নাজি আল-আলী: মৃত্যুতেও যিনি ফিলিস্তিনকে আঁকড়ে রেখেছেন বুকে

ইজেল

16 October, 2023, 07:15 pm
Last modified: 16 October, 2023, 07:20 pm

কার্টুন এঁকে বা কলমের শক্তিতে কি পৃথিবীকে বদলে দেওয়া যায়? বাংলা প্রবাদে আছে, অসির চেয়ে মসি বড়। অর্থাৎ তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী। আসলেই তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী কি না, সে বিষয়ে তর্ক হতে পারে। তবে কলম, কাগজ, পেনসিল বা রং-তুলিও যে ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, ইতিহাসে তার প্রমাণ নিতান্ত কম নেই।

যে কথা মুখে বলা যায় না, সে কথা লেখা যায়। লিখে যা বোঝানো কঠিন, এঁকে তা প্রকাশ করা যায় সহজে। আর আঁকা যখন কার্টুননির্ভর হয়, তখন তা হয়ে ওঠে ক্ষুরধার, সহজবোধ্য, দারুণ শক্তিশালী। ছুঁয়ে যায় কোটি মানুষের হৃদয়। সেই ফরাসি বিপ্লব, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বা দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের শত বছরের যুদ্ধ—সবখানেই তাই এ ধরনের প্রতিবাদ চোখে পড়ে। আগের প্রশ্নটায় তাহলে আবারও ফেরা যাক। এটা কতটা কার্যকর?

এই প্রশ্ন আপনার মনে আসতেই পারে। উত্তরটা একটু ভিন্নভাবে, আরেকটি প্রশ্নের মাধ্যমে দেওয়া যাক। শুধু কার্টুন আঁকার কারণে যদি কাউকে খুন হয়ে যেতে হয়, তাহলে? জবাবটা নাহয় নিজেই খুঁজে নিন। আমি বরং এক বিদ্রোহী হৃদয়ের গল্প শোনাই।

তাঁকে বলা হয় দুঃখী ফিলিস্তিনের অন্যতম শক্তিশালি কার্টুনিস্ট। একদম সঠিকভাবে বললে, ক্যারিকেচারিস্ট। ক্যারিকেচার আঁকতেন। তাঁর আঁকায় উঠে এসেছিল ফিলিস্তিনের দুঃখ। ফুটেছিল তাদের তীব্র প্রতিবাদ। সেই অপরাধেই তাঁর দণ্ড হলো—মৃত্যুদণ্ড।

এই দণ্ড কে দিয়েছে, জানা যায়নি আজও। দিনটা ছিল ১৯৮৭ সালের ২২ জুলাই। কুয়েতি এক সংবাদপত্রের লন্ডন অফিসে কাজ করতেন। পত্রিকার নাম আল কাবাস। অফিস থেকে বেরোতেই গুলি ছোড়া হলো। কয়জন গুলি ছুড়েছিল? উত্তর খুঁজলে জানবেন, অন্তত একজন। শুধু একজন, সে কথা বলার উপায় নেই। মাথায় গুলি খেয়েও এক মাস লড়েছেন। বিদ্রোহী বটে! এত সহজে কি হারবেন?

নাজি আলী। ছবি: এএফপি

লড়েছেন মানে, আবার আঁকতে বসেননি। সেই সুযোগই পাননি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যুর সঙ্গে এক মাসেরও বেশি লড়ার পর হার মেনে নেন ২৯ আগস্ট।

তিনি নাজি আল-আলী। ফিলিস্তিনের দুঃখ যাঁর হৃদয়ে প্রোথিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর নানা সংবাদে উঠে এসেছিল, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই খুনের কথা জানত। তারাই কি দায়ী ছিল? উত্তর নেই এ প্রশ্নের। ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার এ কথা জানার পর তিনি মোসাদের লন্ডন হেডকোয়ার্টার্স বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিদায় করে দিয়েছিলেন কূটনৈতিকদের। সন্দেহটা মোসাদের পাশাপাশি গাদ্দার ফিলিস্তিনি ও বিরোধী ফিলিস্তিন সংগঠনগুলোর ওপরও পড়েছিল। কিন্তু আলীর হত্যা রহস্যের সমাধান হয়নি।

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ একে ইয়ম কিপুরের সঙ্গে তুলনা করছেন। যুদ্ধটির আরেক নাম অক্টোবরের যুদ্ধ। মিসর, সিরিয়া, ফিলিস্তিনসহ একাধিক আরব দেশ যে যুদ্ধে একসঙ্গে হয়েছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। পারেনি। সেটা ১৯৭৩ সালের কথা। প্রায় ৫০ বছর পর আবারও এই তীব্র সংকটকালে অনেকেরই হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছে নাজি আল-আলীর কথা। আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তিনি প্রতিবাদমুখর হতেন।

