বার্সা থেকে মেসির বিদায় ফুটবলের জন্য এক অশনি সংকেত
সুপার লিগের কথা মনে আছে? এপ্রিলে পুরো ফুটবল বিশ্বকে টাল-মাতাল করে দিয়ে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোকে নিয়ে যেই লিগের উত্থান, এবং ব্যাপক জনরোষের মাঝে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই যার পতন।
পরিকল্পনা পর্যায়ে সুপার লিগের হর্তাকর্তাদের একাংশ চাচ্ছিল যত দ্রুত সম্ভব এই লিগের ঘোষণা দিয়ে দেওয়ার। এই অংশে ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনা পেরেজ ও জুভেন্টাস চেয়ারম্যান আন্দ্রে আগনেল্লী। বিশেষ করে উয়েফার বোর্ড পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আগনেল্লী 'ডাবল এজেন্ট' হিসেবে কাজ করার চাপটা নিতে পারছিলেন না।
আর হর্তাকর্তাদের আরেক অংশ চাচ্ছিল সময় নিতে। এই অংশে ছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সফল দুই ক্লাব, লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মার্কিন মালিকেরা। তারা চাচ্ছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা সাজিয়ে তারপর ঘোষণা দিতে।
সেদিন প্রথমাংশ যদি না জিতত, তাহলে এই প্রজেক্ট অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়ে আবার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তলিয়ে যেতো না। অলিম্পিকের পর ও নতুন মৌসুম শুরু হওয়ার আগের কোনো এক সময়ে, হয়তো এই সপ্তাহেই ঘোষণা আসতো নতুন সুপার লিগের।
সুপার লিগ আলোর মুখ দেখেনি, এটা অবশ্যই ফুটবলের জন্য একটি সুসংবাদ। কিন্তু এই সপ্তাহে যা যা হয়েছে, তা ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবারও ভাবাচ্ছে আমাদের। হঠাৎ করেই সুপার লিগের ব্যর্থতা থেকে সান্ত্বনা নেয়ার কিছু আর থাকছে না।
গত বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ দলবদলের রেকর্ড ভেঙে ১১৭০ কোটি টাকা ব্যয় করে জ্যাক গ্রিলিসকে দলে ভিড়িয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। এই রেকর্ড কিন্তু ভেঙে যেতে পারে দ্রুতই। এই সপ্তাহের মাঝেই টটেনহাম হটস্পার্স ও ইংল্যান্ড স্ট্রাইকার হ্যারি কেইনকেও দলে ভেড়াতে পারবে বলে আশা করছে সিটি। ইংলিশ অধিনায়কের দলবদলের ফি ১৭০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
এবং সবকিছুকে ছাপিয়ে, এই সপ্তাহেই, পিএসজির খাতায় নাম লিখিয়েছেন লিওনেল মেসি। এর আগে বার্সা জানিয়েছে, লা লিগার আইন অনুযায়ী ও ক্লাবের অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত দুর্বলতার জন্য ছয়বারের ব্যালন ডি'অর জয়ীকে নতুন মৌসুমের জন্য নিবন্ধন করতে পারবে না তারা। কাতালান ক্লাবটি নিজেদের অপারগতা জানানোর পর ছোটবেলার ক্লাবকে বিদায় জানানো ছাড়া আর কোন পথই খোলা ছিল না মেসির জন্য। এরপর বার্ষিক ২৯৩ কোটি টাকা বেতনে দুই বছরের জন্য পিএসজির সাথে চুক্তি করেছেন এই আর্জেন্টাইন।
গতকাল হাজারো ভক্তের অভ্যর্থনায় প্যারিসে পা রেখেছেন মেসি। আজকে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে একজন পিএসজি খেলোয়াড় হিসেবে উন্মোচিত করেছে ফরাসি দলটি।
এখনো অনেকেই হয়তো পিএসজির জার্সিতে মেসিকে কল্পনা করতে পারছেন না। কিন্তু মেসির জন্য আর কোন বিকল্পই ছিল না। আরেকভাবে বললে, যেই ব্যক্তির পক্ষে যেকোনো কিছুই করা সম্ভব বলে জেনে এসেছি আমরা, সেই ব্যক্তি নিজের পরবর্তী গন্তব্য নির্বাচনের জন্য ক্লাব পেয়েছেন হাতে গোনা কয়েকটি।
বিকল্পের অভাব আধুনিক ফুটবলেরই একটি বৈশিষ্ট্য হতে চলেছে। সর্বকালের সেরা লিওনেল মেসি তার শেষ কয়েকটা বছর কোথায় খেলবেন, সে ব্যাপারেও তার মতামত রাখার তেমন সুযোগ ছিল না।
তিনি থাকতে চেয়েছিলেন বার্সায়। পারেননি। কারণ তার ক্লাব বড়সড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে আছে। মূলত বোর্ডের অযোগ্যতার জন্যই আজ এখানে এসে পৌঁছেছে বার্সা। কিন্তু এর বাইরেও কিছু অনুঘটক আছে।
গত কয়েক বছরে অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ করেছে কাতালান ক্লাবটি। এবং এর মাধ্যমে ক্লাবের দীর্ঘদিনের সুনামও অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, বার্সার এরকম লাগামহীন খরচের পিছনে ছিল ইউরোপীয় ফুটবলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে তাল মেলানোর চাপ।
