সুররিয়ালিজমের ১০০ বছর: স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি

ইজেল

25 April, 2024, 05:20 pm
Last modified: 25 April, 2024, 05:38 pm
‘কুহেলি’ শব্দটা এই ইজমের বেলায় খুব খাঁটি। মনে পড়ে গেল, ‘নটিং হিল’-এ আচমকা হলিউডের নায়িকা জুলিয়া রবার্টস বইয়ের দোকানি হিউ গ্রান্টকে চুমু খেলে তিনি স্বগতোক্তি করেছিলেন–চুমুটা ছিল ‘সুররিয়াল বাট নাইস।’ কেন, সুররিয়াল হলে তা সচরাচর নাইস/চমৎকার/মনোরম হতে পারে না? কেন ওই বৈপরীত্য? 
রেনে ম্যাগরিতের ‘লে ডাবল সিক্রেট’ ১৯২৭। ছবি: বোজার

১. 
আমরা যারা সুররিয়ালিজম বুঝতে চাইতাম

মৃণাল চক্রবর্তীর গলায় একটা গানের কথা মনে পড়ে গেল–
'স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি রেখেছি স্বপনে ডাকিয়া,
স্বপনে তাহারি মুখানি নিরখি, স্বপন কুহেলি মাখিয়া।'

'কুহেলি' শব্দটা এই ইজমের বেলায় খুব খাঁটি। মনে পড়ে গেল, 'নটিং হিল'-এ আচমকা হলিউডের নায়িকা জুলিয়া রবার্টস বইয়ের দোকানি হিউ গ্রান্টকে চুমু খেলে তিনি স্বগতোক্তি করেছিলেন–চুমুটা ছিল 'সুররিয়াল বাট নাইস।' কেন, সুররিয়াল হলে তা সচরাচর নাইস/চমৎকার/মনোরম হতে পারে না? কেন ওই বৈপরীত্য? 

আমাদের ভেতর একটা কথা চালু ছিল, যা কিছু দেখবি কচুকাটা করা হচ্ছে, ওটাই সুররিয়ালিজম। 

ক) হিচককের মুভি 'স্পেলবাউন্ড'-এ দালির তৈরি সেই সুবিখ্যাত স্বপ্নদৃশ্যে চোখ আঁকা পর্দা কুচি কুচি করে কেটে ফেলা হচ্ছে (সিকোয়েন্সটা আদতে ২০ মিনিট দীর্ঘ হবার কথা ছিল)। 

খ) লুই বুনুয়েল আর দালি মিলে চোখকে ক্ষুরে কেটে ভেতরের সব আরক বের করে দিচ্ছেন (দ্য আন্দালুসিয়ান ডগ)।

অস্বাভাবিক ঘটনা– স্বপ্নের মতো মাথামুণ্ডুহীন -উদ্ভট-অযৌক্তিক-হ্যালুসিনেশন এইসব হলো সুররিয়ালিজম। স্থাপত্যের ছাত্র হিসেবে আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন পড়বার সময়ে দেখতে পেলা–

একটি ইজম দাঁড়াল সরণিজুড়ে 
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি। 

কারণ, আর্টের ইতিহাসে যখনই ব্লু রাইডার গ্রুপ দিগ্বিদিকজ্ঞানহীন 'ঘোড়দৌড়' শুরু করলেন, কান্দিনস্কি ছবি আঁকতে শুরু করলেন, মিরো সিরামিক আর্ট শুরু করলেন আর এমন আলু আঁকলেন যা আলু নয়, সব যেন গুলিয়ে গেল। এর আগ অবধি শিল্পীর মনন-মনোভাব-মনোবিকলন সবই যেন বোধ্য, সুন্দর বা মনোরম (এমনকি কুশ্রীতেও সৌন্দর্যের ভিন্ন সংজ্ঞা উপস্থিত)। কিন্তু এরপর কী যেন হলো! ঝানতি পাল্লাম না। আমরা খুদে শিক্ষানবিশ, সমক্ষে শিল্প-স্থাপত্যের অশান্ত পারাবার, হাতে সম্বল অশোক মিত্রের পশ্চিম ইউরোপের চিত্রকলাবিষয়ক বইখানা, খানিকটা গমব্রিখ, ইতিউতি বাংলায় বুদ্ধদেব বসু আর কবীর চৌধুরী। 

