ঢাকার আশপাশ ও নদীর ঠগি

ইজেল

02 April, 2022, 02:30 pm
Last modified: 02 April, 2022, 03:08 pm
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকা এবং এর আশপাশে ঠগিদের উৎপাত চরমে উঠেছিল। এরা বিভিন্ন ছলছুতোয় নিরীহ বণিকদের পণ্যবাহী নৌকা ছিনতাই করে লুটপাট চালানোর পাশাপাশি নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিত।

 

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ঢাকা এবং এর আশপাশে ঠগিদের উৎপাত চরমে উঠেছিল। এরা বিভিন্ন ছলছুতোয় নিরীহ বণিকদের পণ্যবাহী নৌকা ছিনতাই করে লুটপাট চালানোর পাশাপাশি নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিত। এমনি একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ডব্লু এইচ স্লিম্যান নামের এক ইংরেজ কর্মকর্তা। তার সেই বর্ণনা আর এর পরপরই কয়েকটি ঘটনায় ধরা পড়া কয়েকজন ঠগির বিচারের সময় দেওয়া জবানবন্দির ঐতিহাসিক বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে:

মিস্টার স্লিম্যানের বয়ান

'গত জুলাই মাসে এক মুসলমান এবং এক হিন্দু ঢাকা থেকে একসাথে ফরিদপুরের পথে রওনা হলেও তারা গন্তব্যে পৌঁছায়নি। দুই জেলাতেই খোঁজখবর করা হয়েছে যদিও, কিন্তু কারো আর হদিস মেলেনি। ওদের কাছে নাকি ১৫ রুপি ছিল। একই নৌকায় তাদের সাথে আরও যাত্রী ছিল। সেপ্টেম্বরে ভোলানাথ চাঁন নামের এক লোককে আমার সামনে হাজির করা হয়। তার বক্তব্য মোতাবেক বছরের মাঘ মাসে সে এবং আরও কয়েকজন দুজন তামাক ব্যবসায়ীর সাথে যাত্রী বেশে রংপুরে গিয়েছিল। তারা ওই দুজনের গলায় গামছা জড়িয়ে দিয়ে হত্যা করে ওদের কাছ থেকে ৪০ রুপি ছিনিয়ে নিয়ে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তার মতে স্বরূপ চাঁন নামের তার এক আত্মীয় এই ঘটনার কথা আরও বেশি জানে।'

'স্বরূপকে তলব করা হয়, সে হাজির হয়ে জবানবন্দিতে ঢাকায় অন্য আরও পাঁচজনের সাথে একটা ডিঙিতে থাকার কথা বলে। ফরিদপুরে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে দুজন যাত্রীকে নৌকায় তোলে ওরা, তাদের একজন ছিল মুসলমান, অন্যজন হিন্দু। ঢাকা থেকে আন্দাজ দুই ঘণ্টা দূরের একটা চরের বালুতীরে নিয়ে ওদের গলায় গামছার ফাঁস দিয়ে খুন করে লাশ নদীতে ফেলে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায়। ওদের কাছে ১৫ রুপি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পায় ওরা। ওই দলের দুজন সাহস জোগাতে ব্রাহ্মণবেশী যাত্রী সেজে নৌকায় ছিল। পরে ওরা ওখানে দুটো নৌকা থাকার কথা জানায়, ডিঙি নৌকার সাথে পাঁচজন লোকসহ একটা পানশি।'

'পানশির লোকগুলো দুর্গাপূজার যাত্রীদের খোঁজে ঢাকায় আসা ফরিদপুরের কাছাকাছি ছিল। সবাইকেই পাকড়াও করা হয়। এরা প্রথমে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে স্ববিরোধী কথা বললেও পরে সব স্বীকার করে। দুজন ছিল অন্যান্য জিনিসসহ নিখোঁজ দুজন যাত্রীর নৌকার মাল্লা। তৃতীয়জন বাকিদের অনুরোধে মিথ্যা গল্প ফাঁদে। তার ভাই ঢাকার দলটিতে থাকলেও অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়িতে থেকে যায়, তার জায়গায় এসেছিল সে।'

'নৌকায় হিন্দু লোকটার বন্ধুর শনাক্ত করা ধুতি পাওয়া গেছে। এছাড়া মুসলমানের পোশাক এবং নিখোঁজ মুসলমানের বন্ধুর শনাক্ত করা এক টুকরো কাপড়ও ছিল। কিন্তু শেষজন নিশ্চিত করার মতো কাউকে হাজির করতে পারেনি। নৌকায় দুটো পৈতাও পাওয়া যায়, অথচ নৌকার সবাই চণ্ডাল ছিল।'

