মিনিটে ১৬ বার ‘স্যার’ ডাকার আমলাতন্ত্র

ইজেল

28 May, 2022, 09:50 pm
Last modified: 28 May, 2022, 09:50 pm
একটি দেশের আমলারা ঊর্ধ্বতনদের মিনিটে ১৬ বার ‘স্যার’ ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যান। সেই হিসাবে স্যার শব্দটি একবার উচ্চারণ করতে যদি আধসেকেন্ড লাগে, তাহলে দেশটির আমলাদের মোট কর্মঘণ্টার ১৩ শতাংশ সময়ই খরচ হয় ‘স্যার’ বলতে বলতে।

'আমলা' শব্দটির সঙ্গে আমরা খুব ভালোভাবেই পরিচিত। আমলার চাকরি এখন বাংলাদেশে অতি লোভনীয় এক চাকরি। প্রজাতন্ত্র বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শ্রেণির কর্মচারী আমলারা। রাষ্ট্রের নীতি, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা তারাই বাস্তবায়ন করেন। 

আমলাতন্ত্র আছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের পর রাষ্ট্রপরিচালনার কাজকর্মের হিসাব রাখতে শুরু করেন শাসকেরা। আর সেসব নথি সংরক্ষণের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় একদল অক্ষরজীবীকে। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন সুমেরীয় শাসকেরা অক্ষরজীবী করণিক গোষ্ঠী রাখতেন শস্য ও পারিতোষিকের হিসাবপত্র রাখার জন্য। 

শক্তিশালী আমলাতন্ত্র ছিল প্রাচীন মিসরে প্রতাপশালী ফারাওদের আমলেও। আমলাদের মাধ্যমে ফারাওরা প্রজাদের কাছে জমি ইজারা দিতেন, ব্যবসা করার অনুমতিপত্র দিতেন, খাজনা আদায় করতেন। আমলারা ছিল রোমান সাম্রাজ্যেও। রোমান শাসকেরা মাঠপর্যায়ে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আমলা রাখতেন। 

এশিয়ায় আমলাতন্ত্র শুরু হয় চীনে। পরীক্ষার মাধ্যমেও আমলা নিয়োগ শুরু হয় চীনের হান রাজবংশের যুগেও। 

আর ভারতবর্ষে আমলাতন্ত্রের শুরু বলা যায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমল থেকে। এরপর ভারতবর্ষে আমলাতন্ত্র শিখরে পৌঁছায় ব্রিটিশ আমলে। ওয়ারেন হেস্টিংস তার শাসনকালে আমলাতন্ত্রের ওপরের স্তরের পদে নিয়োগ দেন শ্বেতাঙ্গদের। আর নিচের স্তরের পদগুলোতে স্থানীয়দের নিয়োগ দেন। তবে প্রশাসনে স্থানীয়দের সংখ্যা বাড়ান লর্ড বেন্টিঙ্ক। 

ভারতবর্ষে আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা শুরু হয় ১৯২২ সালে, এলাহাবাদ ও লন্ডনে একসঙ্গে। প্রথম ভারতীয় আইসিএস অফিসার ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

এরপর থেকে কালের পরিক্রমায় উপমহাদেশে শক্তিশালী শ্রেণি হয়ে ওঠেন আমলারা। অনেকের মতেই আমলারা হলেন 'পর্দার পেছনের নায়ক'। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র অপরিহার্য। যদিও তাদের নিয়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দায়িত্ব পালনে বিলম্বসহ অনেক অভিযোগ আছে অনেকের। অনেকের অভিযোগ, ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতাদের সামনে সারাক্ষণই 'জি হুজুর' করতে থাকেন আমলারা।

সম্প্রতি নিজের স্মৃতিচারণামূলক বই 'পলিসিমেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি'-এ ভারতের আমলাদের কিছু কাজকর্ম, প্রথা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। 

বিশেষভাবে চিহ্নিত তোয়ালে, উচ্চতা কমানো-বাড়ানো যায় এমন চেয়ার, অনুমতির বহর, মিনিটে ১৬ বার 'স্যার' বলা এবং সময়ানুবর্তিতা বাড়ানোর নিরন্তর প্রয়াস—তিন বছরের গবেষণায় ভারতের আমলাতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করেছেন এই শীর্ষস্থানীয় একাডেমিক ও ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।

লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস থেকে পিএইচডি শেষ করে কৌশিক বসু এখন আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অধ্যাপনা করছেন। মাঝে তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

এর আগে ২০০৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন কৌশিক বসু। ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালেই তিনি ভারতীয় আমলাতন্ত্রের নানা প্রথার সঙ্গে পরিচিত হন।

সদ্য প্রকাশিত স্মৃতিকথায় কৌশিক বসু ভারতের বিশাল আমলাতন্ত্র কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কে অনেক মজাদার স্মৃতিচারণা করেছেন। সেসবের কিছু তুলে ধরা হলো এ লেখায়।

জি স্যার!

