গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: ‘আমি এক সুখী বুড়ো বালিকা’ (শেষ পর্ব)

ইজেল

19 January, 2023, 04:35 pm
Last modified: 19 January, 2023, 05:52 pm
২৪ ফেব্রুয়ারিতে ৮০ বছরে পা দিলেন পণ্ডিত, লেখক, অনুবাদক, মতামত নির্মাতা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। আনজুম ক্যাতালের সাথে তার আলাপচারিতার শেষ অংশ পরিবেশন করা হলো এখানে। ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন সৈয়দ মূসা রেজা

আমি দুই অসধারণ মহিলা গায়ত্রী চক্রবর্তী এবং মহাশ্বেতা দেবীর মধ্যে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধন গড়ে উঠতে দেখেছি। বিভিন্ন দিক থেকে নানা অমিল এবং আলাদা হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে এখনও অনেকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং মিল রয়েছে। পিতৃতান্ত্রিকতাকে অস্বীকৃতির গুলতি এবং তীরের বিরুদ্ধে অন্তত কষ্টার্জিত জয় নয় বরং কঠোর প্রতিরক্ষা ব্যূহ করেন তারা। আমার নজরে পড়েছে, তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। আমি ভাবলাম তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন কি না। গায়ত্রী চক্রবর্তী কথা বললেন। 

সিগাল দফতরে আপনার সাথে দেখা হওয়ার কথা মনে করতে পারছি। মহাশ্বেতাদিকে নিয়ে অনেক কাজ করা বাকি সে সময়ে আপনি সেখানে যান। এ ছাড়া আপনার বিদ্যালয়গুলো...

গায়ত্রী: মহাশ্বেতাদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল প্রচণ্ড টানাপড়েনের। এ থেকে কখনোই আমি বের হয়ে আসতে পারিনি। তার সাথে আমার দেখা হয়েছে এতে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। তবে তার সাথে সম্পর্কটি ছিল খুবই অদ্ভুতগোছের। নানা ভাবেই মহাশ্বেতাদিও ভালোবাসাময় এক শিশুকালের ফসল। তার মা বাবা ছিলেন দারুণ প্রতিভাধর। অবশ্য আমাদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্র ছিলো পুরোপুরি ভিন্নতর। মহাশ্বেতাদি শেষ অবধিই ছিলেন মনীশ ঘটকের আদরের মেয়ে। অন্যদিকে আমি পরিবারের পরিমণ্ডল থেকে বের হয়ে এসেছি। মানুষ বন্দনা করে এমন স্বভাবের নই। অন্যদিকে মহাশ্বেতাদিকে ঘিরে রয়েছে বন্দনাকারী মানুষজনের বিশাল এক পরিমণ্ডল। ওই পরিমণ্ডলে আমার স্থান করে নেওয়ার মতো কোনও অবস্থা নেই। কাজেই তার সাথে আমার একধরণের অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়। পরিণামে তিনি বিদ্যালয়গুলো নিয়ে আমার তৎপরতাকে সমর্থন যোগাতে পারেননি। কেনও পারেননি তাও আমি বুঝতে পারি। 

তার স্কুল নিয়ে তৎপরতার জন্ম হলো প্রকৃত শিক্ষার প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকে। স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেড়ে ওঠা, যার সাথে নম্বর, পদ মর্যাদা এবং পরীক্ষায় পাস করার সাথে যার কোনও সম্পর্ক নেই। তার গভীর মর্মমূল থেকে এসেছে কিছু বিষয় যা তাকে তিনি শিক্ষক হতে সাহায্য না করে পারেনি।

গায়ত্রী: স্কুলগুলো করা হয় আসলে এই কারণে যে প্রশান্ত রক্ষিত, ওই এলাকার একজন তরুণ কর্মী লক্ষ্য করে যে আমি যখন সেখানে যাই, তখন আমি লোকদের কিছু কিছু শেখাতাম। আমি হয়ত বলতাম, "এই, সারথি! তোমার নামের বানান এমন কেন? অবশ্যই নাম লিখতে 'র' ব্যবহার করতে হবে।" কিংবা ভাঙ্গা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে মাটিতেই আঁক কষে গণিতের সাধারণ একটি সমস্যার সমাধান করে দিতাম। 