স্বীকারোক্তিতে উল্লেখিত লোকদের আটক করতে নাজির এবং মুহুরিকে পাঠানো হয়। আটক আরও দুজন জবানবন্দি দিয়েছে। একজন তার বাড়ি থেকে লুটের মালের অংশ উল্লেখ করে একটা লোটা হাজির করেছে। এসব জিনিস আগেই মৃতদের সাথে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিন থেকে চারজন সাক্ষী এগুলো শনাক্ত করে। ওদের সাথে জোটা নিখোঁজ ব্যক্তিদের একজনের ভাই ফরিদপুরের কাছে আটক করা পানশিতে চেপেই নিখোঁজ ব্যক্তিরা রওনা হওয়ার কথা জানায়। দুজন বন্দীই নৌকায় ছিল বলে নিজের বিশ্বাসের কথা বলেছে সে। ব্রাহ্মণ যাত্রীদের একজন, অন্যজন একজন মাল্লা।

প্রথম তথ্য জোগানদাতা স্বরূপকে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। অন্যদের বিরুদ্ধে তাকে সাক্ষী নিয়োগ করা হয়। তাদের ভেতর বিচারের জন্যে আটজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।

'স্বরূপের স্বীকারোক্তিতে এই ঘটনায় সারবুল দোম নামে একজনের কথা উল্লেখ করা হয়। সদরে নেওয়ার পর সে অপরাধ অস্বীকার করে। তবে আমার জেরার মুখে ঢাকার ঘটনা কথা জানার কথা অস্বীকার করলেও মে এবং জুন মাসে অন্য কয়েকজনের সাথে তিনটা নৌকায় যাওয়ার কথা স্বীকার করে। সেগুলোর একটা ছিল ডিঙি নৌকা। প্রথমে ময়মনসিংহে (ফরিদপুরের সীমান্ত-ঘেঁষা) কাপড় কেনার উসিলায় তারা দুজন তাঁতিকে নৌকায় তোলে। এরপর অল্প সময়ের জন্য তীরে নেমেছিল সে। ফিরে আসার পর কাপড় থাকলেও তাঁতিদের দেখেনি। দলের ভেতর কাপড় ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হয়। তাঁতিদের হত্যা করা হয়েছে বলেই ধরে নেয় সে। রংপুরে চলে গিয়েছিল ওরা। ফেরার পথে সিরাজগঞ্জগামী তামাক ও গাঁজাবোঝাই একটা নৌকার দেখা পায়। পাঁচজন ছিল ওই নৌকায়। এক-দুজন নৌকাটার সাথে লেগে থাকে ওরা। অবশেষে হরি নাম জপার উসিলায় তামাকবাহী নৌকার পাঁচজনকে ওদের সাথে গোল হয়ে বসতে রাজি করিয়ে গামছা গলায় বেঁধে খুন করে।

একজন কাজটা করার সময় অন্যজন তাদের হাত-পা চেপে ধরে পেটে চেপে বসেছিল। লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে দুটো নৌকাসহ সন্ধ্যা পর্যন্ত উজান বেয়েছে। তামাক আর গাঁজা নিজেদের নৌকায় চালান শেষে নিহত লোকদের নৌকা কুড়োল দিয়ে ফুটো করে ডুবিয়ে দেয়। ফিরে এসে তামাক এবং গাঁজা মানিকগঞ্জ জেলাতেই বিক্রি করে। এই জবানবন্দিতে অভিযুক্ত সবাইকে আটক করা হয়। তিনজন সারবুল দোমের জবানবন্দি অনুসারে তবে আরও স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তারা এ-ও বলেছে যে মাত্র দুটো নৌকা এবং সব মিলিয়ে লোক ছিল দশজন। জবানবন্দি পর্যালোচনায় একে সত্যি বলেই মনে হয়। এদের একজন প্রথম তথ্যদাতা ভোলানাথ। সে এবং কিষান মোহন নামে আরেকজন দুই তাঁতিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে দেখার কথা বলেছে। অন্য একজন রংপুর থেকে আনা গাঁজা এবং তামাক বিক্রির পক্ষে ছিল। দলের সর্দারদের একজন ছিল সে। প্রায় সবার বাড়িতেই তামাকের বস্তা পাওয়া গেছে।

তদন্তে দুজন তাঁতির উত্তরসূরির সন্ধান পাওয়া গেছে। ফরিদপুরের বাসিন্দা ওরা। ওদের ভাই ময়মনসিংহের এক জায়গায় কাপড় বিক্রি করতে গিয়ে আর ফেরেনি। ওদের নিখোঁজ হওয়ার সময় এবং যাওয়া-আসার জায়গার সাথে আসামিদের বিবৃতি মিলে যায়। ময়মনসিংহে কাপড় বিক্রি করতে না পারায় কাপড়সহ ফিরছিল ওরা। বন্দীদের কাছে পাওয়া বেশ কিছু সূক্ষ্ম কাপড়ের টুকরোয় মৃতদের ব্যবহৃত কাপড়ের মতোই চিহ্ন ছিল। কিন্তু নিশ্চিত করতে পারেনি তারা।

