‘আমি রান করলেই লোকে বলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করেছি’

খেলা

শান্ত মাহমুদ
02 July, 2020, 08:10 pm
Last modified: 02 July, 2020, 08:35 pm
দলে ভূমিকাটা কী, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১২ বছর পরও সেটা জানেন না ইমরুল কায়েস। ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন, অপূর্ণতা, স্বাধীনতা ও যথেষ্ট সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।

১২ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। কিন্তু এখনও দলে জায়গাটা পোক্ত নয়। দলে ভূমিকাটা কী, সেটাই জানেন না ইমরুল কায়েস। এক সিরিজে দলে আছেন তো চার সিরিজে দর্শক। তবে ফেরার ম্যাচ বা সিরিজে সব সময়ই লড়াকু মেজাজে দেখা মিলেছে বাংলাদেশের বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যানের। 

এতেও অবশ্য বিশেষ লাভ হয়নি। দলে ফেরার সিরিজে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েও পরের সিরিজের দুই ম্যাচে খারাপ করে লম্বা সময়ের জন্য বাদ পড়তে হয়েছে তাকে। সেই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ওয়ানডে খেলে যে বাদ পড়েছেন, এই ফরম্যাটে আর ফেরাই হয়নি ইমরুল কায়েসের।

মাঝে চলে গেছে ২০১৯ বিশ্বকাপ। যে বিশ্বকাপে খেলতে না পারার আক্ষেপ কুড়ে কুড়ে খায় ইমরুলকে। সঙ্গে আছে পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে অনেক না পাওয়ার বেদনা। যথেষ্ট সুযোগ না পাওয়ার হতাশাও পোড়ায় বাংলাদেশের হয়ে ৩৯ টেস্ট, ৭৮ ওয়ানডে ও ১৪টি টি-টোয়েন্টি খেলা ইমরুলের।

দীর্ঘ ১২ বছরের ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন, অপূর্ণতা, স্বাধীনতা ও যথেষ্ট সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ, নিজের করা ভুল, দলের জন্য ব্যাটিং স্টাইল বদলে ফেলা, দলে নিজের ভূমিকা না জানা, করোনার কঠিন সময়সহ আরও অনেক বিষয় নিয়েই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন ইমরুল।

টিবিএস: বন্দি অবস্থায় অনেকদিন হয়ে গেল। এখন কীভাবে সময় কাটছে?

ইমরুল কায়েস: বাসায় বসে সারাদিন টিভি দেখি, রানিং করি, জিম করি। পরিবারকে সময় দেই, এভাবেই চলছে। 

টিবিএস: করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে। ম্যাচ, অনুশীলন এমনকি মাঠেই যেতে পারছেন না। পেশাদার ক্রিকেটারদের জন্য এটা কতটা যন্ত্রণার?

ইমরুল: এখন সবই মেনে নিতে হবে। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তো পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু এটা মহামারী, কারও হাত নেই এর ওপর। সবাইকে মানতে হবে। জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিসটা হচ্ছে বেঁচে থাকা। খেলতেই হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। নিজেকে নিরাপদ রাখা সবচেয়ে বড় জিনিস। সুস্থ থাকলে জীবনে বহু খেলাধুলা করা যাবে। এই মুহূর্তে অবশ্যই খারাপ লাগছে, যেহেতু অনেক দিন হয়ে গেছে মাঠে যেতে পারি না। এটা অস্বস্তির ব্যাপার। তারপরও তো বাস্তবতা মানতে হবে সবাইকে। 

টিবিএস: ঘরবন্দি হয়ে থাকা এই অবস্থায় কোন বাস্তবতাকে মেনে নিতে শিখেছেন বা কোন বাস্তবতা সবচেয়ে কঠিন?

