আমার সত্যজিৎ
কিশোরগঞ্জের মেয়ে শুনেই, মেয়ে না দেখে, বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়ার আদি কারণটি ছিলো, মসূয়া গ্রামে সত্যজিৎ রায়ের আদি বাড়ি দেখে নেয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে শ্বশুরবাড়ি গেলেই। এবং সত্যিই একদিন, বিবাহসূত্রে পাওয়া ভাই তাপস তার বাইকে চড়িয়ে আমায় নিয়ে গিয়েছিলো এক বিকেল সে বাড়ি দেখাতে। প্রথম দেখার বিস্ময়ে হতবুদ্ধি আমার মনে হচ্ছিলো ঐ যে ভাঙাচোরা উঁচু উঁচু জানালা সেখান দিয়ে শিশু উপেন্দ্রকিশোর খোলা চোখে তাকিয়ে সকালের আলো হয়ে ওঠা দেখতেন।
উপেন্দ্রকিশোরের মানসবিশ্ব গড়ে ওঠার পশ্চাৎপট মনে পড়ে যায় তারপর। তাঁর ঠাকুরদা লোকনাথ রায় ছিলেন তন্ত্রসাধক। রীতিমত মানুষের মাথার খুলির মালা সহযোগে তিনি তন্ত্র সাধনা করতেন৷ লোকনাথের বাবা রামকান্ত খোল বাজিয়ে খোলা গলায় কীর্তন গাইতেন আর এতো জোরে খোলে চাঁটি মারতেন যে ভালোভাবে আচ্ছাদিত খোলও অনেক সময় ফেটে যেতো। তিনি পুত্রের এইসব সাধনা পছন্দ করতেন না। একদিন সব সাধনার জিনিস ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেন৷ সেই শোকে পুত্র লোকনাথ মাত্র বত্রিশ বছরে ইহধাম ত্যাগ করেন আর তখন বউ কৃষ্ণমণি সন্তানসম্ভবা। কৃষ্ণমণির পুত্র কালীনাথ রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোরের বাবা।
কালীনাথ তিন ভাষায় পন্ডিত ছিলেন- আরবী, ফারসি আর সংস্কৃত। সুকন্ঠ স্তবের জন্যে ভক্ত শ্রোতামন্ডলীতে তিনি 'শ্যামসুন্দর' নামে খ্যাত হয়েছিলেন। জন্মের সময় উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিলো কামদারঞ্জন এবং দূরসম্পর্কের এক কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরি তাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে নিয়ে আসেন ও নাম পাল্টে দেন। উপেন্দ্রকিশোর আর রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় ১৮৮৫ সালের ১৫ জুন। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর সুকুমার জন্মালেন৷ ১৮৯২ সালের দিকে সুকুমার মসূয়া গ্রাম আর মধুপুরে হাওয়াবদলে এসেছিলেন সপরিবার। ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারী দেখা দিলে রায়চৌধুরি পরিবার মসূয়ায় চলে আসেন কিছুদিনের জন্যে। উপেন্দ্রপুত্র সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহের 'যুবক বন্ধু'। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর চলে গেলেন৷ সেদিন ভোরবেলা জানালার পাশে একটা পাখি গান গেয়েছিলো আর চারপাশে দন্ডায়মান বিপন্ন আত্মীয়দের তিনি বললেন,'পাখি কি বলে গেল জানো? সে বললে, যাও চিরদিনের পথে এবার শান্তিতে যাও।' স্ত্রী বললেন, 'চোখ বুঝলেই কী সুন্দর আলো দেখি, ভগবান কত দয়া করে আমাকে পরকালের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন।'
