দিনা শনিচর: নেকড়ে পালের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা বালক

ইজেল

14 January, 2023, 09:50 pm
Last modified: 14 January, 2023, 09:49 pm
অনেকে মনে করেন, কিপলিংয়ের মুগলি চরিত্রটির পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল দিনা শনিচর নামের একজন ওলফ চাইল্ড। ভারতের উত্তরের জঙ্গলে জন্ম নেওয়া এই লোক নিজের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়টিই বন্যপ্রাণীদের সাথে কাটিয়ে দিয়েছিল। তবে কিপলিং 'দ্য জাঙ্গল বুকে' সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়া, বনের অন্য প্রাণীদের সাথে বেড়ে ওঠা মুগলিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক আর রোমান্টিক। তবে বাস্তবে দিনার জীবন এরকম সহজ ছিল না।

পাঠকের যদি রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের 'দ্য জঙ্গল বুক' সম্পর্কে জানাশোনা থাকে, তাহলে জেনে অবাক হবেন যে মুগলির মতো চরিত্রের অস্তিত্ব বাস্তবেই ছিল! সমগ্র ভারতবর্ষেই এরকম অনেক বন্য শিশুর সন্ধান পাওয়া যায়। 

অনেকে মনে করেন, কিপলিংয়ের মুগলি চরিত্রটির পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল দিনা শনিচর নামের একজন ওলফ চাইল্ড। ভারতের উত্তরের জঙ্গলে জন্ম নেওয়া এই লোক নিজের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়টিই বন্যপ্রাণীদের সাথে কাটিয়ে দিয়েছিল।

তবে কিপলিং 'দ্য জাঙ্গল বুকে' সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়া, বনের অন্য প্রাণীদের সাথে বেড়ে ওঠা মুগলিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক আর রোমান্টিক। তবে বাস্তবে দিনার জীবন এরকম সহজ ছিল না।

নেকড়ে বালক দিনা

সময়টা ১৮৬৭। ভারতবর্ষে তখন চলছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলার গহীন জঙ্গলে ঘুরছে শিকারিরা। পথিমধ্যেই তারা এক দল নেকড়েকে দেখতে পেল। তবে শিকারিরা নেকড়ের পালের জন্যে যাত্রাবিরতি ঘটাল না। 

বরং তারা আশ্চর্য হয়েছিল অন্য আরেকটি দৃশ্য দেখে। এই নেকড়ে দলের পেছনেই একটি মানবশিশুকে দেখতে পাওয়া গেল যে মূলত হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছিল, অনেকটা প্রাণীদের মতোই 'চার পায়ে' হাঁটার মতো। 

কিছু সময় পর এই মানবশিশুসহ নেকড়ের দল একটি গুহায় আশ্রয় নিলেও শিকারিরা গুহার সম্মুখভাগে আগুন ধরিয়ে দিল। নেকড়েরা বাইরে আসতে একরকম বাধ্যই হলো। বেরিয়ে আসার পরপরই শিকারিরা গুলি ছুড়ল নেকড়েদের দিকে। ছোট্ট সেই গুহার এক কোনা থেকে বাচ্চা ছেলেটিও বেরিয়ে এল। শিকারিরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল মিশনারির এক আশ্রমে। সেই ছেলেটির নামই দিনা। তার বয়স তখন ছয় বছরের বেশি হবে না।

শুরুতে দিনার সাথে শিকারির দল যোগাযোগ করার বহু চেষ্টা করল, কিন্তু দিনা কোনো উত্তর দিচ্ছিল না। এমনকি সে তাদের প্রশ্নও বুঝতে পারছিল না। দলটির বুঝতে বাকি রইল না যে সে আদতে একজন বন্য শিশু—ফেরাল চাইল্ড।

বোঝা গেল যে দিনার লালন-পালনের কাজটিও হয়তো নেকড়ের পালই করেছিল। তার বেড়ে ওঠার গল্পটি বেশ অদ্ভুত কিসিমের হলেও দিনাই কিন্তু প্রথম বন্য শিশু না। বরং সেসময় ভারতবর্ষে এ রকম ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে, চিতাবাঘ, মুরগি, কুকুর, হরিণের সান্নিধ্যে এবং দেখভালেই অনেক মানবসন্তান বড় হয়েছে। 

অবশ্য এরকম শিশুদের চেনার বেশ সহজ একটা উপায় ছিল। সাধারণত এদের কেউই দুই পায়ে ভর করে হাঁটতে পারত না। অধিকাংশ সময়েই দেখা যেত, তারা চারটি হাত-পায়ের ওপর ভর করে হাঁটার চেষ্টা করছে।

তরুণ দিনা শনিচর

প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে দিনার মতো বন্য শিশুদের কথকতাকে অনেক রোমান্টিকভাবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবতা ছিল খুবই ভিন্ন। অবহেলা-তাচ্ছিল্য এবং একাকিত্বেই অধিকাংশ সময় তাদের দিনাতিপাত করতে হয়েছে। পরে নতুন পরিবেশে নতুনভাবে অভ্যস্ত হতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে অনেক।