ইমরুল: হঠাৎ মৃত্যু। আপনি জানেন না একজন মানুষ মারা যাবে। হয়তো দুদিন আগেই আপনার সঙ্গে কথা বলেছে বা গল্প করেছে। মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে বা দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, ওটা আলাদা জিনিস। এখন একজন মানুষ হুট করে অসুস্থ হচ্ছে আর মারা যাচ্ছে। এসব ব্যাপার মেনে নেওয়া খুব কঠিন। তারপরও প্রকৃতির ওপর তো কারও হাত নেই। আমরা প্রকৃতির অনুগত হয়ে গেছি। এটা মেনে নিতেই হবে। কিছু করার নেই।

টিবিএস: বাংলাদেশের এ বছরের সবগুলো সিরিজই স্থগিত হয়ে গেছে। এ বছর আর সিরিজ নেই বললেই চলে। এটা কতটা হতাশার।

ইমরুল: অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অতো ব্যস্ত সূচি থাকে না এমনিতে। হয়তো ওয়ানডেতে থাকে। টেস্ট বা টি-টোয়েন্টিতে এত বেশি সূচি থাকে না। এর মধ্যে যদি সিরিজ মিস হয়, সেটা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। একটা বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। একজন ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারের অনেক পরিবর্তন আসে। 

এদিক থেকে খেলোয়াড়দের জন্য এটা বড় ধাক্কা। বিশেষ করে যারা টেস্ট খেলে বা যারা সিনিয়র হয়ে গেছে তাদের জন্য। কারণ একটা বছর যাওয়া মানে তাদের ক্যারিয়ার থেকে একটা বছর চলে যাওয়া। একটা বছরের সব খেলাই তো মিস হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে খেলোয়াড়দের জন্য এটা বড় ক্ষতি। 

ইমরুল কায়েস। ছবি: সংগৃহীত

টিবিএস: পেশাদার ক্রিকেটারদের একমাত্র আয়ের উৎস ক্রিকেট। সব সিরিজ, ঘরোয়া ক্রিকেট বন্ধ হয়ে আছে। তাদের জন্য সামনের সময়টা কতটা কঠিন হবে?

ইমরুল: এখন যারা ক্রিকেট খেলে, পেশাদার হিসেবেই খেলে। ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি অন্য চাকরি করা ক্রিকেটার নেই বললেই চলে। সবারই আয় এই ক্রিকেট থেকে। তো প্রিমিয়ার লিগ বা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যদি না হয়, সেটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য বড় একটা ধাক্কা হবে তার পরিবার চালানোর ক্ষেত্রে। আমি বলব নিজেদের জায়গা থেকে সবারই ক্ষতি হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এটা খেলোয়াড়দের জন্য বড় ধাক্কা। 

টিবিএস: মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেন, ক্রিকেট মানেই জীবন নয়। আবার মুশফিকুর রহিমকে দেখে মনে হয় এটাই জীবন? ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে ক্রিকেটকে আপনার কাছে কী মনে হয়?

ইমরুল: ক্রিকেট হচ্ছে একজন ক্রিকেটারের জীবনের একটা অংশ। ক্রিকেট মানেই জীবন হতে পারে না। এটা সম্ভবই না। আপনি একটা সময় অবসরে যাবেন, তখন আপনার নামটা থাকবে। কিন্তু আপনি তো সারা জীবন ক্রিকেট খেলতে পারবেন না। আপনার পরিবার আছে, পারিপার্শিক আরও অনেক কিছুই আছে। সব নিয়েই থাকতে হবে।

সারাক্ষণ ক্রিকেট নিয়েই পড়ে থাকলে আপনি হয়তো কম-বেশি একটা জায়গায় পৌঁছাবেন, কিন্তু তখন মানুষের আর জীবন থাকে না। একটা জিনিস নিয়ে থাকা যায় না। ক্রিকেটের বাইরেও মানুষের একটা জীবন আছে। ওটাকেও উপভোগ করা উচিত। 

টিবিএস: ক্রিকেট নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখিয়েছে। ক্রিকেট জীবন থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা কী?

ইমরুল: ক্রিকেট জীবন থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে সততা। যারা স্পোর্টসম্যান, তারা কখনও খারাপ হয় না। স্পোর্টস মানসিকতার মানুষরা বেশিরভাগ সময় সৎ হয়। সততার ব্যাপারটি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করে। যা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের জীবনে। একজন ক্রিকেটার স্পোর্টস মানসিকতার হলে আপনাকে কখনও ঠকাবে না।

টিবিএস: ২০০৮ সালে বাংলাদেশ দলে আপনার অভিষেক। ১২ বছর হয়ে গেলেও দলে আপনার জায়গা পোক্ত হয়নি। নিজের ভুলের কারণেই এমন হয়েছে নাকি অন্যদেরও দায় আছে?

