জিনস : নাইন্টিজের বালকের চোখে

ইজেল

02 January, 2022, 02:15 pm
Last modified: 02 January, 2022, 02:28 pm
খোকন পরিচালিত 'উত্থান-পতন' সিনেমায় মিশেলার লিপে মিল্টন খন্দকারের কথা সুরে 'রং চটা জিনসের প্যান্ট পরা, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ধরা', এই গান সম্ভবত বাংলা ভাষার সিনেমায় পুরুষ সৌন্দর্যের একমাত্র উদ্যাপন। গেয়েছিলেন ডলি সায়ন্তনী। নতুন করে আবার শুনতে গিয়ে দেখি, কালো চশমায় ঢাকা চোখে শোকের সংবেদনের উল্লেখ 'বাজারি' গানটায় কাব্যের সুন্দর এনেছে। আর ওই বাক্য দুটি –'দৃষ্টি যেন রাসপুতিন, প্রতিদিন আমি হয়ে যাই খুন।'

আমরা ঝরনা কলমের প্রজন্ম তায় মিশনারি স্কুল। দুপুর ঠিক বারোটায় ভূতে ঠেলা না মারলেও গম্ভীর গির্জার ঘণ্টা ও সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে গুড আফটারনুন স্যার। নব্বইয়ে আমরা বেড়ে উঠছিলাম, পূজোর সময় আমাদের বাবাদের কাছে আমাদের আবদার ছিল, নতুন আনন্দমেলা শারদ, অল্প কিছু পকেট মানি এবং অবধারিত একটা নীল জিনস। আমাদের পুত্রকাতর বাবারা তখন অগত্যা হকার মার্কেটে নিয়ে কিনে দিতেন জিনসের প্যান্ট । প্রথম 'কপি' জিনস চেনা ওই জিনসেই। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে উঠতে গিয়ে অনেকের কড়া শাসন পরিবারে নিষিদ্ধ সন্ধ্যা সাতটার পর ফেরা এবং হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্টের দিকে আসতে আসতে আমাদের শরীর আস্তে জেগে উঠেছিল আর আমরা ক্রাশ শব্দের সংজ্ঞা না জেনেই ক্রমাগত ক্রাশ খাচ্ছিলাম এলাকার বড় মেয়েদের প্রতি। তখন ক্যাডার রোমান্টিক শব্দ। এমই কলেজ আর কমার্স কলেজের ছাত্রলীগের ক্যাডাররা অত নিষ্ঠুর নন, প্রায় সবার ঘরে বইপত্র থাকত, কেউ কেউ প্রেম করত আর সেসব প্রেমের প্রধান অস্ত্র হাতে লেখা চিঠি। পত্রলেখার মুকুটহীন সম্রাট হলে সুবিধা বড় ভাইয়েরা নিউমার্কেটের লিবার্টিতে নিয়ে ফালুদা খাওয়াতেন আর দিদিরা কোনো এক অমূল্য মুহূর্তে এই হাতখানি চেপে ধরতেন বুকে। মনে পড়ে, নাইন্টিজের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট জিনস। হাত যে অমন করে একটা বরফাচ্ছাদিত শীতলে ডুবে যেতে পারে তার রোমাঞ্চ উপলব্ধি এখন অসাধ্য। অভিজাত, নিয়মতান্ত্রিক সেন্ট প্লাসিডসের ক্লাস কেটে, স্যারেদের বাসায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া কচি বয়সেই। আমাদের তো কোনো তোশিরো মিফুনে বা গদার ছিলেন না। আমাদের ছিলেন শিবলী সাদিক আর শহীদুল ইসলাম খোকন। তখন প্রেম মানে সালমান শাহ আর যুদ্ধ মানে রুবেল। 