এ প্রেক্ষাপটে প্রশান্ত আমাকে চিঠি দিল, দিদি কেবল টাকা দেওয়ার বদলে কেনও কয়েকটা স্কুল বানান না? তারপর আমি সেখানে কাজ করা শুরু করলাম এবং বিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করেই গড়ে উঠল। 

কিন্তু রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণে সেগুলো শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো। আর আমিও ২০ বছরের সব কাজের ক্ষতি স্বীকার করে পুরুলিয়া ছাড়তে বাধ্য হলাম। 

আমাকে ওই এলাকায় পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সত্যিই মহাশ্বেতার প্রতি কৃতজ্ঞ। মহাশ্বেতার সাথে পরিচয় না থাকলে আমার পক্ষে ওই এলাকায় ঢোকাই সম্ভব হতো না। তবে স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে কখনোই তিনি চিন্তা-ভাবনা করেননি বা আমার এ ধরণের কাজও মেনে নেননি। নানা জায়গা থেকে তহবিল যোগাড় করে তিনি অবশ্য কয়েকটি ছোট বিদ্যালয় ভবন তৈরি করেছিলেন। তবে আমি যতদূর মনে করতে পারছি তিনি কখনোই কোনও স্কুলের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। এ ছাড়া মহাশ্বেতাদি আমার সমর্থনে এগিয়েও আসেননি। 

তবে এটি আমি পুরোপুরি বুঝতে পারি। আমার খাতিরে গ্রামীণ এলাকার এক সহযোগীকে এত সহজে পরিত্যাগ করা মহেশ্বেতাদির পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং তাই তিনি আমাকে সাহায্য করতে পারেননি। তারপরও আমাদের মধ্যে একটি কৌতূহলোদ্দীপক সম্পর্ক ছিল।

আবারও তার টেরোড্যাক্টিল নিয়ে লিখেছি। আমি অবশ্যই মনে করি এটি তার এক দুর্দান্ত কাজ। প্রবন্ধটি রাধা চক্রবর্তী সম্পাদিত হয়ে রাউটলেজ সংকলনে প্রকাশিত হচ্ছে। এই লেখাটি পড়ার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারবে আমি কতটা বড় হয়েছি আর এটি আমার উপরও কতটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। এ সব দেখার জন্য এ প্রবন্ধ তোমার পড়া উচিত। আরেকটি অংশ আছে যা আমি কখনো অনুবাদ করিনি। জগোমোহনের মৃত্যু-এটি একটি হাতিকে নিয়ে লেখা । উফ! আমি এমন লেখা কল্পনাও করতে পারি না। কিছু কিছু লেখা আছে যা তিনি লিখেছিলেন যেগুলো সত্যিই দারুণ চমৎকার।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। ছবি: সংগৃহীত

তিনি নানা ভাবে একজন দুঃখজনক ব্যক্তিত্বের, দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ। তবে বেশিরভাগ মানুষ তা বুঝতে পারেন না। মানুষ তাকে একটি ভিন্ন ধরণের বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখেন। আমি মনে করি এখন হয়ত মানুষ মহাশ্বেতার বাস্তবতাকে কিছুটা ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করবে। কিন্তু তার সাথে আমার সম্পর্ককে আমি প্রচণ্ড টানাপড়েনের হিসেবে অভিহিত করি।

একজন নারীবাদী কর্মী হিসেবে তাকে নিয়ে কথা বলাটা এখন স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এবং এটি গায়ত্রীদির সাথে কথোপকথনে হংকং'এ ক্যান্টনিজ শেখার বিষয়টি অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু করি। অবশ্যই কেন না?