ইমরুল: অন্যদের দায় আছে কিনা, সেটা তো মানুষ বলবে। কারণ সবাই খেলা দেখে, কম-বেশি বোঝে। এখন বাংলাদেশের মানুষ অনেক ক্রিকেট বোঝে। দায় সব যে ভাগ্য বা অন্যের ওপর দেব, তা না। আমারও কিছুটা আছে। হয়তো আমি প্রতিটা ম্যাচে ভালো খেলতে পারিনি, এটা আমার দায়। সব মিলিয়ে চিন্তা করলে কিছুটা তো ভাগ্যের ওপর থাকবেই।

একজন খেলোয়াড় তো সব সময় ভালো খেলতে পারে না। ওই সময়টাই হয়তো কঠিন হয়ে যায়। আমি যখন খারাপ খেলি, তখন দলে থাকি না। এই জন্য হয়তো ক্যারিয়ারটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ধারাবাহিকতা থাকলে হয়তো আমার ক্যারিয়ারটা আরেকটু ভিন্ন হতে পারতো। 

টিবিএস: জীবনের অনেক বাঁক থাকে। আপনার জীবনের কোন বাঁকটা ঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারলে মনেহয় যে ক্যারিয়ারটা আরও গোছানো থাকতো? কিংবা সুযোগ থাকলে কোন ভুলটা মুছে দিতে চাইতেন?

ইমরুল: মানুষের জীবনে চলার পথে ভুল তো থাকবেই। আবার ঠিক হবে। ভুল আবার ঠিক, এটা একটা সার্কেলের মতো। আপনি কখনই সহজভাবে যেতে পারবেন না। বাধা আসবে আবার সহজ হবে। এটা বলা কঠিন যে কোন ভুল মুছে দিতে পারলে ক্যারিয়ার আরও গোছানো হতো। তবে যে ভুলগুলো করেছি, সেগুলো কম করলে আরও ভালো হতে পারতো। 

টিবিএস: তামিম ইকবালের সঙ্গে অনেক ম্যাচে ইনিংস উদ্বোধন করেছেন। তামিম ওপেনার হিসেবে অটো চয়েজ, বাকি জায়গাটা বারবার পরিবর্তন হয়। তামিমের মতো তিথু হতে না পারাটা আফসোসের কিনা?

ইমরুল: অবশ্যই, কেন আফসোস হবে না? তামিমের সাথে আমরা অনেক ওপেনার ইনিংস শুরু করেছি। কেউই সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি। এটা অবশ্যই দুঃখজনক। তামিম আজ সুপারস্টার হয়ে গেছে, বড় খেলোয়াড় হয়ে গেছে। তবে তামিমেরও খারাপ সময় গেছে। স্ট্রাগল করার সেই সময়টায় হয়তো তামিম সেই সমর্থনটা পেয়েছে। অন্যরা হয়তো সেই সমর্থনটা একটু কম পেয়েছে। যে কারণে ওইভাবে দাঁড়াতে পারেনি। 

যেটা বললাম জীবনে বাধা আসবেই। যেটা জয় করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বাধাটা বড় হয়ে যায়। যে কারণে অনেক পিছিয়ে যেতে হয়। তামিমের জীবনে হয়তো দীর্ঘ সময়ের জন্য বাধাটা থাকেনি। অল্প সময়ের জন্য হয়তো ছিল, তামিম যেটা জয় করেছে। আমাদের ক্ষেত্রে হয়তো সময় একটু বেশি লেগেছে। আরেকজন এসে হয়তো দাঁড়িয়ে গেছে। এ কারণেই হয়তো দলে থিতু হওয়া হয়নি। 

টিবিএস: ফেরার সিরিজে বা ম্যাচে আপনি সব সময়ই ভালো করেছেন। আবার ভালো করেও বাদ পড়েছেন। এক ক্রিকেটারকে মজা করে বলতে শুনেছিলাম, বলছিল; "ইমরুল যেহেতু ফেরার ম্যচে ভালো করে, ওকে বারবার বাদ দিতে হবে আবার নিতে হবে।" এটা মজা করে বলা হলেও আপনার জন্য এটা প্রহসনের কিনা?