খোকন পরিচালিত 'উত্থান-পতন' সিনেমায় মিশেলার লিপে মিল্টন খন্দকারের কথা সুরে 'রং চটা জিনসের প্যান্ট পরা, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে ধরা', এই গান সম্ভবত বাংলা ভাষার সিনেমায় পুরুষ সৌন্দর্যের একমাত্র উদ্যাপন। গেয়েছিলেন ডলি সায়ন্তনী। নতুন করে আবার শুনতে গিয়ে দেখি, কালো চশমায় ঢাকা চোখে শোকের সংবেদনের উল্লেখ 'বাজারি' গানটায় কাব্যের সুন্দর এনেছে। আর ওই বাক্য দুটি –'দৃষ্টি যেন রাসপুতিন, প্রতিদিন আমি হয়ে যাই খুন।' একজন কিংবদন্তি স্বৈরশাসকের এমন বাসনাসুন্দর উল্লেখ আমার কাছে গানটির আবেদন কাল্টের পর্যায়ে নিয়ে যায়। আমরা সালমান শাহ আর রুবেলের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে দেখি, তাঁরা প্রায়ই খেটে খাওয়া মানুষের চরিত্রে কিংবা মধ্যবিত্ত/নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সব সময় ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করেন জিনস। শহরে তখনো বইয়ের দোকানের কঙ্কালের ওপর নানা বাহারি কাপড়ের দোকানের উদয় ঘটেনি। এভাবে বয়স বাড়তে বাড়তে প্রেম আর কার্ল মার্ক্সকে একসাথে চিনে উঠি। যে বার দুয়েক আমি প্রেমে পড়েছি, পড়েছিলাম নারীর বুদ্ধিমত্তার। তখনো স্যাপিওসেক্সুয়াল কথাটা আমাদের মুখে সড়গড় হয়নি। আমরা একমাত্র চুমু কিংবা স্পর্শ অনুবাদ করতে জানতাম, এক্স ভিডিও আমাদের নষ্ট করেনি।

জিনসের জনপ্রিয়তায় আছে মেরেলিন মনরোরও অবদান

আমাদের শারীরবিজ্ঞান শিক্ষা বড়জোর গুপ্তসাম্রাজ্যের পাঠ্যে। আমরা বলতাম, বাংলার অবহেলিত বর্ণ – চন্দ্রবিন্দু, বিসর্গ ও খন্ড ত, পাতার পর পাতা লিখে তিনি তাদের পুনর্বাসিত করেছেন, যা কি না রবীন্দ্রনাথ পারেননি। আমাদের বয়সী নারী খুব কমই সালোয়ার কামিজের বাইরে পোষাক পরতেন। শাড়ি তো বিদ্যাদেবীর আরাধনার দিন। সেদিন আমরা অবাক হয়ে যেতাম, পুচকে মেয়েগুলো শাড়ি পরে কেমন অচেনা হয়ে উঠেছে। সিডি প্লেয়ারের কল্যাণে বলিউডের সাবান সুন্দরীরা আমাদের শয়নঘরেও আবির্ভূত হচ্ছেন কিন্তু আমাদের সকল মনোযোগ 'কোথাও কেউ নেই'-এর বাকের-মুনার প্রেমে। আর সেই অভূতপূর্ব আসাদুজ্জামান নূর প্রায় জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি নীল, কালো জিনস। ফিল্ম সোসাইটিতে সংযুক্তির বদান্যতায় যখন 'ঘুড্ডি'-র মুখোমুখি, খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েছিলাম, লোমশ বুকখোলা ম্যানলি রাইসুল ইসলাম আসাদের পাশে শাড়ি পরা মেধাবিনী সুবর্ণাকে দেখে, সেই ছবিতেও আমাদের প্রাণের হ্যাপি আখন্দ গিটারে সুর তুলছেন জিনস পরা অবস্থাতেই। ছিয়ানব্বইয়ের ছয় সেপ্টেম্বরে সালমান শাহের আত্মহত্যাকে আমরা চিরকাল হত্যা বলেই ভেবে এসেছি। নিজেরা বলাবলি করতাম, এমন একজন ছিলেন তিনি লুঙ্গি বা জিনসে সমান স্বচ্ছন্দ। আমাদের রুবেল বলত, ভগবান আমাদের পেছনটা দায়ের একটা কোপ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন আর ওর অনেক যত্ন করে। এমনই এক শোকের দিনে আমাদের সামনে উদয় হলেন তানিয়া আফরিন। কয়েক বছর পরে আমরা সদলবলে তাঁর প্রেমে পড়ব।

