ঢাকার বজরা—চার শতকের কথকতা

ইজেল

14 May, 2022, 06:50 pm
Last modified: 14 May, 2022, 06:55 pm
বাংলা অঞ্চলে নানারকম নৌকা তৈরির চল বহু পুরোনো। বারো ভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানের সাথে ইসলাম খানের যুদ্ধে মুসা খানের বহরে ৭০০ নৌকার উল্লেখ পাওয়া যায়, যার মাঝে ছিল কুশা, জালিয়া, ধুরা, সুন্দর, বজরা, খেলনা নামের নানাধরনের নৌকা। মুঘল আমলে স্থলপথের যুদ্ধে ঘোড়া, হাতির ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও অসংখ্য নদীনালা, জলাবেষ্টিত বাংলায় শক্তিশালী নৌবহরের কোনো বিকল্প ছিল না। সেকারণে ইসলাম খান আগমন-পরবর্তীকালে বুড়িগঙ্গার তীরজুড়ে নৌশিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে। কথিত আছে, ঢাকায় তৈরি দুটি রাজকীয় নৌকা উপহার পেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।

ছবি: ‘প্যানোরামা অব ঢাকা’ অ্যালবামের ছবিতে বুড়িগঙ্গার তীরে জড়ো করা কাঠ, পেছনে লালবাগ দুর্গ, ১৮৪০

'চাঁদনী' থেকে চাঁদনীঘাট

সতেরো শতকের শুরুর কথা। সম্রাট আকবরের শাসনকালে যে শহর ছিল মুঘলদের একটি সাধারণ সামরিক ফাঁড়ি, ইসলাম খানের আগমনে সে শহর হয়ে উঠল সকল সামরিক কর্মকাণ্ডের সদর দপ্তর। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রাজমহল থেকে বদলি করা হলো ঢাকায়, এ শহর হয়ে উঠল সুবা বাংলার রাজধানী। ১৬০৮ সালে রাজমহল ত্যাগ করে ইসলাম খান যখন রওনা হন, তখন প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল বংশী নদীর তীরে রাজধানী স্থাপনের। কিন্তু নিচু এলাকা বিধায় তিনি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। নৌবহর ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার ভাটির দিকে চলতে শুরু করে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। লেখক এফ বি ব্রাডলি বার্ট ঢাকায় ইসলাম খানের পদার্পণের এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর 'Romance of an Eastern Capital' বইয়ে, 'তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন এই স্থানটি দেখে। তিনি বুঝতে পারলেন যে সামরিক দিক দিয়ে এটি হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাছাড়া দূরবিস্তৃত উচ্চভূমি থাকায় এখানে যথেষ্ট সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনি সাথে সাথেই এখানে রাজধানী স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।'

শহর বিস্তার লাভ করল বুড়িগঙ্গার তীর ধরে, পশ্চিমে চকবাজার থেকে পূর্বে সদরঘাট পর্যন্ত। বুড়িগঙ্গা থেকে লক্ষ্যা নদীতে দ্রুততম সময়ে নৌবহর আর সেনা পাঠানোর সুবিধার্থে খনন করা হলো খাল। শহরের পূর্ব সীমানায় সুবাদারের বসবাসের জন্য তৈরি হলো বাগানঘেরা রাজকীয় বাসস্থান, পুরান ঢাকার কারাগারের জায়গায় তৈরি হলো মজবুত দুর্গ। ইসলাম খানের সংক্ষিপ্ত সুবাদারির কালে গোটা বাংলায় যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই রইল। সুবার পরিচালনা, যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণ এসব নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাবার পর দিন শেষে ইসলাম খানের নির্ভার হওয়ার ঠিকানা হয়ে উঠল তাঁর নিজস্ব এক বজরা, নাম 'চাঁদনী'। আর যে ঘাটে সেই রাজকীয় বজরা বাঁধা থাকল, তার নাম হয়ে গেল চাঁদনীঘাট। 'চাঁদনী'র সম্মুখে মাহি-মারাতিবের নকশা কাঁটা, ছাউনিজুড়ে সোনার কারুকাজ, মাস্তুলে পত পত করে ওড়ে সিংহ আর সূর্য আঁকা মুঘল পতাকা। চাঁদনীঘাটের ১২ মাইলের ভেতরে মুঘল নৌবহর ছাড়া কোনো সাধারণ নৌকার তীরে ভেড়ার অনুমতি নেই। বুড়িগঙ্গা তখন সুপ্রশস্ত। সন্ধ্যায় 'চাঁদনী'কে ঘিরে থাকা আলোকমালা নগরবাসীর চোখ জুড়ায়। প্রশস্ত জানালা দিয়ে ইসলাম খান বুড়িগঙ্গার অবারিত জলরাশির রূপ উপভোগ করেন, নিজস্ব সময় কাটান। 