ইমরুল: এটা যে বলেছেন, তাকেই বলবেন ওই অবস্থায় আমার মতো করে খেলতে। তার উত্তরটা সে পেয়ে যাবে। সে বুঝবে কতটা কঠিন ওই অবস্থায় খেলা, মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা। কারণ আপনি জানেন, আজকের ম্যাচে খারাপ খেললে আপনার ক্যারিয়ার শেষ, আর জাতীয় দলে ঢুকতে পারবেন না। এমন অবস্থায় একজন খেলোয়াড় যতবার খেলবে, তার ভালো খেলার সম্ভাবনা কম থাকবে। হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতে ভালো খেলে ফেলি। 

খেলার একটা স্বাধীনতা থাকা লাগে যে আপনি তিনটা সিরিজ খেলবেন, খারাপ খেলেন, ভালো খেলেন আপনাকে বাদ দেওয়া হবে না। ক্যারিয়ার গড়তে বা বড় কিছু অর্জন করতে এই যে একটা স্বাধীনতা লাগে, সবার ক্ষেত্রে এই স্বাধীনতা থাকে না। এই স্বাধীনতা না থাকার কারণে অনেক মেধাবী ক্রিকেটার আমাদের দেশে শেষ হয়ে গেছে। আপনি একটা ম্যাচ খেলবেন, পরের ম্যাচ আপনি খেলবেন কি খেলবেন না, আপনি জানবেন না। এটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য ভালো হয় না। স্বাভাবিক খেলাটা বের হয়ে আসে না। 

ফেরার ম্যাচে আমি সব সময় চিন্তা করি এটা ডু অর ডাই। এটা আমার জীবনের শেষ ম্যাচ, আমি শেষ ম্যাচ খেলে ফেলি। চাপ না নিয়ে উপভোগ করার কারণে হয়তো সফল হয়ে যাই। কিন্তু যখনই চিন্তা করি দলে থাকতে হবে, তখন আবার চাপ কাজ করে। আমি মনে করি একটা খেলোয়াড়কে যখনই দলে নেওয়া হোক না কেন, তার মতো কয়েকটা ম্যাচ বা সিরিজ খেলতে দেওয়া উচিত।

টিবিএস: একজন ক্রিকেটার হিসেবে দল থেকে কতটুকু গুরুত্ব বা স্বাধীনতা পেয়েছেন বলে মনে করেন?

ইমরুল: পাইনি সেটা বলব না আবার পুরোপুরি পেয়েছি, সেটাও বলব না। কারণ একটা সময় ছিল দলে আমার ভূমিকাটা আমি জানতাম। জেমি সিডন্সের তত্ত্বাবধানে খেলা অবস্থায় আমাকে বলা হতো তুমি উইকেট থাকবে। তামিম এক পাশ থেকে মারতে থাকবে, তুমি উইকেট থাকবে। আমিও কিন্তু এক সময় আক্রমণাত্মক খেলতাম। কিন্তু আমার খেলাটা ওই সময় পরিবর্তন করা হয়েছিল। দলের অবস্থা বিবেচনায় আমাকে বলা হয়েছে তুমি উইকেট গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। 

আমি আর তামিম ইনিংস শুরুর আগে একটা সময় ছিল বাংলাদেশের ৩০-৪০ রানে ৪-৫ উইকেট পড়ে যেত। তখন আমাকে জেমি সিডন্স বললেন তুমি উইকেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম, দেখতাম অন্য পাশে রান হচ্ছে। ওই সময় আমি একটা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম যে আমি আমার রোলটা বুঝতাম। 