‘দি এনিগমা অফ ডিজায়ার’ ৯৫ বছর আগে দালির আঁকা ছবি এখনও দর্শককে বিমোহিত করে, প্রশ্নের মুখোমুখি করে।

ছাত্র হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমরা গভীরভাবে বদ্ধ, কী পরিবারে কী সমাজে; খণ্ড করে না নিলে আকাশপ্রতিম প্রতিভাকেও ধরতে পারি না (নানি-দাদিদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ভারী ভালো কবি; কারণ, তিনি দ্বিতীয় দার-পরিগ্রহ করেননি)। সেই আমাদের সামনে এমন এক ইজম সশরীরে উপস্থিত যে আমাদের এলোমেলো স্বপ্নগুলোকে মর্যাদা দিতে প্রস্তুত, আমাদের অবচেতনের যা কিছু খোলা আলো-বাতাসে আমরা নিজেরাই অস্বীকার করি, তার সবকিছুকে চাক্ষুষ করতে এবং নাম ধরে ডাক দিতে পারঙ্গম। যে আমাদের নয় শুধু, সমস্ত বিশ্বের প্রচলিত ব্যক্তিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-নান্দনিক-সাহিত্যিক-তাত্ত্বিক ভাবনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে এসেছে, ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দিচ্ছে অচেনা আকাশে, কী করে সইব সেই সাংঘাতিককে? আমরা তো চিনি সেই অভিভাবক-শিক্ষক-সমাজকে যারা চিরদিন বলেছে– এটা হবে না, ওটাও হবে না, ওটা অর্থহীন। শিগগির এমন জিনিস উপস্থিত যে মুচকি হেসে বলছে–সবই হতে পারে! সবকিছুকেই আবার নতুন করে উদ্ভাবন করা সম্ভব, নিওক্ল্যাসিসিজম বা প্রির‍্যাফায়ালাইটদের মতো পেছনের দিকে তাকিয়ে নয়, নিজের একান্ত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। 

২. 
শুরুর কথা পটভূমির কথা 

যদিও আমি ভাবতে চাই, রেনেসাঁ আমলের ডাচ শিল্পী হেরোনিমাস বশ সুররিয়ালিজমের আদি পিতা, কিন্তু লোকে বলে নানান খাঁটি জিনিসের মতোই সুররিয়ালিজমেরও শুরু প্যারিসে। ১৯২৪ সালে, কবি আঁদ্রে ব্রেতোঁর ম্যানিফেস্টোর মাধ্যমে। ব্রেতোঁ ভাবতেন সুররিয়ালিজমের কেন্দ্রে রয়েছে বাসনা। এর মূল সুর চমক (জঘন্য হলেও), বিরক্তি, সংঘর্ষ, অশান্তি, উত্তেজনা, ঠাট্টা, ক্ষোভ, ভায়োলেন্স, রহস্য; যে মন যুক্তিগ্রাহ্যকে অস্বীকার করতে পারে, যে আর্ট যুক্তিশীল মনের আঁশের বিপরীতে র‍্যাঁদা বুলিয়ে চলে। 

জন্মলগ্ন থেকে এই শিল্পভাবনা অদম্য, উচ্চাভিলাষী, বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন, প্রায় আকাশচারী, জটিল, অসংগত এবং স্ববিরোধী। সুররিয়ালিজমের শেকড় খুঁজতে গেলে আসবেন ব্লেকের মতো রোমান্টিক, গুস্তাভ মরোর মতো সিম্বলিস্ট ফ্যান্টাসিস্ট, আসবেন অঁরি রুশো। প্রাসঙ্গিক হবেন এডগার অ্যালেন পো, রিল্কে, পরে কাফকা, কামু, বোর্হেস, মুরাকামি, ইশিগুরোও। আমি তো বঙ্কিমের কমলাকান্তকেও ডেকে আনতে চাই এ সভার সভ্য হিসেবে, যদি তিনি আসেন। 

