দস্যুতার স্বর্ণযুগ: পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান

ইজেল

24 March, 2024, 03:00 pm
Last modified: 25 March, 2024, 02:33 pm
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, পর্তুগাল এবং স্পেনের মতো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো রমরমা ব্যবসা করে প্রচুর সম্পদ তৈরি করছিল, হয়ে উঠেছিল প্রভাবশালী। তবে তখন বাণিজ্য যেমন বেড়েছে, তেমনি জলদস্যুতাও বেড়েছে। ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে হাজার হাজার জলদস্যু ধনী বণিক জাহাজগুলোকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। তাদের পাকড়াও করার সমস্ত প্রচেষ্টাকেও তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গেছে।
কুখ্যাত পাইরেট সর্দার ব্ল্যাকবিয়ার্ড, রবার্ট মেনার্ডের বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার আগে এই তৈল চিত্র, ১৭১৮। ছবি: কর্বিস/কর্ডন প্রেস

জলদস্যুদের কথা ভাবলে পাঠকের চোখের সামনে কী ভেসে ওঠে? এক চোখে পট্টি, নাবিকের রুক্ষ চেহারা কিংবা গুপ্তধনের সন্ধানে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া দস্যুবাহিনীর পালতোলা জাহাজ। এই তো মাত্র কয়েকটা বিষয় বললাম। প্রতিটির সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে দস্যুতার স্বর্ণযুগে। ১৫ শতকে শুরু হয়ে সেটি স্থায়িত্ব পেয়েছিল তিন'শ বছর।

তৎকালে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ আর আমেরিকার বিভিন্ন উপকূল ছিল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র: ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার সংযোগস্থল। ভারী বোঝাই জাহাজে সে সময় আনা হতো ক্রীতদাসদের; সাথে থাকত চিনি, মূল্যবান ধাতু, তামাক ও কফি।

ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, পর্তুগাল এবং স্পেনের মতো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এসব দিয়েই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল, রমরমা ব্যবসা করে প্রচুর সম্পদ তৈরি করছিল। তবে তখন বাণিজ্য যেমন বেড়েছে, তেমনি জলদস্যুতাও বেড়েছে। ১৮ শতকের মাঝামাঝিতে হাজার হাজার জলদস্যু ধনী বণিক জাহাজগুলোকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। তাদের পাকড়াও করার সমস্ত প্রচেষ্টাকেও তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গেছে।

তবে ১৬ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কিন্তু অনেক ইউরোপীয় দেশও কোনো কোনো বিখ্যাত জলদস্যুর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সে সময় এই দস্যুরা পরিচিত ছিল 'প্রাইভেটিয়ার্স' নামে। শত্রুর জাহাজ, ব্যবসায়িক এবং নৌ– সবকিছু লুটপাট করার জন্য সরকারি কমিশন ছিল তাদের। এদের মধ্যে কেউ কেউ, যেমন এক্সপ্লোরার স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক দেশপ্রেমিক, জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত। ড্রেক তার শোষণ চালাতে সক্ষম হয়েছিলেন; কারণ, ১৫৭২ সালে রানি প্রথম এলিজাবেথ দ্বারা জারি করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠির বাহক ছিলেন তিনি। সেটি তাকে স্প্যানিশ জাহাজে অভিযান চালানোর অধিকারও দিয়েছিল।

আবার ১৬ শতকে উত্তর আফ্রিকার বারবারি উপকূল বরাবর কর্সেয়াররা এমনই প্রাইভেটিয়ার ছিল। অবশ্য পরে শব্দটি জলদস্যুদের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা শুরু হয়। 'বুকানিয়ার' এবং 'ফ্রিবুটার' শব্দ দুটি ১৭ শতকে উদ্ভূত হয়। বুকানিয়াররা ছিল দুঃসাহসী, হিস্পানিওলাতে বসতি স্থাপন করেছিল তারা। আজকের দিনে দ্বীপটি হাইতি এবং ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বিভক্ত। বনের গবাদিপশুর মাংস খেয়ে বাঁচত, বোকান নামের একটি দেশীয় ধোঁয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে এই মাংস তারা সংরক্ষণ করত। ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তারা ফ্রিবুটারদের মতোই জলদস্যুতায় লিপ্ত হতে শুরু করে, ডাচ শব্দ 'ভ্রিজবুটার' থেকে শব্দটি উদ্ভূত, যার অর্থ হলো 'যে ব্যক্তি স্বাধীনভাবে লুট করে'।