তামাকের নৌকার পাঁচজনের উত্তরাধিকারীও পাওয়া গেছে। ওদের চারজন মংমনসিংহের লোক। সিরাজগঞ্জের এক মহাজন বণিকের কাছে নৌকা এবং সেবা ভাড়া দিয়েছিল। লবণের চালান নিয়ে রংপুরে গিয়ে তামাক ও গাঁজা নিয়ে ফেরার সময় তারা খুন হয়।

পঞ্চমজন ওদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গোমস্তার পাঠানো লোক ছিল। রংপুর পুলিশের কাছে যথাসময়ে খবর পাঠানো হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জানান, তলায় দুটো ফুটোসহ সারবুল দোমের বর্ণনার অনুরূপ একটি নৌকা পাওয়া গেছে। নৌকাটা অবস্থানের সাথেও সারবুল দোমের বর্ণনা মেলে। নৌকা উদ্ধার করতে লোক পাঠানো হয়। রংপুরের গোমস্তাও গাঁজা ও তামাকের চালানের সত্যতা নিশ্চিত করে। বিক্রেতা বণিক মানিকগঞ্জে বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করে।

বন্দীদের ভেতর চারজনকে হিসাবের খাতায় যথাযথভাবে উল্লেখ করা বিক্রেতা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। মৃতদের আত্মীয় এবং বাকিদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হিসেবে গৃহীত অন্যরা নৌকা শনাক্ত করেছে। নৌকা মেরামত করা হলেও দুটো ফুটোর আদি আকার বোঝা যায়। দুজনকে অন্যদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়, দুজন তাঁতি এবং পাঁচজন তামাক ব্যবসায়ীর ঘাতক আটজন এবং তামাক গ্রহণ এবং বিক্রিতে সহায়তা করার অভিযোগে একজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। ঢাকার ঘটনায় স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানানো একজনের বাড়িতে পাওয়া একটা তামার বেলু (বাটি) ফরিদপুরের এক গোয়ালা ১৮৩৪ সালের জানুয়ারিতে তার ভাই এবং অন্য দুজন ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহে রওনা হওয়ার সময় তার কাছে থাকার কথা জানিয়েছে। এরপর ওটার কথা হদিস জানে না সে। নিয়মিতভাবে এটি হারানো জিনিসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে মালসামানের অন্য কোনো সাক্ষী এখনো পাওয়া যায়নি।'

ঘটনার এমনি স্পষ্ট এবং কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনা ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডব্লু এইচ মারটিনের লেখা বলেই অনুমান করছি। আমার কাছে এটি দাপ্তরিক আকারে বা তার নাম উল্লেখিত অবস্থায় সত্যায়িত না হলেও সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য দলিলের সাথে ছাপানোর সুপারিশ করছি।

এখানে মামলাসম্পর্কিত জি স্টকওয়েলের একটি চিঠি তুলে ধরা হলো।

ক্যাপ্টেন ডব্লুএইচ স্লিম্যান এবং অন্যদের উদ্দেশে,

প্রিয় মহোদয়,

সময় এবং স্থানিক দূরত্ব ঠগিদের প্রতি অতীতের আগ্রহ হ্রাসে কোনো প্রভাব রেখে থাকলে, যেটা সম্পর্কে আমি সচেতন নই, মাত্র বিচারাধীন থাকা একটা মামলা নতুন করে উৎসাহ জোগাবে। ঠগিদের কায়দা সম্পর্কে অত্যন্ত ওয়াকিবহাল এবং এদের কর্মকৌশল সম্পর্কে বিশদ পরিচিত আপনার কাছে বাংলায় একটি ব্যবস্থা হিসেবে এদের অস্তিত্ব থাকার কথা আদৌ নতুন হওয়ার নয়। আমার কাছে উপস্থাপিত মামলায় বয়ান করা কায়দায় প্রথম এদের অস্তিত্বের কথা জানার পর (সম্ভবত ১৮২৮ সাল) বেশ কয়েকবছর কেটে গেছে। বাংলায় এটাই রায় ঘোষণার প্রথম মামলা মনে করে ফরিদপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রট মিস্টার ডব্লু এইচ স্লিম্যানের কিছু বিবরণের অনুলিপি, বিচার প্রসঙ্গে দায়রা জজের চিঠির অনুলিপি এবং আমার বিবরণের আরেককটি অনুলিপি পাঠালাম। কেননা ফারসি দলিল থেকে পড়ার সময় তাড়াহুড়োয় তোলায় বাক্যগুলো মূলের মতো এই বিমূর্ত তর্জমায় অন্তর্মুখী বলে এগুলোর ক্ষেত্রে উদারতা আশা করি। একসাথে এসব দলিল একটি ঘটনা সম্পর্কে আপনার প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য জোগাবে।

