শীতলক্ষ্যার শুশুকরাও হারিয়ে যাবে! 

ইজেল

28 January, 2023, 04:55 pm
Last modified: 28 January, 2023, 05:02 pm
২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল চরসিন্দুর ফেরিঘাট-সংলগ্ন নদীতে একটি মুমূর্ষু শুশুকের বাচ্চা ভেসে ওঠে। খবর পেয়ে বন্যপ্রাণী রক্ষা সমিতির সেই তরুণেরা ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। সেখানে গিয়ে কিছুটা শুশ্রুষা করে তারা বাচ্চাটিকে আবার নদীতে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সমস্ত জলই যেখানে পরিণত হয়েছে বিষাক্ত তরলে, সেখানে ওরা বেঁচে থাকবে কী করে?
বিষেল জলের প্রভাবে ভেসে উঠা শুশুকের বাচ্চা/ ১৫ এপ্রিল, ২০০৬

আজ থেকে দুই দশক আগে নরসিংদী জেলার সুলতানপুর নামক গণ্ডগ্রামে 'বন্যপ্রাণী রক্ষা সমিতি' নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। একজন স্কুলশিক্ষকের নেতৃত্বে একদল তরুণ বন্যপ্রাণী রক্ষায় মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে। গ্রামের মানুষের কাছে তখন এটা ছিল সম্পূর্ণ এক নতুন বিষয়। তাই কখনো কখনো তাদের তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছিল। বিরল বালুবোরা সাপের জীবন বাঁচানোর জন্য একটি জাতীয় দৈনিক তাদের 'এ সপ্তাহের নায়কে' ভূষিত করে। এতে তাদের উদ্যম আরও বেড়ে যায়।

তখন জেলার বিভিন্ন স্থানে খোলা বাজারে শুশুকের তেল বিক্রি হতো। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস ছিল, শুশুকের তেল বাত রোগের মহৌষধ। এক শ্রেণির লোক রাতের আঁধারে ট্যাঁটা দিয়ে শুশুক হত্যা করে তা কবিরাজদের কাছে বিক্রি করত। 

সেই যুবকেরা শুশুক হত্যার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং এ বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যায়। ওদের নিয়মিত নজরদারি ছিল পার্শ্ববর্তী শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর। মাঝেমধ্যে জেলেদের জালে আটকা পড়েও শুশুক মারা পড়ত। 

একবার খবর পেয়ে ওই যুবকেরা ছুটে যায় লক্ষ্যার তীরে। সেখানে তখন পড়ে ছিল একটি শুশুকের বাচ্চা। জালে আটকা পড়ার পর জেলেরা সেটাকে পানিতে না ছেড়ে ডাঙায় ফেলে দেয়। মৃত বাচ্চাটির মুখ থেকে তখনও মায়ের দুধ গড়িয়ে পড়ছিল। এতে যুবকদের মন খুবই খারাপ হয়ে যায়। ওরা আরও সচেতন হয়ে ওঠে শীতলক্ষ্যার শুশুকদের জীবন রক্ষার জন্য।

শুশুক হচ্ছে দেশের মিঠা পানির একমাত্র জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী, অনেকে যাদের শিশু বলেও ডাকে। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় River dolphin/ Gangetic dolphin. আর এদের বৈজ্ঞানিক নাম Platanista Gangetic.

একটি পূর্ণবয়স্ক শুশুক সর্বোচ্চ ১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে, যদিও ১৩ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা শুশুক ধরা পড়ার রেকর্ডও রয়েছে। এদের মাথার অগ্রভাগে রয়েছে লম্বা একটি ঠোঁট। ওপর ও নিচের চোয়ালে রয়েছে প্রায় ৩৩ জোড়া করে দাঁত। এদের দেহের আকৃতি অনেকটা টর্পেডোর মতো, তাই পানির নিচ দিয়ে এরা দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে। 

শুশুক দক্ষ শিকারি। ছোট মাছের পাশাপাশি বড় আকৃতির বোয়াল, কাতল, রুই, আইড় ইত্যাদিও রয়েছে এদের শিকার তালিকায়। অনেকসময় শুশুকের ধাওয়া খেয়ে বড় বড় মাছ প্রাণ বাঁচাতে ডাঙায় উঠে আসে। শুশুক খুব বুদ্ধিমান এবং শান্ত স্বভাবের স্তন্যপায়ী প্রাণী। 

এই সুরমা রঙের প্রাণীগুলির দেহের তুলনার চোখ কিন্তু খুব ছোট ছোট। নদীতে একটা নির্দিষ্ট সীমানাজুড়ে এরা জোড়ায় জোড়ায় বাস করে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে এরা নিজেদের সীমানা অতিক্রম করে না।

শুশুক বাচ্চা দেয় বর্ষাকালে। একটি থেকে দুটি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে বাচ্চারা চটপটে হয়ে ওঠে। বাচ্চারা দেখতে খুবই সুন্দর। মায়ের সঙ্গে যখন একটু পরপর জলের উপর ভেসে ওঠে, তখন এক চোখ জুড়ানো দৃশ্যের অবতারণা হয়।

শুশুক যেসব নদীতে বাস করে সেসব নদীর তীরে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই এদের দেখা পাওয়া যায়। এরা কিছুক্ষণ পরপর শ্বাস নেয়ার জন্য পানির ওপর ভেসে উঠে। শ্বাস নেয়ার সময় এরা 'হুম' বা 'হুশ' বলে এক ধরনের শব্দ করে। এজন্য অনেকে এদের হুম মাছ নামেও ডাকে।