জলদস্যুতার সূত্রপাত

১৭১৩ সালে ইউট্রেখট চুক্তি ইউরোপে যুদ্ধরত দেশগুলিতে স্থিতাবস্থা এনেছিল। ফলস্বরূপ, তৎকালে তাদের নৌবাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, আর কাজের সন্ধানে অসংখ্য নাবিক ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেকেই ভেবে দেখলেন যে কার্যকর একটা বিকল্প পেশা হতে পারে দস্যুতা। আবার অনেকে এমন বণিক জাহাজে ছিলেন, যেখানে আয় ছিল যৎসামান্য, আর জাহাজের ভয়ানক অবস্থা তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী পেশায় উদ্বুদ্ধ করে। শত্রু জাহাজকে বন্দী করার পরে জলদস্যুদের মর্যাদাও বেড়ে যেত। কিন্তু সমস্ত বন্দী সদস্যকে তাদের প্রতিপক্ষের সাথে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়নি। অনেকে বরং স্বেচ্ছায় দল পরিবর্তন করেছেন।

কোনো কোনো নারীও কুখ্যাত জলদস্যুর খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ জলদস্যু ছিল যুবক। ১৮ শতকের শুরুতে তাদের গড় বয়স ছিল ২৭ বছর। অর্থাৎ ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে থাকা ও বণিক জাহাজের নাবিকদের সমবয়সী। অবশ্য বয়সের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বৈচিত্র্য না থাকলেও সেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য ছিল: ইউরোপীয়, নেটিভ আমেরিকান এবং আফ্রিকানসহ নানান জাতির মিশেল ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষেরা প্রায়ই দাসত্বের জীবনের বিকল্প হিসেবে জলদস্যুতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন। তবে আরও অনেক কারণে মানুষ এই জাহাজগুলিতে এসেছিল। কেউ স্বাধীন ছিলেন, আবার কেউ কেউ দাসজীবন থেকে পালিয়েছিলেন। কেউ ছিলেন বিদ্রোহী নাবিক, আবার কেউ হয়তো জলদস্যুদের হাতে বন্দী।

ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জলদস্যুদের অধিকাংশ ছিল ইউরোপীয় ও কালোরা। ছবি: প্রিজমা আর্কাইভো

জলদস্যুর জীবন

জীবন এখানে বড্ড কঠিন; সুস্বাস্থ্য, শক্তসমর্থ শরীর এবং সহিষ্ণুতা, আর অবশ্যই যৌবন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সবাই ছিল অবিবাহিত। বেশির ভাগ জলদস্যু কাপ্তান অসংলগ্ন, পারিবারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, ছন্নছাড়া কর্মীদের পছন্দ করতেন; কারণ, তাদের পারিবারিক কারণে বাকিদের ফেলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। ধারণা করা হয় যে, ১৭১৬-১৭২৬ সালের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ জলদস্যু বিবাহিত ছিল।

ক্রুয়ের সংখ্যা অবশ্য একেক জায়গায় একেক রকম। গড় আকার ছিল প্রায় ৮০ জন পুরুষ। অবশ্য এটি একটি বণিক জাহাজের স্বাভাবিক সদস্যসংখ্যা থেকে অনেক বেশি, সেখানে গড়পড়তায় ২০ জনের বেশি দেখা যায় না।

জলদস্যুদের আজীবনের জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে হতো না। যারা কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দী হয়েছেন ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তারা বাদে অনেক জলদস্যুই কয়েক বছর পর অবসর নিতে পারত। তবে এটি মূলত পর্যাপ্ত সম্পদ ও টাকা জোগাড় করে নেওয়ার পরই। ক্যাপ্টেন জনসন বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে কেপ ভার্দেতে আফ্রিকান উপকূলে মেরামতের জন্য থামার পর, ওয়েলশ জলদস্যু হাওয়েল ডেভিস স্থানীয় নারীদের প্রেমে পড়ে যাওয়া পাঁচজন ক্রু সদস্যকে ফেলে রেখে গেছিলেন।

