বাংলার শোরা, রহস্যময় ‘প্রকৃতির প্রেয়সী’  

ইজেল

30 December, 2021, 03:45 pm
Last modified: 30 December, 2021, 03:48 pm
১৩শ শতাব্দীর মাঝে ইউরোপে বারুদের উপাদান হিসেবে সুপরিচিত ছিল শোরা (পটাসিয়াম নাইট্রেট), গন্ধক ও কার্বন সঠিকভাবে চূর্ণ করা, মেশানো এবং মূল উৎসের মান- এই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করে শোরার গুণগত মান নির্ধারিত হতো।

নভেম্বর ১৬৪৬ সাল। ইংরেজ সংসদ সদস্যরা তখন তাদের গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করাকে উদযাপন করছিলেন। তখন স্টলব্রিজ, ডরসেটে অবস্থিত পারিবারিক এস্টেটে অন্তরীণ থাকা উনিশ বছর বয়সী রবার্ট বয়েল শোরার দিকে মনোনিবেশ করেন।

রাজতন্ত্রের সমর্থক আর্ল অফ কর্ক এর অনুজ বয়েল ইটন থেকে পাশ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি ফ্রান্স, ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডেও পড়াশুনা করেছেন। তিনি আদর্শ বৈজ্ঞানিক পন্থাসমূহ নিয়ে কৌতুহলী একদল মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এবং চিঠি আদানপ্রদানের মাধ্যমে এমন অনেকের সাথেই পরিচিত হন যারা পরবর্তীকালে রয়াল সোসাইটির গোড়াপত্তনকারী সদস্যরূপে পরিচিত হয়েছেন।

"আরাধ্য কাদা" কিংবা "গোবর রাঙা মাটি"র প্রতি বয়েলের আগ্রহ জন্মায় সেসব শোরামানবদের দেখে, যাদেরকে তিনি "নিচু বংশের দু-পেয়ে আঁচিল" বলে সম্বোধন করতেন। এই শোরামানবেরাই তার বাসার নিচের মাটি খনন করতে এসেছিল।

"আমার কবুতরের বাসার মত ঘরটি তারা খুঁড়ে ফেলছিল। না থামালে আমার ভাঁড়ার আর আস্তাবলেরও একই পরিণতি হতো। যদি না আমি তাদেরকে আরো মূল্যবান কোনো খনিজ পদার্থ মুক্তিপণ হিসেবে না দিতে পারতাম।" এই কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন প্রজেক্টর বেঞ্জামিন উরস্লেকে। শোরামানবদেরকে বয়েল ডাকতেন প্রথম দিকের আধুনিক ইংল্যান্ডের "অনুমোদিত অগ্নিসংযোগকারী", যারা সারা দেশে ঘুরে বেড়াত গোবর আর প্রশ্রাব মিশ্রিত মাটির সন্ধানে। যেকোন ব্যক্তিগত জমি থেকে এই বস্তু সংগ্রহ করার লাইসেন্স ছিল তাদের। বয়েল এবং অন্যান্য ধনী জমিদারগণ আবিষ্কার করেছিলেন যে শোরামানবদের এই লুন্ঠনপ্রক্রিয়াকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে মাঝে মাঝে বিঘ্নিত করা যেত। অবশ্য তারা যে উপাদান সংগ্রহ করতো তা রাষ্ট্রকে গোলাবারুদ-সজ্জিত করার জন্যও ছিল অত্যাবশ্যক।

শোরা নিয়ে গবেষণায় এক গবেষক

এশিয়ার ইসলামিক বারুদ সাম্রাজ্যগুলোর মতো ( কনস্ট্যান্টিনোপল ভিত্তিক অটোম্যান সাম্রাজ্য, পারস্য ভিত্তিক সাফাভিদ সাম্রাজ্য এবং ভারত ভিত্তিক মোঘল সাম্রাজ্য) পশ্চিম ইউরোপের বারুদ রাষ্ট্রগুলোতেও সামরিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল. যে কারণে তারা নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিল বিস্ফোরকের কাঁচামাল বারুদের  সংগ্রহের।