ভারতের আমলা মহলে 'স্যার' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত। সরকারি কর্মকর্তারা এই ডাকটি শুনতে যেমন ভালোবাসেন, তেমনি ভালোবাসেন বলতেও। তাই তো অধস্তন কর্মকর্তারা আকছারই ঊর্ধ্বতনদের স্যার ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে যান। 

এই ব্যাপারটি কৌতূহল জাগায় কৌশিক বসুর। কাজেই এক সরকারি বৈঠকের সময় 'স্যার' শব্দটি কতবার বলা হবে, তা গুনে রাখার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

ওই সভায় একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ওই সভায় প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬ বার 'স্যার' শব্দটি উচ্চারণ করেন।

কৌশিক বসু হিসাব কষে দেখেছেন, একবার স্যার শব্দটি উচ্চারণ করতে যদি আধসেকেন্ড লাগে, তাহলে ভারতের আমলাদের মোট কর্মঘণ্টার ১৩ শতাংশ সময়ই খরচ হয় 'স্যার' বলতে বলতে।

সবকিছুতেই অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা

কৌশিক বসু দেখেছেন, ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজের জন্যও অনুমতি নিতে হয়।

কোনো অনুমতির আবেদন ধাপে ধাপে সরকারের নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, অতি তুচ্ছ অনেক ব্যাপারও উচ্চ পর্যায়ে, মূলত মন্ত্রীর কাছে যায় অনুমোদনের জন্য।

ভারতের সরকারি দপ্তরে—অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যাওয়ার জন্য একদিন ছুটি নেওয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ে পরিবেশন করা কফির ব্র্যান্ড বদলানো, এমনকি বাথরুমের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বদলানো পর্যন্ত—প্রায় সব কাজের জন্য আক্ষরিক অর্থেই অনুমতির আবেদন করতে হয়।

এ রকম অনুমতির আবেদন শক্ত কার্ডবোর্ডের ফোল্ডারে এক কর্মকর্তার ঘর থেকে অন্য কর্মকর্তার ঘরে চক্কর কাটে অনুমোদনের আশায়।

দরজায় নক নিষেধ!

ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোতে সব কাজে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কেউ কারও কক্ষে প্রবেশের সময় অনুমতির তোয়াক্কা করেন না।

কৌশিক বসু তার পর্যবেক্ষণে দেখেছেন, ভারতের সরকারি দপ্তরে দরজায় নক করা অভদ্রতা। 'হয় কোনো কর্মকর্তার অফিসে আপনার প্রবেশাধিকার আছে, অথবা নেই।'

যদি অধিকার থাকে, তাহলে সোজা ওই কর্মকর্তার অফিসে ঢুকে যাওয়াই নিয়ম।

কৌশিক বসু লিখেছেন, 'এই রীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমার কিছুটা সময় লেগেছে। কারণ, পশ্চিমে কারও রুমে প্রবেশের আগে নক করার রীতি কঠোরভাবে পালন করা হয়।'

এই নতুন রীতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তিনি ছোট একটা সমস্যায় পড়েছিলেন।

'ভারতের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে দরজাগুলো ফুলে উঠে জ্যাম হয়ে থাকে। কাজেই দরজা খোলার জন্য বেশ জোরে ধাক্কা দিতে হয়,' লিখেছেন তিনি।

কারও অফিসে ঢোকার সময় নক তো করা হয়ই না, উপরন্তু অনেকেই একেবারে আচমকা ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

দেরি করা বারণ

অর্থ মন্ত্রণালয়ে কৌশিক বসু দেখেছেন কাগজপত্র ও নথি রাখার প্রতিটি ফোল্ডারের ভেতর দুটি পৃষ্ঠা আছে। ওই পৃষ্ঠা দুটোতে বিভাগীয় প্রধান ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত ৪৪টি সাধারণ বাক্যাংশ পেয়েছেন তিনি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসবের মধ্যে অনেকগুলো বাক্যই সময়নিষ্ঠা মেনে চলা এবং বিলম্ব এড়ানোর উপদেশ। যেমন:

—দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ

—বিলম্ব অগ্রহণযোগ্য

—বিলম্ব এড়ানো আবশ্যক

—বিলম্ব করলে ব্যাখ্যা প্রদান বাধ্যতামূলক

—আজই/অতিসত্বর/অবিলম্বে উত্তর দিন

—আজই ইস্যু করুন

কৌশিক বসু লিখেছেন, 'এমন সব অনুরোধের পরও ভারতে সময়ানুবর্তিতা মেনে চলা হয় না।'

এই মন্তব্যের পরপরই তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে ১০-১৫ বছর আগের চেয়ে ভারত এখন অনেক বেশি সময়ানুবর্তী দেশ।

সঠিক চেয়ারে বসেছেন তো?

