‘পাঁচ মিনিটের শহর: ঢাকা—যেখানে আমি থাকতে চাই’

ইজেল

নিক্লাউস গ্রেবার
18 March, 2023, 04:40 pm
Last modified: 18 March, 2023, 04:54 pm
২০ শতকের গোড়ার অথবা মাঝামাঝি সময়ে আঁকা ঢাকার যেকোনো ছবি অথবা তোলা কোনো ছবি দেখলে যে কেউই অবিশ্বাসে চোখ কচলাতে বাধ্য হবে। ওইসব ছবি-চিত্রে তারা দেখবে ঢাকা বাগান, নদীনালা, নদীতীরবর্তী বিহারস্থান ও গাছগাছালিতে ঘেরা সব ভবনে পূর্ণ এক সুপরিসর নগরী। উদ্ভিদ, লেক আর খালবিলের সুবাদে প্রাক্-আধুনিক পর্যায়ে ঢাকা একসময় মানসম্পন্ন এক নগরী ছিল।

বাংলাদেশের ২ কোটি জনসংখ্যার রাজধানী ঢাকায় পোস্টকার্ড খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। 

সাম্প্রতিক সময়ে ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে এই নস্টালজিক যোগাযোগমাধ্যমটির জায়গা দখল করে নিয়েছে, সে কারণে কিন্তু পোস্টকার্ড দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়নি। দশ বছর আগেও একবার বুড়িগঙ্গার তীরে এসেছিলাম আমি। সে সময়ও এই স্যুভেনিরটি খুঁজে পাইনি। অবশ্য ঢাকা নিয়ে কোনো ছাপা গাইডবই তো নেই-ই, এমনকি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতেও এই ক্রান্তীয় মেগাসিটি সম্পর্কে খুব একটা নির্ভওযোগ্য তথ্য দিতে পারে তাও না। কাজেই এ শহরে সাধারণ পোস্টকার্ড খুঁজে না পাওয়ার ব্যাপারটিও স্বাভাবিকই। ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে ঢাকা মনে হচ্ছে খুব একটা ট্রেন্ডি না। 
বাংলাদেশ পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক স্লোগান হচ্ছে 'বাংলাদেশে আসুন, পর্যটকরা আসার আগেই!'

ভারত, নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে পর্যটকের ঢল না আসার অনেক কারণ থাকতে পারে। ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোতেও পশ্চিমা ভ্রমণার্থী বা বাসিন্দা চোখে পড়ে কম। পশ্চিমে আমরা অনেকেই বাংলাদেশ আর তার রাজধানীর নাম জানি কেবল টুকরো-টাকরা খবর থেকে। এসব খবরের সিংহভাগই হয় নেতিবাচক ও একচোখা। এসব সংবাদ পড়ে যে কারও ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে এই তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিংবা অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। আমাদের কেউ কেউ এখনো বাংলাদেশকে সেই ১৯৭১ সালের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ দিয়েই মনে রাখে। ওই কনসার্টের উপস্থাপনায় বাংলাদেশ ছিল বন্যাক্রান্ত, ক্ষুধায় পিষ্ট ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত এক দেশ, যার সাহায্য বড় প্রয়োজন। সেই চিত্রই এখনো অনেকের মনে গেঁথে রয়েছে। পঞ্চাশ বছর বাদে জর্জ হ্যারিসনের সেই অমর লিরিক 'বাংলা ডেশ, বাংলা ডেশ' আজও বোধ হয় বহু পশ্চিমার কানে বাজে। ভারতের ঘরের পাশেই এক সমস্যাপীড়িত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের চিত্রটা পশ্চিমাদের মনে গেঁথে গেছে।

তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ঢাকাকে মনে হবে স্রেফ বিশৃঙ্খল, হই-হট্টগোলে পরিপূর্ণ এক দূষিত নগরী। সহস্র যানবাহনে ভর্তি এক বিশৃঙ্খল শহুরে জঙ্গল। এ জঙ্গল গিজগিজ করছে অস্থির বাসিন্দায়। কাজেই পশ্চিমাদের বিচারে মানসম্পন্ন জীবনযাপনে র‍্যাংকিংয়ের তলানিতে থাকা এই শহরে কে ঘুরতে আসার কথা ভাববে?