তাদের রেলগাড়ি, যুদ্ধ জাহাজ, দূর্গ এবং মাস্কেট বন্দুক প্রচুর পরিমাণে বারুদ খরচ করতো, কারণ কতৃত্বপরায়ণ মনোভাবের কারণে তারা তাদের সেনাবাহিনীকে নিজ দেশ থেকে আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে রেখেছিল। ১৫শ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, সুইডিশ এবং ইংরেজদের সামরিক শক্তি পুরোপুরি বারুদের উপর নির্ভরশীল ছিল। রাজতন্ত্র কিংবা সামরিক বাহিনী, কোনটাই এই বিশেষ পণ্য ব্যাতিরেকে পরিচালিত হতে পারতো না। বারুদচালিত অস্ত্রশস্ত্র ব্যাতিত কোনো দেশ তার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো না। আর এই বারুদের মূল উপাদান; শোরা  ছাড়া থাকতো না কোনো গুলি কিংবা কামানের গোলা। উনিশ শতকের শেষের দিকে রাসায়নিক বিস্ফোরকের আবিষ্কারের পরেই কেবল বারুদের উপর নির্ভরতা কিছুটা কমে আসে।

১৩শ শতাব্দীর মাঝে ইউরোপে বারুদের উপাদান হিসেবে সুপরিচিত ছিল শোরা (পটাসিয়াম নাইট্রেট), গন্ধক (সালফার কিংবা ব্রিমস্টোন নামেও পরিচিত) এবং কার্বন (কাঠকয়লা থেকে প্রাপ্ত)। সঠিকভাবে চূর্ণ করা ও মেশানো এবং মূল উৎসের মান—এই  ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করে শোরার গুণগত মান নির্ধারিত হোত। কাঠকয়লা জ্বলনের জন্য, গন্ধক তাৎক্ষনিক অগ্নিসংযোগের জন্য এবং সাদা শোরা বিস্ফোরণের জন্য উপযুক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করতো। ১৬শ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে ইংরেজরা কামানের গোলায় ব্যবহৃত পাউডারে ছয় ভাগ শোরার সাথে এক ভাগ ব্রিমস্টোন এবং এক ভাগ কাঠকয়লা মেশাতো।

শোরা সম্পর্কে ধারণাগুলো শুরুতে বেশ বিতর্কিত এবং অস্বচ্ছ ছিল, কিন্তু তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হিসেবে এর প্রচুর গুরুত্ব ছিল, কিন্তু এর পাশাপাশি রক্তাক্ত যুদ্ধের মারণাস্ত্র বানানোর উপাদান হিসেবেই মূলত শোরা কুখ্যাত ছিল। রেনেসাঁ যুগের লেখকরা শোরাকে প্রায়ই তার অন্তঃগাঠনিক গুণাবলী দিয়ে বিশ্লেষণ করতেন, যেমন গরম, ঠান্ডা, আদ্রতা কিংবা শুষ্কতা, ইত্যাদি। 

তাদের কাছে এই বস্তুটি ছিল একটি অস্পষ্ট ধাঁধার মতো, যা একই সাথে প্রাণি, সবজি এবং খনিজের বৈশিষ্ট্য বুকে ধারণ করে রেখেছিল। রানী এলিজাবেথের সময়ের পন্ডিত পিটার হোয়াইটহর্ন বলেছিলেন যে "আমি নিশ্চিত নই শোরা আসলে কি। এতে রয়েছে সব ধরনের উপাদানের বৈশিষ্ট্য; যা একে একটি ভিন্ন ধরনের স্বাতন্ত্র এনে দিয়েছে"। প্যারাসেলসাস এর অনুসারীরা শোরাকে একটি রহস্যময় এবং রাসায়নিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতো। তারা মনে করতো শোরার রয়েছে জাগতিক এবং অতিপ্রাকৃতিক যোগসূত্র।

শোরা প্রস্তুত করার সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ বর্ণনাটি লিখেছিলেন ল্যাজারাস এরকার (১৫৩০-১৫৯৪)। তিনি ছিলেন বোহেমিয়ার সম্রাট রুডলফের (দ্বিতীয়) খনি সমূহের চিফ মাস্টার। এরকারের জার্মান ভাষায় লিখিত পান্ডুলিপিটি আবিষ্কৃত হয় প্রাগ শহরে ১৫৭৪ সালে এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে ১৫৮০ সালে। কিন্তু ১৬৮০ সালের আগে এর কোন ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। এরকার শোরা তৈরি করার এবং তা পরিশোধনে এমন একটি বাণিজ্যিক পন্থার কথা লিখেছিলেন, যা ছিল খুবই উচ্চাভিলাষী। ইংল্যান্ডে এরকম বড় মাপের উৎপাদন এর আগে কেউ চিন্তাই করেনি। তার আঁকা ডিজাইনগুলোতে দেখানো হয়েছিল শোরার বেড, পানি নিষ্কাষনকারী চৌবাচ্চা এবং পটাসিয়াম নাইট্রেটকে স্ফটিকীকরণের পদ্ধতি। শোরা পরিশোধনের প্রাথমিক ধাপগুলো একই ছিল। তবে এরকারের বর্ণিত পদ্ধতির লক্ষ্য এবং জটিলতা অনেক বিস্তৃত এবং চমকপ্রদ ছিল। 