সুকুমার রায় বিদেশ থেকে ফেরার পর তাঁর বাবামায়ের পাত্রী খোঁজার সময় তিনি যে মন্তব্যটি করেন, তাতে তাঁর ধাতটা বোঝা যায়, 'সুন্দরটুন্দর বুঝি না, দেখতে খারাপ না হলেই হল। গান গাইতে পারলে ভালো হয়। আর ঠাট্টাতামাশা করলে যেন বুঝিয়ে বলতে না হয়। ' অর্থাৎ আজকালকার ভাষায় উইট আর সেন্স অফ হিউমার সমৃদ্ধ জীবনসঙ্গীর অনুসন্ধানে ছিলেন সুকুমার রায়৷ সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায়, সাধক কালীনারায়ণ গুপ্তের নাতনি। কালীনারায়ণ অসংখ্য সাধনসঙ্গীতের প্রণেতা। সুপ্রভা সুন্দর কণ্ঠের জন্যে রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে গেয়েছেনও একাধিকবার। ১৯১৩ সালে সুকুমার সুপ্রভার বিয়ে হয়।
বাংলা ১৩২৭ সালের মাঘ মাসে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সুকুমার এবং ১৩২৮ সালের বৈশাখের ঊনবিংশ দিবসে জন্মালেন সত্যজিৎ। ১৯২১ সালে যে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সে কালান্তক ব্যাধি আর তাঁকে বাঁচতে দিলো না। ১৯২৩ সালের ২৯ অগাস্ট রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ সুকুমারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আনন্দের, স্বস্তির, সুখের, পূর্ণতার গান শুনতে চেয়েছিলেন সুকুমার। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর অনুরোধে একাধিক গান গেয়েছিলেন৷ একটা গান হচ্ছে - ' দুঃখ এ নহে সুখ নহে গো, গভীর শান্তি এ যে। ' ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া আটে চলে গেলেন সুকুমার। কলকাতায় সেদিন ভূমিকম্প ঘটার তথ্য নথিবদ্ধ আছে। মাধুরীলতা রায়ের স্মৃতিকথায় জানা যাচ্ছে, তাঁর শেষ কথা, 'এইবার বেরিয়ে পড়ি।'
সেদিন বিকেলবেলা জীর্ণ, পুরনো, পলেস্তরা খসে আসা ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়েছিলো এসব পুরনো পাঠের স্মৃতি। মনের চোখের নগর হয়ে ওঠা মসূয়াকে যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পটভূমিতে অন্তত শ দেড়েক বছর পিছিয়ে ভাবছিলাম তখন রোমাঞ্চ হচ্ছিলো খুব।
২.
বিশ্বের সত্যজিৎ কেমন করে আমার সত্যজিৎ হয়ে উঠলেন তার একটা মজার ইতিহাস আছে। আমরা তখন সাধু মিষ্টি ভাণ্ডারের উপর যে বাসাটায় থাকতাম সেখানে একটা বারোয়ারি বিশাল খাটের উপর বড়ো কাকা তাঁর দশ টাকার প্রাইজবন্ডের বান্ডিল সাজিয়ে বসেছিলেন। আমি পাশেই খেলছিলাম। টুক করে একটা সরিয়ে তোষকের নিচে রেখে দিলাম। দশখানা ছিলো, বাংলাদেশ ব্যাংকে দিতে একশো টাকা পেলাম৷ সে টাকা নিয়ে চলে গেলাম নিউ মার্কেটের উল্টোদিকে কারেন্ট বুক সেন্টারে।
বাংলা চৌদ্দ শো সাল৷ আকাশে সাদা মেঘের ঝাঁপি। শারদ উৎসবের অল্প কয়েকদিন বাকি। কিনে ফেললাম আনন্দমেলা ১৪০০ পুজো সংখ্যা। আঠাশ বছর আগের সে আনন্দ আর নিষ্কাম ক্রিমিনালত্ব আজো ভুলিনি৷ প্রচ্ছদের ডানকোণায় উপরের দিকে পাইপ মুখে একটি লোকের টুপি পরা মুন্ডু আর নিচে বামদিকে টাকমাথা, এক মুখ দাড়িওলা বুড়ো আর গুঁফো দুই মানুষ। সেখানেই সত্যজিৎ রায়ের দুটি চরিত্র তারিণী খুড়ো এবং প্রফেসর শঙ্কুর সাথে পরিচয় ঘটলো। তারিণী খুড়ো অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। এখন সেসব গল্প করেন এলাকার কিশোরদের জমায়েতে, ঘরোয়া আড্ডায়। প্রফেসর শঙ্কু একজন বিজ্ঞানী, মঙ্গলে গিয়েছিলেন। ঐটুকু বয়সে ঢাউস পুজো সংখ্যার আরো নানা আনন্দের সাথে দুটো চরিত্র মনে সেঁটে গেলো স্ট্যাম্পের মতো। অনেক পরে টের পাই, ঐ আনন্দমেলা সংগ্রহের আগের বছরই সত্যজিতের মহাপ্রয়াণ। ফলে আনন্দমেলার নিয়মিত আয়োজন শঙ্কুকাহিনির নতুন বিস্তার ঘটানো যায়নি। আগের বছর দেখি, দুটি অসম্পূর্ণ শঙ্কু কাহিনি মুদ্রিত হয়। আর পুনর্মুদ্রণ ঘটে 'প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য' গল্পের। সত্যজিৎ রায়ের কথাসাহিত্যিক সত্তাকে তিন টুকরোতে ভাগ করলে আমরা ফেলুদা, তারিণী খুড়ো আর শঙ্কুকে পাই।