গায়ত্রী: সেই দিনগুলোতে, ১৯৮৪ থেকে হংকংয়ে অনেকবার গিয়েছি। এক পর্যায়ে আমি হংকং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পড়াতাম এবং অনিবার্যভাবে আমি ক্যান্টনিজ শিখলাম। অন্য কারণও ছিল। আমি সবসময়ই অ্যাক্টিভিস্ট বা সক্রিয়বাদী। এর ভিত্তিতে ভাবমূর্তি তৈরি করে তা বিকানোর চেষ্টা করিনি। তাই সবসময় সে দিকে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেছি যাকে পরে আমি 'কল্পনাপ্রবণ সক্রিয়বাদ' বা 'ইমাজেনেটিভ অ্যাক্টিভিজম' বলা শুরু করি। 

ওখানে কোরীয় নারী কর্মীরা ছিলেন। তারা 'স্থায়ী ভাবেই অস্থায়ী ভিত্তিতে' কাজ করতেন। কখনোই কোনও ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন না এবং তারা প্রতিরোধ করতে এবং কোম্পানির কাছ থেকে কিছু কিছু সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। এ কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর বৃত্তি প্রদান করত। একদিকে তলে তলে তারা কোরীয় নারী কর্মীদের ওপর অবিশ্বাস্য অত্যাচার চালাত। অন্যদিকে 'তরুণদের সহায়তা' করার লোক দেখানো তৎপরতার চালাত। এ সব মোটামুটি সাধারণ ঘটনাই ছিল। সে সময় আমি হংকংয়ের কাউলোনে শিক্ষকতা করতাম। এশীয় লেবার মনিটর নামের একটি দুর্দান্ত সাময়িকীর দফতর ওখানে ছিল। সাময়িকীটির দফতরে একদিন গেলাম। তাদেরকে বললাম, নারীরা (কোম্পানির) দ্বিমুখী নীতির মোকাবেলা করেছেন এবং তাদের পক্ষে কী ভাবে নারী হিসেবে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হলো। 

আর ওখানকার এক কর্মী বললেন, অধ্যাপক স্পিভাক কেউ এ কথাটা জিজ্ঞাসাই করেন না। কেউই জানতে চান না কোন চেতনাবোধ এ সব নারীর এমন ভূমিকা পালনকে সম্ভব করে তুলেছে। আর সত্যিই যদি আপনি তাদের মনের কথা জানতে চান তবে আপনাকে কিছুটা ক্যান্টনিজ শিখতেই হবে। এ কারণ হলো, প্রথমত আপনি তাদের সাথে তাদের হৃদয়ের ভাষায় কথা বলবেন। দ্বিতীয়ত তারা এ ক্ষেত্রে আপনার চেয়ে তারা কিছু একটা অনেক ভালো ভাবেই জানবে, আপনি কোনদিনই তাদের মতো চমৎকার ক্যান্টনিজ বলতে পারবেন না। এর মধ্য দিয়ে একটা পারস্পারিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। 

ভাবতো, এশীয় লেবার মনিটরের দফতরের ওই নারীরা আমার জন্য কী করেছে! কোথা থেকে কী শেখা যায় সে শিক্ষা দিয়েছে! আমি সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিখেছি এবং তার ভিত্তিতে এখনও কাজ করছি। উদাহরণস্বরূপ, আমার স্কুলগুলোর কথা বলা যায়। সংস্থাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে পরিণত করা কাজ সত্যি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর নারীবাদী এবং সক্রিয়বাদী বা অ্যাক্টিভিস্টদের বন্ধু আপনি। অ্যালিস ওয়াকারের সাথে আপনার ভাল জানাশোনা রয়েছে। জুডিথ বাটলারকে চেনেন। এ ছাড়াও আরও অনেকে রয়েছেন...

গায়ত্রী: 'নারীবাদ'—শব্দটি হলো এক ধরনের সংক্ষিপ্ত শব্দরূপ, প্রকৃত কোনো উদ্ধৃতি ছাড়াই লোকে শব্দটি ব্যবহার করে। এর কারণ হলো নারীবাদ-এর কোনো নেতা নেই। মার্কসবাদে মার্কস আছেন। নারীবাদে—কেউই নেই। (হাসি)।

নারীবাদে একটা ধারা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল। কারণ আমার মা সবসময় নিজের মতো করে চলতেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যখন আমার বয়স ১৫, আমি সবেমাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমি একটি বড় মেয়ে, দেখতে সুন্দর, ভাল পরিবার, এবং আমার বাবা দুই বছর আগে মারা গিয়েছিলেন, এবং আমার মা বাঙ্গালী বিধবা তখন তার বয়স ৪৩। ঠিক? যখন আমার জন্ম হয় তখন মায়ের বয়স ছিল ২৮। 