জেমি সিডন্স চলে যাওয়ার পরে বাদ পড়া শুরু হলো আমার। কারণ তখন আমি আমার ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার হতে পারিনি। আমি আমার আগের যে ভূমিকায় খেলেছি, নতুন কোচ এসে হয়তো আগের ভূমিকাটা পছন্দ করেননি। ওই জায়গাগুলো হয়তো মেনে নিতে পারেননি। হয়তো ভেবেছে আমি কেন এভাবে খেলেছি, আমাকেও তামিমের মতো খেলতে হবে।

কিন্তু একজন মানুষ তো রাতারাতি পরিবর্তন হতে পারে না। আমি দুই-তিন বছর একভাবে খেলছি, হুট করে আপনি বলবেন তুমি কাল থেকে এভাবে খেলবে, এটা তো সম্ভব না। আমাকে তো সময় দিতে হবে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরে আমি হাথুরুসিংহেকে বললাম, কোচ আমার কী করা লাগবে। তিনি আমাকে বললেন, "তোমার স্ট্রাইক রেট বাড়ানো লাগবে। তোমাকে ৯০ এর উপরে স্ট্রাইক রেট দিতে হবে।"

তখন আমি বুঝতে পেরেছি জাতীয় দলে আমার রোলটা কী, আমাকে আক্রমণাত্মক খেলতে হবে। ২০১৫ সালের পর থেকে আমি যতগুলো ওয়ানডে খেলেছি, প্রতিটা ম্যাচে আমার ৯০ এর উপরে স্ট্রাইক রেট। তখন আমি জেনেছি আমার ভূমিকা কী। এখন আমাকে আমার ভূমিকা ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলা হয় না।

যেমন মুশফিক বা রিয়াদ ভাইকে যদি প্রশ্ন করেন মিডল অর্ডারের তাদের ভূমিকা কী, তারা কিন্তু জানে সেটা। তামিম যেমন তামিমের ভূমিকা জানে। একজন মানুষকে যখন একটা ভূমিকা দেওয়া হয় যে, তোমাকে এভাবে খেলতে হবে, সেটাই হচ্ছে তার স্বাধীনতা। এর বাইরে আউট হলে সেটা তার দায়। 

তামিম এখন কী করে, খেলতে খেলতে ইনিংসটা লম্বা করে। এখন তামিমকে যদি বলা হয়, প্রথম থেকেই মারতে হবে, তামিম কিন্তু সফল হবে না। কারণ তামিমের আগের সেই খেলা নেই। তামিম এখন ক্রিকেট বোঝে, খুব ভালো বোঝে। প্রতিটা মানুষের তার ভূমিকাটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

টিবিএস: জাতীয় দলে আপনার অভিষেক ২০০৮ সালে। এর পরে অনেকে এসে নিয়মিত সদস্য হয়ে গেছেন। অনেকে আবার বেশ সুযোগও পেয়েছেন। তাদের জায়গা দিতে আপনাকেও জায়গা হারাতে হয়েছে। তাদের মতো আপনাকেও সুযোগ দেওয়া হলে নিজেকে আরও উপরে নিতে পারতেন কিনা?

ইমরুল: এটা আমি বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি এই কারণে, এটা আমি প্রমাণ করে দিয়েছি। ২০১০ সালে যখন ধারাবাহিকভাবে আমাকে ওয়ানডে ম্যাচ খেলেয়েছিল, ওই বছর আমি বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলাম এবং বিশ্বে মনেহয় চার নম্বরে ছিলাম রানের দিক থেকে। আমি জানতাম আমি ম্যাচ খেলব, খারাপ খেলি আর ভালো খেলি। 

আমি জানতাম এক বা দুই ম্যাচ খারাপ খেললেও আমি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবো। পরবর্তীতে এটা ছিল না। আমাকে বাদ দেওয়া আবার দলে নেওয়ার মধ্যে রেখেছে। যে কারণে হয়তো আমি আমার সেরাটা দিতে পারিনি। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার যে, আপনি যখন সুযোগ পেতেই থাকবেন, ভুল করতেই থাকবেন, ভুল করতে করতে আপনি কিন্তু একটা সময়ে বুঝবেন। 