রহস্য রোমাঞ্চ, মাথা খাটিয়ে সমাধানে উৎসাহী ফেলুদা, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির নতুন বিস্তার শঙ্কুর ডাইরিতে আর অলৌকিক যত অমীমাংসিত রহস্য এ জাতীয় লেখা তারিণীখুড়োতে। 'প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য'- গল্পে সত্যজিতের কল্পনাশক্তির পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম কচি বয়সে। মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম গ্রহ যারা কি না জ্ঞানবিজ্ঞানে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে, সে গ্রহ ওজনে ভারি হলেও এক হাতেই তুলে নেয়া যায় এবং গ্রহটির এক বছর আমাদের একদিনের সমান৷ সে গ্রহের পরিণতির খুব সুন্দর ও মানবিক সমাধান দেন সত্যজিৎ। কথাসাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের জন্ম রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে 'সন্দেশ' পুনঃপ্রকাশকে কেন্দ্র করে৷ একই বছর শঙ্কুর জন্ম 'ব্যোমযাত্রীর ডাইরি' নামে এক গল্পে, প্রথম প্রকাশ সন্দেশে আর পরে আমার কেনা সেই আনন্দমেলা ১৪০০ তে গল্পটি রিপ্রিন্ট হয়৷
ফেলুদা আবির্ভূত হলেন ১৯৬৫ সালে। সত্যজিৎ রায়ের নিয়মিত ভ্রমণের নেশা, রহস্যপ্রিয়তা, নানা মডেলের গাড়ির প্রতি টান, প্রাচীন ইতিহাসকে তলিয়ে দেখতে চাওয়ার আগ্রহ ইত্যাদি আরও নতুন জিনিস ফেলুদাতে আমরা পাই যা ঠিক সত্যজিৎ রায়ের মতো করে বাংলায় আর হয়নি৷ পরে, সাগরময় ঘোষের অনুরোধে দেশ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রায় বছরওয়ারি ফেলুদা লিখলেও তিনি কখনো তাতে প্রাপ্তবয়স্ক উপাদান ঢোকাননি, ফেলুদায়। এমনকি আমার পড়া প্রথম তারিণী খুড়ো গল্প 'মহারাজা তারিণী খুড়ো' পড়ে মনে আছে চরিত্রটি ফেলুদা আর শঙ্কুর মতোই মদ খায় না। পরে জানি, সত্যজিৎ নিজেও ও রসে বঞ্চিত ছিলেন। স্রষ্টার অভ্যাস, রুচি এমনকি বাম হাতের কড়ে আঙুলের লম্বা নখটি অবধি ফেলুদাতে তিনি আরোপ করেন। একটি অঞ্চলকে কেমন করে বিশেষ আঞ্চলিক রূপ রস গন্ধসহ তুলে আনতে হয় সেসব আমরা শুরুর ফেলুদা গল্প 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি' থেকে শেষ গল্প 'রবার্টসনের রুবি' ধারাবাহিক পাঠে পাই।
আনন্দমেলা কেনার কিছুদিন পর হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখার অভ্যাস হলো। তখন সালমান শাহের, রুবেলের রাজত্ব৷ আমাদের শৈশব কৈশোরে কোনো তোশিরো মিফুনে বা গোদার ছিলেন না৷ আমরা শিবলী সাদিক, শহীদুল ইসলাম খোকনে তৃপ্ত ছিলাম। কেন না, ফ্রন্ট স্টল তখনো পিচ্ছিল হয়ে পড়েনি। এমনই এক দিন, বনানী সিনেমা কমপ্লেক্সে এক টিকিটে দুই ছবির, মানবিক ও অমানবিক দুই রকম মারামারির শেষে কোনো এক বন্ধুর বাসার দূরদর্শনে 'আগন্তুক' নামে এক চলচ্চিত্রের শেষ আধা ঘন্টার মত দেখি।
আমার সিনেমা দেখার চোখ একটা বড়ো ধরণের ধাক্কা খায়।
৩.