বেলজিয়াম নারী সুররিয়েলিস্ট জেন গ্রাভেলের আঁকা ছবি,‘লিবারেটেড উম্যান’।

১৯১৭ সালে কবি গিয়ম অ্যাপোলিনেয়ার প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন জঁ ককতোঁর ব্যালের বর্ণনা দিতে। ফ্রয়েড এই ইজমের পেছনে খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক, অবচেতন কী করে আমাদের অজান্তেই আমাদের জীবনকে চালিত করে, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন তিনি, স্বপ্নের অনুবাদ নিয়ে এসেছিলেন 'দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস'-এ। 

ইউরোপ তখন প্রথম মহাযুদ্ধে খাবি খাচ্ছে, মানুষ তখন বিশ্বযুদ্ধের অভাবনীয় ক্ষয়ক্ষতি সামলাতে ব্যতিব্যস্ত, শিল্পে এসেছে ডুশ্যাম্প-জারা-হাউসম্যানদের দাদাইজম, প্রতি-চিত্রকলা? অনেক শিল্পীই সেকালে মহাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অথবা বিহ্বল হয়ে নিজের শহরকে পরাস্ত হতে দেখেছেন, চোখের সামনে আপন মানুষকে মরতে দেখেছেন। তাঁরা এমন একটি শিল্পভাবনাকে খুঁজছিলেন, যা তাঁদের সেই সময়ের বিপন্নতাকে ভাষা দেবে। জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারা নয় কেউ কেউ খুঁজেছিলেন উন্মাদ কোনো অর্থহীনতার ধারাকে।

দাদাইজমের সাক্ষাৎ শাগরেদ হিসেবে এসে গেল সুররিয়ালিজম। সে সময়কার আর্টে নিয়ে এল স্বপ্ন এবং অবচেতনের আলোড়ন। য পলায়তি স জীবতি। সর্বদেশলেহী সর্বসংহারী ভয়ানক বাস্তব থেকে পলায়নের পন্থা হয়ে গেল অনর্গল মানব-মনের ভেতরকার সেই অনন্ত ল্যাবিরিন্থ। তা সাবকনশাস/অবচেতন তো খিড়কিদরজায় ছাতিমতলায় চকিতে দেখা দেয়া পরী, সে কি আর ডাকলেই আসে? 

একরকম সুররিয়ালিস্ট আর্টের বিষয়–স্বপ্নের উপাদান, ফ্রয়েডীয় সিম্বলে ঠাসা। আরেক রকমের বিষয় 'অটোম্যাটিজম' (অবলীলা-বিলাস?), কিছু না ভেবে শুধু তুলি বা কলম চালিয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে যা মনের ভিতর থেকে মন্থন করা দুধের মাখনের মতো ভেসে ওঠে, সাহিত্যে এসে যা স্ট্রিম অব কনশাসনেস বা চেতনাপ্রবাহ; যাকে আমরা গাল ভরা নামে ডাকি–প্রবৃত্তি।

সাজানো-গোছানো-নির্ধারণ করে দেয়া সমস্ত সামাজিক নিয়মকে পিছে হঠিয়ে দিয়ে সেই গোপনবাসীর কান্নাহাসি তুলে আনা। 

