রফিকুন নবীর সাক্ষাৎকার: ‘বাবা যে ইচ্ছাটা পোষণ করতেন, যাতে আর্টিস্ট হই!’

ইজেল

05 November, 2022, 04:55 pm
Last modified: 05 November, 2022, 06:06 pm
শিল্পী রফিকুন নবী বেশি পরিচিত রনবী নামে। রফিকুন থেকে শুধু র নিয়ে নবীর সঙ্গে মিলে রনবী। পত্র-পত্রিকায় এ নামে তাঁর কার্টুন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার রনবী নামও পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে একইসঙ্গে। রনবীর সবিশেষ চরিত্র “টোকাই”, তাঁর অনন্য এক সৃষ্টি। রফিকুন নবী শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অন্যান্য প্রথিতযশা শিল্পীকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে, তার গড়ে ওঠা এবং অন্য অনেকের প্রভাবসহ চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা ইজেলের পাঠকদের জন্য।

[শিল্পী রফিকুন নবী চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, শিল্পসমালোচক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, চিত্রকলার শিক্ষক। বহুমুখী প্রতিভার এই শিল্পীর জন্ম ২৮ নভেম্বর ১৯৪৩, রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। শিল্পকলায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বেসামরিক পুরষ্কার একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও পেয়েছেন চারুকলায় জাতীয় সম্মাননা শিল্পকলা একাডেমি পুরষ্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরষ্কার, বুক কভার ডিজাইনের জন্য ১৩ বার ন্যাশনাল একাডেমি পুরষ্কার অর্জন করেছেন। ২০০৮ সালে তাঁর আঁকা খরা শীর্ষক ছবির জন্য ৮০ টি দেশের ৩০০ জন চিত্রশিল্পীর মধ্যে "এক্সিল্যান্ট আর্টিস্ট অ দ্য ওর্য়াল্ড" হিসেবে মনোনীত হন।

শিল্পী রফিকুন নবী বেশি পরিচিত রনবী নামে। রফিকুন থেকে শুধু র নিয়ে নবীর সঙ্গে মিলে রনবী। পত্র-পত্রিকায় এ নামে তাঁর কার্টুন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার রনবী নামও পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে একইসঙ্গে। রনবীর সবিশেষ চরিত্র "টোকাই", তাঁর অনন্য এক সৃষ্টি।

১৯৬৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক জীবন শুরু করেন রফিকুন নবী। ১৯৭৩ সালে গ্রীস সরকারের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বৃত্তি নিয়ে তিনি ভর্তি হন গ্রীসের এথেন্স স্কুল অব ফাইনআর্টসে। তাঁর বিষয় ছিল প্রিন্ট মেকিং। ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে প্রথমে প্রভাষক, পরবর্তীতে সহকারি অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক, পরে অধ্যাপক হন। ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ফাইন আর্টস-এর ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগের প্রধাণ দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই ইন্সটিটিউটের পরিচালক। 

২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রথম নির্বাচিত ডিন হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় যোগদান করেন। এ বছরই, জুন মাসে তিনি শিক্ষকতা থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়েছেন। এখন সব ব্যস্ততা চিত্রকলায়, রং-তুলি, ক্যানভাসে।]

রফিকুন নবী শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনসহ অন্যান্য প্রথিতযশা শিল্পীকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে, তার গড়ে ওঠা এবং অন্য অনেকের প্রভাবসহ চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা ইজেলের পাঠকদের জন্য। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিবানী কর্মকার।

প্রশ্ন: ছবি আঁকার গল্পই শুনি আগে—

রনবী: আসলে সবকিছুই তো একরকম বলা হয়ে গেছে। এ যাবৎকালে যত ইন্টারভিউ দিলাম। মানে এত এত কথা বলেছি, কখন যে কী বলেছি, মনে হয় সবই তো বলা হয়ে গেছে। আর কী বলার আছে?

এখন নতুন করে কী বলব? জীবনে তো নতুন কিছু আর নাই। জীবন তো এখন একরকম মোনোটোনির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হয় ছবি আঁকছি, হয় না বলে বলি ছবি তো আঁকতেই হবে, আঁকছি তাই। জীবনযাপনে সংসার পালন তো করতেই হবে, করি। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে হয়, দিই। এ রকম ঘটনাই তো, তারপর ছবি নিয়ে মানুষজনকে দেখানো—এটাও একটা ঘটনা। সেসব করার চেষ্টা করি। এসব ঘটনা আমি বুঝি যে কারও কাছে মনোটোনাস, কিন্তু এই একভাবেই চলছে। আমিও তাই মনে করি। তার মধ্যে থেকে বিশেষ করে ছবি আঁকা নিয়ে যখন বসি, ছবি আঁকি, তখন যে কনসেন্ট্রেশনটা দিই, এটা একদমই আলাদা। ছবি আঁকার জায়গাটায় মনোটোনিক ব্যাপারটা ভাঙে। ছবি তো সব সময় নতুন। কালারে বলি, ড্রইংয়ে বলি, কম্পোজিশনে বলি বা টেকনিক্যালি বলি। সব সময় নতুন একটা ঘটনা থাকে। আজকে যেটা করলাম, কালকে তো সেটা একরকম হবে না। সাবজেক্ট হয়তো সেইম কিন্তু এক্সিকিউশন আলাদা, তো ওটাই।

আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

প্রশ্ন: তাহলে ছবি আঁকাটাই এখনো নতুন আর উপভোগ্য?