সে আমাকে বলল, তুমি জানো গায়ত্রী, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ বা পারিবারিক বিয়ে সব সময় খারাপ না। আমার মা বাংলায় এমএ ছিলেন এবং তিনি যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতেন তখন উঁচু স্তরের বাংলায় কথা বলতে পারতেন। আমি যে শব্দগুলিকে "লিবিডিনাল চয়েস" হিসেবে অনুবাদ করেছি তখন তিনি বাংলায় যে সব কথা বলছিলেন তার সাথে শব্দ দুটো মিলে যায়।

তিনি বলেছেন, কারও লিবিডিনাল আবেগজাত প্রেমে পড়া (তথাকথিত), সে পছন্দটি অগত্যা একটি পছন্দ নয়। তিনি বলেন, পারিবারিক ভালো বিয়েতে বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কী ভালো হবে তা খুঁজে বের করতে যত্নবান হোন – অনেক তত্ত্ব-তালাশ করা হয়, এ বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি। পারিবারিক বিয়ে সফল হওয়ার একমাত্র উপায় যদি বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সম্পর্কে ভালো করে জানেন, জানেন যে কী তার সন্তানকে খুশি করবে।

কিন্তু এরইমধ্যে পরিবারের বাইরে তোমার এমন একটি জীবন রয়েছে যে আমি ঠিক জানি না কীসে খুশি হবে তুমি। তোমার বিয়ে আমি ঠিক করতে পারব না। কথাটা কল্পনা করুন। আমার মা আমাকে বলতেন যে আমার শরীরের যত্ন নেওয়া উচিত - সাঁতার কাটা, ব্যায়াম করা উচিত - এবং সেই দিনগুলোতে এ সব খুবই অস্বাভাবিক ছিল। লোকেরা যখন মার কাছে আমার সমালোচনা করতেন যে আমি তাকে সত্যিই অসুখী করেছি – তুমি জানো, আমার কোনও স্বামী নেই, কোনও সন্তান নেই –(এ সব সমালোচনার জবাবে) আমার মা বলতেন, যেমনটি তিনি আমাকে বলেছিলেন, আগে গায়ত্রী সম্পর্কে কথা বলার অধিকার অর্জন করুন, তারপর তাকে নিয়ে কথা বলুন। (এতেই রয়েছে) নারীবাদের ছোঁয়া।

এবং এছাড়াও, আমাকে অবশ্যই বলতে হবে মাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে মেনে নিতে পেরেছিলেন আমার বাবা। বাবা এ কথা স্বীকার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও অবশ্যই এই জাতীয় তুলনা চলে না। এমনটি হয়ত সম্ভব হয়েছিল বাবার চেয়েও চৌকস ছিলেন মা। কোনও বিরূপ ভাবনা ছাড়াই ... এটা এমনই প্রোটো- ফেমিনিজম বা আদি-নারীবাদী পরিস্থিতি যা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। আর তোমাকে আগেই বলেছি প্রেসিডেন্সিতে কী সব ঘটেছে।

কিন্তু তারপরে আমি একাডেমিক নারীবাদীদের প্রথম প্রজন্মের অংশে পরিণত হই। জুডিথ বাটলার, বেটি ফ্রিডান , জেন মার্কাস, গ্লোরিয়া স্টেইনমের সাথে বন্ধুত্ব হয়। – তারা সবাই বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং সাধারণভাবে বলতে গেলে, উদার নারীবাদী। এবং আমি যখন তাদের সাথে ছিলাম তখন আমরা সবাই সমান ছিলাম। মানে, সঙ্গত কারণেই বেটি ফ্রিডান, গ্লোরিয়া স্টেইনেম অনেক বেশি খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু আমি যখন তাদের সাথে ছিলাম, তখন আমি তাদের সমতুল্য হিসেবেই ছিলাম। এই অনুভূতির মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা আমার নারীবাদকে চিহ্নিত করেছে।

