চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন এবং আমাদের এক ছোড়দি

ইজেল

14 May, 2023, 07:45 pm
Last modified: 14 May, 2023, 07:46 pm
ষাট সত্তর আশির দশকের মফসসলের কথা বলি। সেই যায় দিন ভালোর মফসসল। পাড়া-পরিবারভিত্তিক মানুষের সম্পর্ক। এক পাড়া এক পরিবার। পাড়ার সকলে সকলের তরে। আজিজ জ্যাঠা যেমন সকলের জ্যাঠা, দীপন কাকা যেমন সকলের কাকা, কাওসারের বড় আম্মা যেমন সকলের বড় আম্মা। পোলাপানের ঘর গোটা পাড়াটা। এর ঘরে খাচ্ছে, ওর ঘরে শুচ্ছে—সন্ধ্যায় মায়েরা যার যার পোলাপান গুনে গুছিয়ে বুঝে পেলেই হলো।—সেইসব যায় দিন ভালো নিশ্চয়ই বলব কিন্তু হায় আফসোস করি না মোটে। দিন  ফিরে না, যায় কেবল।

মৃণাল সেন। পোরট্রেট: রাজিব রাজু

যায় দিন ভালো আয় দিন খারাপ।

বানানো কথা। মুখের বুলি। প্রবাদ হয়ে গেছে।

বাজে প্রবাদ।

সব যায় দিন ভালো যায় নাকি?

আয় দিন মাত্রই খারাপ?

যায় দিনে যদি কারো বউ মরে গিয়ে থাকে?

আয় দিনে যদি কারো সন্তান জন্ম হওয়ার কথা থাকে?

কাট্ কাট্ কাট্ কাট্!

গলে যাচ্ছে সালভাদর দালির 'পার্সিসটেন্স অব মেমরি' পেইন্টিং-এর ঘড়ি।

কাট্ কাট্ কাট্ কাট্!

জীবনানন্দ দাশ ট্রাম লাইনে হাঁটছেন।

কাট্ কাট্ কাট্ কাট্!

শুটিং-এর গাড়ি যাচ্ছে আকালের সন্ধানে। পোলাপান শোর তুলে সেই গাড়ির পেছন পেছন বেজান ছুটছে।

কাট্ কাট্ কাট্ কাট্।

ষাট সত্তর আশির দশকের মফসসলের কথা বলি। সেই যায় দিন ভালোর মফসসল। পাড়া-পরিবারভিত্তিক মানুষের সম্পর্ক। এক পাড়া এক পরিবার। পাড়ার সকলে সকলের তরে। আজিজ জ্যাঠা যেমন সকলের জ্যাঠা, দীপন কাকা যেমন সকলের কাকা, কাওসারের বড় আম্মা যেমন সকলের বড় আম্মা। পোলাপানের ঘর গোটা পাড়াটা। এর ঘরে খাচ্ছে, ওর ঘরে শুচ্ছে—সন্ধ্যায় মায়েরা যার যার পোলাপান গুনে গুছিয়ে বুঝে পেলেই হলো।—সেইসব যায় দিন ভালো নিশ্চয়ই বলব কিন্তু হায় আফসোস করি না মোটে। দিন  ফিরে না, যায় কেবল।

বইপত্রের প্রচ্ছদ বানিয়ে অন্নসংস্থান করতে হবে বলে ছিয়াশি থেকে আমি ঢাকায়। বিরানব্বই পর্যন্ত চারুকলায় পড়েছি। নিউমার্কেট কাঁচাবাজার সংলগ্ন শহীদ শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসে থাকতাম। সেটা স্বৈরশাসক এরশাদের আমল। ছাত্র জনতার আন্দোলন জোরদার হলেই বিশ্ববিদ্যালয় 'ক্লোজড সাইনে ডাই' দিত। —অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। আমরা বলতাম এরশাদ ভ্যাকেশন। তেমন এক এরশাদ ভ্যাকেশনে গেছি টাউনে, বিষণ্ন মা একদিন বলল, 'টাউন ঠেঙাতে বেরোনোর আগে একবার তোমার ছোড়দিকে দেখে যেও।'

কোন ছোড়দি? কী হয়েছে? পাড়া-পরিবারে আমাদের দুই ছোড়দি। ঝুলন ছোড়দি, বীনা ছোড়দি। পিংকু দুলির বোন ঝুলন ছোড়দি। বীনা ছোড়দিরা অনেক ভাইবোন। গোলাপদি, দিদিমনি, মেজদি, সেজদি, ছোড়দি, দেবল সজল মাধবী চপল। গোলাপদিকে আমরা ডরাই। সেজদি বিজয়া ভালো গান গায়—কে বিদেশী বন উদাসী...। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ছোড়দি। হায় রে আমার যায় দিন ভালো, কোথাও কোনো সমস্যা নাই, শরীর সামান্য খারাপ, জ্বর জ্বর লাগে, পরীক্ষানিরীক্ষা করে ডাক্তাররা বলে দিলেন ছোড়দির ক্যান্সার হয়েছে। সাতাশির ঘটনা। তড়িঘড়ি পাসপোর্ট ভিসা করে ছোড়দিকে কলকাতায় নিয়ে গেল দেবল। কলকাতায় তখন সবে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল হয়েছে। সেই হাসপাতালে ভর্তি হলো ছোড়দি। সার্বক্ষনিক অ্যাটেনডেন্ট দেবল। ট্রাংক কলের যুগ, টরে-টক্কার যুগ, ছোড়দি কেমন আছে জানা দুরূহ। তবে সে ভালো আছে নিশ্চয়। ভালো হয়ে ফিরবে।