ভিনদেশি ভ্রমণকথায় 

'চাঁদনী' নামের বজরাটি কোথায় তৈরি হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে বাংলা অঞ্চলে নানারকম নৌকা তৈরির চল বহু পুরোনো। বারো ভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানের সাথে ইসলাম খানের যুদ্ধে মুসা খানের বহরে ৭০০ নৌকার উল্লেখ পাওয়া যায়, যার মাঝে ছিল কুশা, জালিয়া, ধুরা, সুন্দর, বজরা, খেলনা নামের নানাধরনের নৌকা। মুঘল আমলে স্থলপথের যুদ্ধে ঘোড়া, হাতির ব্যাপক ব্যবহার থাকলেও অসংখ্য নদীনালা, জলাবেষ্টিত বাংলায় শক্তিশালী নৌবহরের কোনো বিকল্প ছিল না। সেকারণে ইসলাম খান আগমন-পরবর্তীকালে বুড়িগঙ্গার তীরজুড়ে নৌশিল্প ব্যাপক প্রসার লাভ করে। কথিত আছে, ঢাকায় তৈরি দুটি রাজকীয় নৌকা উপহার পেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। নৌকা নির্মাণে প্রশিক্ষণের জন্য সুবাদার মীর জুমলা ৫০০ টাকা মাইনেতে টমাস প্লাটা নামের এক ইংরেজকে নিয়োগ করেছিলেন। প্লাটার কাজ ছিল নৌযুদ্ধে উপযোগী নৌকা ও গোলা তৈরিতে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দেওয়া। ফরাসি পর্যটক তাভের্নিয়ের যখন ঢাকায় আসেন, তখন চলছে শায়েস্তা খানের সুবেদারি। মগ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য ঢাকার নৌশক্তি তখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। ৪৩ হাজার সৈন্যের বিপুল নৌবাহিনীর সাথে তখন বুড়িগঙ্গায় ভাসছে ৩০০ রণতরী। পাগলা পুল ফেলে ঢাকার দিকে আসবার কালে বুড়িগঙ্গার তীরে অনেক মাটির কুঁড়েঘর দেখতে পান তাভের্নিয়ের। এগুলো ছিল নৌকার কারিগর ছুতার মিস্ত্রীদের আবাস। ১৬৮২ সালে ঢাকা এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর উইলিয়াম হেজেস। হেজেসের বর্ণনা তাভের্নিয়ের তুলনায় বিস্তারিত। শায়েস্তা খানের শত শত রণতরীর সাথে শাহি বজরার উপস্থিতি হেজেসের নজর এড়ায়নি। হুগলী থেকে ঢাকা আসবার সময় অবশ্য তিনি বজরায় চেপেই এসেছিলেন। বাংলার বিস্তীর্ণ প্লাবিত অঞ্চলে আয়েশি চলাচলের জন্য বজরা ছিল অপরিহার্য। 

