পাখির বাসায় মাটির পিঁড়ি

ইজেল

12 June, 2023, 02:55 pm
Last modified: 12 June, 2023, 03:03 pm
প্রতিটি টিলায় রয়েছে আনারস বাগান। একটা টিলার গা বেয়ে আমরা ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। টুনটুনি, বুলবুলি, ঝুঁটি শালিক, গোশালিকের প্রচুর বাসা চোখে পড়ল। এই পাখিগুলোর বাসা বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামাঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। তাই এগুলোর পেছনে সময় ব্যয় না করে আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।
ছবি / অরিত্র সাত্তার

শিকার এক দুর্দান্ত নেশা, রোমাঞ্চকর কাজ, মানুষের আদিম প্রবৃত্তি জড়িয়ে আছে এতে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর বিষয়টি এখানে জড়িত, যা একটা সময় শিকারির মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে একসময় শিকার করা ছেড়ে দেই। অস্ত্রের বদলে হাতে উঠে আসে ক্যামেরা।

শিকারিজীবন ছেড়ে আমি যখন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি শুরু করি, ইনাম আল হক তখন সে জগতের মহীরুহ, খ্যাতিমান পাখিবিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ক পত্রিকায় ছাপা হওয়া প্রতিটি ছবির আর লেখার প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি ছিল।

একবার ইনাম ভাই ছবি তোলার কাজে অ্যান্টার্কটিকা গেলেন। ফিরে আসার পর একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হওয়া আমার তোলা বাচ্চাসহ সাত ভায়লা পাখির একটি ছবি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পেরেছিল, ছবিটা তোলার সময় আমার দ্বারা পাখি এবং বাচ্চা দুটোই বেশ বিরক্ত হয়েছিল। আসলে বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী হিসেবে তখন আমি অনেকটাই অনভিজ্ঞ, অনেক কিছুই অজানা। তিনি সেই পত্রিকা অফিস থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমাকে চিঠি লিখলেন। চিঠিটা লিখেছিলেন অ্যান্টার্কটিকায় তার তোলা দুটি পেঙ্গুইনের ছবির পেছনে। সেখানে তিনি খুব সুন্দর করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, কী করে আরও যত্নবান হয়ে পাখি এবং বন্য প্রাণীর ছবি তোলা যায়।

আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে এরপর থেকে খুব সাবধানে কাজ চালিয়ে গেছি। বরাবরই খেয়াল রেখেছি আমার ফটোগ্রাফিক আগ্রহ কিংবা কৌতূহল যাতে কোনোভাবে পাখি অথবা কোনো বন্য প্রাণীর বিরক্তি কিংবা ক্ষতির কারণ না হয়।

সেই বিখ্যাত মানুষটি নবীন এক বন্য প্রাণী আলোকচিত্রীকে চিঠি না লিখলেও পারতেন। কিন্তু পাখি আর বন্য প্রাণী রক্ষার অনেক বড় দায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পাখিপাগল মানুষটি। সেই দায় আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকটা নিভৃতে। তার চিঠিটা জীবনের এক দিকনির্দেশনা হিসেবে আজ পর্যন্ত খুব যত্ন করে রেখেছি। তবে তার চিঠি পাওয়ার আগে কিন্তু অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যার মাধ্যমে বেশ কিছু নতুন এবং বিস্ময়কর তথ্যের সন্ধান পেয়েছিলাম। প্রিয় পাঠক, আসুন ঘুরে আসা যাক ২১ বছর আগের সেই ভুল সময় থেকে।

এক জঙ্গলপ্রিয় বন্ধুর চিঠি এসে পৌঁছে আমার হাতে। তার বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার বড়চালা গ্রামে। চিঠিতে সে লিখেছে, বরাবরের মতো এবারও তাদের গ্রামের বিভিন্ন স্থানে নানা জাতের পাখি বাসা বানাতে শুরু করেছে। আরও জানতে পারলাম, এখন যদি আমি তাদের গ্রামে যাই, তবে বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির বাসা ও বাচ্চার ছবি তুলতে পারব। আমিও আসলে কয়েক দিন ধরে মনে মনে ভাবছিলাম পাখির বাসা ও বাচ্চার ছবি তোলার কথা। মার্চ, এপ্রিল, মে- এই তিন মাস হচ্ছে আমাদের দেশের বেশির ভাগ পাখির প্রজননের সময়। এ সময় এরা বাসা বানায়, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করে তোলে। পাখির জীবন প্রত্যক্ষণের জন্য এই সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একদিন দুপুরে ঢাকা থেকে বাসে উঠে রওনা দিলাম বড়চালা গ্রামের উদ্দেশে। বিকেলের দিকে বাস এসে পৌঁছাল কাপাসিয়া সদরে। বাস থেকে নেমে চলে গেলাম নদীর ঘাটে। কিছুক্ষণের মধ্যে রানীগঞ্জগামী একটা ইঞ্জিন বোট এসে ভিড়ল। নৌকার চালে উঠে বসে পড়লাম আমি। শীতলক্ষ্যার দুই দিকের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত রানীগঞ্জ বাজারে। রানীগঞ্জ বাজার থেকে বড় রাস্তা ধরে আমি হেঁটে চললাম পশ্চিমের দিকে। চারদিকে ছোট-বড় পাহাড়ের মতো টিলা। সামনের দিকে তাকাতেই একটা বড় টিলার মাথায় দুর্গের মতো বাড়ি দেখতে পেলাম। এই বাড়িটা আগেও বহুবার দেখেছি। এক প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ অনেক দিন আগে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। টিলার গাজুড়ে রয়েছে সিমেন্টের সিঁড়ি। কয়েক'শ ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে ওই বাড়িতে উঠতে হয়। যতবার আমি ওই বাড়িটা দেখেছি ততবারই মনে মনে প্রশংসা করেছি বাড়ির মালিকের সৌন্দর্যপ্রীতির। ওই দুর্গের মতো পুরোনো বাড়িটার পরের টিলার মাথায়ই আমার সেই জঙ্গলপ্রিয় বন্ধুর বাড়ি।