২. 
তানিয়াদি আমাদের চেয়ে চার বছরের বড়। পড়তেন নৃতত্ত্বে। তখন দুই হাজার-পরবর্তী সময়ে কেউ ঘোষণা করেনি, ঘন ঘন ভূমিকম্প মেয়েদের জিনস পরার কারণে হয়, তাই তিনি জিনস পরতেন। ফেমিনিজম কথাটা তাঁর মুখেই প্রথম শোনা। তখন লেফট পলিটিক্সে সদ্য হাতে খড়ি, বিপ্লবস্পন্দিত বুকে নিজেকেই গোর্কি মনে হয়, তাই প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শিকেয় উঠেছিল। তাঁর বাসাতেই যা কিছু শিক্ষিত হওয়া খানিক। লেভি স্ত্রাউস অনেক বড় নৃবিজ্ঞানী হলেও তিনি যে জিনসের স্রষ্টা নন, তখনো জানিনি। হির্শ্চ স্তাউস আর তাঁর দুই নম্বর স্ত্রী রেবেকা হাস স্ত্রাউসের ঘরে, আরও তিনটে ভাই ও দুই বোনের সাথে বড় হয়ে উঠছিলেন তিনি, তখনো অজানা। স্তাউসদের নিজেদেরই সুগন্ধি, সাবান আর পোষাকের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। রেনোর দর্জি জ্যাকব ডেভিস যখন স্ট্রাউসের সাথে যোগ দিলেন, তখন জিনস নামক বিশ্বব্যাপী 'সমাজতান্ত্রিক' ব্র্যান্ডের জন্ম হলো। সমাজতান্ত্রিক এই অর্থে যে যেকোনো আয় স্তরে থাকা মানুষ অ্যাফোর্ড করতে পারেন এই পোষাক। ১৮৭৩ সালের মে মাসের বিশ তারিখ আমেরিকান সরকারের পেটেন্ট আর ট্রেডমার্ক অফিস ১৩৯, ১২১ ট্রেডমার্ক নাম্বার পাঠাল। ফলে এই দিনটাই জিনসের আনুষ্ঠানিক জন্মদিন। তানিয়া দিদির ওয়েস্টার্ন কাউবয় সিনেমার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। এই যে কাউবয়রা, অনেক সময় বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো র‍্যাঞ্চে র‍্যাঞ্চে কাজ করে, কেউ কেউ হয়ে পড়ে বাউন্টি হান্টার, তাদের প্রতি গভীর একটা মমতা তাঁর দেখাদেখি আমার মধ্যেও জন্মেছিল। জিনসের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার এক ইউনিক সেলস পয়েন্ট, সোভিয়েত প্রকাশনার বইয়ের মতো, প্রায় অমরত্ব। এই জিনিস সংগ্রহ থেকে হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু নষ্ট হবে না। 'গুড বাই, লেনিন' আমার ওখানেই দেখা। এক মধুর বিকেলে আফরিন আমাকে সিনেমা দেখতে বসিয়ে পাশের ঘরে তাঁর তখনকার প্রেমিকের সাথে প্রেম করছিলেন। আমায় তখন বেশি টানত সিনেমা, প্রেমের চেয়েও। সে সিনেমায় দেখি, বার্লিন দেয়াল ভেঙে পড়েছে, কমিউনিস্ট মা আগের দিন কোমায় চলে গেছেন, ফিরে আসার পর পুত্রের একমাত্র কাজ পূর্ব জার্মানিতে সমাজতন্ত্র আর নেই, এই সত্য মা যাতে বুঝতে না পারেন, কেননা বুঝলে মাকে ফেরানো যাবে না। কত সমষ্টির স্বপ্ন ধূলিসাৎ হলো, ছেলেটি দেখে, ছেলেবেলায় তার স্বপ্নের নায়ক মহাকাশচারী এখন ট্যাক্সি ক্যাব চালাচ্ছেন জীবিকার দায়ে। মনে পড়ে, বার্লিন দেয়াল পতনের সেই ফুটেজে প্রায় সবার পরনে জিনস। জিনস প্রায় এক অলীক পোষাক, যেখানে সাম্য আর পুঁজি একাকার। খনিশ্রমিকদের স্বল্প আয়ে অনেক দিন পরার পোষাকটি কী আশ্চর্য সাবলীল ফিরে আসে বিল গেটস কিংবা স্টিভ জবসের পরনে। 