সেই উদ্যমী  তরুণেরা মানুষের হাত থেকে শুশুকদের বাঁচাতে পারলেও রক্ষা করতে পারেনি শিল্প দানবের আগ্রাসন থেকে। তখন প্রায়ই রাতের আঁধারে পলাশ উপজেলার দুটি সার কারখানা থেকে লক্ষ লক্ষ গ্যালন তরল অ্যামোনিয়া বর্জ্য ফেলা হতো নদীতে। এর ফলে নদীর জলে অক্সিজেনের মাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যেত। 

আর তাতে বোয়াল, রিটা, চিংড়ি, গোলশা, টেংরা, বাইম, বাহোক বাইমসহ নানা জাতের মাছ প্রাণ বাঁচাতে নদীর কিনারায় চলে আসত। এই সুযোগে চরসিন্দুর ও মোক্তারপুর ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী লোকজন আলো নিয়ে ছুটে আসত মাছের লোভে। নির্জন নদীতীর আলোকিত হয়ে উঠত সারি সারি টর্চ লাইটের আলোয়।

পরদিন নদীর বুকে ভেসে উঠত নানা জাতের ছোট-বড় মাছ আর জলজ প্রাণীর দেহ। এসব মৃতদেহের লোভে নদীর তীরে লাইন ধরে বসে থাকত কানিবক, সাদা বক, কাকসহ নানাজাতের মৃতভোজী পাখি। ঝোপের আশ্রয় ছেড়ে নদীর পাড়ে এসে ঘুরে বেড়াত সর্বভুক গুইসাপ। আকাশে উড়ে বেড়াত শত শত চিল। 

মোটকথা, সমস্ত এলাকাজুড়ে ভেসে উঠত ভয়াবহ এক মহামারির প্রতিচ্ছবি। সে সময় প্রায়ই নদীর বুকে ভেসে উঠত শুশুক শিশুর মৃতদেহ। শুশুকেরা এমনিতেই স্পর্শকাতর প্রাণী, তাই বিষাক্ত অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝে প্রাণ হারাত বাচ্চারা। 

২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল চরসিন্দুর ফেরিঘাট-সংলগ্ন নদীতে একটি মুমূর্ষু শুশুকের বাচ্চা ভেসে ওঠে। খবর পেয়ে বন্যপ্রাণী রক্ষা সমিতির সেই তরুণেরা ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। সেখানে গিয়ে কিছুটা শুশ্রুষা করে তারা বাচ্চাটিকে আবার নদীতে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সমস্ত জলই যেখানে পরিণত হয়েছে বিষাক্ত তরলে, সেখানে ওরা বেঁচে থাকবে কী করে?

সে সময় স্থানীয় বন্যপ্রাণী রক্ষা সমিতির যুবকেরা চেষ্টা চালিয়ে যায় এই দূষণ রোধের জন্য। বেশ কিছু জাতীয় দৈনিকে এ বিষয়ে কিছু প্রতিবেদনও ছাপা হয়।

কিন্তু সেই যুবকেরা পারেনি। আসলে এত বড় শিল্প সাম্রাজ্যের সাথে গ্রামের কিছু সাধারণ যুবকের তো পেরে ওঠার কথা নয়!

ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। শীতলক্ষ্যার শুশুকদের আজ বড় দুর্দিন। উজান-ভাটির কোথাও আর তাদের তেমন একটা দেখা যায় না।

তবু অনেকের মনে কৌতূহল জাগতে পারে, বর্তমান সময়ে শীতলক্ষ্যার শুশুকেরা কেমন আছে? এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, মোটেও ভালো নেই। 

ঘোড়াশাল থেকে লাখপুর পর্যন্ত নদীর ২০ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে এক ব্যক্তিগত জরিপ চালিয়ে মোটামুটি ভয়াবহ এক তথ্য পাওয়া গেছে। ২০ বছর আগে এ জায়গাটুকুতে ২০০-র অধিক শুশুকের বিচরণ ছিল। সেই সংখ্যা এখন ২০ থেকে ২৫-এ নেমে এসেছে। 

আমার এই জরিপটি সম্পর্কে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। শুনেছি কোথাও কোথাও বন্যপ্রাণী জরিপে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়। আসলে সদিচ্ছা এবং মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থাকলে এটা মোটেই ব্যয়বহুল কিংবা কষ্টসাধ্য কাজ নয়।

যাহোক, শুধু এ অঞ্চলে নয়, শীতলক্ষ্যার সমস্ত সীমানাজুড়েই শুশুকেরা আজ মহাবিপন্ন এক প্রাণী। উজান-ভাটির নানা স্থানে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা। দূষিত জল ছেড়ে বিশুদ্ধ জলে যে পালিয়ে যাবে, সে সুযোগও নেই শুশুকদের। ভয়াবহ এক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে দেশের মিঠা পানির একমাত্র জলজ স্তন্যপায়ীটির জীবন। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে শীতলক্ষ্যার বুক থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে শুশুক কিংবা শিশুর অস্তিত্ব।

বন্যপ্রাণী রক্ষা সমিতি নামের সেই সংগঠনটির অস্তিত্বও আজ আর নেই। সেই যুবকেরা জীবিকার অন্বেষণে নানা স্থানে নানা কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। শুধু বাচ্চু স্যার রয়ে গেছেন। তিনি সেই পুরোনো সংগঠনটিকে আবার নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছেন।

বি.দ্র.: আরিফ ভূঁইয়া, এবিএম সাহেদ উদ্দিন, আবুল হোসেন, শামীম মিয়া, দেলোয়ার হোসেন, ফরহাদ কাজী, জাকির হোসেন- সেই উদ্যমী তরুণদের নাম না লিখলে আসলে এই লেখাটি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.