজিদার বাবা কৃষক। মা গৃহিনী।

প্রশ্ন: পরিবার থেকে আপত্তির কথা বলছিলেন। তাঁদের কিভাবে বুঝিয়েছেন আপনি?

মফিজ উদ্দিন: অনেক কিছুই বলতে বলতে হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের নারীরা আর আগের মতো পিছিয়ে নেই। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মেয়েদের ফুটবলের উদাহরণ দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করেছি।

প্রশ্ন: সাফ ফাইনালে প্রথম গোল করেছেন যে শামসুন্নাহার জুনিয়র, তার গল্পটা শুনতে চাই।

মফিজ উদ্দিন: আমরা যখন খেলা শুরু করি, তখন শামসুন্নাহার একেবারে ছোট। ওকে অনেকে পিচ্চি শামসু বলত। সানজিদাদের ১৭ দলের দলে ও থাকত, তবে শুরুর একাদশে না। খেলার শেষ দিকে মাঠে নামাতাম। দেখা যেত, ওই চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সে একটা ঝলক দেখাত। মানুষকে আনন্দ দিত। একবার মনে আছে, ওই শেষ চার-পাঁচ মিনিট খেলেই ও ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে যায়।

প্রশ্ন: সাফ ফাইনালেও তো প্রথম একাদশে শামসুন্নাহার জুনিয়র ছিলেন না। বদলি হিসেবে নেমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোল দিয়েছেন আপনার বলা সেই ছোটবেলার মতোই। তাঁকে ফুটবলে নিয়ে আসাটা কিভাবে?

মফিজ উদ্দিন: শামসুন্নাহারের বাবা তেমন কাজ-টাজ করতেন না। বাড়ির কাছে মসজিদ ছিল। সেখানেই নামাজ-কালাম পড়তেন। উনি শামসুন্নাহারকে খেলায় দিতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করাতে হয়েছে। শামসুন্নাহারের একটা ছোট বোন ছিল। নাম নাজমুন্নাহার। ও-ও ভালো ফুটবলার ছিল; দলে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওকে পরে স্কুল থেকে নিয়ে মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের প্রথম সাফ বিজয়। ছবি: মীর ফরিদ

প্রশ্ন: এই জাতীয় দলে কলসিন্দুরের আরেক ফুটবলার তহুরা খাতুন। তাকে ফুটবলে নিয়ে আসাটা কাহিনীটা কেমন? তার পরিবারকে বোঝানোটা কত কঠিন ছিল?

মফিজ উদ্দিন: তহুরার বিষয়টা আরও কঠিন ছিল। ওর দাদা একজন হাজী। ওনাকে আমিও দাদা ডাকি। আমাকে এক দিন বললেন, 'তুই যে আমার নাতিরে খেলা শিখাইতাছোস, ওরে বিয়া দেওন লাগব না! বল খেললে ওরে বিয়া দেওন যাইব?' এ নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। তহুরার দাদা ফুটবল খেলতে নিষেধ করে দেয়। ওর বাবাও নিষেধ করে। তহুরার দুলাভাই একজন হাফেজ এবং মওলানা। তহুরা ফুটবল খেললে খুব রাগ করতেন। এ কারণে তিনি এলে তহুরা আর বাড়িতে থাকত না। এরপর আমি এলাকার মেম্বারকে সাথে নিয়ে গিয়ে তহুরার বাবাকে অনেক বুঝিয়েছি। শুধু ওর কাকারা রাজি ছিল মেয়েকে খেলতে দিতে। আর মেয়ের যেহেতু এত আগ্রহ, তাই সবাই মিলে বোঝানোর পর তহুরার বাসা থেকে ফুটবল খেলতে দিতে রাজি হয়েছে। এখন তো মেয়ে স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। সবাই তাই ক্রেডিট নিতে চায়।

প্রশ্ন: মারিয়া মান্দার বেলাতেও কি পরিবারের এমন বাধা এসেছিল?