‘দি কাট গ্লাস বাথ’ রেনে ম্যাগরিৎ, ১৯৪৬।

৩. 
গোঁফ দিয়ে যায় চেনা

আরেকটি কাজ সুররিয়ালিস্টরা শুরু করলেন, যাকে বলে- জাক্সটাপজিশন। অর্থাৎ যারা পাশাপাশি যায় না, অন্বয় হয় না বরং যারা পরস্পরসংঘাতী, এমন সব জিনিসকে একত্র করে আর্ট নির্মাণ। যেমন সালভাদর দালির লবস্টার টেলিফোন (১৯৩৬), মেরেট অপেনহাইমের রোমশ চামড়ার কাপ-পিরিচ-চামচ (ডোরা মার এবং পাবলো পিকাসোর সঙ্গে আড্ডার ফসল)। সুররিয়ালিস্টরা আর্টের প্রসেসের ওপরও এর নির্মাণ ছেড়ে দিতেন। আঁদ্রে ম্যাসন রং মেশানো আঠার ওপর বালু ঢেলে ছবি আঁকতেন, এর্নস্ট ভিক্টোরীয় ছবির সঙ্গে এনসাইক্লোপিডিয়ার ছবির কোলাজ করতেন, কেউ ফটোগ্রাফিক নেগেটিভে আগুন লাগিয়ে দিতেন। 

হিউমার নয় শুধু, এই আর্টের উদ্দেশ্য গভীর অস্বস্তির উদ্রেক করা, ম্যাক্স এর্নস্টের ১৯৩৭ সালের পেন্টিং 'দ্য ট্রায়াম্ফ অব সুররিয়ালিজম'-এর কথা ভেবে দেখুন, রিক্ত আকাশের পটভ'মিতে দাঁড়িয়ে ওটা কি প্রাণী আনন্দে নাচছে– ওটা কি কাপড়ের তৈরি নাকি মাংসপেশির? সুররিয়ালিজমের প্রকাশসূত্র হিসেবে পেইন্টিং-এর পাশাপাশি প্রচুর ভাস্কর্য এবং ইনস্টলেশন ব্যবহৃত হয়। সুররিয়ালিস্টের আর্ট সৃষ্টির উপাদান সহজলভ্য, কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস (ফাউন্ড অবজেক্ট), অনেক সময় সেসব কারখানায় পাইকারি দরে তৈরি- যেসব জিনিস সকলেই চেনে। কিন্তু সুররিয়ালিস্ট তাতে টুইস্ট ঢুকিয়ে দেন—

ক) অপেনহাইমের চেনা টেবিলটা দাঁড়িয়ে আছে পাখির দুই ঠ্যাঙের ওপরÑযেন নারীর মেটাফর, সে গৃহস্থের আসবাব, কিন্তু কোথায় যেন যথেষ্ট ভরসা নেই ভারসাম্য নেই, যেন টেবিলটা একটা জন্তু, যাকে ঠিক পোষ মানানো যায়নি। 

খ) ডাঁটিওয়ালা চশমাটা শুধু এক চোখের, 

গ) দালির টুকটুকে লাল সোফাটা দেখতে ঠিক যেন লিপস্টিক দেয়া ওষ্ঠাধর, যেন ওটা পুরুষের ব্যবহার্য কোনো বস্তু, যদৃচ্ছা পুরুষ তাতে আসন নিতে পারে। 

ঘ) রেনে ম্যাগ্রিৎ পাইপ এঁকে তলায় লিখে দিলেন– এটা পাইপ নয়। (দ্য ট্রেচারি অব ইমেজেস ১৯২৯)

ঙ) ম্যান রে ইস্ত্রির তলায় জুড়ে দিলেন এক সারি পেরেক (দ্য গিফট, ১৯২১)। 

চ) দালির ঘড়িগুলো গলে গলে পড়ছে এমন একটা দীর্ঘক্ষণ জীবের ওপর, যেটা পাখি না মানুষের প্রোফাইল বোঝা যায় না, পকেটঘড়িটার ওপর একগাদা পিঁপড়া (দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমরি)।