১৫৮৯ সালে, একটি পুরনো দলিল থেকে রানী এলিজাবেথের সরকার এই প্রস্তুতপ্রণালীটির একটি আংশিক অনুবাদ হাতে পায়, যা ইংরেজ শোরা উৎপাদনের উদ্যোগকে আরো লাভজনক বানায়। এরকারের প্রদর্শিত পথ ধরে ইহুদী ধাতুবিদ্যা বিশারদ ইয়োকিম গাউঞ্জ শোরা তৈরির সবচেয়ে সঠিক এবং নিখুত পন্থাটি উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। এরকারের মত গাউঞ্জও সূক্ষ্ম অনুপাত, ওজন নেওয়া, বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জোর দেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার পান্ডুলিপিটি অপ্রকাশিত থেকে যায় ফলে পদ্ধতিগুলো থেকে যায় অজানা। 

শোরার প্রস্তুত প্রণালী নিয়ে অনেকেই অনেক রকম মতবাদ দিতে থাকেন পরবর্তী দুইশো বছরে। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন স্যামুয়েল হার্টলিব। ১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি "দর্শনতত্বের শোরা" এবং "দর্শনতত্বের গোবর" নামক দু'টি লেখা লিখেন, যার মধ্যে তিনি তার লব্ধ জ্ঞান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেছিলেন। হার্টলিব (১৬০০-১৬৬২) ছিলেন বহুবিদ্যায় শিক্ষিত বিজ্ঞান অনুরাগী। তিনি সেকালের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে নিয়মিত চিঠির আদান-প্রদান করতেন। যেমন চিকিৎসাবিদ বেঞ্জামিন ওরস্লে (১৬১৮-১৬৭৭)। ওরস্লের স্বপ্ন ছিল একটি দর্শনতত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত বিজ্ঞান ভিত্তিক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। যেখানে গরীবেরা কাজ করতে পারবে এবং মানুষ স্বাধীনভাবে শোরা প্রস্তুত করে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে পারবে।

চিলির শোরা

ওরস্লের তরুণ সহযোগী রবার্ট বয়েল (১৬২৭-১৬৯১) বিশ্বাস করতেন যে মাটির নিচে সুপ্ত শোরার মূল নীতিগুলো বুঝে নিতে পারলেই মানুষের হাতে এই বস্তুর সীমাহীন এক খনি চলে আসবে। বয়েল ভেবেছিলেন যে শোরার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে প্রাকৃতিক দর্শনতত্বকে চাঙ্গা করতে পারবেন। কিন্তু সরকারি তহবিল কখনোই আসেনি, এবং সেসময় শোরা নিয়ে কাজ করতে থাকা সকল বিশেষজ্ঞরা একে একে অন্যান্য প্রকল্পের দিকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিতে থাকেন। 

প্রযুক্তি ও জ্ঞান 

যুগ যুগ ধরে নিরীক্ষক এবং প্রাকৃতিক দার্শনিকেরা বারুদ কিভাবে "বজ্রপাতের চেয়েও জোরালো শব্দ এবং বিদ্যুৎচমকের চেয়েও উজ্জ্বল" ভাবে প্রজ্বলিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় গোলাগুলি ছুঁড়ে দিতে পারে, সেটার খুটিনাটি অনুধাবনে আগ্রহী ছিলেন। এমনকি আধুনিক রসায়নবিদরাও বারুদকে একটি খুবই জটিল এবং সূক্ষ্ম উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।  একজন বিশেষজ্ঞ তো বলতেই বাধ্য হয়েছেন "এখনো বারুদের কার্যপ্রণালীর মূল তত্ত্বগুলো আমাদের কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়"। 