অনেক সূত্র থেকে সেই যুগে জলদস্যু সংস্কৃতি কী রকম ছিল, তার একটি ধারণা বিশেষজ্ঞরা পান। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হলো 'আ জেনারেল হিস্ট্রি অব দ্য রবারিস অ্যান্ড মার্ডারস অব দ্য মোস্ট নোটোরিয়াস পাইরেটস'। যদিও এখানে কিছু অতিরঞ্জন থাকার সম্ভাবনা আছে। ১৭২৪ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির লেখক ছিলেন ক্যাপ্টেন চার্লস জনসন। কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তার দাবি যে জনসন মূলত ড্যানিয়েল ডিফোর ছদ্মনাম। পাঠক রবিনসন ক্রুসো পড়েছেন নিশ্চয়ই। সেই বিখ্যাত বইয়ের লেখক ডিফো। চিঠিপত্র, ঔপনিবেশিক ও নৌ প্রতিবেদন, জলদস্যুদের প্রাক্তন বন্দীদের বিবৃতি এবং সংবাদপত্রের নিবন্ধ সেই দুই দশকে জলদস্যুতা সম্পর্কে অনেক তথ্য সরবরাহ করে। ফলে জলদস্যুদের জীবন সেই সময় কেমন ছিল, তা বুঝতে ইতিহাসবিদদের সুবিধা হয়েছে।

দস্যুরানি

অ্যান বনি ছিলেন একজন আইরিশ নারী। বাহামা দ্বীপপুঞ্জের এক নাবিকের স্ত্রী। বাহামার রাজধানী নাসাউয়ে একটি সরাইখানা পরিচালনা করতেন তিনি। জন র‍্যাকহ্যাম বা ক্যালিকো জ্যাক নামে পরিচিত বিখ্যাত ডাকাত সর্দারের সেই সরাইখানায় ছিল নিয়মিত বিচরণ। একসময় গিয়ে অ্যানের সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়। পুরুষের বেশভূষায় নিজেকে সজ্জিত করে অ্যানও যোগ দেন সেই ডাকাতদলে। অবশ্য তাদের জাহাজেই আরেকজন নারী ছিলেন। ম্যারি রিড তার নাম। ইংরেজ এই নারী নিজেও বনির মতো পুরুষের বেশভূষায় সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেও ডাকাতদলে নাম লেখান। দুইজন নারীই যুদ্ধে প্রবল শারীরিক শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন।

জ্যামাইকার কাছাকাছি কিছু জলদস্যুকে একসময় ব্রিটিশ বাহিনী পাকড়াও করেছিল। সেখানেই ক্যালিও জ্যাকের ফাঁসি হয়। নিজেদের গর্ভবতী প্রমাণ করে দুইজন নারী সেই যাত্রায় ছাড়া পান। ম্যারি জ্বরে ভুগে কয়েদখানায় মারা গিয়েছিলেন। অ্যান ফিরে এসেছিলেন নিজের বাবার কাছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনায়।

১৯০৫ সালে জলদস্যুদের গল্প নিয়ে 'দ্য ফেট অফ আ ট্রেজার-টাউন' আঁকেন হাওয়ার্ড পাইল। ছবি: ব্রিজম্যান/এসিআই

দস্যু জাহাজের রকমফের

সেই স্বর্ণযুগে অনেক জলদস্যুর সেরা জাঁকজমকপূর্ণ ও সবচেয়ে উন্নতমানের জাহাজ ছিল। দ্রুত ও নমনীয় সেসব জাহাজে গোটা দশেক কামান সংরক্ষণ করার মতো জায়গা ছিল। ক্রুদের লক্ষ্য ছিল বৃহৎ নৌকা, যেমন তিন মাস্তুলসংবলিত 'বারক' জাহাজ, তিরিশেক কামান দিয়ে সেসব সজ্জিত। এই ধরনের জাহাজ তাদের যুদ্ধজাহাজকে আরও শক্তিশালী করে। যেমন ব্যাকবিয়ার্ডের জাহাজ 'কুইন অ্যান'স রিভেঞ্জ'-এ ৪০টি বন্দুক ও বার্থলোমিউ রবার্টসের 'রয়্যাল ফরচুন'-এ ৪২টি বন্দুক ছিল।

দস্যুদের জাহাজে থাকা বন্দীদের কাছ থেকে দস্যুজীবনের বিবরণ উঠে এসেছে। ১৭২২ সালের একটি বিবৃতিতে যেমন একজন বলেছেন, 'আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এ রকম কুখ্যাত নরকের মধ্যে আটকে পড়ার চেয়ে মৃত্যুই ভালো। ... ওরা সারা দিন অবিরত মদ খেয়ে উৎসব করে, যাচ্ছেতাইভাবে গালিগালাজ করে। ধর্মভীরুতার লেশমাত্র এখানে নেই। ক্ষণিকের বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই।'

জলদস্যুদের জাহাজে যে বণিক জাহাজের মতো কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়নি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, এখানে লোকসংখ্যাও ছিল বেশি। তাই তারা মদ্যপান, জুয়া খেলা এবং গানবাজনার জন্য অবসর পেত। প্রায়ই মারামারি লেগে যেত; কারণ, অন্যের সম্পদ লুটপাট করার উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো মিল তাদের মধ্যে ছিল না।