মফিজ উদ্দিন: নাহ্। মারিয়া মান্দার পরিবারের দিক থেকে কোনো বাধা ছিল না। ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল দারিদ্র্য। এমনও হয়েছে যে, ওর বুট কেনার টাকা নেই। অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে সে টাকা দিয়ে মারিয়া মান্দা বুট কিনেছে-এমন ঘটনাও আছে। আমাকে বলেছে, স্যার আমি দুদিন খেলায় আসতে পারব না। আমি ওকে ছুটি দিয়েছি। পরে জানতে পেরেছি, সেই দুদিন মারিয়া অন্যের জমিতে কাজ করে সে টাকা দিয়ে বুট কিনেছে। ওর মা-ও অন্যের জমিতে কাজ করত। এরকমও দিন গেছে ওদের।

প্রশ্ন: তাকে খেলায় আনতে অন্যদের মতো সমস্যা হয়নি?

মফিজ উদ্দিন: না। ওরা তো আদিবাসী। ওদের সমাজে মেয়েকে খেলতে দেবার ব্যাপারে বিধিনিষেধ নেই।

প্রশ্ন: এখন তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন?

মফিজ উদ্দিন: ভালো। তবে কলসিন্দুরের যে মেয়েদের কথা বললেন, ওদের মধ্যে সানজিদা ও তহুরা ছাড়া বাকি সবাই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। আমি যখন কলসিন্দুর স্কুল থেকে বদলি হয়ে যাই, তখন ৭০-৮০ জন মেয়েকে নিয়ে ফুটবল প্র্যাকটিস করাতাম। তাদের প্রায় সবাই গরীব। এখন যারা জাতীয় পর্যায়ে খেলছে, ওদের আর আগের মতো দরিদ্রতা নেই। মোটামুটি চলার মতো সংস্থান হয়েছে।  

প্রশ্ন: মারিয়া মান্দার ওই অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে বুট কেনার মতো আর কোনো কাহিনী কি আপনার মনে পড়ছে?

মফিজ উদ্দিন: না, ওরকম নেই। তবে দরিদ্রতার ছাপ ছিল প্রায় সবার মধ্যে। আমরা করতাম কী, সাপ্তাহিক একটা টাকা নিতাম। সবাই আমার কাছে টাকা জমা রাখত। আমি খাতায় লিখে রাখতাম। কারও বুট কেনার টাকা জমা হয়ে গেলে সেটা ওকে দিতাম; ও বুট কিনে আনত।

প্রশ্ন: এসব কাজে কি এলাকার কারও সহযোগিতা পেতেন?

মফিজ উদ্দিন: ২০১১ সালে তো আমরা শুরু করি। ২০১৪-১৫ পর্যন্ত নিজেদেরই সব করতে হয়েছে। এরপর কেউ কেউ কিছুটা সহযোগিতা করেছেন। যেমন মেয়েদের খেলা দেখে খুশি হয়ে হয়তো পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন। সেটা দিয়ে ওদের খাবারের ব্যবস্থা করতাম। কেউ হয়তা জার্সি দিত; কেউ বুট দিত। এগুলো পরে এসেছে। শুরুর চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে বেশি ছিল।

প্রশ্ন: এখন তো বাংলার এই মেয়েরাই দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন। তাদের নিয়ে আরও কত বড় স্বপ্ন দেখেন আপনি?

মফিজ উদ্দিন: আসলে স্বপ্ন তো দেখাই যায়। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা বড় কথা। আমাদের আর্থ-সামাজিক যে অবস্থা, আমাদের মেয়েদের যে শারীরিক গঠন, শক্তিমত্তা—এসব বিবেচনা করলে এত বেশি উচ্ছ্বসিত হওয়া যায় না। তারপরও আমি আশা রাখি, যে গ্রুপটা এখন আছে আর পাইপলাইনে যে মেয়েরা আছে, তাদের নিয়ে বিশ্বকাপে যেতে না পারলেও দক্ষিণ এশিয়ার রাজত্বটা যেন আরও কিছু দিন থাকে।


  • সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.