ছবি: উইলিয়াম প্রিন্সেপের ড্রয়িংএ বিভিন্ন প্রকারের বজরা ও দেশি নৌকা

তাভের্নিয়ের ঢাকায় নৌকা নির্মাণের যে বিবরণ লিখে গেছেন, তার প্রায় দুই শ বছর পরেও ঢাকার নৌশিল্প একইভাবে অটুট ছিল। ইংরেজ প্রকৌশলী কর্নেল ডেভিডসনের লেখায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ঢাকা এসেছিলেন ১৮৪০সালের জানুয়ারি মাসে। ডেভিডসন দেখতে পান, বুড়িগঙ্গার তীরে নৌকা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রচুর কাঠ ফেলে রাখা হয়েছে। ততদিনে অবশ্য বদলে গেছে নির্মিত নৌকার ধরন। মুঘল আমল সমাপ্তির সাথে বিদায় নিয়েছে রণতরি নির্মাণের শিল্প। ঔপনিবেশিক শাসনে ব্যাপক রপ্তানির প্রয়োজনে নৌকার কারিগরেরা তখন ঝুঁকেছে বিশালাকার মালবাহী নৌকা নির্মাণে। পাশাপাশি ইংরেজ সিভিলিয়ানদের সহজ চলাচলের প্রয়োজনে তৈরি হচ্ছে একের পর এক বিলাসী বজরা। ইংরেজ হাউজবোটের আদলে তৈরি হলেও এসব বজরায় যুক্ত হয় নানা দেশীয় অলংকরণ। বজরার খোল ছিল শাল বা সেগুন কাঠের তৈরি, প্রশস্ত। বেশ ভারী হলেও তলা চ্যাপ্টা হওয়ায় অগভীর জলে চলাচল করতে পারত। ভেতরে সাধারণত দুটি কক্ষ থাকত। পৃথক রান্নাঘর আর শৌচাগারের ব্যবস্থাও থাকত। ভারী এই নৌকা টানবার জন্য প্রয়োজন হতো কমপক্ষে ছয়জন কর্মী। স্টিমার আসবার পর কখনো কখনো একে টেনে নিয়ে চলত স্টিমার। ডেভিডসন নিজেও কলকাতা ফেরার পথে ভাড়া করেন বিশাল এক ঢাকাই বজরা এবং দুটি পুলওয়ার। 

ছবি: উইলিয়াম প্রিন্সেপের ড্রয়িংএ বিভিন্ন প্রকারের বজরা ও দেশি নৌকা

এ সময়ে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় 'প্যানোরামা অব ঢাকা' নামের অজানা শিল্পীর তুলিতে নদীতীরের ঢাকার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপনার জলরঙে আঁকা ছবি। ডেভিডসনের বর্ণনার সাথে এ ছবিগুলো একেবারেই মিলে যায়। বুড়িগঙ্গায় ভাসমান নানা ধরনের নৌকার পাশাপাশি ছবিগুলোতে ইংরেজ পতাকাবাহী বজরারও দেখা মেলে। 

ঢাকায় তৈরি বজরার ক্রেতা তালিকায় ইংরেজদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য এক সংযুক্তি হলো দেশীয় নব্য ধনী আর জমিদার শ্রেণি। এদের অনেকেরই জমিদারি ছিল নদীনালা, খালবিলে ঘেরা পূর্ব বাংলায়। রেলগাড়ি তখনো এ দেশে এসে পৌঁছায়নি, তাই নৌকা ছাড়া এসব জমিদারি তদারকি ছিল প্রায় অসম্ভব। তবে শুধু নৌকা হলেই তো চলবে না। জমিদারের দরকার বিলাসী আয়োজন! দূরের যাত্রায় বজরার চেয়ে আরামদায়ক আর কিছু হতে পারে না। জাকজমকপূর্ণ বজরা তৈরির জন্য তখন ঢাকা সবার প্রথম পছন্দ। বিলাসব্যসনে মত্ত জমিদারেরা কে কার থেকে বড় আর আয়েশি বজরা তৈরি করাতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বাহারি সেসব বজরা নিয়ে জমিদারেরা রীতিমতো গর্ব বোধ করতেন। তাঁদেরই একজন কলকাতার জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। 