তা সত্ত্বেও অনেকের মতে, জলদস্যু জাহাজগুলিতে কিছু ক্ষেত্রে নিয়মশৃঙ্খলা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, সদস্য ও জাহাজকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, তাদের প্রহরীর দায়িত্ব নির্ধারিত করতে হতো। মাস্তুল তোলার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার পাশাপাশি বার্ট রবার্টসের মতো কিছু নাবিকের নির্দিষ্ট আচরণবিধিও ছিল। যেমন জুয়া খেলা, মারামারি এবং নিচের ডেকে মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল। আর প্রত্যেক ব্যক্তির অংশীদারত্ব, জামাকাপড় এবং অবশ্যই লুটের অংশ অগ্রিম বরাদ্দ করা থাকত। জলদস্যু আক্রমণের সময় কাপ্তানদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বহাল থাকত।

এই জাতীয় নিয়ম প্রায়ই পুরো ক্রু দ্বারা অনুমোদিত হতো। তারা পর্যায়ক্রমে তাদের অধিনায়ক নির্বাচিত করত। অন্যান্য নৌযানের শ্রেণিবিন্যাস থেকে এই নিয়মটি একদমই ভিন্ন। জলদস্যু ক্রুরা প্রায়ই অত্যন্ত মেধাবী হতেন। দলের মধ্যে যোগ্যতমকেই কাপ্তান হিসেবে বেছে নেওয়া হতো, যার সমুদ্র নিয়ে অগাধ জ্ঞান আছে কিংবা খুব শক্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী; যেন বিশৃঙ্খল অবস্থায় তিনি শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারেন। সামাজিক অবস্থানকে এখানে আমলে নেওয়া হতো না। ফলে যোগ্যতার ভিত্তিতে অনেকে দ্রুতই উপরে উঠে আসতে পারতেন।

জলদস্যুদের আক্রমণে অবরুদ্ধ বণিক জাহাজ। ১৯ শতকের চিত্র। ছবি: আর্ট আর্কাইভ

দস্যুদের ডেরা: আস্তানা ও আশ্রয়স্থল

জলদস্যুতা সেসব জায়গাতেই চাঙা হয়েছে, যেখানে ক্রুরা বিশ্রামের জায়গা পেয়েছে আর তাদের জাহাজগুলি মেরামত করা সম্ভব। এজন্যই লুকানো খাদ ও জনবসতিহীন দ্বীপপুঞ্জ ক্যারিবিয়ান দস্যুদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল। অবশ্য দ্রুতই পোতাশ্রয়ের কাছাকাছি জায়গাগুলোতে তাদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল। এখানে কাপ্তানেরা সহজেই নতুন লোকজনকে নিয়োগ করতে পারতেন। যেমন হিস্পানিওলার উপক'লে টর্টুগা দ্বীপ (হাইতিতে অবস্থিত)। পরে টর্টুগার স্থলাভিষিক্ত হয় জ্যামাইকার প্রধান বন্দর পোর্ট রয়্যাল। 'বিশ্বের সবচেয়ে পাপী শহর' হিসেবে খেতাব পেয়েছিল এটি। পরে অবশ্য ১৬৯২ সালে একটি ভ'মিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়।

জলদস্যুতার স্বর্ণযুগে বাহামার নাসাউ ছিল এর নিউক্লিয়াস: কেন্দ্রবিন্দু। ইংরেজ গভর্নররা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর, একটি শক্তিশালী জলদস্যু প্রজাতন্ত্র সেখানে গড়ে ওঠে। সেই সময়ের বিখ্যাত জলদস্যুদের দিয়ে ফিরিয়ে আনা লুটের মাধ্যমে এর অর্থায়ন করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড, চার্লস ভেন, জন র‍্যাকহাম (ক্যালিকো জ্যাক), স্যামুয়েল বেলামি (ব্যাক স্যাম), এডওয়ার্ড টিচ (ব্যাকবিয়ার্ড) এবং বার্থলোমিউ রবার্টস (ব্যাক বার্ট) প্রমুখ।