'সভ্যতায়' ফিরে আসার পর সামাজিকীকরণ, নগর-অরণ্যের দূরত্ব, ঠিক কোন গুণাবলি আমাদের মানুষ করে তোলে, এরকম বহু চিন্তার উদ্রেককারী বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবিয়েছে এই বন্য শিশুরা।

ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো এ ধরনের ঘটনায় বেশ আগ্রহী ছিল। ব্রিটিশরা মোটা দাগে দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল, কেউ কেউ এই গল্পগুলোতে মোহাবিষ্ট ছিল আবার কেউ এতে পরিবর্তন আনতে চাইত, শোধরানোর চেষ্টা চালাত। ব্রিটিশ কথা সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিং প্রথম শিবিরের মানুষ। বেশ কিছু সময় তিনি ভারতবর্ষে থেকেছেন। ব্রিটিশ শাসিত বোম্বে প্রেসিডেন্সির মস্ত বাড়িতে ছিলেন। দিনা শনিচরের গল্প তখন লোকমুখে ঘুরছে। 

১৮৯৪ সালে প্রকাশিত কিপলিংয়ের দ্য জাঙ্গল বুক গল্প সংকলনে মুগলি নামের ম্যান-কাবকে পাওয়া যায়। হয়তো এই শনিচরই কিপলিংয়ের জনপ্রিয় শিশুতোষ গ্রন্থের মুগলি চরিত্রটির অনুপ্রেরণা ছিল। 

দিনাকে যে শিকারি দল খুঁজে পেয়েছিল, তারা তাকে গ্রামে ফেরত নিয়ে এল। স্থানীয় লোকজনের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিল। গ্রামের লোকজন দিনাকে দেখে একইসাথে আশ্চর্য আর ভীতও হয়ে উঠল, আর ভয় পাওয়া অস্বাভাবিকও না, ছেলেটি নেকড়ে পালের কাছে বড় হয়ে ওঠেছে!

দিনাকে এরপর তারা আগ্রার সিকান্দ্রা মিশন অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছিল। সেখানে দিনার নামকরণ করা হয়, উর্দুতে। শনিচর শব্দের অর্থ শনিবার। সম্ভবত দিনাকে এদিনই খুঁজে পেয়েছিল শিকারির দল। আর এভাবেই তার নাম হয়ে উঠল দিনা শনিচর।

দিনার জীবনের শুরুর দিনগুলো

শিকারিদের বদৌলতে দিনা তার নাম পেল, মাথার ওপর একটি ছাদও পেল। কিন্তু সেই অনাথ আশ্রম স্বাভাবিকভাবেই তার জন্য উপযুক্ত ছিল না। দিনার যত্ন-আত্তিতে আশ্রমের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হয়তো কোনো ফাঁকফোঁকর রাখেনি, কিন্তু তার সাথে ঠিক কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে, তা তারা বুঝতে পারছিল না।

আশ্রমপ্রধান ফাদার এরহার্ড শুরুর দিকে দিনাকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ভেবেছিলেন। দিনাকে তিনি পছন্দ করতেন না, 'পাগল' মনে করতেন তাকে। তবে পরবর্তী সময়ে তার ধারণা ঈষৎ পাল্টায়। দিনার মধ্যে মাঝেমাঝে বিচারবোধ এবং বুদ্ধিমত্তার লক্ষণও দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।

দিনার শারীরিক চাহিদার যত্ন কীভাবে নিতে হবে, সেটিও আশ্রমের লোকজন বুঝে উঠতে পারেনি। দিনাকে 'সভ্য' করার চেষ্টা চালালেও কাজটা বেশ কঠিনই ছিল। জঙ্গলে নেকড়েদের কাছে দিনা যেভাবে বড় হয়েছিল, সেই আদবকেতাই দিনার কাছে যৌক্তিক লেগেছে। তাই নতুন জীবনধারায় তাকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা দুঃসাধ্যই ছিল বটে।

প্রায়ই দিনা নেকড়ের মতো চিৎকার করে উঠত, তা দেখে আশ্রমের কর্মচারীরা ভাবতেন, সে বোধ হয় তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাটাই করছে। 

ওয়েইন ডেনিস নামক শিশু মনস্তত্ত্ববিদ তার ১৯৪১-এর আমেরিকান জার্নাল অব সাইকোলজি প্রবন্ধে দিনার মতো বন্য শিশুদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। অরণ্যে প্রতিপালিত শিশুদের গবেষণায় তিনি দেখান যে এই শিশুরা মানুষের সাথে মিশতে তেমন কোনো আগ্রহই দেখাত না, তাছাড়া গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়াতেও তারা কোনোরকম কাবু হতো না। 