হ্যাঁ, এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকেনি। আজকের বাস্তবতায় ওপরে বলা পশ্চিমা নেতিবাচক ক্লিশে চিত্রও অনেকটাই পাল্টে গেছে। সাম্প্রতিক কয়েক দশকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যকে চোখ বুজে উপেক্ষা করে যাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের ত্বরিত উন্নয়ন পশ্চিমাদের কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। এক ঢাকাই সুইজারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণসংখ্যক মানুষকে বুকে ধারণ করে আছে। শহরটি তরতর করে আন্তর্জাতিক মহানগরী হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২২-এর শেষ নাগাদ চালু হয়েছে বহুলপ্রতীক্ষিত মেট্রোরেল। এ ট্রেন মানুষকে ভয়াবহ যানজট থেকে মুক্তি দেবে। 

একটা অনলাইন ভ্রমণ প্ল্যাটফর্মে বলা হয়েছিল, 'ঢাকা এক দৈত্যাকার ঘূর্ণিপাক। যারা এবং যেসব বস্তু এর নাগালের মধ্যে আসার বোকামি করে, তাকেই গিলে খায় সে।' কথাটা পুরোপুরি ভুল না। এই মেগাসিটিতে নানা রূপে, নানাভাবে বিদ্যমান গতি আর চপলতা। ঢাকা আসলেই মাঝে মাঝে জঙ্গলের মতো। তবে শুধু গাড়ি-ঘোড়ার নিনাদপূর্ণ অ্যাসফল্টের জঙ্গল নয়। কিছু কিছু এলাকায় শহরটিতে আসলেই প্রকৃত জঙ্গলের আবহ রয়েছে। গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ সেই জঙ্গল, সেখানে ক্রান্তীয় সূর্যের নিচে চকচক করে লেক। সেই জঙ্গল মুখর হয় পাখির কুজনে, কানে এসে কোমল পরশ বোলায় রিকশার মৃদু টুংটাং ঘণ্টির আওয়াজ।

সবকিছুই প্রবহমান

ঢাকা নগরীটা এ গ্রহের সবচেয়ে বড় বদ্বীপের ঠিক কেন্দ্রে। হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরের মুখোমুখি আর্দ্র জলাভূমিতে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার মতো প্রমত্তা নদীকর্ষিত নরম এই ভূমিতে সবই কেমন প্রবহমান। এখানে সর্বত্র পাওয়া যায় পানি: বদ্বীপটির শত শত নদী-খালে, সমুদ্রে এবং বর্ষায়। যে বর্ষা নিয়ে আসে উর্বরতা বাড়ানোর বৃষ্টি। এই পানি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমি চাষ ও নির্মাণকে প্রভাবিত করে এসেছে। এ পানি বাংলাদেশিদের আত্মা আর সংস্কৃতির হাড়ে-পাঁজরে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। পানিই আশীর্বাদ, আবার পানিই আতঙ্কের আরেক নাম। পানি যেমন জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বন্যা আর ঝড়ের রূপ ধরে এই পানিই বারবার বয়ে আনে বিপদ। এই পরিস্থিতি এবং ক্রান্তীয় জলবায়ুতে এখানে গড়ে উঠেছে প্রকৃত বদ্বীপ স্থাপত্য, যা একই সঙ্গে পানির জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় আবার পানির বিরুদ্ধে সুরক্ষাও দেয়।

পানি তো বটেই, এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে রকম দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে এখানকার সবকিছুই প্রবহমান মনে হয়। বাংলাদেশ সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। দেশটির আয়তন টেনেটুনে গ্রিসের চেয়ে একটু বড়। অথচ গ্রিসের জনসংখ্যা যেখানে ১০ মিলিয়ন, সেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭০ মিলিয়ন! কৌশলগত অবস্থান, অবকাঠামো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের কারণে কখনো কখনো মনে হয় পৃথিবী বুঝি ঢাকার কাছে এসে বেশি গতিতে ঘোরে। বিস্ফোরক নগরায়ন, যা এমনকি এশীয় মানদণ্ডেও ব্যতিক্রমÑবাংলাদেশকে রুদ্ধশ্বাস গতিতে বদলে দিচ্ছে। ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতেও প্রতিদিন নতুন করে এক হাজার মানুষ আসছে! পূর্বাভাস অনুসারে, বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী নগর অঞ্চলে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ মিলিয়ন মানুষ বাস করবে। এর ফলে ঢাকা পরিণত হবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মেগাসিটিতে।

ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩০ হাজার। আর পুরান ঢাকার মতো এলাকাগুলোতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮০ হাজার মানুষ বাস করে। বার্লিন (বর্গকিলোমিটারে ৪ হাজার) বা লন্ডনের (বর্গকিলোমিটারে ১৫ হাজার) সঙ্গে তুলনা করলেই কেবল কল্পনা করা যায় জঠরে কত বিশাল নগরাঞ্চলীয় ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে আছে ঢাকা।

আসলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষ যে নগরাঞ্চলে বাস করে, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিস্তরীয় সমস্যা নিয়ে এসেছে। প্রথম স্তরের সমস্যা হলো ঢাকা ও অন্যান্য নগরের জনসংখ্যার উচ্চ-ঘনত্ব সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। আবার একই সঙ্গে এ কথাও ভুললে চলবে না যে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো গ্রামাঞ্চলে বাস করে। এছাড়া নগরবিদেরাও জানেন, এই মেগাসিটিকে ধসে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হলো দেশের গ্রামাঞ্চল ও ছোট শহরগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া।

এ কথা সর্বজনবিদিত যে নগর কেন্দ্রগুলো শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিনের কাজ করতে পারে। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশজুড়ে ছোট ও মাঝারি আকারের শহরগুলোকেও আকর্ষণীয় করতে হবে। রাজধানীর মতোই এসব শহরেও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে আজকাল 'রিমোট ওয়ার্ক' করা যায়। এর কল্যাণে বদ্বীপের এক প্রান্তের নিরালা ছোট শহর বড় শহরগুলোর বিকল্প হতে পারে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যৎ ঢাকা ও বাংলাদেশ কতটা সফল হবে সেটি নির্ভর করছে কতটা সফলভাবে একটি বিকেন্দ্রীকৃত নগর নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন করা যায়, তার ওপর। এ সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে বাধাহীন, মসৃণ পরিবহনের জন্যে বিস্তৃত ট্রেন নেটওয়ার্ক ও মেট্রোলাইন। তবে নগর নেটওয়ার্কিং গড়ে তোলা যেতে পারে জলপথগুলোকে পুনঃসচল ও সম্প্রসারিত করে। আবহমান কাল থেকে জলপথগুলো এই বদ্বীপের অর্থনৈতিক লেনদেন ও বসতি গড়ায় ভূমিকা রেখে আসছে। গণপরিবহন সহজলভ্য হয়ে গেলে রিকশার জন্য আলাদা লেন করাও সম্ভব। ২০ বছর আগে কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল ম্যানহাটন বা প্যারিস প্রকৃত অর্থে বাইসাইকেলের শহর হয়ে উঠবে? তাই ঢাকায় যেকোনো মূল্যে রিকশা টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ, রিকশা নগর ক্ষুদ্র অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।

জলের নগরী

অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণের মূল্যও চুকাতে হচ্ছে। এ ছাড়া দ্রুত নগরায়নের ফলে, সময় ও ব্যয়ের প্রচণ্ড চাপের কারণে গড়ে উঠছে চেহারাবিহীন, ঘিঞ্জি, কিউব আকৃতির ভবন। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ঢাকা অঞ্চলকে বৈশিষ্ট্য দানকারী বহু জলাধার হারিয়ে গেছে মাটি ফেলে ভরাট করার কারণে। এতে অবশিষ্ট জলপথগুলো আরও ভারগ্রস্ত, আরও দূষিত হয়ে পড়েছে।