'পদ্মা'—রবীন্দ্রনাথের ঢাকাই বজরা

দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্যবসায়িক অবস্থা তখন রমরমা। পৈত্রিক সূত্রে বিরাহিমপুর পরগনার জমিদারি তো আগেই ছিল। এরপর বিভিন্ন কোম্পানিতে অংশীদারত্ব আর দেওয়ানির সুযোগে নিজ ব্যাংক, কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি আর স্টিমার কোম্পানিও চালু করলেন। লাভের টাকায় তখন কিনতে থাকলেন রাজশাহীর কালিগ্রাম, পাবনার শাহজাদপুরের মতো একের পর এক জমিদারি। মুশকিল হলো, নতুন এসব জমিদারি পড়েছে জলঘেরা পূর্ব বাংলায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে এবার ঢাকাই কারিগর দিয়ে তৈরি করাবেন তাঁর রাজকীয় বজরা। সাধের বজরাকে তিনি চাহিদা মোতাবেক সাজিয়ে নিলেন। বজরার ভেতরেই দুটি বড় বড় কক্ষ, তা ছাড়া খাবার ঘর, আরও দুটা ছোট ছোট কক্ষ। ঢাকা থেকে তৈরি হয়ে বজরা চলল কলকাতার পথে। হুগলি নদীর ধারে বাঁধা থাকল সেই ঢাকাই বজরা। তবে দ্বারকানাথ ঠাকুর এই বজরা বেশিদিন ব্যবহার করতে পারলেন না। ১৮৪৬ সালে বিলাতে পরলোকগমন করলেন দ্বারকানাথ। পিতার মৃত্যসংবাদ যখন পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এসে পৌঁছাল, তখন তিনি পিতার নির্মিত সেই বজরায় তিন পুত্র নিয়ে গঙ্গায় বেড়াতে বেরিয়েছেন। এই বজরা ছিল মহর্ষির অতিপ্রিয়। এতে চেপে একবার বেনারসও চলে গিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষভাগে পূর্ব বাংলার এসব জমিদারির দায়িত্ব বর্তালো মহর্ষির ছোট ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই নদীময় বাংলার পরগনাগুলোয় ভ্রমণের জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে বজরাটির মালিক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া সব উপহারের মধ্যে এই বজরা হয়ে উঠল সবচেয়ে মূল্যবান। কবির মনে বজরাটি বিশেষ জায়গা অধিকার করে নিল। শিলাইদহের পদ্মায় ভাসিয়ে দিয়ে কবি এর নাম দিলেন 'পদ্মা'।

ছবি: উনিশ শতকের ড্রয়িং এ বুড়িগঙ্গার বুকে ঢাকার বজরা, পেছনে বড় কাটরা দৃশ্যমান, উৎস- ‘প্যানোরামা অব ঢাকা’, ১৮৪০।