আমার ইচ্ছা, আপনার অস্থায়ী দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করা হবে, ফলে নিটকস্থ দপ্তরের কর্মকর্তা নিঃসন্দেহে সঠিক নির্দেশনা পাবে। আমার ধারণা আরও তৎপরতার চমৎকার ভিত্তি তৈরি হয়েছে এবং অনুমোদনকারীদের ঠিকভাবে বোঝানো গেলে কার্যকরভাবে উপযোগী প্রমাণিত হতে পারে। সংক্ষেপে, প্রায়ই কঠিন বলে প্রমাণিত সমস্যায় কিছুটা অগ্রগতি লাভের মতো পথ পাওয়া গেছে। আপনার সহকারীদের এখন যেহেতু বাংলায় পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে, ধরে নিচ্ছি তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে সার্কিট কমিশনার মারফত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্দেশ পাঠানো হবে।

ভুলে যাওয়ার ভয় থেকে আমি এই মামলা-সংক্রান্ত দলিলপত্র হস্তান্তরের কথা বলেছি। সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও আগে উল্লেখ করা কিছু জবানবন্দি জোগাড় করতে পারিনি। আমি আবার একথা বলতে চাই, বাঁকুড়ার সাথে সম্পর্কিত একজন সহকারী পেলে নিশ্চয়ই ওই ছোট্ট শহরে মসুলমান ঠগিদের একটা বিরাট দলের খোঁজ পাবে। ১৮৩০ সালে ওদের আটক করেছিলাম আমি, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে না পারায় গোটা দলটির এখনো ওখানে থাকার ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

আমি যেহেতু উদার সত্যিকারের সেবার জন্য আবেদন করছি, আবহাওয়া এবং দায়িত্ব পালন থেকে স্বস্তি পাওয়ায় আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগকে অবশ্যই আপনার সুস্বাস্থ্য কামনাতেই সীমিত রাখতে হবে।

এখানেই শেষ করছি, প্রিয় মহোদয়।

আপনার একান্ত

স্বাক্ষরিত জি স্টকওয়েল

কলকাতা, ২৬ মার্চ ১৮৩৬

ফোর্ট উইলিয়ামের নিজামুত আদালতের রেজিস্টার জেএফএম রিড এস্কোয়ারের কাছে পাঠানো ঢাকা জেলার দায়রা জজ আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত দায়রা জজ জেএফজি কুকের চিঠি থেকে এবং আটক ঠগিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় কয়েকজন আসামির জবানবন্দি থেকেও ঠগিদের কাজের ধরন সম্পর্কে ধারণা মেলে।

প্রতি জেএফএম রিড এস্কোয়ার,

নিজামুত আদালতের রেজিস্টার, ফোর্ট উইলিয়াম

মহোদয়,

বিগত ১৯ ও ২০ তারিখে ঢাকায় মামলায় মার্জিনে উল্লেখিত আমার বিবরণ এবং ফরিদপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডব্লু এইচ মার্টিনের বয়ান নিজামুত আদালতে পেশ করছি।

১. বিবাদীরা নির্দোষ দাবি করেছে।

২. নিখোঁজ ব্যক্তিদের ভাই জয়গোবিন্দ তাঁতি এবং লক্ষ্মীকান্ত বলেছে, বৈশাখ মাসে কিছু কাপড় বিক্রি করতে হুকুমচান্দের বাড়ির উদ্দেশে তারা বাড়ি ছেড়ে যায়। কিন্তু এরপর আর তাদের দেখা মেলেনি। জানা গেছে, হুকুমচান্দ তাদের কাছ থেকে কিছু কেনেনি। তারা সাথে সাথেই তার বাড়ি থেকে বিদায় নেয়। জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, আসামিদের কেউ কেউ কাপড় কেনার কথা বলে তাদের নৌকায় উঠতে বলেছিল। এই সাক্ষীরা খুঁজে পাওয়া দুই প্রস্থ কাপড়ের সাথে তাঁতিদের সাথে থাকা কাপড়ের মিল থাকার কথা বলেছে।

৩. তামাকের নৌকার লোকদের আত্মীয় শিবু মাঝি এবং অন্য তিনজন সিরাজগঞ্জে যেতে জৈষ্ঠ্য (মে) মাসে তাদের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেছে। সেখানে দীনবন্ধু নামে এক মহাজনের চাকরি নেয় তারা। এরপর সেখান থেকে লবনের চালান নিয়ে কলিঘাটে গেছে। খুঁজে পাওয়া নৌকায় তাদের আত্মীয়রা ছিল বলে স্বজনেরা নিশ্চিত করেছে। শেষে উল্লেখিত জায়গার ওদি চান্দ গোমস্তা ২৬ জৈষ্ঠ্য ৫২ মণ তামাক ও ৩১ মণ গাঁজাসহ সিরাজগঞ্জে পাঠানোর কথা বলেছে। পনেরো দিন পর সেখান থেকে ওদের ওখানে না পৌঁছানোর খবরসহ একটা চিঠি পায় সে। 
হরগোবিন্দ এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