সরকারি সভায় পদমর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৌশিক বসু লক্ষ করেছেন, চেয়ারের উচ্চতা পদমর্যাদার জেল্লা বাড়াতে পারে।

সরকারি সভাগুলোতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বসার চেয়ার অন্যদের তুলনায় কিছুটা উঁচু হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু চেয়ারে বসে অন্যদের দিকে চোখ নিচু করে তাকাতে পারলে সভাগুলোতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। এতে সহজেই বাকিদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, প্রভাব ফেলা যায় অন্যদের মনে।

এই সুবিধা হাসিলের একটি সহজ কৌশল খুঁজে বের করেছিলেন কৌশিক বসু।

ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোর বেশির ভাগ চেয়ারের ডান হাতলের নিচে একটা ছোট্ট লিভার থাকে। সবার অজান্তে আস্তে করে ওই লিভার ঘুরিয়ে চেয়ারের উচ্চতা বাড়িয়ে নেওয়া যায়। সভা চলাকালে সবার অগোচরে ওই লিভার টেনে চেয়ারের উচ্চতা বাড়িয়ে নিতেন কৌশিক বসু।

তবে মুশকিল হচ্ছে, সভায় অংশ নেওয়া সবাই-ই যদি এই কৌশল খাটায়, তবে কেউই উপকার পাবে না।

তোয়ালেরও শ্রেণিবিন্যাস

ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের বসার চেয়ারে পিঠের নিচে তোয়ালের রাখার প্রচলন চলে আসছে উপনিবেশকাল থেকেই। তবে কৌশিক বসু ঝামেলায় পড়েছিলেন বাথরুমে ব্যবহারের তোয়ালে নিয়ে।

ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় ভবনের নিচতলায় ছিল ঊর্ধ্বতন আমলাদের ব্যবহারের জন্য একটি বাথরুম। ওই বাথরুম ব্যবহার করতেন দেশটির অর্থ, রাজস্ব ও ব্যয়বিষয়ক সচিব। ওই বাথরুমে তিনটি তোয়ালের তাক আছে। প্রতিটি তাকে পরিষ্কার, পরিপাটি তোয়ালে রাখা থাকে। তাক তিনটিতে যথাক্রমে লেখা থাকত—অর্থ সচিব, রাজস্ব সচিব এবং ব্যয় সচিব। অর্থাৎ এই তিন পদমর্যাদার ব্যক্তির জন্যই কেবল বাথরুমটি নির্দিষ্ট।

কৌশিক বসু অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার পর তার অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রথম ঝগড়া বাধে মন্ত্রণালয়ের ওই বড়, সুসজ্জিত বাথরুমে কৌশিক বসুর প্রবেশাধিকার নিয়েই। কারণ, এই বাথরুম অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারতেন না। করলে ওই ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তার দর্প ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। তাই বাথরুমটিতে কৌশিক বসুকে প্রবেশ করতে দিতে নারাজ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা।

কিন্তু কৌশিক বসুর কর্মচারীরাও নাছোড়। তাদের দাবি, ওই বাথরুম ব্যবহারের অধিকার কৌশিক বসুর আছে।

কৌশিক বসু লিখেছেন, 'তাদের অহমে ঘা লেগেছিল।' ওই বাথরুমে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে তিনি রাজি ছিলেন না।

কিন্তু তার কর্মচারীরা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোর 'লড়াই' চালিয়ে যায়। অবশেষে 'অভিজাত বাথরুমে' প্রবেশাধিকার পান কৌশিক বসু। সিইএ (চিফ ইকোনমিক অ্যাডভাইজার) লেখা চতুর্থ একটি তোয়ালের তাক তৈরি হয় তার জন্য।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসার সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ৬৩তম।

ভারতের সরকারি কাজকর্মের বড় একটি অংশই আটকা পড়ে থাকে নানা রীতিনীতি ও লাল ফিতার ঘেরাটোপে।

কৌশিক বসুর মতে, আমলাতন্ত্রের এই দীর্ঘসূত্রতাকে ঔপনিবেশিক খোঁয়ারি (কলোনিয়াল হ্যাংওভার) বলা চলে। আমলারা এভাবে কাজ আটকে রেখে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন।

পাঠক, এই অবস্থার খুব একটা হেরফের এদেশেও হয় না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা এগিইে থাকব হয়তো। স্যার আমরা কতবার বলি!

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.