জন্মের কয়েক দশক আগে তৈরি 'পদ্মা' বোটটি রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দিল আবহমান বাংলার গভীরে। বছরের পর বছর 'পদ্মা'য় চেপে তিনি দেখে ফিরলেন বাংলার রূপ, পল্লিজীবন। চোখের দেখার সাথে মেশালেন নিজ কল্পনা। কবি রচিত ছিন্নপত্রের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে স্থায়িত্ব পেল ঢাকাই বজরা 'পদ্মা'। জমিদারি দেখাশোনা তো ছিলই, কিন্তু যৌবনে লেখালেখির জন্য কাক্সিক্ষত নির্জনতার সুযোগ তৈরি করে দিল 'পদ্মা'। কখনো কখনো পরিবার নিয়েও বেরিয়ে পড়লেন কবি। কবির পুত্র-কন্যার স্মৃতিকথায় তাই বারবার এসেছে এই বজরার কথা। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'হাউজবোটে ঢুকে গেলেই সবকিছু বাড়ির মতো। এর ভিতরকার চমৎকার কারুকাজ আর পারিবারিক পরিবেশে আমি স্বস্তিবোধ করতাম—হাউজবোট পদ্মা বাবার যথেষ্ট কাজে লেগেছে। পৃথিবী যখন তাঁর শান্তি কেড়ে নিয়েছে, তখন তাঁকে আশ্রয় ও শান্তি দিয়েছে।' ছোট মেয়ে মীরার চোখে: 'একসময় বাবা শিলাইদহে পদ্মার চরে আমাদের নিয়ে "পদ্মা" নামে বজরায় ছিলেন। তখন আচার্য জগদীশচন্দ্র ও নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় প্রায়ই শিলাইদহ যেতেন। তাঁরা পদ্মার ওপর বোটে থাকতে খুব ভালবাসতেন। আমাদের দুটি বজরা ছিল, তাই তাঁরা গেলে কোনো অসুবিধা হতো না। একটি বোটের নাম আগেই উল্লেখ করেছি, 
অপরটির নাম ছিল "আত্রাই"। আমাদের আর একটি পরগনাতে আত্রাই নদী ছিল, তার থেকে "আত্রাই" নামকরণ হয়েছিল।'

সারাদিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলত লেখালেখি, দুই কূল ভেঙে এগিয়ে যেত পদ্মা, জেগে উঠত চর, কচি সবুজ রবিশস্য উঁকি দিত, সেই শস্যখেতে খেলে যেত মেঘ, রৌদ্র-ছায়া, আসত বর্ষা, বছর ঘুরে বসন্ত। এসবকিছু জুগিয়ে যেত তাঁর লেখার রসদ। সন্ধ্যা নেমে এলে তিনি গিয়ে বসতেন বজরার ডেকে। অবারিত আকাশের নিচে কবিকণ্ঠে তখন মিলিয়ে যেত—'তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা।' উনিশ শতকের শেষভাগে 'পদ্মা' রবীন্দ্রনাথকে যে তৃপ্তি দিয়েছিল, তা তিনি কখনো ভোলেননি। বহু বছর পর ১৯২৬ সালে ঢাকা এসেও অল্প কদিনের অবস্থানের জন্য তাই বেছে নিয়েছিলেন ঢাকার নবাবদের বজরা 'তুরাগ'কে। 

নওয়াববাড়ির বজরা

অন্যান্য অবস্থাপন্ন জমিদারের মতো ঢাকার নওয়াব পরিবারও জমিদারি পরিচালনা এবং বিনোদনের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু বজরা নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৯৫ সালে তৈরি এক সম্পদের তালিকায় জাহাজ, ফ্লিট, কলের নৌকা ইত্যাদির মূল্যসংবলিত উপস্থিতি দেখা যায়। বজরায় চেপে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীপথে সাভারের সাদুল্লাপুরের বাইগুনবাড়িতে শিকারের উদ্দেশ্যে যাওয়ার বহু বিবরণ নওয়াব আহসানউল্লাহর ডায়েরিতে পাওয়া যায়। তুরাগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি খাল বাইগুনবাড়ির পাশ দিয়ে চলে যেত। সেই খাল ধরে পরিবারের সদস্য কিংবা ইংরেজ সঙ্গীসাথিদের নিয়ে শিকারে যাওয়া ছিল নওয়াবের জন্য নিয়মিত বিষয়। ইংরেজ অতিথিদের আপ্যায়নেও বজরার উপস্থিতি লক্ষণীয়। ১৮৮৮ সালের নভেম্বরে লেডি ডাফরিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পৌঁছান বজরায় চেপে। তাঁর বজরাটিকে নওয়াববাড়ির ঘাট পর্যন্ত টেনে এনেছিল এক স্টিমার। 