সন্ধ্যার আলো-আঁধারির পথ ধরে আমি হাজির হলাম বন্ধুর বাড়ির দুয়ারে। নাম ধরে ডাকতেই ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল সে। শিকারিজীবনে গভীর জঙ্গলে প্রথম দেখা হয়েছিল সিরাজির সঙ্গে, সেই থেকে এই জংলি বন্ধুত্ব। মহাখুশিতে আমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল বন্ধুটি। হাত-মুখ ধোয়ার পর চা খাওয়া থেকে শুরু হলো আমাদের গল্প। বেশির ভাগ গল্পই হচ্ছিল বন আর বন্য প্রাণী নিয়ে। কত কিছুই না হারিয়ে গেল চোখের সামনে। বাঘ, চিতাবাঘ, হরিণ, শুয়োর হারিয়েছে একে একে। টিকে ছিল কিছু অজগর, কিছুকাল আগে একটা অজগর প্রায় মরতে বসেছিল লোকজনের আক্রমণে। পরে বন বিভাগের লোকজন এসে সেটাকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যায়। কিছু হনুমান আর বানর টিকে আছে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে। আনারস বাগানগুলোতে বসবাসকারী সজারুর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়, বুনো খরগোশের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। এসব নিয়েই আমাদের গালগল্প চললো রাতের খাবার আগপর্যন্ত। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাকে বললাম, কাল খুব ভোর থেকে আমরা আমাদের কাজ শুরু করব। সেই আরণ্যক রাতে বিছানায় শুয়ে চারদিক থেকে ভেসে আসা শেয়াল, হুতুমপেঁচা আর নাইট জারের ডাক শুনতে শুনতে একসময় ঘুমের অতলে হারিয়ে গেলাম।

ভোরে প্রিয় বন্ধু সিরাজি মিয়ার ডাকে ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি নাশতা ছেড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি সিরাজির কাছ থেকে জানতে পারলাম কোন কোন স্থানে কী কী ধরনের পাখির বাসা সে আমায় দেখাতে পারবে। এদিকের মানুষের প্রধান অর্থকরী ফসল হচ্ছে আনারস। চারদিকে ছোট-বড় টিলা। প্রতিটি টিলায় রয়েছে আনারস বাগান। একটা টিলার গা বেয়ে আমরা ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। টুনটুনি, বুলবুলি, ঝুঁটি শালিক, গোশালিকের প্রচুর বাসা চোখে পড়ল। এই পাখিগুলোর বাসা বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামাঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। তাই এগুলোর পেছনে সময় ব্যয় না করে আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।

গত বছরও আমি এই টিলায় উঠেছিলাম পাখির বাসার খোঁজ করতে। টিলার মাথায় রয়েছে প্রাচীন এক আমগাছ। আমগাছের একেবারে মাথায় বাসা করেছিল একটা তিলানাগ ইগল। সে বছর তিলানাগের বাসা আর ডিমের বেশ কিছু সুন্দর ছবি তুলতে পেরেছিলাম। সিরাজির কাছ থেকে একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানতে পারলাম। তিলানাগ ইগলের বাসাটা নাকি এ বছর দখল করে নিয়েছে একটি শঙ্খচিল। ব্যাপারটা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তিলানাগ বছরের পর বছর একই বাসা ব্যবহার করে। শুধু ডিম দেওয়ার আগে পুরোনো বাসাটাকে মেরামত করে নেয়। এরা আকারে শঙ্খচিলের চাইতে বড় এবং হিংস্র। তাই যে শঙ্খচিল তিলনাগের বাসাটাকে দখল করেছে তার সাহসের প্রশংসা না করে পারলাম না। তবে বিষয়টা এমনও হতে পারে, তিলানাগ এই বাসাটাকে নিজেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল।

সিরাজিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম আমগাছের ঠিক নিচে। মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখলাম বাসাটা গাছের ঠিক মগডালে রয়েছে। নিচ থেকে শঙ্খচিলের অস্তিত্ব চোখে পড়ল না। সন্দেহ দেখা দিল মনে। সিরাজিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই বলল, গত এক সপ্তাহ সে নিয়মিত এখানে এসে দেখে গেছে শঙ্খচিল বাসায় বসে আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম। বাসাটার দিকে উড়ে আসছে শঙ্খচিল। তার নখরে আটকে আছে ছোট্ট একটি মাছ। বুঝতে বাকি রইল না বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে সে। শঙ্খচিলটা বাসার কাছাকাছি আসতেই বাচ্চার চিঁচিঁ শব্দ ভেসে এল কানে। মাটি থেকে বাসাটির উচ্চতা কমপক্ষে ১৩০ ফিট। আমার ক্যামেরার ব্যাগে চিকন একটা রশি রয়েছে। রশিটা বের করে এক প্রান্ত বাঁধলাম কোমরের সঙ্গে, অপর প্রান্ত ক্যামেরার বেল্টের সাথে। ক্যামেরাটা সিরাজির কাছে দিয়ে উঠতে শুরু করলাম গাছ বেয়ে। 

গাছের প্রথম ত্রিশ ফুটের মধ্যে তেমন কোনো ডালপালা নেই। তাই এই জায়গাটুকু উঠতে গিয়ে আমি বুঝলাম ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি কাকে বলে! এরপর একের পর এক ডাল বেয়ে ওপরের দিকে উঠে গেলাম। এভাবে একসময় পৌঁছে গেলাম একেবারে আমগাছের মাথায়। শঙ্খচিল তিনবার আমার মাথা লক্ষ্য করে দাগ দিল। সে হয়তো ভাবছে আমি তার বাসা থেকে বাচ্চা চুরি করে নিতে এসেছি। ১৩০ ফুট ওপর থেকে নিচে পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। তবু কিছুই করার নেই, বাসাসহ শঙ্খচিলের ছানার ছবি যে আমাকে তুলতেই হবে। গাছের মাথায় দাঁড়িয়ে বাসার দিকে তাকাতেই দেখলাম একটিমাত্র ছানা বসে আছে সেখানে। তার গায়ের রং সাদা। কিন্তু শঙ্খচিল তো বছরে কমপক্ষে দুটো ডিম পাড়ে। তাহলে আরেকটা বাচ্চা কোথায়? হয়তো কোনো কারণে একটা ডিম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অথবা কোনো কারণে অন্য বাচ্চাটি গাছ থেকে পড়ে মারা গেছে।

এদিকে রশি ধরে টান দিতেই সিরাজ হাত থেকে ক্যামেরা ছেড়ে দিল। ক্যামেরা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছবি তোলা শুরু করলাম। এরপর একসময় ছবি তোলা শেষ হলে বাসা এবং বাচ্চাটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। এই বাসা থেকে গত বছর আমি ডিমসহ তিলানাগ ইগলের বাসার ছবি তুলেছিলাম। একটা দারুণ জিনিস চোখে পড়ল। শঙ্খচিল বাসাটাকে দখল করার পর নতুন এক উপাদান দিয়ে বাসাটাকে সাজিয়েছে। ভীষণ অবাক করা বিষয়, সেই নতুন উপাদান হচ্ছে মাটি। বাসার নিচটায় প্রায় দেড় ইঞ্চি পুরু মাটির আস্তরণ। আকৃতিতে অনেকটা রুটি তৈরির পিঁড়ির মতো। খুবই মসৃণ, যেন এইমাত্র কেউ লেপে রেখে গেছে। গাছের মাথায় মাটির পিঁড়িতে বসা পাখির ছানার দিকে তাকিয়ে আমার তখন বেহুঁশ হওয়ার অবস্থা।

শঙ্খচিলের বাসার সেই মাটির পিড়ি সম্পর্কে আমি পরবর্তী সময়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছি। তবে সবচেয়ে যুক্তিসংগত উত্তরটি দিয়েছিলেন পাখিবিশারদ শরীফ খান। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, বাসায় মাটি নিয়ে রাখা অথবা মাটি দিয়ে বাসার তলদেশ লেপে দেওয়া শঙ্খচিলের একটা নিরাপত্তা কৌশল। এর মাধ্যমে সম্ভবত নিজের বাসাটাকে দ্বিগুণ ভারী করতে চায় সে, যাতে ঝোড়ো বাতাসে বাসাটা উড়ে যেতে না পারে।

তিনি আরও জানান, প্রতিটি পাখি নিজের নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা বিবেচনায় অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেদের বাসা তৈরি করে থাকে। যদি বলা হয় প্রতিটি পাখি একেকজন মেধাবী আর্কিটেক্ট কিংবা দক্ষ প্রকৌশলী, তবে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না; বরং এখনো অনেক স্বনামধন্য প্রকৌশলী এবং বিখ্যাত আর্কিটেক্ট অতি আধুনিক স্থাপনা নির্মাণের সময় পাখিদের বাসা তৈরির কৌশলের সাহায্য নিয়ে থাকেন।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.