সত্যজিতের সত্যজিৎ হয়ে ওঠার পেছনে পাঁচটি ঘটনা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে হয়৷ প্রথম ঘটনা, সঙ্গী নির্বাচন। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের সঙ্গ নির্বাচনে তিনি সতর্ক ছিলেন৷ যেমন ধরা যাক, বংশী চন্দ্র গুপ্ত কিংবা বিজয়া রায়ের এই নামগুলো। দ্বিতীয় ঘটনা, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি চর্চা তথা অভ্যাসে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলা। ছেলেবেলায় জন্মদিনে উপহার পাওয়া খেলনা গ্রামাফোনে গান শোনা। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি ও আগ্রহটিকে লালন। খুব অল্প বয়স থেকেই চলচ্চিত্র পত্রিকা পড়ে নিজের মনের মধ্যে এই সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গী নির্মাণের চেষ্টা। চলচ্চিত্র দেখার নিয়মিত অভ্যাস। প্রায় রিলিজিয়াসলি এই অভ্যাসের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নেয়া। তৃতীয় ঘটনাটি হচ্ছে, ১৯৪০ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক হওয়ার পর শান্তিনিকেতন যাত্রা। এতোদিন তিনি চিত্রকলার পাশ্চাত্য প্রভাবে আচ্ছন্ন ছিলেন, শান্তিনিকেতন তাঁর সামনে প্রাচ্যের দিগন্তবিস্তারী সৌন্দর্য খুলে দিলো। 'চিনে ল্যান্ডস্কেপ, জাপানি কাঠখোদাই আর ভারতীয় মিনিয়েচার হঠাৎ ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিল আমার চেতনা। ' - 'মাই ডেইজ উইথ অপু'-তে লিখছেন তিনি। এই সময় তিনজন বন্ধুর সাথে অজন্তা, ইলোরা আর খাজুরাহোয় শিক্ষাসফর প্রাচীন ভারতের শিল্পসুষমা বিষয়ে তাঁকে অধিক সচেতন করে তোলে। এই শিল্প ভ্রমণের ব্যাপারটা অনেক পরে ফেলুদা কাহিনিতে ঘুরে ঘুরে আসতে দেখবো আমরা যদিও সেটি অনেকদিন পরের কথা।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের বছরখানেক পর জাপানিদের প্রথমবার কলকাতায় বোমা বর্ষণের দিন শান্তিনিকেতন ছাড়লেন তিনি, গুরু নন্দলাল বসুর আশীর্বাদ নিয়ে, পাঁচ বছরের কোর্স শেষ না করে, গুরু অবশ্য বলেছিলেন, ক্যালিগ্রাফিতে তিনি বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন৷ দ্বিতীয়বার বর্ষণের দিন নিজের শহরে পৌঁছালেন। সিনেমাকে তিনি কেমন করে প্রাণে ধারণ করেছিলেন তার এক নমুনা পাওয়া যাবে এই টুকরো উদ্ধৃতিতে : ' কলকাতা আর সে-কলকাতা নেই, পাল্টে গেছে তার চেহারা। রাস্তাঘাটে গিসগিস করছে মার্কিন সৈন্য। এদিকে বোমার ভয়ে অর্ধেক লোক শহর ছেড়ে চলে গেছে। যারা ছবির ভক্ত, তাদের পক্ষে আবার এটাই ছিল মস্ত সুসময়। কথাটা এইজন্য বলছি যে, হলিউডের টাটকা সব ছবি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর এখানে একইসঙ্গে ছাড়া হচ্ছিল। সে-সব ছবি তখন একটার পর একটা আশ মিটিয়ে দেখে নিয়েছি। ' চতুর্থ ঘটনা, বিজ্ঞাপনের চাকরিসূত্রে তিনি প্রথম বিদেশযাত্রায় ছয়মাস ছিলেন। এই ছয়মাসে নিরানব্বইটা সিনেমা দেখেন।
মে ফেয়ারের কার্জন সিনেমায় একদিন পরপর দুটো ফিল্ম, আ নাইট অ্যাট দ্য অপেরা' এবং 'বাইসাইকেল থিফ' দেখে তাঁর ভেতরে সিনেমা নির্মাণের স্থির প্রত্যয় জন্মালো। পঞ্চম ঘটনা, বিজ্ঞাপন সংস্থায় কিংবদন্তী দিলীপ কুমার গুপ্তের সাথে পরিচয়। এই ভদ্রলোক বাংলা বইয়ের ডিজাইনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিগনেট প্রেসের মাধ্যমে। সত্যজিতের নিজের লেখায় তিনি জানাচ্ছেন, ' বিশুদ্ধ বঙ্গীয় মোটিফের অলঙ্কৃত প্রচ্ছদ, হাতের লেখার ছাঁদে গ্রন্থ-নাম, সেইসঙ্গে কখনও- কখনও তুলি কিংবা কলমে আঁকা ছবি,- বইয়ে এ-কাজ আমিই প্রথম করি।'