নওয়াব আহসানউল্লাহর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল তাঁর এস্টেট বজরায়। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে তিনি ঢাকাবাসীর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা চালু করেন। এরপর থেকে তিনি আহসান মঞ্জিলের সামনের ঘাটে বাঁধা নিজস্ব বজরায় অবস্থান করছিলেন। 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকা থেকে: 'তিনি হৃষ্টচিত্তে আহসান মঞ্জিল প্রাসাদের সম্মুখস্থ নদীর ঘাটে স্বকীয় সুরম্যজলযানে অবস্থান করিতেছিলেন। সোমবার সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে নবাব সাহেব আহারাদি করিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। হঠাৎ বক্ষঃস্থলে কেমন এক প্রকার বেদনা অনুভব করেন। দেখিতে দেখিতে বিদ্যজ্যোতিঃ সম্পন্ন নবাবের নয়নযুগল চিরতরে নিমিলিত হইল। ঢাকার গৌরবরবি চিরতরে অস্তমিত হইল।'

ঢাকায় আগত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের রাজকীয় বজরায় আপ্যায়নের রেওয়াজ নওয়াব আহসানউল্লাহর মৃত্যুর পরেও অব্যাহত ছিল। এ তালিকায় আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু গুণী মানুষের নাম। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফরে রবীন্দ্রনাথের বিশ্রামের বন্দোবস্ত করা হয় ওয়াইজঘাটে বাঁধা 'তুরাগ' বোটে। তিনি ফিরে যান তাঁর 'পদ্মা' বোটের দিনগুলোতে, পূর্ব বাংলার জলরাশি আরও একবার তাঁকে মুগ্ধ করল। কবির ভাষায়, 'অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়েছিল জলমণ্ডলীর ওপর, আর আমার চোখে-মুখে। কি চমৎকার দেখাচ্ছিল নদীর ওপর দিয়ে সেই সূর্যাস্তের দৃশ্য!'

কবি নজরুলের জন্য নওয়াববাড়ির উদ্যোগে আয়োজন করা এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের কথা জানা যায় পারমিতা সেনের লেখা স্মৃতিকথা 'কবির মর্যাদা' থেকে। কবির ঢাকায় অবস্থানের খবর জানতে পেরে নওয়াব পরিবারের লোকেরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন বিশাল বজরায়। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও নজরুলের দেখা না পেয়ে তাঁরা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলেন। শেষমেশ কর্মচারীরা নজরুলের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। কবি নজরুলের দেখা মিলল বন্ধুদের এক আড্ডায়। আড্ডায় মশগুল কবি আমন্ত্রণের কথা একদম ভুলেই গিয়েছিলেন। তড়িঘড়ি করে আড্ডা ছেড়ে ভোজসভার পথ ধরলেন তিনি। 