৪. মানিকগঞ্জের বুল্লা পাল আসামি স্বরূপ মিস্ত্রী, জগমোহন বিশ্বাস এবং বংশীচানকে শনাক্ত করেছে। ৯ এবং ১০ আষাঢ় তাদের হয়ে কিছু তামাক ও গাঁজা বিক্রি করে আসামি স্বরূপ মিস্ত্রীকে টাকা দেয়। রামহরি চক্রবর্তী জগরনাথ সাহাল গোলায় চাকরিরত। ৯ই আষাঢ় এই সাক্ষী আসামি স্বরূপ মিস্ত্রীকে ধরে আনে। আসামি নিজের নাম স্বরূপ বলে জানায়। সাক্ষী ওই দিন বিক্রি করা তামাকের পরিমাণ খাতায় লিখে রেখেছিল। সাক্ষী আসামি জগমোহন বিশ্বাসকে দলের একজন হিসেবে শনাক্ত করে। কিতাব উপস্থিত করা হয়েছে। সেখানে বিক্রি করা তামাক ও গাঁজার পরিমাণ লেখা আছে। পরিমাণ হিসেবে প্রায় সমান অর্থ নৌকায় থাকার কথা বলা হয়েছে।

৫. আসামি সুবল দোম একটা ধুতি নেওয়ার সময় দুজন সাক্ষী হাজির ছিল। ওই ধুতি তাঁতিদের ছিল বলে ধারণা। পরের পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য এটাই প্রমাণ করে যে আসামিরা সবসময় বাড়িতে ছিল না। জবানবন্দির সাক্ষীদের জেরা করা হয়েছে।

৬. ভোলনাথ চান এবং কিষান মোহনকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তারা হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছে, কিন্তু তাদের বিস্তারিত সাক্ষ্য জবানবন্দির পর নেওয়া। মানিকগঞ্জের সাক্ষী এবং আসামিদের বিবৃতি তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেও আমি হত্যাকাণ্ডের সময় নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিত থাকার ব্যাপারে নির্ভর করতে পারছি না।

৭. আসামি গঙ্গারাম মিস্ত্রী যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামি নবীন দেও দুজন তাঁতিকে ডাকার সময় নৌকায় ছিল। কিছু কাপড় কেনার কথা বলেছে সে।

৮. আসামি সুবল দোম জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আসামিদের সাথে থাকার কথা বলেছে। তামাকের নৌকার মতো একই জায়গায় হাজির হওয়া তিনটা নৌকা ছিল তাদের। সে এবং অন্য একজন খাবার আনতে গিয়ে ফিরে এসে অন্য নৌকার লোকদের দেখেনি। তামাক ওদের নৌকায় তোলার পর অন্য নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

৯. আসামি স্বরূপ মিস্ত্রী জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং আমার সামনে আসামি গঙ্গারাম মিস্ত্রীর অনুরোধে তামাক ও গাঁজা বিক্রির কথা স্বীকার গেছে। অন্য ছয়জন আসামি এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার গেছে।

১০. আসামি সুবল দোমের ডাকা তিনজন সাক্ষী সাত বছর আগে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেছে। এখন সে কোথায় থাকে জানে না। আসামি বংশী চান এমন একজন সাক্ষীকে তলব করেছে যে আত্মীয়ের বাড়িতে আসার আগে কখনো তাকে দেখেনি। তার একটা ডিঙি নৌকা ছিল, সেখানে ওটা মেরামত করে সে।

১১. আসামি সুবল দোমকে দুটো হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার এবং তামাকের নৌকা লুটের সহযোগী হওয়ার দায়ে জবানবন্দি বলেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়। আসামি গঙ্গারাম মিস্ত্রীকে তার জবানবন্দির ভিত্তিতে খুন ও রাহাজানি এবং অন্য হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ায় সাজা দেওয়া যায়। আসামি স্বরূপ মিস্ত্রীকে তার কাছে থাকা তামাক ও গাঁজা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দানে ব্যর্থতা ও বিক্রির কারণে জবানবন্দির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। আসামি বংশী চান্দকে বুল্লে পালের সাক্ষীর বরাতে এবং আসামি জগমোহন বিশ্বাসকে একই সাক্ষীর ভিত্তিতে সাজা দেওয়া যায় এবং রামহরি চক্রবর্তীকে বিক্রিতে সংশ্লিষ্ট থাকার দায়েও সাজা দেওয়া যায়।

স্বাক্ষরিত

জেএফজি কুক

দায়িত্বপ্রাপ্ত দায়রা জজ।

জেলা ঢাকা,

দায়রা জজ আদালত, ১ফেব্রুয়ারি১৮৩৬।

আসামিদের নাম:

১.    সুবল দোম, পিতা রামশরণ দোম, বয়স ৩২ বছর।

২.    গঙ্গারাম মিস্ত্রী, পিতা, ধূনি রাম, বয়স ৩৫ বছর।

৩.    স্বরূপ মিস্ত্রী, পিতা ঈশ্বরদাস, বয়স ৩৫ বছর।

৪.    নোবীন্দু, পিতা, রাধাকিশান্দিও, বয়স, ৩৩ বছর।

৫.    বিরজমোহন বিশ্বাস, পিতা, জগমোহন বিশ্বাস, বয়স ২৫ বছর।

৬.    লক্ষ্মীকান্ত সেন, পিতা রামগোপাল সেন, বয়স ২৭ বছর।

৭.    কমলদাস, পিতা হরগোবিন্দ দাস, বয়স ৩২ বছর।

৮.    বংশী চান্দ, পিতা দূর্গারাম।

৯.    জগমোহন বিশ্বাস, এসব অপরাধের সহযোগী

এবং জেনেশুনে চোরাই মাল গ্রহণ করার দুটো ধুতি পেশ করা হয়। আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে।

জয়গোবিন্দ তাঁতি শপথ গ্রহণ করে: জয়নাথ আমার আপন ভাই ছিল। মোজিরাম বা মুচিরামকে আমি চিনতাম। পায়োলায় ছিল সে। গত বৈশাখে (এপ্রিল) একদিন ভোরের দিকে মুজিরাম দুই জোড়া ধুতি নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির হয়। আমার ভাই নিয়ে এসেছিল ছয় জোড়া। তারা কাপড় বিক্রির জন্যে হুকুমচান্দের বাড়ির পথে মৌজা বিনানির উদ্দেশে রওনা হয়, কিন্তু আর ফিরে আসেনি। তিনদিন পর আমি এবং মুজিরামের ভাই লক্ষ্মীনাথ ওদের খোঁজে হুকুমচাদের বাড়ি যাই। সে বলে তিনদিন আগে কাপড় নিয়ে দুজন তাঁতি তার ওখানে এলেও দামে না বনায় কাপড়সহ তারা বিদায় হয়ে গেছে। তো আমরা ফিরে আসি, কিন্তু আমাদের তল্লাশি একরকম ব্যর্থই ছিল। কার্তিকে পুলিশের কর্মকর্তারা ফরিদপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাকে হাজির করে। তার কাছে জবানবন্দি দিই আমরা। ধুতি নম্বর ১১১-এর মতো ধুতিই আমার ভাই এবং মোজি পরত।

লক্ষ্মীকান্ত তাঁতি, তারিখ ভুলে গেছি: বৈশাখ মাসে একদিন ভোরের দিকে আমার ভাই মুজিরাম দুই জোড়া ধুতি বিক্রি করতে বিনানি গ্রামে হুকুমচান্দের বাড়িতে যায়। সেদিনই ফিরে আসার কথা ছিল তার। কিন্তু তিনদিন পরও না ফিরে আসায় আমি ভাবলাম জয়নাথ যখন তার ভাইয়ের খোঁজে গেছে, আমার উচিত জয়নাথের সাথে কথা বলা। তাই আমি জয়গোবিন্দকে নিয়েই যাই। ধুতি নম্বর ৪৭ আমার ভাইয়ের বানানো ধুতির মতো।

শিও মানজি। গত জৈষ্ঠ্য মাসে আমার ভাই কালাচান্দ লোচন, হুকুমচান্দ এবং রামপ্রসাদসহ আমার একটা পানশিতে করে সিরাজগঞ্জের পথে রওনা হয়। সেখানে স্বরূপ দীনোবন্ধু শাহর গোলা বা গুদামঘরে কাজ নিয়ে রংপুর জেলার খুল্লাইঘাটে লবণ পৌঁছানোর দায়িত্ব পায়। আষাঢ় মাসে (জুন) সেই একই গোলায় গিয়ে শুনতে পাই আমার ভাই লবণসহ গন্তব্যে পৌঁছে তার নৌকায় তামাক ও গাঁজা বোঝাই করে সিরাজগঞ্জে ফিরতি পথ ধরেছে, কিন্তু সে বা নৌকা কখনো গন্তব্যে পৌঁছায়নি। শেষপর্যন্ত বণিক স্বরূপ ভাইয়ের খোঁজে যেতে আমাকে অন্য একটা নৌকা দেওয়ার কথা বলে। আমি সেটা নিয়ে তিসুর নদী অবধি যাই, কিন্তু বৃথা। তাই আবার সিরাজগঞ্জে ফিরে আসি। ওরা হারিয়ে গেছে ধরে নিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে যাই। ওই নৌকাটা যেভাবেই হোক ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট রংপুর জেলা থেকে উদ্ধার করেছেন। এটা এখন কাছারির (ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত) ঘাটে আছে।

সুপুল মানজি, রামপ্রসাদের ভাই, কালাচান্দ মানজির ভৃত্য এবং গত জৈষ্ঠ্যে তার সাথে বাকি সবার মতো সিরাজগঞ্জে গিয়েছিল, পেশ করা নৌকা তার চেনা।