চলুন, সেই বিদ্রোহী রণক্লান্ত মুসাফিরের গল্পটা শুনি।

নাজি সালিম হুসাইন আল-আলী জন্মেছিলেন ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইনের গালিলির আশ শাজারা গ্রামে, ১৯৩৭ সালে। তখনো ইসরায়েলের জন্ম হয়নি। তাঁর বয়স যখন দশ, তখন একদল সশস্ত্র জায়োনিস্ট তাঁদের গ্রামে হামলা করে। আলী ও তাঁর পরিবার এ সময় পালিয়ে চলে যান লেবানন। দেশটির দক্ষিণে সিডন নামের একটি শহরে রিফিউজি ক্যাম্প। নাম, আইন আল-হিলওয়াহ। সেখানেই জোটে আশ্রয়।

আলীর মুখেই শুনুন, 'আমার বয়স তখন সবে দশ। পালিয়ে এলাম আইন আল-হিলওয়াহ রিফিউজি ক্যাম্পে। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর, খালি পা, অনেকটা লোপ পেয়েছে স্বাভাবিক চিন্তাক্ষমতা। ক্যাম্পের জীবন ছিল অমানবিক। দারিদ্য ও হতাশার হাত ধরে নিত্য অপমানের স্বীকার মানবেতর জীবন কাটিয়েছি।'

স্বদেশ হারানো সেই শিশুটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল আলীর বুকে। সেই শিশুটিই ফুটেছিল তাঁর আঁকার কলমে, হয়ে উঠেছিল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি। কার্টুন সেই চরিত্রের নাম হান্দালা। ১৯৬৯ সালে প্রথম কুয়েতের এক সংবাদপত্রে দেখা যায় তাকে। ১০ বছরের খালি পায়ের এক ফিলিস্তিনি শিশু, মরোমরো, গায়ে খুশকির মতো গুটি গুটি ময়লা জমেছে। স্বদেশ হারানো লাখো ফিলিস্তিনি শিশুর প্রতীক হান্দালা। আলীর বক্তব্যেও তা পরিষ্কার, 'আমি যে বয়সে ফিলিস্তিন ছেড়ে আসি, সে-ও সেই বয়সী। এক অর্থে আজও আমি সেই শিশুটিই রয়ে গেছি। ভেতরে টের পাই, ফিলিস্তিনি শিশু হিসাবে পেরিয়ে আসা প্রতিটি গাছ, ঝোপঝাড়, ঘরবাড়ি, প্রতিটি পাথর—সব মনে আছে আমার স্পষ্ট। ঘুরেফিরে তারা দেখা দেয় আমার স্মৃতিতে।' 

১৯৭৩ থেকে হান্দালা নানা জায়গায় উঠে এসেছে, প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু কোথাও আর মুখ দেখায়নি। পুরো পৃথিবী যে ফিলিস্তিনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, পিছু ফিরে কাজ করে যাচ্ছে নিজেদের মতো, আর ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম ও বন্দী দিনগুলোয় একের পর এক হান্দালারা কাটাচ্ছে অসহ্য মানবেতর জীবন—এই ছিল তার প্রতিবাদ। হান্দালার নামটিও এই প্রতিবাদেরই প্রতীক। ফিলিস্তিনের এক তেতো উদ্ভিদের আরবি নাম 'হান্দাল'। সেখান থেকেই এই নাম। ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবনের প্রতিরূপ।

হান্দালার এই পথচলা শুরু ফিলিস্তিনের এক লেখকের হাত ধরে। তাঁর নাম ঘাসান কানাফানি। তিনিও খুন হয়েছেন ১৯৭২ সালে। ১৯৫০-এর দশকে তিনি আইন আল-হিলওয়াহ ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর দেখা হয় আলীর সঙ্গে। আলীর কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। সেই সূত্র ধরেই বেশ কিছু আরব সংবাদপত্রে কাজ জুটে যায় আলীর। এভাবেই একসময় আলী চলে আসেন কুয়েতে। ৬০ ও ৭০ দশকের বেশির ভাগটা তিনি সেখানে আস সিয়াসা ও আল কাবাস নামে দুটি সংবাদপত্রের জন্য কাজ করেন। তাঁর কার্টুনের মুখ্য বিষয় ছিল ওটিই—ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম ও আরব নেতাদের নীরবতা, ব্যর্থতা। রাজনৈতিক সমর্থন তাই কখনোই জোটেনি। বরং ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য মৃত্যুর হুমকি কড়া নেড়েছে বারবার। তবে সাধারণ আরবদের মনে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন নাজি আল-আলী।