২০ শতকের গোড়ার অথবা মাঝামাঝি সময়ে আঁকা ঢাকার যেকোনো ছবি অথবা তোলা কোনো ছবি দেখলে যে কেউই অবিশ্বাসে চোখ কচলাতে বাধ্য হবে। ওইসব ছবি-চিত্রে তারা দেখবে ঢাকা বাগান, নদীনালা, নদীতীরবর্তী বিহারস্থান ও গাছগাছালিতে ঘেরা সব ভবনে পূর্ণ এক সুপরিসর নগরী। উদ্ভিদ, লেক আর খালবিলের সুবাদে প্রাক্-আধুনিক পর্যায়ে ঢাকা একসময় মানসম্পন্ন এক নগরী ছিল। কিন্তু আজ এ শহরে এক টুকরো সবুজ জায়গা বড় দুর্লভ হয়ে পড়েছে।

তবে ঢাকার অনেক জায়গায় এখনো জলা রয়েছে। জলাধারগুলোর অধিকাংশ নেই হয়ে গেছে, মিউনিসিপ্যাল পানি নেটওয়ার্ক প্রচণ্ড চাপে আছে, তবু মাঝে মাঝেই এ শহরে রূপকথার মরূদ্যানের মতো জলার দেখা মেলে। বৃক্ষে ছাওয়া ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্কের পুকুর এখনো প্রশান্তির ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছগাছালি পরিপূর্ণ কোনো আবাসিক এলাকায় সকালে হাঁটতে বেরোলে মনেই হয় না যে কোনো শহরে আছি। বুড়িগঙ্গার বুকে পণ্য ও মানুষ নিয়ে ছুটে চলা নৌকার দৃশ্য বড় মনোরম। বনানী ও গুলশান এলাকায় ইস্পাত ও কাচের রাজত্ব ক্রমেই বাড়ছে। তবে কয়েক কদম এগিয়ে লেক বনানী বা গুলশান লেকে গেলেই সহসা মনে হবে কোনো শ্যামল শান্তির রাজ্যে চলে এসেছেন যেন। পানির বুকে শহরের ছায়া দেখে মুগ্ধ হতে হয়।
 
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনা কৌশলের সম্ভাবনা কোথায় খুঁজবেন, তা অনুমান করা সহজ। জলাধারপূর্ণ ও নগর অঞ্চলে। ঢাকার স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুত করা ভিশনে পাবলিক স্পেস ও পার্কের সঙ্গে নদীপথ, ভাসমান বাগান, ওয়াটার ট্যাক্সি ও গাছগাছালিতে পূর্ণ আবাসিক এলাকা রাখা হয়েছে।

তবে বৃহৎ পরিসরের নগর পরিবর্তন সাধারণত ধীর ও অনিয়মিত। এ কারণে শহরটির ঘনত্ব কমানোর উদ্যোগগুলো আকুপাংচারের মতো ছোট পরিসরে বিরতি দিয়ে দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা নিয়েছে। এ রকম উদ্যোগেরই অংশ হিসেবে শহরজুড়ে তৈরি করা হচ্ছে কয়েক ডজন ছোট ছোট পার্ক, যাতে মানুষ একটু প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা পায়। কয়েক বছর আগে ঢাকার বৃহত্তম বস্তি কড়াইলের বাসিন্দারা পানির ওপর একটা বাঁশের মাচা বানিয়েছিল। এ মাচা ব্যবহার করা হতো বাচ্চাদের খেলার মাঠ, লাইব্রেরি ও উন্মুক্ত সিনেমা হল হিসেবে। মাঝে মাঝে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নদী ও লেকের তীর দখল করে নেয়। সম্প্রতি এক বৃহৎ পরিসরের অভিযানে পানিদূষণকারী ট্যানারিগুলোকে ঢাকার বাইরে আধুনিক শিল্পাঞ্চলে পাঠানো হয়। সরকারি উদ্যোগে হাতিরঝিল লেকের তীর উন্নত করা হয়েছে। এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ হাতিরঝিলের তীরে হাঁটতে যায়। বড়, সিঁড়ি আকৃতির ঘাটগুলো লেকের তীরকে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মঞ্চ বানিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয় ধানমন্ডি লেক। সবুজে ছাওয়া এই জায়গাটিও ঘুরে যাওয়ার জন্য ছেলে-বুড়োদের কাছে জনপ্রিয় গন্তব্য। ধানমন্ডি লেকের ঘাটে পছন্দের মানুষের সঙ্গে তোলা ছবির চেয়ে রোমান্টিক সেলফি আর কী হতে পারে।

