বন্ধুর হাত ধরে ব্যাডমিন্টন থেকে ক্রিকেটে শারমিন 

খেলা

23 November, 2021, 11:00 pm
Last modified: 23 November, 2021, 11:46 pm
ছোটবেলায় শারমিনের ইচ্ছে ছিল প্রকৌশলী হবেন। তার খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু ব্যাডমিন্টন দিয়ে। ব্যাডমিন্টনটা শারমিন খেলতেনও বেশ ভালো। স্কুলজীবনে নাহিদ কটন মিলস টুর্নামেন্ট ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নও হন। তবে নিয়তি শারমিনকে বানিয়েছে ক্রিকেটার।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর শারমিন আক্তার। ছবি: বিসিবি

ইনিংসের শুরু করতে নেমে ব্যাটিং করেছেন পুরো ৫০ ওভার। করেছেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি করেও একটু আক্ষেপে পুড়তেই পারেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ব্যাটার শারমিন আক্তার সুপ্তা। ম্যাচটি আন্তর্জাতিক ওয়ানডের মর্যাদা পেলে এই সংস্করণে দেশের প্রথম নারী ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে যে তার নাম লেখা হয়ে যেত ইতিহাসের পাতায়। তবে কাগজে-কলমে স্বীকৃতি না পেলেও অলিখিতভাবে এবং ক্রিকেটভক্তদের মনের পাতায় ঠিকই ঠাঁই করে নিয়েছেন শারমিন।

ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে মঙ্গলবার ১৩০ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন শারমিন। ১৪১ বলের ইনিংসে বাউন্ডারি মেরেছেন ১১টি।

শারমিনের জন্ম গাইবান্ধার বালুয়া বাজার এলাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা একসময় গাইবান্ধার সাঘাটার একটি কলেজে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, মা গৃহিণী। দুই বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে শারমিনই সবার বড়। গত বছর প্রয়াত হয়েছেন শারমিনের বাবা। বাবা বেঁচে থাকতে তারা গাইবান্ধা শহেরর পলাশপাড়া এলাকায় ভাড়া থাকতেন। 

ছোটবেলায় শারমিনের ইচ্ছে ছিল প্রকৌশলী হবেন। তার খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু ব্যাডমিন্টন দিয়ে। ব্যাডমিন্টনটা শারমিন খেলতেনও বেশ ভালো। স্কুলজীবনে নাহিদ কটন মিলস টুর্নামেন্ট ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নও হন।

তবে নিয়তি শারমিনকে বানিয়েছে ক্রিকেটার। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর হাত ধরে গাইবান্ধা শাহ আব্দুল হামিদ স্টেডিয়ামে অনুশীলন শুরু করেন তিনি। প্রথম প্রথম পরিবার তার ক্রিকেট খেলায় আপত্তি জানালেও পরে শারমিন পরিবারের সদস্যদের সমর্থন আদায় করে নেন।

শারমিনের খুব কাছের বান্ধবী জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের আরেক ক্রিকেটার ফারজানা পিংকী। পিংকীই ব্যান্ডমিন্টন খেলার এক ফাঁকে প্রশিক্ষক মো. বাবলু খান ওরফে সোহেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন শারমিনকে। তখন শারমিন তাকে বলেন, 'আমি ক্রিকেট খেলাও শিখতে চাই।' 

এরপর বাবলুর কাছেই ২০০৫-০৬ সালের দিকে ক্রিকেট খেলার প্রথম প্রশিক্ষণ পান শারমিন। বাবলুই তার মনে ঢুকিয়ে দেন জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন। ওই সময় শারমিন পড়াশোনা করতেন গাইবান্ধার ট্রাফিক মোড়ের আসাদুজ্জামান স্কুলে।  

তাকে বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষাকেন্দ্র বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-এর (বিকেএসপি) পথ চেনান বাবলু। একদিন তিনি শারমিনকে জানালেন, বিকেএসপিতে সামনের মাসে একটা ট্রায়াল আছে। সেখানে চেষ্টা করলে সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। এ কথা বাড়িতে জানাতে শারমিনের মা আপত্তি তোলেন। পরে অবশ্য মেয়েকে ট্রায়ালে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেন তিনি।

কোচ বাবলু জানালেন, 'সেদিন ভর্তির ট্রায়াল দিতে সভারে গেটে ঢুকেই শারমিন দেখল অনেক ছেলেমেয়ে সাদা জার্সি গায়ে দিয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে খেলছে। গেট থেকে দেখেই এই পরিবেশটা খুব ভালো লাগে ওর। মনে মনে তখন শারমিন ভাবে, এখানেই ভর্তি হবে সে।' 

যা-ই হোক, বিকেএসপিতে ট্রায়ালে অংশ নিলেন শারমিন। তাৎক্ষনিক ফলে ১৫ জনের মধ্যে পাওয়া গেল শারমিনের নামও। এ খবর বাড়িতে জানানোর পর আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন তার মা। মেয়ে কীভাবে অচেনা জায়গায় থাকবে, পড়াশুনা কেমন করে হবে—সব নিয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন তিনি। তবে সব দুশ্চিন্তা আর বাধার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ২০০৮ সালে শারমিন ভর্তি হন বিকেএসপিতে। 

শারমিনের বাবলু আরও বলেন, 'বিকেএসপিতে ভর্তির পর পাড়া-প্রতিবেশীরা বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। বাড়িতে এসে শারমিনের মাকে অনেক কথা শুনিয়েছে।' 

তবে এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে বলে জানালেন বাবলু। শারমিন জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর প্রতিবেশীসহ গোটা এলাকাবাসীই এখন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

বিকেএসপিতে কোচ রাশেদ ইকবালের মাধমে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন শারমিন। হাতে-কলমে তিনিই শারমিনকে ক্রিকেট শিখিয়েছেন। বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটও যে একদিন উন্নতি করবে, ক্রিকেটকেও যে মেয়েরা পেশা হিসেবে নিতে পারবে—এই বিষয়টি প্রথম শারমিনের মাথায় ঢুকিয়েছেন কোচ রাশেদ । 

বস্তুত শারমিনের ক্রিকেটার জীবনের মূল ভিত্তি গড়ে দেয় বিকেএসপি। এখানকার পরিবেশ, শৃঙ্খলা ও জীবনযাত্রার ধরন তাকে শাণিত হতে সাহায্য করেছে।

২০০৯ সালে শারমিন ক্লাব টুর্নামেন্ট ও বিভাগীয় পর্যায়ে লেভেলে খেলেন। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসাবে অর্ধশত করেন (৫৩ রান) শারমিন। এই ম্যাচই ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

শারমিন এখন মাস্টার্স পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিষয়ে। ভালো খেলোয়াড় হিসেবে কলেজেও বিনা বেতনে পড়েছেন শারমিন। 

শারমিনকে নিয়ে গাইবান্ধা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেনও বলেন, 'অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ শারমিন জাতীয় দলের হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। শারমিন অনেক উদয়মান নারী ক্রিকেটারকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.