১৯৮৫ সালে পাঁচ সন্তানসহ সস্ত্রীক তিনি চলে আসেন লন্ডনে। আল কাবাসের লন্ডন শাখায় কাজ করতে। মৃত্যুই কি তাঁকে লন্ডনে নিয়ে এসেছিল? প্রশ্ন রয়েই যায়। কারণ, লন্ডনে এসে ফিলিস্তিনি নেতাদের ব্যর্থতা ও ইসরায়েলের নির্মমতা নিয়ে আরও জোর আওয়াজ তোলেন আলী। তাঁর পত্রিকার সম্পাদক জানান, একের পর এক মৃত্যুর হুমকি আসতেই থাকে। কিন্তু আলী দমে জাননি।

এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মৃত্যুর প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আলী প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কল পান। সেই কর্মকর্তা তাঁকে 'সোজা' হয়ে যেতে বলেছিলেন। এই হুমকি অবশ্য পাওয়ার কথাই ছিল। কারণ, এর কিছুদিন আগেই তিনি ইয়াসির আরাফাতের এক বন্ধুকে তীব্র আক্রমণ করে কার্টুন এঁকেছিলেন।

দুই সপ্তাহ পর অমোঘ মৃত্যু এসে হাজির। বুলেটে লেখা ছিল আলীর নাম। দক্ষিণ লন্ডনের অফিস থেকে বেরোতেই সেই বুলেট আঘাত হানল। এক মাস লড়ে হার মেনে নিলেন আলী। চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।

২০১৭ সালে আবারও তদন্ত হয় তাঁর মৃত্যু নিয়ে। একাধিক সন্দেহভাজনের বর্ণনাও উঠে আসে। কিন্তু খুনি (বা খুনিরা) আজও রয়ে গেছে অধরা।

লন্ডনের দক্ষিণে ব্রুকউড সেমেটারিতে কবর দেওয়া হয়েছে আলীকে। যদিও তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর বাবার পাশে, আইন আল-হিলওয়াহতে তাঁকে কবর দেওয়া হোক। তাঁর সেই চাওয়া পূর্ণ হয়নি। তবে তাঁর কবরের মুখে, কালো মার্বেল পাথরের এপিটাফে জড়িয়ে রাখা হয়েছে ফিলিস্তিনের পতাকা। রয়েছে একটি ছোট্ট নোট বই। ওতে আছে হান্দালা-আলীর প্রতিবাদের স্মৃতিচিহ্ন।

নাজি আলী শেষ নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন লন্ডনের ব্রুকউড সিমেটারিতে, কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন বাবার পাশে, আইন আল-হিলওয়েহ-তে। ছবি: ইন্দলিব ফারাজি সাবের

তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে, ২০০৯ সালের ২৩ মার্চ প্রকাশিত হয় 'আ চাইল্ড অব প্যালেস্টাইন'—ফিলিস্তিনের শিশু। এই বইতে হান্দালার সঙ্গে আছে আলীর অন্যান্য কিছু কার্টুন চরিত্র। কিছু ক্যারিকেচারও রয়েছে আরব নেতাদের। সাংবাদিক ও মানবাধীকারকর্মী জন পিলারের মতে, বইটি অসাধারণ। পশ্চিমা পাঠকেরা এ বইতে ছবি-চিত্রে টের পাবেন ফিলিস্তিনিদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, দেখতে পাবেন অমানবিক পরিস্থিতিতে তাদের প্রাণে বয়ে যাওয়া জীবননদের স্রোতটিকে।

পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে মনে রেখেছে কি রাখেনি, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, আজও তারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছে ফিলিস্তিনিদের থেকে। আলীর মৃত্যুর এত বছর পরেও হান্দালারা মারা যাচ্ছে, অকাতরে, নির্মমভাবে। শুধু একটিই দোষ তাদের—তারা ফিলিস্তিনি শিশু।

নাজি আল-আলীর মৃত্যুও যেন এর প্রতিবাদ। বুলেট মাথায় নিয়ে তিনি শুয়ে আছেন সেই ছোট্ট শিশুটি হয়ে। ফিলিস্তিনের প্রতিবাদের অংশ হয়ে। তিনি আছেন, থাকবেন, প্রতিবাদ করে যাবেন মৃত্যুতেও, প্রতীকী রূপে—যত দিন বেঁচে থাকবে ফিলিস্তিনের শিশুরা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.