বাকল্যান্ড বাঁধ, বজরা এবং অতঃপর

গত কয়েক শতক ধরে বুড়িগঙ্গার তীর ছিল বাসস্থান তৈরির জন্য ধনী, অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের প্রথম পছন্দ। বাকল্যান্ড বাঁধ তৈরির পর নদীতীরের আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়। নদীভাঙন ও বন্যা থেকে ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য বুড়িগঙ্গার উত্তর তীর ধরে বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছিলেন কমিশনার চার্লস টমাস বাকল্যান্ড। পরবর্তীকালে নওয়াব খাজা আব্দুল গনি, জমিদার রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাসের উদ্যোগে এর সম্প্রসারণ হয়। উনিশ শতকের শেষভাগে তোলা বেশ কিছু ছবিতে বুড়িগঙ্গার তীরের প্রাসাদোপম বাসস্থানের সাথে ব্যক্তিগত নৌকা বা বজরার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকার নওয়াব পরিবার ছাড়াও আর্মেনি জমিদার মানুক, নীলকর জেমস ওয়াইজ, প্রমুখের ব্যক্তিগত বজরা বাঁধা থাকত নিজ নিজ বাড়ির ঘাটে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটে উচ্চবিত্তদের জন্য বিলাসবহুল বজরা বা গ্রিনবোট নির্মাণকে ঢাকার একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গেজেটের দেওয়া তথ্যমতে, এ সময়ে একটি বজরা তৈরিতে আনুমানিক ব্যয় হতো সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিশ শতকের প্রথমভাগে বজরা নির্মাণের ধারা অব্যাহত থাকে। বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, জমিদার রূপলাল দাস, ভাওয়ালের রাজা প্রমুখের ব্যক্তিগত বজরার পাশাপাশি 
দানবীর রনদাপ্রসাদ সাহার 'মির্জাপুর' নামের বজরাগুলো সে সময়ে বুড়িগঙ্গার শোভাবর্ধন করত। বজরা কিংবা নৌকায় চেপে বাইগুনবাড়িতে বনভোজনের উদ্দেশ্যে যাওয়া ছিল ঢাকাবাসীর অন্যতম বিনোদন। উৎসবের দিনগুলোতে ঘাট ছেড়ে বজরাগুলো নদীতে ঘুরে বেড়াত। রঙিন পতাকা আর আলোকমালায় সাজান বজরা থেকে ভেসে আসত গানের সুর, নুপুরের ধ্বনি।

গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার গুমোট স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় নগরবাসীর একমাত্র বৈকালিক গন্তব্য তখন বাকল্যান্ড বাঁধ। নদীতীরের শীতল হাওয়ার স্বাদ নিতে তখন ঢাকার লোকেরা সপরিবার ছুটে আসতেন এই বাঁধে। বাকল্যান্ড বাঁধের একপাশে পার্ক (করোনেশন পার্ক, লেডিস পার্ক), বসবার বেঞ্চ—এসবের ব্যবস্থা করা ছিল। করোনেশন পার্ক থেকে নওয়াববাড়ির ফটক পর্যন্ত অনেকে সান্ধ্যভ্রমণ করতেন। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর সদ্য কৈশোর পেরোনো দিনগুলোর কথা মনে করে স্মৃতিমেদুর হয়েছেন—'সদরঘাট পিছনে ফেলে, আমরা যাই অল্প ভিড়ের ওয়াইজ ঘাটে সূর্যাস্তের সময়—বিখ্যাত আবেদ কোম্পানির রুটি-বিস্কুটের গন্ধ ছড়িয়ে নদীর ধারে নির্জন প্রান্তে, যেখানে ছেয়ে গেছে আইভিলতার একটি পুরনো বাড়ি, ফটকে এক ইংরেজের নাম দেখা যায় কিন্তু ভেতরে কেউ থাকে ব'লে মনে হয় না। হঠাৎ কখনো যাই আরো দূরে, মেডিকেল স্কুলের পিছনে নির্জন আঙিনায়—নদীর ধারে ব'সে জলের সঙ্গে চাঁদের আলোর খেলা দেখি কিছুক্ষণ।'

এসময়ে নদীতীরের এক মনোগ্রাহী বর্ণনা পাওয়া যায় গৃহবধু শোভা ঘোষের লেখনিতে—'বুড়ীগঙ্গাকে যখনই যেভাবে দেখিয়াছি, মুগ্ধ হইয়া গিয়াছি। নদীর পারটি বহুদূর পর্যন্ত্য বাঁধান ছিল, ইহার নাম ছিল "ইঁপশ-খধহফ"। বিদেশে এমন নদীর পারকে নাকি চৎড়সবহধফব বলে। এই বাঁধান পার এত প্রশস্ত ছিল যে প্রায় কুড়িজন লোক পাশাপাশি হাঁটিয়া বেড়াইতে পারিত। এই ইঁহফ এর একপাশে নদী কুলু কুলু স্বরে বহিয়া যাইতেছে, অন্য পাশে বড় বড় প্রাসাদ। নদীর দিকে চোখ ফিরাইলে দেখা যায়, একটার পর একটা পানসী বা পিনীস নৌকা পারের ধার ঘেঁসিয়া সাজান রহিয়াছে। নৌকাগুলি যেন এক একটা সেই ছেলেবেলার রূপকথার 'ময়ূরপঙ্খী নাও' মুখের দিকটা ময়ূরের আকৃতি। দুই পাশে অনেকগুলি জানালা। ভিতরে একখানি বড় থাকিবার ঘর, একখানি ছোট ঘর, তাহার পার্শ্বে একটা ছোট রান্নাঘর; তাহার পাশে একটা ছোট কুঠুরী—স্নান ইত্যাদি করিবার জন্য। নৌকার বাহিরটা সবুজে, নীলে, হলদে, সাদায় এমন সুন্দর রঙ করা, মনে হয় যেন ইহার ভিতরে কেশবতী কোন রাজকন্যাকে দেখা অসম্ভব নয়। কত লোক এই সব নৌকা ভাড়া করিয়া মাসের পর মাস নদীর উপরে বাস করেন, স্বাস্থ্য ফিরাইবার জন্য।'