১৭ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ধনী শহরগুলোতে ঘন ঘন জলদস্যুদের আক্রমণ হতো। পোর্টোবেলো, কার্টেজেনা, হাভানা এবং পানামা সিটির মতো স্প্যানিশ শহরগুলো তত দিনে তাদের লোভনীয় লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। বারবার তারা এই শহরগুলোতে লুটতরাজ চালিয়েছে। আবার উত্তর আমেরিকায় ব্যাকবিয়ার্ডের তাণ্ডবও লক্ষ করা গেছে ১৭১৮ সালের সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লস্টনের সফল লুটে।

অরক্ষিত বণিক জাহাজগুলো আক্রমণের শিকার হতো সবচেয়ে বেশি। খুব কমসংখ্যক জাহাজই জলদস্যুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে। একবার জাহাজে উঠে যেতে পারলে, জলদস্যুরা পণ্যসম্ভার খুঁজে বের করত কিংবা পেতে জাহাজের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সেসব বের করে আনত। এখানে বিশেষভাবে পৈশাচিক দস্যু নাবিকের ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যায়। বেশ কজন ভুক্তভোগীর বয়ান অনুযায়ী, চার্লস ভেনের মধ্যে নাবিকদের নির্যাতন করার প্রবণতা ছিল। সমসাময়িক আরেক জলদস্যু এডওয়ার্ড লোর ব্যাপারে জানা যায় যে আত্মসমর্পণের আগে জাহাজের মালামাল পানিতে ফেলে দেওয়ার কারণে তিনি পুরো জাহাজের ৩২ জন সদস্যকে হত্যা করেছিলেন।

জলদস্যুরা যা কিছু লুট করতে পারত, তা দখল করতে পারলেই খুশি ছিল। যেমন স্বর্ণ, রুপা, রত্ন এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিস। তবে তারা সব সময় যে ধনরত্ন খুঁজত, তা নয়। তামাক, চিনি এবং কোকো লাভজনক পণ্য ছিল। স্বর্ণযুগে এসব পণ্য বন্দরে এনে প্রতিবেশী দ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ বণিকদের কাছে বিক্রি করা হতো। এই জলদস্যুদের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান লুট ছিল একটি পালতোলা নৌকা।

ব্রিটিশ উপনিবেশকে দুর্বৃত্ত জলদস্যু এবং ফরাসিদের হাত থেকে বাঁচাতে সেন্ট কিটসে নির্মিত হয় ব্রিমস্টোন হিল। ছবি: গ্যাভিন হেলিয়ার/কর্বিস/কর্ডন প্রেস

অবশ্য এই স্বর্ণযুগের ইতি একসময় এসেছে। ১৭ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপীয় দেশগুলি শক্তিশালী দস্যুবিরোধী আইন প্রবর্তন করতে শুরু করে। নিজ নিজ এলাকায় যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আর যারা জলদস্যুদের ধরিয়ে দেবে, তাদের জন্য পুরস্কার (বাউন্টি) ঘোষণা করে। ১৭০৯ সালে মাদাগাস্কারে জলদস্যু এবং বুকানিয়ারদের স্ত্রী এবং আত্মীয় এমন ৪৭ জন নারী ইংল্যান্ডের রানি অ্যানকে সাধারণ ক্ষমার জন্য একটি আবেদনও পাঠিয়েছিলেন। এই ঘটনার আট বছর পর জলদস্যু অধিনায়ক এবং সদস্যদের সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দিয়েছিল ইংল্যান্ড। যদি কেউ এতে বারণ করে, তাহলে যদি এবং যখন তারা ধরা পড়বে, তখন তাদের কোনো করুণা হবে না বলে হুমকিও দিয়েছে।

পরবর্তী সময়ে বুকানিয়ার ক্যাপ্টেনদের এক এক করে পতন ঘটতে থাকে। ব্যাক স্যাম ১৭১৭ সালে একটি জাহাজডুবিতে মারা যান। পরের বছর ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে ব্যাকবিয়ার্ড মারা যান। ১৭২০ সালে জ্যামাইকায় ক্যালিকো জ্যাকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল; আর ১৭২২ সালে গিনি উপসাগরে ব্যাক বার্টকে হত্যা করা হয়। যা এখনো মুছে দেওয়া সম্ভব হয়নি বা সামনেও হয়তো হবে না, তা হলো সেই দস্যুতার কল্পনা-বাস্তবের মিশেলে গড়ে ওঠা রোমাঞ্চকর সব গল্প-অভিজ্ঞতা। যুগ থেকে যুগান্তরে সেই ফ্রিবুটিংয়ের স্মৃতি, নিষ্ঠুরতা ও বীরত্বের কাহিনি সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্রের মতো শিল্পকলায় চিরায়ত হয়ে টিকে আছে এবং সামনেও থাকবে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.