দালির জিরাফ আগুনে পুড়ছে, যে কিনা দালির মতে কেয়ামতের আলামত– এ যেন ইউরোপ জুড়ে হিটলারের উত্থানের আগামবার্তা (দ্য বার্নিং জিরাফ ১৯৩৭), দালির নারীদের শরীরে চেস্ট অব ড্রয়ার্সের মতো একাধিক দেরাজ– কেননা ফ্রয়েড ভাবতেন মানুষের মন ও রকম একাধিক ড্রয়ার ধারণ করে রয়েছে- মনের গোপন কথায় সেসব বোঝাই।

সিনেমায় সুররিয়ালিজমের কথা লিখতে গেলে আলাদা করেই লেখা উচিত, লেখা উচিত কিউব্রিক-বুনুয়েল-অ্যারনফস্কি-বার্গম্যান-লি -টিম বার্টনের কথা, আরও বড় পরিসরে। হিচককের 'স্পেলবাউন্ড' সাইকো-অ্যানালিসিসের ভিত্তিতে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত মুভি। কম্পটন বেনেটের মেলোড্রামা 'দ্য সেভেন্থ ভেইল'-এর কথা এখানে মনে পড়ছে, সাবকনশাস নিয়ে এমন তিক্তমধুর গল্প, জেমস মেসনের অভিনয়গুণে যা অপার্থিব বিষণ্ণ রূপ নিয়েছে। 

ফ্রিদা কাহলোর ‘টু ফ্রিদাস’ ১৯৩৯।

৪. 
গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পারো

সুররিয়ালিজমের প্রাণপুরুষ সালভাদর দালি, ইগোর জন্য সুবিদিত। দালি একটি প্রক্রিয়া ব্যবহার করতেন, যার নাম প্যারানইয়াক ক্রিটিক্যাল মেথড, হ্যালুসিনেটিং ওষুধ খেয়ে সেই সময়কার ধোঁয়াশা আর উদ্ভট কল্পনা থেকে আর্ট সৃষ্টি করতেন, বলতেন– আই ডোন্ট ডু ড্রাগস, আই অ্যাম ড্রাগস। ইগোর প্রথম কথাই কিনা সোহম, আমিই স্বয়ং।

সুররিয়ালিজমের আরেক অধিশ্বরী ফ্রিদা কালোও ছিলেন ইগোর প্রতিমা, জীবদ্দশায় বিরচিত ১৪৩টি ছবির ভেতর ৫৫টিই তাঁর সেলফ পোর্ট্রেট; আর্টের বয়েজ-অনলি ক্লাবের পুরুষদের যিনি ঘুরে তাকাতে বাধ্য করেছিলেন, সুররিয়ালিস্ট শিল্পী আঁদ্রে ব্রের্তো যাঁকে নিয়ে বলেছিলেন– এ যেন ফিতেয় বাঁধা বোমা। দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে ডিভোর্সের পরিপ্রেক্ষিতে আঁকা ফ্রিদার দ্য টু ফ্রিডাস ছবির কথা ভেবে দেখুন– ঘনঘোর আকাশের পটে দুই নারী, দুজনই ফ্রিদা, উচ্চবিত্তদের মতো কাপড় পরা ফর্সা ফ্রিদা সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গী ফ্রিদার পাশে হাত ধরাধরি করে বসে আছেন, একটি নাকি যে ফ্রিদাকে দিয়েগো ভালোবাসতেন আর অপরটি যাঁকে দিয়েগো ভালোবাসতে পারেননি, উভয়ের হৃৎপিণ্ড দৃশ্যমান (দৃশ্যমানতা ফ্রিদার ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, দিয়েগো অন মাই মাইন্ড ছবিতে ফ্রিদার কপাল ফুঁড়ে কপালের লিখনের মতো দিয়েগো দৃশ্যমান, ফ্রিদা অ্যান্ড দ্য সিজারিয়ানে শরীরের ভেতরকার ভ্রুণ দৃশ্যমান), কৃষ্ণা ফ্রিদার হাতে দিয়েগোর একখানা ছোট্ট পোর্ট্রেট, ফর্সা ফ্রিদার হাতে কাঁচি যা দিয়ে হৃৎপিণ্ডের নালি কাটা– টপটপ করে রক্ত ঝরছে, সেই রক্তই যেন ফর্সা ফ্রিদার ফর্সা কাপড়ে ফুলের প্রিন্ট হয়ে উঠছে।