সেসব প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের মালিকানা পরিষদের দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখবেন শুধু বিভিন্ন দেশের কোটিপতি ও রাজ্য শাসকদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না তারা, পুরো রাষ্ট্রের মালিকানাতেও চলছে কিছু ক্লাব। এসব মালিকদের অনেকেরই আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। ক্লাবের পিছনে কত টাকা ঢালছেন তারও ইয়ত্তা নেই। এবং সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, কতটুকু খরচ করতে পারবে সে ব্যাপারে এখন কোন বাস্তবিক বিধিও নেই।
গতবছর উয়েফা ফিনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে (এফএফপি)-র বিধি ভাঙার জন্য ম্যান সিটিকে দোষী সাব্যস্ত করে ইউরোপীয় ফুটবল থেকে ইংলিশ ক্লাবটিকে দুই বছরের নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে ঠিকই সেই নিষেধাজ্ঞা খারিজ করিয়ে নিয়েছে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় অর্থে চলা ক্লাবটি।
সিটির অর্থনৈতিক অনাচারের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছিল প্রিমিয়ার লিগও। কিন্তু এফএফপির বিধি ভাঙার জন্য সেই তদন্ত ২০১৮ সালে খোলা হলেও তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি এখনো।
গত সপ্তাহে বার্সা মেসির বিদায়ের সংবাদ দেওয়ার পর পুরো ইউরোপে মাত্র তিনটি ক্লাব ছিল যারা বাস্তবিকভাবে মেসির বেতন বহন করতে পারতো। সেই তিনটি ক্লাব হচ্ছে- ম্যান সিটি, চেলসি ও পিএসজি। তিনটি ক্লাবের পিছনেই আছে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বা রাষ্ট্রীয় ব্যবসা থেকে আসা অর্থ। তিনটি ক্লাবই একাধিকবার এফএফপির ব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
অনেকের কাছেই মেসির পিএসজিতে যাওয়াটা একটি রুচিশীল সিদ্ধান্ত। নেইমারের সাথে পুনর্মিলিত হচ্ছেন, বিস্ময়বালক এমবাপ্পের সাথে যোগ দিচ্ছেন, সাবেক এল ক্লাসিকো প্রতিদ্বন্দ্বী সার্জিও রামোসের সাথে যোগ দিচ্ছেন; এ সবই মুখরোচক।
পিএসজিতে মেসির সময়কালও নিঃসন্দেহে মনোমুগ্ধকর হবে। এছাড়া জার্সি বিক্রি, স্পন্সরশিপ ও টিভি সত্ত্ব থেকে অভাবনীয় অর্থ পেতে যাচ্ছে ফরাসি লিগ। হয়তো ফরাসি ফুটবলেই নতুন প্রাণ দিবে এই দলবদল। আর মাঠের ফুটবলও হয়তো দর্শনীয়ই হবে।
কিন্তু এতকিছু পাওয়ার ভিড়ে আমরা কী হারাচ্ছি সেটাও ভাবতে হবে।
এপ্রিলে ফুটবলের যাবতীয় সমস্যার যেই উত্তর নিয়ে সুপার লিগ মাথাচাড়া দিয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে ভুল। তারা ফুটবলের যেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছিল, সেটা বাকিদের দূরে ফেলে দিয়ে শুধু সুপার লিগের ওই কয়েকটি ক্লাবকেই উপকৃত করতো।
কিন্তু উত্তর ভুল হলেও তারা যেই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল, সেটা কিন্তু সঠিক। ওই এক ডজন ক্লাবের হর্তাকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ফুটবলের বর্তমান মডেল আর টেকসই নেই। খরচ অনেক বেড়ে গেছে এখন, আর এর সাথে বেড়েছে ঝুঁকিও। পরিবর্তনের তাগিদটা তারা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু স্বার্থ ও লোভের মধ্যে নিমজ্জিত থেকে সেই পরিবর্তনটা কীভাবে হলে আদর্শ হয়, সেটা আর বের করতে পারেনি তারা।
মূলত দুই-তিনটি ধনী ক্লাবের সাথে কীভাবে লড়বে সেটা নিয়ে কূল কিনারা করতে পারছিল না তারা। তাদের কাছে মনে হচ্ছিল বাকিদের জন্য যেই আইন তা এই দুই-তিনটি ক্লাবের উপর ফলছে না। এবং দ্রুতই সব ধরনের শিরোপার দখল নিয়ে নিবে পিএসজি, চেলসি ও সিটি।
এবং তাদের ধারণা সত্যিও হচ্ছে। পিএসজি সবেই মেসিকে দলে ভেড়াল। ওদিকে সিটি এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে যাচ্ছে দুইজন ফুটবলারের পিছনে। চেলসিও কম যাচ্ছে না। একজন স্ট্রাইকারের পিছনেই তারা এবার খরচ করেছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। সুপার লিগের হর্তাকর্তাদের যাবতীয় দুঃস্বপ্ন যেন এই সপ্তাহেই সত্য হচ্ছে।
তবে তাই বলে তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানোরও কিছু নেই। এই সুপার লিগের ক্লাবগুলোর যাবতীয় পরিকল্পনা ছিল নিজেদেরকে ঘিরেই। তাদের স্বার্থ রক্ষার কারণে ফুটবলে যে প্রতিযোগিতামূলক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে, সেদিকে মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেনি তারা।
কিন্তু হারার সময় তারা একা হারেনি। এপ্রিলের সেই ৪৮ ঘণ্টা শেষে ফুটবল রক্ষা পেয়েছে ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছিল ফুটবল ভক্তরা। মঙ্গলবার যখন মেসি প্যারিসে পৌঁছেছেন, তখন একটা প্রশ্নই আবার ঘুরেফিরে আসছে- আসলেই কি রক্ষা পেয়েছে ফুটবলের ভবিষ্যৎ?
সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
অনুবাদ: কিরো আদনান আহমেদ