অবশ্য তার পাশাপাশি বাংলা প্রচ্ছদের ইতিহাসে খালেদ চৌধুরী এবং পূর্ণেন্দু পত্রীর নাম ভুলে গেলেও চলবে না। তো, দিলীপ বাবু সত্যজিৎকে পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু অলংকরণের দায়িত্ব দেন। ততোদিন, সত্যজিৎ স্বীকার করছেন, গান শোনা ও সিনেমা দেখার বাইরে তিনি বাংলা বই বিশেষ পড়েননি। কলকাতায় জাঁ রেনোয়ার 'দ্য রিভার' চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসা এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে রেনোয়ার কাজ দেখতে যাওয়া যুবক সত্যজিতের ভেতরটা আস্তে আস্তে উল্টেপাল্টে দিচ্ছিলো। মূলত, ভারত শিল্পসন্ধানে ছাত্রকালীন শিক্ষাসফর এবং প্রবাসকালে শখানেক সিনেমা দেখা সত্যজিতের সুনির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক জীবনের দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
দেশভাগের সময় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বংশী চন্দ্র গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্তের মতো মানুষজন ছিলেন তার সভ্য। তাঁরা , জনা পঁচিশ , প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভালো ছবি দেখতে লাগলেন ৷ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঋত্বিক কুমার ঘটকের এক অমর উক্তি:' ঢ্যাঙাটা দেশভাগ দেখে নাই। '
৪.
'আগন্তুক'- এর শেষটা দেখেই চিত্রপরিচালক সত্যজিতের সাথে আমার পরিচয়। এটা মূলত রায়বাবুর ফাইনাল স্টেটমেন্ট। যেমন কুরোসাওয়ার 'ম্যাদাদেও'( নট ইয়েট)। আগন্তুকের মধ্যে সত্যজিতের মনের পৃথিবীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আছে৷ প্রথমত, ওয়ান্ডারলাস্ট বা জার্মান উচ্চারণে ভেন্ডারলুস্ত। দ্বিতীয়ত, কূপমন্ডুক হয়ো না আর তৃতীয়ত, অনামী আদি শিল্পীদের প্রতি প্রণতি। যেহেতু, স্পেনের আলতামিরা গুহার সেই বাইসন আঁকা যাবে না সেই আবেগের সত্যে ফলত 'আর যাই হই, শিল্পী' হতে চাননি মনোমোহন মিত্র। ধর্ম জিনিসটাকে সত্যজিৎ কেমন করে দেখেন, ঈশ্বর বিষয়ে তাঁর ভাবনা এই সিনেমায় অনেক স্পষ্ট। এটা আমার কাছে খুব বিউটিফুল একটা প্রবন্ধের বইও মনে হয় যেখানে জীবনকে অন্য এক মাত্রায় দেখা যায়।
পরে চলচ্চিত্র সংগঠনে যুক্ত থাকার সুবাদে আস্তে আস্তে এই নির্মাতার প্রায় সব সিনেমা আস্বাদনের সুযোগ ঘটে আমার। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার - অপুত্রয়ী এক রাত জেগে দেখবার পর আমার মনে পড়েছিলো এক বিকেলে কিয়েসলোস্কির থ্রি কালার্স দেখার স্মৃতি। দুটি ত্রয়ীই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নির্মাণ কেন আমি আস্তে আস্তে বুঝে উঠছিলাম। যেখানে পোলিশ পরিচালক সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার রঙ দিয়ে চিহ্নিত করতে চান তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রা সেখানে সত্যজিতের অন্বেষণ গন্তব্য নয় কেবল যাত্রার আনন্দ। চরৈবেতি। অপু ফিরে আসছে আবার কাজলের কাছে, এই ফিরে আসার অভিঘাত দৃশ্যমাধ্যমে অমর। পথের পাঁচালী নির্মাণে আড়াই বছর লাগার ও নানারকম বাধাবিপত্তির কথা পড়ে সমীহ জেগেছিলো। আপাদমস্তক নাগরিক সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে কেমন করে গ্রামের গন্ধমাখা পথের পাঁচালীকে এমন অনুপুঙ্খে নির্মাণ সম্ভব হলো তা সেকালে বিস্ময় জাগিয়েছিলো বৈকি ।