ফ্রিদা নিজে যদিও সুররিয়ালিস্ট হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে চাননি, রোমান্টিক অ্যালিগরি আর মেক্সিকান ফোক আর্টের ব্যবহার ফ্রিদার সুররিয়ালিস্ট যাত্রাকে এমন এক নাটকীয়তা দিয়েছে, যার মানবিকতা-কাতরতা-উজ্জ্বলতা এবং সার্বজনীনতা সুররিয়ালিজমকেই এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। 

ফ্রিদা কালো ছাড়াও ডরোথিয়া ট্যানিং, লিওনোরা ক্যারিংটন, ডোরা মার, মেরেট অপেনহাইম একঝাঁক উজ্জ্বল নারী শিল্পীর নাম যুক্ত হয়েছে এই মুভমেন্টে। পুরুষ শিল্পীকে উদ্বুদ্ধ করা মানস-সহচরী, প্রেরণা কিংবা মিউজ হিসেবে নয়, স্বয়ং শিল্পী হিসেবে তাঁরা স্থান করে নিয়েছেন সুররিয়ালিজমের ইতিহাসে। অত প্রতিভাদীপ্ত হবার পরেও মারি কাসাট বা বের্ত মরিজো বা ইভা গঞ্জালেস যেমন পুরুষ ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের আলোর বলয়ে নিষ্প্রভ রয়ে গেছিলেন, তেমন হয়নি এঁদের বেলায়। 

ফার্স্ট সুররিয়েলিজম মেনিফেস্টো’ ১৯২৪ ঘোষণায় আঁদ্রে ব্রেতোঁ. দালিসহ অন্যরা ছবি, দালি মিউজিয়াম।

৫. 
যাও গান আনবিক বোমাটাকে ধরো

যুদ্ধের সঙ্গে এবং জাতীয় বিপ্লবের সঙ্গে সুররিয়ালিস্ট মুভমেন্টের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ রয়েছে। দালির সঙ্গে স্পেনের ফ্যাসিস্টবিরোধী যুদ্ধের, রেমেদিয়াস ভারোর সঙ্গে ফ্যাসিস্ট ইউরোপের। অনেক সুররিয়ালিস্ট যুদ্ধের কারণে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই মুভমেন্ট উপনিবেশবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং বুর্জোয়াবিরোধী। সুররিয়ালিস্ট ক্লদ কাহুন এবং মার্সেল মুর ছদ্মবেশে জার্মান সভায় ঢুকে নাৎসিবিরোধী প্রপাগান্ডা ছড়াতেন। 

রেনে ম্যাগ্রিতের আঁকা আকাশ থেকে অঝোরে ঝরত একই রকম ট্রে  কোট আর বোলার হ্যাট পরা সাধারণ বৃত্তির লোক, প্রজাতন্ত্রের যেকোনো মানুষ– যাদের চেহারা ঢেকে যেত উড়ন্ত গাঙচিল/আপেল/একগোছা ফুলে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা? নাকি জীবন বইবার ভার? নাকি জলে ডুবে আত্মহত্যা করা মায়ের মৃত মুখ ঢেকে ছিল ভেজা কাপড়ে– চৌদ্দ বছরের রেনের সেই ভয়ানক ট্রমা? রেনে অবশ্য বলেছিলেন, তাঁর কাজ রহস্য তৈরি করা, রহস্য তা-ই, যাকে জানা অসম্ভব (আননোয়াবল)। 'ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল', কত রকম কারণেই তো হতে পারে। 

এক মহাযুদ্ধ থেকে আরেক মহাযুদ্ধ ছিল সুররিয়ালিজমের আয়ু, অথচ এখনো বিশ্বজোড়া শিল্পীর কুশলতায় সুররিয়ালিস্টদের অসম্ভবের গান সুর তোলে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.