আদর্শ বারুদ খুব দ্রুত পুড়ে যেত সর্বোচ্চ বেগের সাথে। একইসাথে, যে অস্ত্র থেকে তা থেকে ছোড়া হয়েছে, সেটার কোনো ক্ষতিও করতো না। সারপেন্টাইন পাউডার ছিল একদম বালুর মত সূক্ষ্ম এবং ময়দার মত নরম, কিন্তু নতুন দানাদার পাউডারগুলো ছিল বেশি বিস্ফোরণ ক্ষমতাসম্পন্ন। 

ষোড়শ শতাব্দীর গোলন্দাজদের কাছে প্রত্যাশা থাকতো; কোন ধরনের বন্দুক ও কামানে কোন ধরনের বারুদ ব্যবহার করা যাবে সে ব্যাপারে তাদের গভীর জ্ঞান থাকবে। ভুল বারুদ ব্যবহার করলে বন্দুকের ক্ষতি হতো। আর ১৮শ শতাব্দির শুরুতে, একজন গোলন্দাজের কাছে প্রত্যাশা থাকতো, সে বারুদের তিনটি উপাদানের প্রকৃতি ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে। গোলন্দাজদের এই দক্ষতার চাবিকাঠি ছিল অ্যালকেমি, সামরিক বিজ্ঞান এবং গাণিতিক প্রক্ষেপক জ্ঞান।

১৪শ শতাব্দির শেষের দিকে প্রাচীন বারুদ তৈরিতে সমান পরিমাণ শোরা, গন্ধক এবং কাঠকয়লা ব্যবহৃত হতো। ১৫শ শতাব্দীর শুরুতে এই বন্টন পরিবর্তিত হয়ে শোরার পরিমাণ তিন গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এসময় অনেক গোলন্দাজ আরো বেশি পরিমাণে শোরা ব্যবহার করে পরীক্ষা চালাতেন।

তখনো প্রস্তুতপ্রণালীতে অনেক বৈচিত্র্য ছিল, কিন্তু ১৬শ শতাব্দীতে এসে মোটামুটি সর্বজনগৃহীত প্রণালীটি ছিল এরকম; তিন ভাগ শোরা, দুই ভাগ কাঠকয়লা এবং এক ভাগ গন্ধক; বড় কামানের জন্য। পাচ ভাগ শোরা, দেড় ভাগ কয়লা এবং এক ভাগ গন্ধক; ছোট ছোট কামানের জন্য। এবং দশ ভাগ শোরা, এবং এক ভাগ করে কয়লা ও গন্ধক ব্যবহার হতো হাতে বহনযোগ্য বন্দুক এবং কামানের জন্য। দানার আয়তন এবং তাতে ধুলার পরিমাণসহ আরো বেশ কিছু উপাদানের তারতম্যের সাথে সাথে বারুদের গুণগত মানেরও পরিবর্তন হোত। এমনকি খুব ভাল করে প্রস্তুত করা বারুদও অনেক সময় আদ্রতা শুষে নিয়ে নষ্ট হয়ে যেত। তখন আবার শোরা মিশিয়ে একে ব্যবহার উপযোগী করতে হতো। 

১৫২০ সালে সবচেয়ে উন্নত মানের পাউডারে চার ভাগ শোরার সাথে এক ভাগ করে কাঠকয়লা ও গন্ধক মেশানো হতো। পরবর্তীকালে ১৬শ শতকে ইংরেজ পাউডারের স্বীকৃত অনুপাত ছিল ৬:১:১। ১৭শ শতাব্দীর গোলন্দাজ নাথানিয়েল নাই' দাবী করেছিলেন যে, তিনিই সবচেয়ে শক্তিশালী বারুদটি প্রস্তুত করেছেন। সেই বারুদের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিল উপাদানসমূহের দাহ্যতা, এবং তা সংরক্ষণে মজবুত সিলিন্ডার বা পিপের ব্যবহার।