রামজি মানজি, ৭ জৈষ্ঠ্য, বুধবার, কালাচান মানজি রওনা দেওয়ার সময় বিবাদীর ভাই হুকুমচান্দকে মাঝি হিসেবে নিয়েছিল। বাকি ওপরের মতোই। পেশ করা নৌকা তার ভাইয়ের ওঠা নৌকার হিসেবে চিনতে পেরেছে।

মুসা জয়মালা, গত জৈষ্ঠ্য (মে) মাসে কালাচান্দকে আমার ছেলে লোচনকে মাঝি হিসেবে নেওয়ার পর থেকে সে নিখোঁজ রয়েছে।

উদিচান্দের শাহ, দীনবন্ধু শাহর গোমস্তা, রংপুর জিলার খিল্লাইঘাট সংশ্লিষ্ট। সাধারণত ওখানে কেনা তামাক ও গাঁজা আমি সিরাজগঞ্জে পাঠাতাম। কালাচান্দ গত ১২ জৈষ্ঠ্যের চালান এবং ৫২ মণ লবণসহ এসেছিল। ২৫ জৈষ্ঠ্যে পৌঁছায় সে। ২৬ তারিখে তার মারফত ৫২ মণ লবণ, ২১ সের তামাক এবং ৩১ মণ গাঁজা পাঠাই আমি। রসদ তার নৌকায় তুলে সিরাজগঞ্জের পথে রওনা করিয়ে দিই। তার সাথে পাইলট হিসেবে পাহাতুকেও পাঠাই। পাহাতু আর ফেরেনি, কালার নৌকাও গন্তব্যে পৌঁছায়নি। আমি শিল্লিতগঞ্জের থানায় নিখোঁজ সংবাদ জানাই। নৌকা রওনা হওয়ার ১৫ দিন পর সিরাজগঞ্জ থেকে আসা একটা চিঠিতে কালাচান্দের গন্তব্যে না পৌঁছানোর খবর জানানো হয়।

ভোলাই চান্দ: আসামি নম্বর ৪,৬,৭,১,২,৮,৯-কে আমি চিনি। গত বৈশাখের (এপ্রিল) গোড়ার দিকে নোবেন্দু চালের ব্যবসা করার লক্ষ্যে আমাকে তার বাড়িতে ডেকে নেয়। সেখান থেকে আমাকে একটা নৌকায় নিয়ে যায় সে। সেটা ছিল শতমণি পানশি। আরও পাঁচজন লোক বসেছিল নৌকায়, কাউকেই চিনি না। ছোট একটা নৌকায় সাতজন লোক কি করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম নোবিনকে। সে জবাব দেয়, 'বংশী, মানজির আরেকটা নৌকা আছে, সেটা আনলে যথেষ্ট জায়গা হয়ে যাবে।' সেদিন আমরা নৌকায় ছিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় বংশী মানজি, সুবল দোম, বিরজমোহনএবং গঙ্গারাম মিস্ত্রী আমাদের নৌকার কাছেই একটা ডিঙিতে চড়াও হয়। তখন কমলদাস আমাদের নৌকা ছেড়ে রাম গোবিন্দ নামে একজনকে ডাকে। রাত নামলেও আমরা ওখানেই থেকে যাই। পরদিন ভোরে ডিঙিতে ছয়জন এবং একটা পানশিতে ১০ জন ছিল। একদিন পেরিয়ে যাচ্ছিল, আমরা রওনা দেব, এমন সময় স্বরূপ মিস্ত্রী চিৎকার করে বলে, 'থামো!  নৌকাগুলো থেমে যায়, স্বরূপ তীরে নেমে বেশ কয়েক জোড়া ধুতিসহ দুজন তাঁতিকে সঙ্গে করে এনে নোবীন্দুকে বলে, 'এই যে, কুটুম, তুমি কাপড় কিনতে চেয়েছিলে না, বিক্রেতাদের নিয়ে এসেছি।' জবাবে সে বলে, 'ওদের নৌকায় তোলো।' তখন কাপড়সহ তারা নৌকায় ওঠে। আমি স্বস্তি বোধ করি। সুবল দোম এবং স্বরূপ মিস্ত্রী একটা গামছা ছুড়ে দিয়ে দুজন তাঁতির গলায় পেঁচিয়ে নৌকার পাটাতনে ঠেসে ধরে। কিছুক্ষণ ওদের পানির নিচে চেপে ধরে রেখে ছেড়ে দেয়। এরপর উত্তরে রওনা হয়ে পনেরো দিন পর রংপুর জেলার কাকীনুর উদ্দেশে এগিয়েছি। সেখান থেকে খোলাবোরির দিয়ে সুরার দিকে এগোই। একটা বাঁকে তামাক আর গাঁজাবোঝাই একটা নৌকা দেখতে পাই।