একজন মানুষ যখন ভুল করছে আবার ভালো করছে, কিন্তু তাকে বাদ দেওয়া-দলে নেওয়ার মধ্যে রাখছেন; এটা তো হয় না। কোনো জায়গাতেই এটা সম্ভব না। কোনো চাকরিতেও যদি আজ আপনাকে এই ডেস্ক, কাল আরেক ডেস্ক, পরের দিন আরেকটায় দেওয়া হয়, আপনি কাজ করতে পারবেন না, সফল হতে পারবেন না। 

বাদ দেওয়া আবার দলে নেয়ার যে ব্যাপারটা, এটা হতে থাকলে আমি বলব একজন ক্রিকেটারের পেছনে এটা খারাপ ইনভেস্টমেন্ট। ২০০৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বোর্ড আমার পেছনে যত টাকা ইনভেস্ট করেছে, আমার সময়টা যখন দেওয়ার ওই সময়টা আমি দিতে পারছি না। এটা খারাপ ইনভেস্টমেন্ট। আমার যখন দেওয়ার সময়, আমি তখনই দিবো। আমার যখন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সময়, তখন কিন্তু আমি দিতে পারব না। আমি যেটা দিবো, ওটা বোনাস। 

টিবিএস: আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১২ বছর হয়ে গেছে। আরও কতটা সময় পাড়ি দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন?

ইমরুল: যে কয়দিন ফিট থাকতে পারি, যে কয়দিন খেলা উপভোগ করতে পারব। যতদিন মনে করব যে পারছি, ব্যাটে রান আসবে, হয়তো সে পর্যন্ত খেলব। যখন দেখব শরীর আর পারছে না বা ব্যাটে আর হচ্ছে না, তখন আর কাউকে বলা লাগবে না। তার আগেই ছেড়ে দিবো। 

টিবিএস: ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের মধ্যে দুই সেঞ্চুরি ও আরেকটি ৯০ রানের ইনিংস খেলেন। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই ম্যাচে খারাপ করতেই দল থেকে বাদ। ওই বাদ পড়ার পর এখন পর্যন্ত আর ওয়ানডে খেলা হয়নি আপনার। দুই ম্যাচের বাজে পারফরম্যান্স আগের তিন ম্যাচের দারুণ সাফল্য মুছে দেয়। আপনার সাথে সে সময় কি অবিচার করা হয়েছিল?

ইমরুল: এটা তো আপনারাই বলবেন। আমি নিজেও হতবাক ছিলাম। আমার মনে হয় না পৃথিবীতে এমন আর হয়েছে। আমার খারাপ লেগেছিল, যখন দেখলাম আমি ২০১৯ বিশ্বকাপের দলে আমি সিলেক্ট হইনি। ওই সময় মনটা অনেক খারাপ ছিল। তারপরও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি যে, হতেই পারে। বিশ্বকাপটা খেলার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। যখন হলো না, তখন মেনে নিয়েছি। 

আপনি একটা সিরিজে সর্বোচ্চ রান করবেন, সিরিজ সেরা হবেন আবার বাদও পড়বেন! আমি এরআগের সিরিজে ব্যাটিং করেছি এক-দুইয়ে, পরের সিরিজে ব্যাটিং করেছি তিন নম্বরে। কোথায় ব্যাটিং করছেন এটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুইদিন পর ওলট-পালট করা কীভাবে, এটার জন্য মানসিক পরিবর্তন দরকার। রাতারাতি আপনি এটা করতে পারবেন না। 

বাংলাদেশে কী হয়, দেখে যে আজ কী করছে, কাল কী করেছে। আপনি কী করেছেন, এটা মানুষ ভুলে যায়। আর আমার সাথে একটা ব্যাপার হয়, আমি রান করলেই মানুষের ধারণা আমি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রান করি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারলে কিন্তু তখন আবার অন্য ব্যাপার। অনেকেই জিম্বাবুয়ে বা এর-ওর সাথে রান করে, তখন বলা হয় রান করেছে, ভালো করেছে। কিন্তু ইমরুল কায়েস রান করলে হয়ে যায়, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রান করেছে। টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে ৭টি যে সেঞ্চুরি করেছি, এর মধ্যে তিনটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। বাকি চারটি তো অন্য দলের বিপক্ষে করেছি। 