সেই আমলের কামান, মাস্কেট (গাদা বন্দুক) এবং পিস্তলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে উপাদান দরকার হতো। পুরনো এবং ভঙ্গুর অস্ত্রে বারুদ ভরার কাজটি করতে হতো অনেক সাবধানতার সাথে। নাই' এর উপদেশ মতে, ভারি কামানের জন্য ৪:১:১, মাস্কেটের জন্য ৫:১:১ এবং পিস্তলের জন্য ৬:১:১ অনুপাতে উপাদানের মিশ্রণ ঘটাতে হতো। অন্যান্য ফর্মুলায় শতকরা আশি ভাগ পর্যন্তও শোরা থাকতো। ১৬৬০ সালে এসব ফর্মুলার ব্যাপার আলোচনা করতে গিয়ে রয়্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানী টমাস হেন'শ বলেন যে "আমাদের ইংরেজ কর্মীরা তাদের গোপন ফর্মুলা নিয়ে এত বেশি চিন্তিত ছিল, যে গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি ব্যাতিরেকে আমি তাদের কাছ থেকে এই ফর্মুলাগুলো জেনে নিতে পারিনি। কিন্তু সব কিছুর শেষে তাদের গোপন ফর্মুলা আসলে সবচেয়ে সেরা বারুদ তৈরি করতে পারতো না। বরং আর্থিক দিক দিয়ে সবচেয়ে লাভজনক বারুদ তৈরি করতে পারতো।"

বারুদের পিপে

বারুদ উৎপাদনকারীদের প্রয়োজন ছিল কাঁচামালের নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী। ইংল্যান্ডের বন থেকে সহজেই কাঠকয়লা পাওয়া যেত, যা মূলত অ্যলডার, লাইম, উইলো, হ্যাজেল এবং বিচ গাছ থেকে আসতো। দক্ষিন ইতালির আগ্নেয়গিরিপূর্ণ অঞ্চল থেকে আসতো আমদানিকৃত গন্ধক। কিন্তু এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খনিজ ঝর্ণা থেকেও তা আহরণ করা যেত। সম-সাময়িক পর্যবেক্ষক উইলিয়াম হ্যারিসনের এর বক্তব্য অনুযায়ী, রানী এলিজাবেথের সময়ে ইংল্যান্ডে গন্ধকের বিপুল সরবরাহ ছিল।

ঝামেলাপূর্ণ উপাদানটি ছিল শোরা। কারণ এর গুণাবলী, উৎপত্তিস্থলএবং শক্তিমত্তা ছিল জ্ঞানগর্ভ আলোচনার বিষয়। নাইট্রিফিকেশানের সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়া নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকায়- সে যুগের পন্ডিতরা ভেবে কূল পেতেন না যে শোরা কি খননযোগ্য না চাষযোগ্য উপাদান।

এটা কি প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে, নাকি শোরাকে গবেষণা ও সংস্করণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করে তোলার দায়িত্ব রয়েছে মানবজাতির? কি কি ভেজাল দূর করতে হবে, বা কীভাবে তা করলে ব্যবহারযোগ্য স্ফটিক পাওয়া যাবে? এক ধরণের উৎস থেকেই কি বেশি উন্নত শোরা পাওয়া সম্ভব, না সবগুলোই একইরকম? আর কীভাবেই বা এর নিয়মিত সরবরাহ সুনিশ্চিত করা যাবে? এগুলো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যার উত্তর লুকিয়ে ছিল প্রযুক্তি, প্রচলিত রীতি, কৃষিকাজ এবং খনিজ আহরণের মূলনীতিসমূহের সঙ্গে। ইতালি এবং বোহেমিয়াতে পাওয়া যেত এ সংক্রান্ত সবচেয়ে উন্নত ধরনের জ্ঞান। ১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের মাঝে।

তারা জানতো কিভাবে বিস্ফোরক দ্রব্যের জন্য শোরা আহরণ করতে হয়। যদিও বিশেষজ্ঞরা এর প্রকৃতি এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে বর্ণনা করতে গিয়ে হিমশিম খেতেন। প্রাক-আধুনিক যুগের  অ্যালকেমিষ্ট, প্রাকৃতিক দার্শনিক, সামরিক প্রকৌশলী এবং খনিজ বিশেষজ্ঞরা শোরার রসায়ন এবং তা আহরণের প্রযুক্তি নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা করেছেন।

কেউ এটি কীভাবে তৈরি হয় তা জানতেন না, আর কেউ এর সমীহ জাগানিয়া প্রভাবগুলোকে ব্যাখা করতে পারতেন না পুরোপুরি। কেউ সঠিক ভাবে এটাও জানতেন না কিভাবে সার, পণ্য সংরক্ষণে, ঔষধ এবং গোলাবারুদে শোরার ব্যবহার শুরু হয়।