৩. 
আমাদের গানের নায়ক অঞ্জন দত্ত। পরে তিনি আমাদের চোখের সামনে চলচ্চিত্র পরিচালক হয়ে উঠলেন। অভিনেতা তো বটেই, মৃণাল সেনের মতো মানুষের জন্য গল্প লিখেছেন। দেখি, তাঁর মনোযোগ সমাজে নানাভাবে অবরুদ্ধ মানুষদের প্রতি। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ইতিহাস আমরা কমবেশি জানি। বেশির ভাগ আটকে পড়া ইংরেজদের দরিদ্র, প্রান্তবাসী বংশধর। তাঁর পরিচালিত প্রায় সব ছবিতে রাগী, বঞ্চিত যুবকদের পরনে জিনস। জিনসের নীল রং দুনিয়াজুড়ে এত ভালোবাসার যে হলো, তার আসল কারণ আমার মনে হয়, আমাদের জিনেই নীলের প্রতি দুর্বার টান, সহস্র প্রজন্মান্তরজুড়ে নীল আকাশ আমাদের জিনে খোদাই করা। এক পরিচালক তো বলেই দিয়েছেন, 'ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালার।' এই ধরিত্রীর সমাজব্যবস্থায় যে সাম্যের অভাব, তার বেদনা নীল ছাড়া কে আর ধারণ করতে পারে! পৌরাণিক নীলকণ্ঠের মিথও এই চিন্তা থেকেই আমরা পাই। আরেকটা কারণ, প্রাকৃতিক রং নীল এমনভাবে ব্যবহৃত হয়, অতি ব্যবহারে জিনসের প্যান্ট খানিকটা বর্ণহীন হয়ে অন্য আরেক রকম বন্য সুন্দরের জন্ম দিতে পারে। আমাদের দরিদ্র দেশের পৃথুলা নায়িকারা তো বটেই, কোনো কোনো হারিয়ে যাওয়া নায়িকা (যেমন শামা), অতি জনপ্রিয় মৌসুমীকে যখন নাইন্টিজের ছবিতে হাতে গোনা কয়েকবার জিনসে দেখা যায়, তখন তাঁকে তৎকালীন অচলাবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই স্মরণযোগ্য ভাবি। 

জিনসের পোষাকের সাথে যুদ্ধের ইতিহাস বা সিনেমার ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধে জেরবার তরুণ প্রজন্ম তখন দেশ-দেশান্তরে বেরিয়ে পড়ছিল। আমাদের তখনকার ভারতবর্ষের মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অবন ঠাকুরের দৌহিত্র হিচ হাইকিং করে চলে গিয়েছিলেন চেকোস্লোভাকিয়া আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে। তাঁর দুটি ভ্রমণ কাহিনি 'চরণিক' আর 'লাফা-যাত্রা' (হিচ হাইকিংয়ের মোহন কর্তৃক বাংলায়ন) বইতে সরস বিবরণ আছে। ভ্রমণসমগ্রের প্রচ্ছদে এই ভ্রমণপ্রিয়কে দেখি জিনসের পোষাকেই। হিপিরা যে এসেছিলেন, অমর গিনসবার্গ (আহা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড! তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি হোক) ও তাঁর বন্ধুরা, ওই ইতিহাস ঘাঁটলে কিংবা আমেরিকার যুদ্ধাবাহ পরাশক্তি হয়ে ইতিহাস ও নিরীহ মার্কিন মায়েদের নিরুপায় মরে যাওয়ার ইতিহাস পড়লে, ভিতেয়নামের প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনাবলিতে জিনসের অকথিত কত ইতিহাস না লুকিয়ে! 

একটি দৃশ্য ভাবুন, মেরিলিন মনরো একটি সিনেমায় জিনস পরে এসেছেন। সাদাকালো সিনেমা পত্রিকা হাতে কোনো এক ধূসর সেনাশিবিরে, বিনা ইন্টারনেট ও ব্যক্তিগত ফোনহীন অবসরে একজন আদম সন্তান ছবিটি দেখতে দেখতে মার্কিন কোনো এক অজ পাড়াগাঁয় ফেলে আসা প্রেমিকাকে ভাবছেন, যার হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে বা তত দিনে মৃত। মানব সভ্যতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উপহার এই জিনস, যার রং স্বপ্নের অধরা মাধুরী, নীল!                  
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.