আমাদের দুটো নৌকাই সেখানে নোঙর ফেলে। সুবল দোম মানজিকে (সর্দার) তামাকের নৌকা কোথা থেকে আসছে জিজ্ঞেস করে। সে জানায় ওই নৌকা খিল্লাইঘাট থেকে সিরাজগঞ্জে যাচ্ছে। একথায় নোবিন্দু বলে, 'আমাদের বাড়ি মুথে, আমরা মানিকগঞ্জে যাচ্ছি,' এভাবে তিনটা নৌকাই সেরাতে ওখানে থেকে যায়। পরদিন দুপুরে সবগুলো নৌকা একসাথে রওনা হয়। নোবিন্দু একটা চর দেখতে পেয়ে তামাক ব্যবসায়ীদের বলে, 'অ্যাই, মানজি, (সর্দার), চলো এখানে নৌকা ভিড়িয়ে রান্না করে নিই।' তামাক নৌকায় পাইলট ছিল। আমরা সবাই ওই চরে নোঙর ফেলে রাতের খাবার খাই। নোবিন্দু বলে, 'আমি দেবতা হরির দিব্যি কেটেছি, সেটা এখানে পূরণ করতে দাও।' তারপর মানজি এবং তার নৌকার মাঝিদের সাহায্য করবে কিনা, জানতে চায়। তো প্রথম নৌকার সামনে একটা মাদুর পাতে সে। তামাকের নৌকার চার নাবিক এবং পাইলট এলে সুবল বলে, 'আমি কি দেবতা হরি সোতের গান ধরব।' এরপর তারা একটা গান শেষে আরেকটা গান ধরলে নোবিন্দু বলে, 'এবার জলদি করো, আমাদের লুটের জিনিস দিয়ে দাও,' একথার পর বিরজমোহন এবং স্বরূপ মিস্ত্রী এবং সুবল দোম এবং কমলদাস এবং লক্ষ্মীনাথ সেন, এই পাঁচজন তামাকের নৌকার চারজন এবং পাইলটের গলায় হামলে পড়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে বালিতে ঠেসে ধরে।

অন্যরা একই সময়ে তাদের আঁকড়ে ধরে কিল এবং কনুইয়ের আঘাতে খুন করে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দেয়। রামগোবিন্দ, সুবল এবং আমাকে তামাকের নৌকায় তুলে দেওয়ার পর তিনটা নৌকাই একসাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে। সন্ধ্যায় আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে তামাক ও গাঁজা পানশি এবং ডিঙিতে তোলা হয়। তামাকের নৌকা কুড়োল দিয়ে ফুটো করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন রওনা হয়ে পাঁচদিন পর কিষানপুরে এসে নৌকা মেরামত করি। ওখান থেকে তামাকের বাজার দর দেখতে মানিকগঞ্জের পথ ধরে স্বরূপ। ফিরে এসে ঝামেলার কারণে বাজার ফাঁকা থাকার কথা জানায়। এরপর পানশিতে গাঁজা বোঝাই করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় স্বরূপ। আমি, সুবল, বিরজমোহন এবং কমল তামাক নিয়ে আসি, বাকিরা যে যার বাড়ি ফিরে যায়। মানিকগঞ্জে এসে আমাদের পক্ষে তামাক বিক্রির জন্যে বুল্লাই শাহকে দিই। পরদিন আমি চলে যাই, পনেরো দিন পর ফিরে এসে দেখি নৌকাটা তখনো ওখানেই আছে। স্বরূপ বলল, ১৬ রুপি দামের তামাক বিক্রি হয়েছে, আমাকে সে ১ রুপি দিতে চাইলে আমি অস্বীকার করে বাড়ি চলে যাই। এরপর রেদম সিং এবং পুনো প্রামাণিক আমাকে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে আসে। তাকেই আমি দুই দিন ধরে আমার জানা সবকিছু খুলে বলেছি।

বিজনাথ মিস্ত্রীর জবানবন্দি: স্বরূপ আমার আপন ভাই। জৈষ্ঠ্য মাসের শেষদিকে মানিকগঞ্জে যাওয়ার কথা বলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ৬ কিংবা ৭ আষাঢ় বাড়ি ফিরে আসে। তারপর আবার উত্তরে গিয়ে আশ্বিন মাসে ফিরে আসে। এটুকুই আমি জানি। আশ্বিনে সে একবান্ডিল তামাক নিয়ে আসে। আশ্বিন দুসরা আগে উদিশাহর কাছ থেকে তিন রুপি ধার করেছিল সে।

জগমোহন বুরুশমা: সে কেবল ২ নম্বর আসামিকে চেনে। একই বস্তিতে থাকে তারা। মুহুরি এবং নাজির সদরে তার জবানবন্দি নিয়েছে। স্বরূপ দুজন তাঁতিকে কাপড় কেনার অজুহাতে নৌকায় নিয়ে আসে, তাকে চারজন লোক এবং পাইলটসহ তামাকের নৌকা, খুন ও নৌকা ডোবানোর কথা জানায়। পরে স্বরূপের বাড়িতে কিছু পুরোনো কাপড়, একটা নতুন চমৎকার ধুতি, দুই সের তামাক পাওয়া গেছে। এটাই সেই ১১১ নম্বর কাপড় জানায় জগমোহন।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.