'ফাইভ মিনিটস সিটি'

ঢাকা অনেকগুলো বড় বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মাঝে মাঝে মনে হয় শহরটি বুঝি ধসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। তবে নিবিষ্টভাবে দেখলে এই শহরের কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণ চোখে পড়ে। বর্তমানের নগরবিদদের মধ্যে আলোচিত বৈশিষ্ট্য, যেমন 'ফাইভ মিনিটস সিটি' বা মাইক্রো আরবানিজমের বৈশিষ্ট্য এ শহরে স্পষ্ট।

ঢাকার অনেক জায়গা থেকেই বদ্বীপীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেছে। আদতে বিপুল উন্নয়নের চাপে নেওয়া অসমন্বিত নগর উন্নয়নের কারণে এ শহরের জলাভূমির অনেকটাই কবরস্থ হয়েছে। ঢাকা এখন আর পূর্বের ভেনিস নেই। এ ছাড়া বদ্বীপ শহরের বাস্তবসম্মত ভবিষ্যৎ ভিশন অর্জনের পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যা হোক, অতীত নিয়ে হাহাকার করে তেমন কোনো লাভ নেই। এ ছাড়া অতীতের অনুলিপি ফিরিয়ে আনা সুদূর ভবিষ্যতের আকাক্সক্ষায় বসে থাকারও দরকার নেই। এ দুটোই আমাদের বর্তমানের বাস্তবতা সম্পর্কে অন্ধ করে রাখে। বর্তমান নিখুঁত না হতে পারে, কিন্তু বর্তমানের গুণগুলোও উপেক্ষা করার মতো নয়।

আজকের ঢাকার মোড়ে মোড়ে জলাশয় না থাকলেও শহরটির বেশ কিছু 'তরল' গুণ আছে। এখানে নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যকার সীমারেখা অস্পষ্ট। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক এখানে হাত ধরাধরি করে হাঁটে। এখানে জীবনযাপন আর কাজকে কঠোরভাবে আলাদা করা হয় না। অপরিবর্তনীয় শহুরে কাঠামোর মধ্যেই পুষ্পিত হচ্ছে ভাসমান বিক্রেতা, অনলাইনভিত্তিক হোম ডেলিভারির 'মাইক্রো আরবানিজম', যা সমৃদ্ধ করছে রোজকার নাগরিক জীবনকে। আপনার সিমে টাকা রিচার্জ করতে চান? এ জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বা ডেটা থাকা অত্যাবশ্যকীয় নয়। রাস্তের পাশের সিগারেটওয়ালাও রিচার্জ ব্যবসা করে, তাকে নম্বর দিলেই কাজ হয়ে যাবে। ঢাকা তথাকথিত 'ফিফটিন মিনিটস সিটি'কে এমনভাবে মূর্ত করেছে যে তা ইউরোপের সবচেয়ে প্রগতিশীল নগরবিদেরও কল্পনার বাইরে। ঢাকায় আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি সেবা মানুষের এত কাছে যে একে শুধু 'ফিফটিন মিনিটস সিটি' নয়, 'ফাইভ মিনিটস সিটি'ই বলা চলে!

বহু রাস্তার মোড়ে এবং বহুতল অফিস ভবনের পাশেই হরহামেশা চোখে পড়ে অস্থায়ী বাজারের গাড়ি ও বাজার। এসব বাজারে তাজা সবজি, ফল, মাছ সবই পাওয়া যায়। এমন তাজা ফলমূল, সবজি, মাছ কেবল গ্রামেই পাওয়ার কথা। কারওয়ান বাজার ও নিউমার্কেট এমন দুটি বাজারের উদাহরণ। ঢাকায় শহরের মতোই গ্রামের বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান। বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ছাগলের পাল নিয়ে পশু ব্যবসায়ীও দেখা যায় আকছারই। এখানে তেষ্টা মেটাতে এনার্জি ড্রিঙ্কের জন্য ইউরোপের মতো ভেন্ডিং মেশিনের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় না। প্রায় প্রত্যেক মোড়েই পাওয়া যায় ডাব বিক্রেতা।