আর অন্য ধরনের নারীবাদ ছিল বাংলাদেশে। ফরিদা আখতার – আমার মনে আছে ফরিদার সাথে তাদের এনজিও প্রবর্তনা'র সদস্য হিসেবে ১৯৯৪ সালে কায়রোতে জাতিসংঘের প্রথম এনজিও ফোরামে গিয়েছিলাম। এ ছিল খুব ভিন্ন ধরনের এক অভিজ্ঞতা। ফরিদার সাথে আমি এক ধরণের বাঙালি নারীবাদ নিয়ে খুব সক্রিয় হয়ে উঠি। তখন আমি বুঝতে পারি যে আমি পশ্চিমবঙ্গের নারীবাদ সম্পর্কে খুব একটা জানি না। তাই আমি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে মধ্যমগ্রাম হয়ে সারা পথ হেঁটেছি, নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক সোমিনী সেনগুপ্তার খালার সঙ্গে। এও একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা।

ভারতীয় নারীবাদের সাথে কাজ করার তেমন কোনও কৃতিত্ব আমার নেই – ভারতে একটি খুব শক্তিশালী নারীবাদী, নারী আন্দোলন রয়েছে, কিন্তু সেই বিশেষ ঘটনার সাথে আমার তেমন কোনও সম্পর্কই নেই। আমি এটার অনুরক্ত করি, আমি যখন সম্ভব হয় তখন এতে যোগ দিই। কিন্তু আমার দুইটি দিক রয়েছে, প্রথমত, বাংলাদেশের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নারীবাদের সাথে জড়িত হই, এবং দ্বিতীয় প্রজন্ম বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাডেমিক নারীবাদের প্রথম প্রজন্মের সাথে জড়িত। এ এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। 

(তিনি বেশ ক্লান্ত। আলাপচারিতা শেষ করার সময় হয়েছে, যদিও আমরা আরও অনেক বিষয় কথা বলতে —এবং হাসাহাসি করতে পারি—অনেক অনেক বিষয় আছে।) তাই আমি জানতে চাই, আপনি ৮০ বছর বয়সী, এখন আপনার প্রত্যাশাগুলো কী?

গায়ত্রী: আমি দ্যু বোয়েসকে নিয়ে লেখা আমার বই শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমি যা চাই তার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে এটাকে আটকে রেখেছি। কিন্তু আমাকে এটা শেষ করতেই হবে। আমি তাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। তাকে বোঝার সক্ষমতা আমার আছে কিনা জানি না। তবে শিরোনামটি খুব অদ্ভুত, এটি হলো- মাই ব্রাদার বারগার্ড। ডব্লিউ ই বি দ্যু বোয়েস তাই না? উইলিয়াম এডওয়ার্ড বারগার্ড ডু বোইস। এবং যেভাবে তিনি বারগার্ড নামে পরিচিত হয়েছেন তা সত্যিই বেশ আকর্ষণীয়। তাই একে কি বলা যায়।

আমরা বাংলা দ্বিভাষী সংস্করণ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছি, এখনও একে আর্থিক দিক থেকে নিরাপদ করার চেষ্টা করছি। এটি দারুণ উত্তেজনায় ভরপুর প্রকল্প। আমি এ প্রকল্প দেখার জন্য অপেক্ষা করছি।

এবং তারপরে রয়েছে রেডিয়টিং গ্লোবালিটি (সেনেগাম্বিয়া এবং ফরাসি ভারতে তথাকথিত বিশ্বায়নের প্রাগৈতিহাসিক) প্রকল্প যেখানে লক্ষ্মী সুব্রামানিয়ান, আমি এবং অন্যরা একত্রিত হয়েছি। আমাদের সাথে ছিলেন পরলোকগত হরি বাসুদেবন।