দর্শনতত্বের শোরা 

আমদানীকৃত ভারতীয় শোরা ১৭শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইউরোপের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে প্রতিস্থাপন করে। একইসময় ইংরেজ বিজ্ঞানীরা শোরা উৎপাদনের বিভিন্ন প্রকল্প বাদ দিয়ে এর রাসায়নিক গুণাবলি উদঘাটনের দিকে মনোনিবেশ করতে থাকেন।

শোরা  বুদ্ধিজীবীদের জল্পনা-কল্পনার একটি প্রিয় বিষয় থেকে যায়। যদিও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কল্যাণে সরবরাহ সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। সে যুগের প্রথিতযশা রাসায়নিক দার্শনিকদের মধ্যে ছিলেন লন্ডনের টমাস হেন'শ এবং ওয়ারউইক এর হেনরি স্টাব। তারা প্রকাশনার মাধ্যমে শোরার আদি উৎস এবং প্রকৃতি নিয়ে তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। টমাস হেন'শ ছিলেন রয়্যাল সোসাইটির গোড়াপত্তনকারীদের মধ্যে একজন। শোরা নিয়ে ১৬৬২ সালে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। তার কথাগুলো ছাপা হয়  ১৬৬৭ সালে। সোসাইটির ইতিহাসের অংশ হিসেবে।

মানবজাতির জন্য উপকারসমূহ

ততদিনে শোরা দার্শনিকদের প্রিয় আলোচনার বিষয় হবার পাশাপাশি মানব জাতির জন্য সীমাহীন কল্যাণও বয়ে আনতে পেরেছিল । একদিকে মিলিটারি অফিসারগণ শোরাকে "বারুদের জন্মদাত্রী" বলে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন, আর অন্যদিকে দার্শনিকরা একে "বিশ্বব্রক্ষান্ডের আত্মা" বলে অভিহিত করছিলেন। পাশাপাশি চিকিৎসকরাও থেমে ছিলেন না। তারা বিভিন্ন ওষুধপত্রে শোরার ব্যবহার শুরু করেছিলেন। যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা কমে আসায় শোরার অন্যান্য ব্যবহার সামনে চলে আসে। অতিরিক্ত আবেগের বশবর্তী হয়ে শোরাকে কেউ কেউ "প্রকৃতির প্রেয়সী" বলেও অভিহিত করতে থাকেন।

বারুদের যথেচ্ছ ব্যবহার হয় চিলির সান্তা মারিয়া স্কুলে

রানী এলিজাবেথের রাজসভার সদস্য টমাস চ্যালোনার প্রথম শোরার গুরুত্বপূর্ণ এবং বিরল গুণাগুণ নিয়ে লিখেন। সে লেখার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তারই চাচাতো ভাই, যিনি ছিলেন লন্ডনের একজন ঔষধ বিক্রেতা। সেসময় খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে চামড়ার বিভিন্ন ক্ষত ও চর্মরোগের চিকিৎসা করা শুরু হয়েছে মাত্র। শোরাকে তিনি ক্ষত এবং চুলকানির কার্যকর ওষুধ এবং জোলাপের গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবেও অভিহিত করেন। চ্যালোনারের শোরা  ছিল অনেক পরিশোধিত এবং কম দাহ্য। পাউডার প্রস্তুতকারীদের কাঁচামালের চেয়ে এতে সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক কম ছিল এবং স্বাদ ছিল খানিকটা টক টক।

চিকিৎসাশাস্ত্রে শোরার ব্যবহার খুব কম সময়ের মধ্যে বেড়ে যায়। জ্ঞানী চিকিৎসকরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এর বহুমুখী ব্যবহার আবিষ্কার করেন। এর মাঝে সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক উন্নতিটি দেখা যায় রুপচর্চা খাতে। সেসময়ও মানুষ ফর্সা এবং পরিষ্কার ত্বক নিয়ে আগ্রহী ছিল। মধু, বিভিন্ন ভেষজ উপাদান ও মুরগীর চর্বির সাথে শোরা মিশিয়ে যে আরক প্রস্তুত করা হোত, তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল "চুল, মুখ এবং গায়ের চামড়াকে কোমল, মসৃণ ও ফর্সা করার"। মুখের ঘা, চুলের খুশকী, রুক্ষতা ও আদ্রতার অভাবসহ আরো বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার মোকাবেলায় শোরা ছিল অতুলনীয়। ছোট শিশুদের মুত্রের সাথে শোরা মিশিয়ে চুলকানী প্রতিরোধক মলম বানানো হতো। রেশম কিংবা পশুর চামড়া থেকে ময়লা ও মাটির দাগ দূর করা এবং লিলেন কাপড়কে সাদা করার জন্যেও শোরা দিয়ে তৈরি আরকের ব্যবহার ছিল।