অবশ্য ডিটেলিং এ বন্ধু কমলকুমার মজুমদারের সাহায্যের কথা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না । ইন্দির ঠাকুরণের মৃত্যুর পর ঘটি গড়িয়ে পড়া, দুর্গার চুরি করা হার পুকুরে ছুঁড়ে মারলে পুকুরের কচুরিপানায় ফাঁক হয়ে আবার ঢেকে যাওয়ার সংবেদন আর দশটা বাঙালির মতো আমাকেও স্পর্শ করেছিলো । করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মশত নিরবে চলে গেলো । এমন সর্বংসহ চরিত্র তিনি বাদে আর কারো পক্ষে সম্ভব হতো বলে আমি বিশ্বাস করি না । একনিষ্ঠ বামপন্থী কর্মী , মঞ্চাভিনেত্রী, লেখক ও সমালোচক হিসেবে একটা স্বতন্ত্র পরিচয় তাঁর ছিলো । ১৯৫৮ সালে পরশপাথর আর জলসাঘরের মতো দুটি বিপরীত ধরণের চলচ্চিত্র মুক্তি পায় । পরশপাথর রূপকথা ঘরানার, মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ আর পুনর্মূষিকভব চরিত্র এই সিনেমায় হালকা হাসির চালে এসেছে আর জলসাঘরে সত্যজিৎ একটা ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত সমাজকে দেখাচ্ছেন ।
কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিচালকের প্রথম রঙিন ছবি । মজার বিষয় হলো, দার্জিলিং ভ্রমণে সত্যজিতের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর যে কটি ছবি এঁকেছিলেন তার মধ্যে একমাত্র যে ছবিটি রায় পরিবারে সংরক্ষিত সেটি কাঞ্চনজঙ্ঘার চিত্ররূপ । প্রাপ্তবয়স্ক, প্রতিষ্ঠিত সত্যজিতের প্রথম রঙিন ছবি করবার সময় নিজের সপরিবারে দার্জিলিং ভ্রমণের বালকবেলার ও পরবর্তীকালের স্মৃতি কিংবা ঠাকুরদার ছবির অভিঘাত কাজ করেছে কি না ভেবে দেখা পারে। আমাদের মনে পড়তে পারে, ফেলুদার প্রথম আবির্ভাবও দার্জিলিং এ । প্রথম রঙিন ছবিতে সত্যজিৎ রেডিয়েশনের ফলে পাখি বিলুপ্তির আশংকার কথা জানিয়েছেন । মণীষা চরিত্র দেখতে দেখতে মনে পড়ে সুনীলের মণীষাকে যে কি না দরিদ্রকে পয়সা দেবার সময় আত্মার একটা টুকরো খুলে দেয় । এখানে মণীষাকে তার ভগ্নীপতি প্রেমহীন বিয়ে না করবার পরামর্শ দেন । পাহাড়ে এলে সবার মন বদলে যায়। কুয়াশাও কেটে যেতে পারে রোদের আলোতে ।
আমার এক প্রিয় ছবি মহানগর যেখানে একটি লিপস্টিকও প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে পারে । অ্যাংলো এক সহকর্মীর প্রতি ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদে নারী নিজেকে ঠেলে দিতে পারে নিরাপত্তাহীনতার দিকে , সাহস না হারিয়ে । সত্যজিৎ শেষ দিকে, ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্থানের সময় যাকে বলে আউটস্পোকেন হয়ে পড়েছিলেন । নইলে হেনরিক ইবসেনের রূপান্তরের সময় আরো অনেক কিছু ত ছিলো, মন্দির কেন এলো! সেই যে উদ্ধত চিৎকার ' মন্দির ঐখানেই বানাবো' তার সপাট উত্তর ? গণশত্রু , ঘরে বাইরে , শাখাপ্রশাখা আর আগন্তুক এই চার সিনেমায় সত্যজিৎ যেন ফেটে পড়ছেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে । এই সব মিলেই আমার সত্যজিৎ । ভালোবাসি । জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধা জানাই। আশা করি , আমাদের প্রজন্ম তাঁর জীবন ও কাজ থেকে শেখার উপাদানগুলো গ্রহণ করবে ।
( পুনশ্চ : এই লেখায় রায় পরিবার সংক্রান্ত নানা প্রবন্ধের তথ্য বেমালুম আত্মসাৎ করা হয়েছে। লেখাটি বাংলাদেশের সত্যজিৎ গবেষক আনোয়ার হোসেন পিন্টুর করকমলে নিবেদিত হলো।)