১৯৪৭ সালের পর বিলাসবহুল অনেক বজরার মালিকানায় পরিবর্তন আসে, কিছু বজরা পরিত্যক্ত হয়। ঢাকা তখন নতুন প্রাদেশিক রাজধানী। হঠাৎ প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্র হয়ে ওঠা এ শহরে তখন প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু লোকের সমাবেশ ঘটে। আবাসিক হোটেলের অভাব এখানে আগে থেকেই ছিল। উনিশ শতকের বিভিন্ন স্মৃতিকথায় প্রসঙ্গটি এসেছে, যেখানে হোটেলের অভাবে বহিরাগতদের নদীতীরে নৌকায় রাত কাটাবার কথা উল্লেখ আছে। দেশভাগের পর সে সংকট আরও প্রকট হলো। বেশ কিছু পরিত্যক্ত বজরা তাই আবাসিক হোটেলে রূপ নিল। যেমন ভাওয়াল রাজার বজরা হোটেলে বদলে গিয়ে নাম হলো 'নাজমা'। এ রকম আরও যেসব হোটেল বা বোর্ডিংয়ের নাম জানা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'উমা উজালা হিন্দু হোটেল', 'বুড়িগঙ্গা হিন্দু হোটেল', 'শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিং', 'ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিং' ইত্যাদি। এসব ভাসমান হোটেলের মুখরোচক খাবারের ব্যাপক সুনাম ছিল। এখানে থাকার জন্য কেবিনের ব্যবস্থা ছিল। তবে সময়ের সাথে খাবারের ব্যবস্থা লোপ পেয়েছে। ওয়াইজঘাটের অদূরে নোঙর করা ৫টি জীর্ণ, পুরোনো ভাসমান হোটেলে এখন আছে শুধু থাকার ব্যবস্থা। এখানে ঢালাই বিছানা পেতে মাত্র ৫০টাকাতে রাত কাটানো যায়। কালের বিবর্তনে বিত্তশালী লোকদের আভিজাত্যের প্রতীক বজরা হারিয়েছে তার গতি, বিলীন হয়েছে সব জৌলুশ; নিম্নবিত্তের রাত্রিযাপনের ঠিকানায় পরিণত হয়ে গুনছে অস্তিত্বের শেষ দিনগুলো। 


  • সহায়ক সূত্র:

১. Glimpses of Old Dhaka by Syed Muhammed Taifoor, 1956
২. আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ: রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবির চান্দ অনূদিত, আডর্ন পাবলিকেশন, ২০১৬
৩. নজরুল স্মৃতি, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, সাহিত্যম, কলকাতা, ১৯৭০
৪. আজও তারা পিছু ডাকে, শোভা ঘোষ, ১৯৮১
৫. Dacca: A record of its changing fortunes by A.H. Dani, 1962
৬. জীবন যখন ভাসমান হোটেলে, হোসাইন মোহাম্মদ জাকি, ২০১৪।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.