তারপর রয়েছে আমার বিদ্যালয়গুলো। বিদ্যালয়গুলোও কাজ করতে শুরু করছে। জ্ঞানগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজ্ঞাকে কীভাবে সাধারণীকরণ উপযোগী করে তোলা যায় এবং ভোটারদের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রকে কীভাবে ভোট দিতে হয় সে সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে সে কাজটি করার চেষ্টা থেকে আমি শিখেছি, কীভাবে আমরা তাদের বোঝাতে পারি যে বর্তমান সময়ে মহা জলবায়ু বিপর্যয়ের সময়ে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও তারাই সম্ভবত যা করা দরকার তুলনায় কম কাজ করেছে। তবে পরিবর্তন ঘটছে। সত্যিই ঘটছে।

এতটা বদলে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমি তাদের বলেছি, আমি জানি না কীভাবে আপনাদের ছোঁব। কারণ আমরা আপনার সাথে যে সব আচরণ করেছি। অন্যদিকে, আমি আপনাকে রোমান্টিক করে তুলছি না, কারণ, ফ্রেয়ার যেমন বলেছেন - এবং আমি তাদের সবাইকে বলি - নির্যাতিতরা উপ-নিপীড়ক হতে চায়। তাই আপনি আমাদের মতোই লোভে পরিপূর্ণ, কিন্তু আমরা নৈতিকভাবে ক্ষুব্ধ বোধ করি কারণ আমাদের কাছে অর্থ আছে। এখন আপনি অর্থোপার্জন করছেন, লোভ ইত্যাদি ইত্যাদিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

এ সব প্রকল্প আমার কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি এখনও যতবার পারি সেখানে ছুটে যাই। আমি এখনও একটি মোটরবাইকের পিছনে বসতে পারি, এবং এখন আমি অনেক বৃদ্ধ হয়েছি আমি অনলাইন থেকে স্থূল ব্যক্তির জন্য একটি বেল্ট কিনেছি, ৭৩ ইঞ্চি। (হাসি) তাই যখন আমি মোটরবাইকের পিছনে উঠি তখন আমি এই বেল্ট বেঁধে নেই। যে গাড়ি চালাচ্ছে তার সাথে বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখি যেনও আমি পড়ে না যাই ।

আমি বিমান ভ্রমণের কারণে প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকি। মাল-সামান কোনভাবে কোলকাতায় রেখে চলে যাই। ঘুম যেন না আসে সে জন্য আমি গলা ফাটিয়ে গান করি, কিন্তু তাও প্রায়ই কাজ করে না। যাইহোক, এই বেল্ট বাধা অবস্থায় মোটরবাইক চালক সুনীল লোহারকে নিয়ে চারপাশে বলাবলি হয় "হেভি মোটরসাইকেল চালায়।" (হাসি) সুনীল বলে, এই ভালো আমি সবসময় চিন্তায় থাকি যে দিদি কখন পেছন থেকে পড়ে যায় কিন্তু এখন আমি আমি এই বেল্ট দিয়ে তার সাথে বাঁধা, ফলে পড়ে যাওয়ার কোনও আশংকা নেই।

এখন আমি ৮০তে পা দিয়েছি , তাই মৃত্যুর কথা ভাবছি। আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমি পৃথিবীকে ভালোবাসি, কিন্তু অন্যদিকে কাউকে বাস্তববাদী হতে হবে। এই অনুভূতি যে খুব বেশি সময় নেই, এ ধরণের চিন্তাভাবনা প্রকল্পগুলোকে নির্দিষ্ট ধরণের গুরুত্ব দেয় এবং আমার জীবনকেও পরিপূর্ণ করে তোলে। আমি একজন সুখী বৃদ্ধ মেয়ে (হাসি)। প্রয়োজনীয় হতে চেষ্টা করছি এই প্রচেষ্টা আমাকে আনন্দিত করছে।

ক্যাতালে, ঠিক আমরা শেষ প্রান্তে এসে গেছি। ধাববান মোটরবাইকের পেছনে ড্রাইভারের সাথে শক্তভাবে বাঁধা, গলা ফাটিয়ে গান গাইতে গাইতে অজানার পথে ছুটে চলেছেন তা সে চিত্রটি মনে ধরে রেখেছি। শুভ জন্মদিন, আপনাকে আশিবছর বয়সী রকস্টার। আপনি অনেক অনেক দিন "সুখী বুড়ো মেয়ে" হয়েই থাকুন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.