ঢাকা যে এত সমৃদ্ধ, তা সম্ভবত শহরটির কয়েক স্তরের বৈচিত্র্য থেকে এসেছে। এ জায়গাটি পলল মাটির মতোই মিশ্র। প্রতিনিয়ত এখানে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে। এখানে স্থানীয়রা আন্তর্জাতিকের সাথে মিশে গেছে, অতীত মিশে গেছে ভবিষ্যতের সঙ্গে, আর 'উঁচু' মিশেছে 'নিচুর' সঙ্গে। ঢাকা জলরঙের মতোই, অনেকগুলো আবরণ নিয়ে গড়ে উঠেছে। এই স্তরগুলো যখন একসঙ্গে সক্রিয় হয়, এ নগর আরও রঙিন হয়ে ওঠে।

কয়েক স্তরের নিত্যদিনের জীবনকে যে নাগরিক সংস্কৃতিকে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে তুলছে, তা নয়—প্রাণবন্ত করে তুলছে শহরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও। অগুনতি ভাসমান বিক্রেতা স্বাধীনভাবে উপার্জন করছে। ভোক্তা ও বিক্রেতার অবস্থান এত কাছাকাছি যে পণ্য অর্থ প্রবাহ হচ্ছে মসৃণভাবে। হাতবদল হওয়া টাকার পরিমাণ সামান্য হলেও রোজ লেনদেনের পরিমাণ কিন্তু কয়েক মিলিয়ন। এই অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। ক্ষুদ্র পরিসরের বাণিজ্যকে অটুট রাখতে হলে শহরের সরকারি ও বেসরকারি উভয় উন্মুক্ত স্থানগুলোকেই আকর্ষণীয় রাখতে হবে। নতুন ভবনগুলোর ভেতরে-বাইরে, উন্মুক্ত স্থানেও সেলস স্ট্যান্ড বা বাজার গড়ে তুলতে হবে। আর তা এমনভাবে করতে হবে যাতে পথচারী ও যানবাহনের চলাচলে কোনো বাধা সৃষ্টি না করে। যেমন বেইলি রোডের মহিলা সমিতির উদাহরণ দেওয়া যাক। সেখানে উন্মুক্ত নিচতলাটা সড়কমুখী। এর মাধ্যমে কমিউনিটি-বিল্ডিং কার্যক্রম করা যায়। আবাসিক এলাকায়ও এ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সম্প্রতি সম্পন্ন বনানী মার্কেটই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বাণিজ্য জেলায় কীভাবে সুসংহতভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। 

ঢাকার 'চার্টা'

এ কথা তো সুবিদিত যে, শহুরে বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে নানা ধরনের আগ্রহ আর বাস্তবতার সমন্বয়ে। অন্যদিকে অনেক ইউরোপীয় নগর, যেগুলোর সিংহভাগই ১৯ শতকের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, দিন দিন একই চেহারার হয়ে যাচ্ছে। এই শহরগুলো অতি ব্যবহার ও পর্যটন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে ফেলছে। কোপেনহেগেন থেকে বার্সেলোনা কিংবা নেপলসে যান, দেখবেন সব শহরেই একই চেহারা বড় বড় চেইন স্টোর, যেগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি টি-শার্ট বিক্রি হয়। দেখা যাবে একই চেহারার গ্রোসারি স্টোর, এয়ারবিএনবির অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের পাশে ফ্যামিলি অ্যাপার্টমেন্ট। রাস্তায় একই ফ্যাশনের পোশাক পরা পথচারী আর তরুণ-তরুণী। রাতের বেলায় শহরের কেন্দ্রের সড়কগুলো এমন নীরব আর ফাঁকা থাকে যে মনে হয় মাছবিহীন নদী যেন। 