দিনা মানুষের মতো পোশাকআশাক পরলেও স্রেফ কাঁচা মাংস ছাড়া আর কিছু খেত না। নখ আর দাঁতও নেকড়ের মতো ধারালো ছিল তার। কোনো ভাষা রপ্ত করতে পারেনি সে, কিন্তু বোবা ছিল না। বরং নেকড়ের মতো আওয়াজ করত। দিনাকে দেখভাল করায় দায়িত্বরত লোকজন আশাবাদী ছিলেন যে দিনা হয়তো একসময় 'স্বাভাবিক' হয়ে উঠবে। 

দিনা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল, মানুষের মতো বিভিন্ন আচার-আচরণে কিছুটা অভ্যস্তও হয়ে উঠছিল। প্রক্ষালন কক্ষ ঠিকঠাক ব্যবহার করা থেকে শুরু করে স্বাভাবিকভাবে খাওয়াদাওয়া, পোশাক পরিধান, ঠিকমতো হাঁটাচলা, এমনকি পায়ে জুতো পরার কাজটিও দিনা রপ্ত করতে পেরেছিল। তবে দিনা প্রায়ই নেকড়ের মতো আওয়াজ করে উঠত, এটা যোগাযোগ করার চেষ্টা কিনা নিশ্চিত হতে পারেনি কেউ।

দিনার কখনোই মানুষের ভাষায় কথা বলা হয়ে ওঠেনি। মনে করা হয় তার কখনো মানুষের ভাষায় কথা বলতে না পারার কারণ, শৈশবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, সাধারণভাবে অন্যান্য বাড়ন্ত শিশুর মতো সে এই শিক্ষাটি পায়নি। তবে আশ্রমের বাকি লোকজনের সাথে যোগাযোগ করার একটি স্বকীয় ধরন সে গড়ে নিয়েছিল। তাদের সাথে নিজের একরকম বোঝাপড়া তৈরি করে নিয়েছিল সে। 

দিনার সাথে বাকিদের সম্পর্কের তেমন উন্নতি না হলেও তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আশ্রমে থাকা আরেক বন্য শিশুর সাথেই। দুজনের মধ্যে বেশ মিল থাকায় দ্রুতই তারা বন্ধু বনে গিয়েছিল।

একে অপরের খেলার সঙ্গী ছিল তারা, চায়ের পেয়ালা থেকে কীভাবে চুমুক দিয়ে চা পান করতে হয়, সেটিও দিনা সেই ছেলেটিকে শিখিয়েছিল। আর দশজন কর্মচারীর চেয়ে সে এই ছেলের সাথেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে সময় কাটাত। 

দিনার পরিণতি

ক্ষুদ্র জীবনের প্রায় সিংহভাগ অনাথ আশ্রমে কাটিয়ে দিলেও মানুষের মতো স্বভাব-আচারে দিনার খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি। থালা থেকেই খাবার খেত দিনা। কিন্তু প্রতিবারই খাবার হাতে পাওয়ার পর আগে শুঁকে নিত। এ ছাড়া কাঁচা মাংস ছাড়া কিছু খেতে চাইত না দিনা।

পোশাক-পরিচ্ছদ আর ঠিকঠাক হাঁটা-চলার পাশাপাশি দিনা কেবল একটি অভ্যাস স্বাচ্ছন্দ্যে বেছে নিয়েছিল। আর তা হলো ধূমপান। এই বদঅভ্যাসটিও হয়তো সে অনাথ আশ্রমের কর্মচারীদের কারও কাছ থেকে রপ্ত করে নিয়েছিল। ঠিক কেন এ কাজটি সে করত, তা স্পষ্ট নয় যদিও। হয়তো দিনার কাছে মনে হয়েছিল যে এটি তাকে আশেপাশের মানুষের মতো হতে সাহায্য করছে। তবে ধূমপানই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। দিনা একসময় তীব্র ধূমপায়ী হয়ে ওঠে। তার স্বাস্থ্যে অবনতি দেখা যায়। খুব অল্প বয়সেই ১৮৯৫ সালে মারা যায় দিনা। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল সে।

দিনা যে আর দশটা মানুষের মতো নয়, তা বলতে কোনো দ্বিধা নেই। তার শৈশব কেটেছে গহিন বনে, নেকড়েদের সান্নিধ্যে। শিকারির দল তাকে এতিমখানায় নিয়ে তো এল ঠিকই, কিন্তু কোনো দিন হারানো আরণ্যকের কথা ভুলতে পারেনি দিনা। তাই 'মানুষ' কীভাবে হয়ে উঠতে হয়, তা রপ্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তার। মানুষের চেয়ে বুনো নেকড়ের বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে প্রকটভাবে ছিল। 

'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে' দিনা শনিচরের ক্ষেত্রে যেন এ কথাই সত্যি ছিল। অরণ্য থেকে তাকে ফিরিয়ে এনে 'মানুষ' বানানোর চেষ্টা করা ছিল ভুল পদক্ষেপ!

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.