আধুনিক রসায়ন এখনও বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এবং ওষুধ বিজ্ঞান খাতে শোরার বিবিধ ব্যবহার আবিষ্কার করে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তা আর গোবর-পূর্ণ ভুমি থেকে আহরণ করার প্রয়োজন পড়ে না। বেকন এবং রয়েলের মত বিজ্ঞানীদেরকে যেসব রহস্য হতভম্ব করে রেখেছিল- তার বেশিরভাগেরই সমাধান চলে এসেছে। শোরা এখনও "ব্ল্যাক পাউডার"এর মূল উপাদান। যার পরিমিত ব্যবহার রয়েছে খনি খনন এবং অস্ত্র উৎপাদন খাতে।

এছাড়াও এটি সার তৈরির মূল উপাদান। তবে সার ভিত্তিক বোমা তৈরিতে এর তেমন কোন ভূমিকা নেই। সেখানে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ব্যবহার বেশি। শোরা ব্যবহার করে এখন মাংস সংরক্ষণ করা হয়। এসিড ও সিগারেট বানানো হয় এবং টুথপেস্টকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এছাড়াও, এটি ডিউরেসিস (মূত্রবর্ধক ঔষধ) হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে তা শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

সব ধরনের নিরাপত্তা নির্দেশিকায় আজকাল বলে দেয়া থাকে, যে পটাসিয়াম নাইট্রেট চামড়ার সংস্পর্শে আসা ক্ষতিকর। এবং অসাবধানে সেবন করলে কিংবা এর ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিলে তা রক্ত, কিডনী এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে, যারা নিয়মিত এর সংস্পর্শে আসে; তাদের জন্য এই ঝুঁকি অনেক বেশি। কর্মীদের উপদেশ দেয়া হয় রবারের তৈরি জুতা এবং এপ্রন পড়ে কাজ করতে। সাথে রেস্পিরেটর এবং গ্লাভস ব্যবহারসহ অন্যান্য সকল যৌক্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করার নিয়ম মেনেও চলতে হয় তাদের।

প্রাক-আধুনিক যুগের শোরামানবগণ এসবের কিছুই জানতেন না। খুব নিবিড়ভাবে শোরা  নিয়ে কাজ করার কারণে তাদের যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে- সে ব্যাপারে তেমন কোনো লিপিবদ্ধ প্রমাণও নেই। আমরা শুধুই আশা করতে পারি যে, প্রসাধনীদ্রব্য হিসেবে উপদিষ্ট হলেও খুব বেশি মানুষ তাদের গালে আর কপালে শোরা মাখেননি।

আজকের দিনে শোরা সামরিক শক্তির ভিত্তি কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুনত্ব নিয়ে আসার নিয়ামক হওয়ার চেয়ে বরং আমোদ-প্রমোদের উৎস হিসেবেই বেশি পরিচিত। পূর্ব শতাব্দীগুলোর লোককথায় শোরাকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে যে শোরা যৌন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং তরুণ ব্যক্তিদের খাবারের সাথে মিশিয়ে দিলে তারা অক্ষম হয়ে যায়। এই গল্পের তেমন কোন ভিত্তি নেই। বরং শোরাকে নাইট্রেট ও নাইট্রেট অক্সাইডের সাথে যুক্ত করে পরীক্ষা চালিয়ে রক্তচাপের চিকিৎসা করা হয়েছে, এবং সাথে ভায়াগ্রার উপাদান হিসেবেও এটি অন্যতম।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শয়নকক্ষ, আলকেমির অনুসন্ধান থেকে ঔষধের দোকানের শেলফ, শোরার রয়েছে বিভিন্ন ধরণের উদ্দীপক এবং রহস্যময় প্রয়োগ। রবার্ট বয়েল যেমনটি বলেছেন, শোরা আমাদের বিস্তারিত অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.