এশিয়ার শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা, হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নাগরিকতা গড়ে ওঠে মূলত অনেকগুলো ভিন্ন জিনিস—আগ্রহ, মানুষ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির সমন্বয়ে। কাজ, জীবনযাপন, উৎপাদন ও সংস্কৃতি এখানে হাত ধরাধরি করে চলে—এরা পরস্পরকে অনুপ্রাণিত করে। ঢাকা অবশ্য আমাদের এতগুলো বৈচিত্র্যময় শ্রেণির মানুষের একসঙ্গে বাস করার আরেকটা দিকের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে মানুষের পক্ষে একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা করে সুখ-দুঃখের কথা ভাগাভাগি করে নেওয়া সহজ। এতে একজন আরেকজনের বাড়িতে, অফিসে কিংবা শপিং মলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমে।

 'ঢাকা' শব্দটা এসেছে 'আবৃত' থেকে। কিন্তু এখন ঢাকা কোনো কিছুই লুকায় না। ঢাকার ভূত্বক ফেসবুকের স্ক্রিন মেসেজের মতো চকচকে, সমতল নয়। তবে এ নগর এমন সব চেহারার বই যা আমার প্রতিদিন অসংখ্য গল্প বলে। ঢাকাইয়াদের গল্প, যারা শহরটিকে এক টুকরো স্থাপত্যের চেয়েও বড় করে তোলে। ঢাকাকে বোধ হয় 'পড়া-সিটি' বলা যায়। এ শহর আমাদের আমন্ত্রণ জানায় তাকে পড়ার জন্য।

২০ শতকে অ্যাথেন্সের জন্য 'চার্টা'র প্রয়োজন পড়েছিল। পশ্চিমাদের জন্যও বোধ হয় আজকের ঢাকার 'চার্টা' প্রয়োজন—যে চার্টায় ঠাঁই পাবে সব ধরনের বৈচিত্র্য।

ঢাকার জীবন কতটা ক্লান্তিকর, কঠিন আর স্নায়ু-উৎপীড়নকারী, তা আমি জানি। এ-ও জানি, প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামা লাখ লাখ মানুষের চেহারার পেছনে লুকিয়ে আছে কত নিয়তি। এ শহরের প্রতি আমার আগ্রহ কোনো রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে না। এ শহরকে দেখতে হবে সূক্ষ্ম, সমালোচকের দৃষ্টিতে। অনেক খামতি আছে এ শহরের, সেগুলোও দেখে মেনে নিতে হবে। তবে সে কারণেই শহরটির আরও অনেক সুবিধা ও গুণ খুঁজে বের করাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এর অনন্য সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কোমলে-কঠোরে, পানিতে, সবুজে, ইটের জঙ্গলে মেশানো এক নতুন ধরনের সৌন্দর্য আছে এ শহরের। বুড়িগঙ্গার জীবনীশক্তি আর গতিময়তার কারণে আমি বারবার নদীটির কাছে ফিরে আসি। 'ফাইভ মিনিটস সিটি' আর ক্ষুদ্র-নাগরিকতার উদ্ভাবন, আর বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য আতিথেয়তা আমাকে বারবার বুড়িগঙ্গার তীরে ফিরে আসতে বাধ্য করে।

পানিকে ফের নগর উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বানানোর জন্য ছোট্ট কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপ নিচ্ছে ঢাকা। এ উদ্যোগ আমাকে আশা জোগাচ্ছে, অচিরেই খাল, লেক আর পুকুরের রূপে এই ঘনবসতিপূর্ণ নগরীতে তারল্যের শরীরী রূপ দেখতে পাব। আমার আশা, একদিন আমি ঢাকা থেকে পোস্টকার্ড পাঠাতে পারব। সেই পোস্টকার্ডে থাকবে জলপথে পূর্ণ শ্যামল নগরের ছবি, যা আমরা আগে কখনো দেখিনি। তবে এই লেখা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরে আমি আনন্দিত, কারণ আমার কাছে ঢাকা ইতিমধ্যে সেই শহরের রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে—যেখানে আমি থাকতে চাই।


  • ( লেখক: স্থপতি, কিউরেটর, প্রতিষ্ঠাতা গ্রেবার অ্যান্ড স্টাইগার আর্কিটেক্টস, লুসার্ন সুইজারল্যান্ড। কিউরেটর বেঙ্গল স্ট্রিম। শিক্ষক লুসার্ন ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লাইড সাইন্স অ্যান্ড আর্টস )
  • ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ হোসেন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.