আমি যেদিন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪৪ করলাম, ওদিন কিন্তু বাংলাদেশ হারতো। তারপরও ওই ইনিংসটা কেউ মূল্যায়ন না করে বলল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রান করেছে। এটা তো সবাই করতে পারে। এটা দুঃখজনক, এটায় খুব খারাপ লাগে। আপনি একজন মানুষকে সম্মান দেবেন না কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু একজন মানুষকে তো আপনি নিচে নামাতে পারেন না। এতে খেলোয়াড়রা কষ্ট পায়। 

আমি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০০ করলাম। বলা হলো ওর ১০০ স্বার্থপর ১০০। ও ১০০ করে ম্যাচ জেতাতে পারে না। কিন্তু একা তো কেউ ম্যাচ জেতাতে পারে না। এটা সম্ভব না। আমি ১০০ করেছি, অন্য পাশ থেকে দেখেছি উইকেট শেষ। এখানে আমার কী করার আছে। আমি যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০০ করলাম, সেটার কোনো মূল্যই হলো না। ইমরুল কায়েসকে নিয়ে মন্তব্য করাটা একটা সহজ ব্যাপার হয়ে গেছে। 

টিবিএস: দর্শকদের সমালোচনা একজন ক্রিকেটারের মনোযোগে কতটা ব্যাঘাত ঘটাতে পারে?

ইমরুল: এটা সহজ ব্যাপার, বাংলাদেশের বেশিরভাগ দর্শক ক্রিকেট কম বোঝে। বিনোদনের জন্য চার-ছয় বোঝে। এটা আমি সব সময়ই বলি। তারা ভালোভাবে ক্রিকেট বুঝলে টেস্ট ক্রিকেটকে ভালোবাসতো। এবং মুমিনুলকে তারা সেই পর্যায়ের সম্মান দিতো। সে টেস্টে বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান। কিন্তু টেস্ট অধিনায়ক হওয়ার পরও তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তারপরও বলব দর্শকরা বিনোদনের জন্যই মাঠে যায়। তারা চার-ছয় দেখে খুশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা ক্রিকেট বুঝেও এমন করে, তখন আমাদের কষ্ট লাগে। 

টিবিএস: তামিমের সঙ্গে টেস্টে আপনার রেকর্ড জুটি আছে, অনেক ভালো শুরু এনে দিয়েছেন। তারপরও আপনাকে সেভাবে বিবেচনা করা হয়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৮টি টেস্ট খেলেছে, আপনি খেলেছেন ৫টি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে খেলেছে ৫টি, আপনি ২টি। এখানেও আপনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে কিনা?

ইমরুল: হয়তো অনেককে ট্রাই করেছে। হয়তো ভেবেছে আমার থেকে বড় অপশন আছে। কিংবা নতুন কাউকে স্থায়ী করার চিন্তা করেছে। আমি আগে কী করেছি সেটা দেখে লাভ নেই। আমি আগেই বলেছি আমাদের দেশে প্রমাণ করা বা আপনি কী করেছেন সেটা অতীত হয়ে যায়। কাল বা আজ কী করছেন সেটাই আসল হয়, ইনস্ট্যান্ট রেজাল্ট। 

টিবিএস: কোন ফরম্যাটের খেলোয়াড় হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়? নাকি তিন ফরম্যাটেই? 

ইমরুল: আমি তো সব সময় তিন ফরম্যাটই উপভোগ করি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টি-টোয়েন্টি বেশি না খেলা হলেও এই ফরম্যাটটা খেলতে আমার ভালো লাগে। কোনো ফরম্যাটই আলাদা নয়। সব ফরম্যাটই উপভোগ করি।

টিবিএস: এখন পর্যন্ত আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা কোনটি। যেটা পূরণ না হওয়ায় আপনার আক্ষেপ হয়।

ইমরুল: ২০১৯ বিশ্বকাপ না খেলতে পারাটা। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মিস। এই আসরটাকে আমি খুব মিস করেছি। এ ছাড়া তেমন কোনো অপূর্ণতা নেই। বাংলাদেশের বড় জয়ে আমার একটু হলেও অবদান আছে। শুধু এই বিশ্বকাপে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ হয়নি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.