ছুটি ফুরাল। আমি ফিরলাম। আবার মাস চারেক পর এভি—এরশাদ ভ্যাকেশন। টাউনে গিয়ে শুনলাম ছোড়দি ফিরেছে। 'ক্যামোথেরাপি' কথাটা এই প্রথম শুনলাম। ছোড়দিকে ক্যামোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। মাথা ভর্তি চুল ছিল, সব চুল পড়ে গেছে ছোড়দির। ক্যামোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তা হোক, ছোড়দি ভালো হয়ে উঠুক। আমাকে দেখে কত খুশি হলো, 'ভাই রে, তোর এই কী অবস্থা?'

আমার তখন অল্প দাড়ি গোঁফ হয়েছে। শেভ-টেভ করি না।

'তোকে তো পাগলের মতো দেখায় রে ভাই। কাট এইসব।'

আমি হাসি, 'কাটব। তুমি এখন অনেক ভালো আছো বলো।'

চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছোড়দির, 'ভালো রে ভাই। সত্যি অনেক ভালো আছি এখন। এত যত্ন, এত মায়া! ডাক্তার না, এরা দেবতা রে ভাই!'

দেবল বলল, 'মৃণাল সেনের কথাটা বল।'

'অ্যাঁ? হ্যাাঁ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মৃণাল সেন!'

চোখ-মুখ আরো উজ্জ্বল হলো ছোড়দির। চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন একদিন ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ছোড়দির সঙ্গে কথা বলেছেন অনেকক্ষণ। ছোড়দি নিশ্চয় সেরে উঠবে বলেছেন।

দেবল ডিটেইল বলেছিল পরে। ডোনেশন জাতীয় কিছুর ব্যাপার ছিল, ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন মৃণাল সেন। ক্যামেরা ইউনিট ছিল সঙ্গে। 'ভুবন সোম', 'বাইশে শ্রাবণ' 'মৃগয়া'র নির্মাতাকে নিয়ে কারা একটা প্রামাণ্যচিত্র তুলছিল। সেই প্রামাণ্যচিত্রে মৃণাল সেন একজন ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে কথা বলবেন। বিদেশী রোগী হলে ভালো। এপার বাংলা ওপার বাংলা মধ্যিখানে চর বা বর্ডার, ছোড়দি তো বিদেশী অবশ্যই। হুইল চেয়ারে বসিয়ে ছোড়দিকে তারা নিয়ে গেল মৃণাল সেনের কাছে। মৃণাল সেন অনেকক্ষণ কথা বললেন সেই 'বিদেশিনী' আমাদের ছোড়দির সঙ্গে। ক্যামেরার সামনে।

আমাদের ফরিদপুরের মানুষ মৃণাল সেন।

'জীবনে আর কিছু চাই না রে ভাই।' ছোড়দি বলল।

সত্যি আর চাওয়ার কিছু কি ছিল?

আমাদের ছোড়দি বীনা তালুকদার, এই পৃথিবীতে খুব বেশি দিন থাকেনি। নির্দিষ্ট কোন প্রামাণ্যচিত্রে মৃণাল সেনের সঙ্গে সে আছে, আমরা কেউ এখনো জানি না। কখনো জানতে পারব বা পারব না হয়তো।

সেই ছবিটা কি আছে ছোড়দির? চপলকে ফোন করেছিলাম সন্ধ্যায়। সেই ছবি হারিয়ে গেছে। এত বছরে কম জল ঝড় যায়নি। ছোড়দির মৃত্যুর কয়েক বছর পর সেই সাদা কালো ছবিটা দেখেছিলাম। ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে ডাকে পাঠানো। মৃণাল সেনের সঙ্গে ছোড়দির ফটোগ্রাফ। সেই শুটিং-এর সময়ে তোলা। হুইল চেয়ারে বসে আছে উজ্জ্বল ছোড়দি, মৃণাল সেন পরম মমতায় তার হাত ধরে কথা বলছেন। বোঝা যায় ইনি সাধুদার ভাই।

সাধুদা কে?

মৃণাল সেনের আত্মজীবনীমূলক লেখাজোকায় আছেন যে সাধুদা।

কাট্ কাট্ কাট্ কাট্!

শুটিংয়ের গাড়ি যাচ্ছে।

আকালের সন্ধানে যাচ্ছে।

কাট্! কাট্ কাট্ কাট্ কাট্!

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.