রনবী: উপভোগ্য এবং প্রয়োজনীয় বিষয়। ওইটার ওপরেই তো চলতে হয়। কিন্তু উপভোগ্য তো বটেই। উপভোগ না করলে তো ছবি আঁকাটা কঠিন। আর জীবনসম্পর্কিত ব্যাপার যদি বলি, জন্মটা তো ব্রিটিশ আমলে, সেই ১৯৪৩-এ। তারপরে ৪৭-এ দেশ ভাগ, মানে ভারত ভাগ হলো। দেশভাগের পর হলো পাকিস্তান। পাকিস্তান হওয়ার পরে পাকিস্তানি সময় কাটল। আমাদের স্কুলিংটা পাকিস্তানি সময়ে। মেট্রিক পাস করলাম ৫৯-এ। তো পাকিস্তানি সময়ের প্রায় পুরো সময়টা স্কুলের মধ্য দিয়েই গেল। আমার স্কুলিং ছিল ঢাকাতে, প্রগতি স্কুল। তখন প্রগতি স্কুল বেশ ভালো স্কুল। কয়েকটা স্কুলই ছিল তখন পুরান ঢাকায় নামকরা, তার মধ্যে প্রগতি একটা। তো আমি প্রগতি স্কুলে পড়তাম। এখান থেকেই আমার লেখাপড়া বলি, আমার ছবি আঁকার প্রতি ইন্টারেস্ট হওয়া বলি কিংবা অন্যান্য যে অবজারভেশনস, চারিদিকে যা কিছু ঘটছিল। নানা এক্সপেরিয়্যান্স এগুলো থেকেই নেওয়া, তো এই যে আফটার ৪৭, আমার একটু একটু জ্ঞান হচ্ছে। আফটার ফিফটি, তখন তো যথেষ্ট বুদ্ধি। তখনকার অনেক কিছু মনে পড়ে এখন। স্কুলে পড়ার সময় কী রকম রাজনীতি চলছিল, সেগুলো দেখছি। তারপরে সেই রাজনীতিগুলোর উত্থানপতন, লিডারদের আসা-যাওয়া, নানা রকম ঘটনা দেখেছি তখন। 

প্রশ্ন: ঘটনাবহুল সময় তখন। বিপুল প্রভাব পড়ার কথা।

রনবী: তা ফেলেছিল একরকম। ভাষা আন্দোলনের যে ঘটনাগুলো, সেগুলো সম্পর্কে জানতে পারছি তখন। সেইটাকে ঘিরে একুশে ফেব্রুয়ারির যে আন্দোলন, গোলাগুলি, সরকারি আক্রমণে সালাম, বরকত উনারা যে মারা গেলেন, আমরা তখন জানছি। পরবর্তীতে আন্দোলনটা আরও জোরদার হলো। পাড়ায় পাড়ায় নানা রকম বক্তৃতা হচ্ছে সব সময়। এই নিয়েই তখন আমাদের সময়। একদিকে স্কুলে লেখাপড়া, আরেক দিকে রাজনীতিতে অনেক বড় বড় কাজ হচ্ছে তখন। হুলুস্থুল চলছে, এগুলো একটু-আধটু টের পাই। কোথাও কোথাও গোলাগুলিও হতো এগুলোও টের পাচ্ছি। এর মধ্য দিয়েই ফিফটি নাইনে মেট্রিক পাস করে বেরোলাম। 

আমার বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তো তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল ছবি আঁকার কলেজে ভর্তি হবেন। তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাসও করেছিলেন। ঠিক ওই সময়ে তিনি যখন ভর্তি হবেন, তখন তাঁর বাবা মানে আমার দাদা মারা যাওয়ায় সেটা তাঁর আর হয়ে ওঠেনি। সাংসারিক কারণে তাঁর সেই ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে হয়। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। সেই সময়ের একটা ব্যাপার ছিল। বাবা যদি মারা যান তাহলে ছেলের যদি যোগ্যতা থাকে, ছেলে সেই পদে নিয়োগ পেতে পারে। তখন সবার চাপে পড়ে তিনি সেই পদ নিয়ে নিলেন। ভেবেছিলেন পরে ছেড়ে দিবেন। সেটা আর ছাড়া হলো না।

প্রশ্ন: তার মানে আপনার দাদাও পুলিশে ছিলেন।

রনবী: হ্যাঁ, দাদাও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। সেই পরম্পরায় আসলে আমার পুলিশ হওয়ায় কথা ছিল। তো কী কারণে আমার দাদা মারা যাওয়ার আগে বাবাকে বলেছিলেন, আর যা-ই করো পুলিশ হবে না। কিন্তু উনার ভাগ্যে পুলিশ হওয়াই হলো। তো বাবাও বলে আর যা-ই হোক আমার ছেলেমেয়েরা যেন পুলিশ না হয়। বরং তিনি যে ইচ্ছাটা পোষণ করতেন, আর্টিস্ট হওয়ার তার যে তাড়না, সেটা যাতে আমরা হই। 

তো সবারই ধারণা হয়েছিল যে আমি ছবি আঁকতে পারি। একটা ন্যাক আছে, ভেতরে একটা ইন্টারেস্ট আছে। ছবি আঁকা নিয়ে অনেক কিছুর সাথে আমার যুক্ততাও আছে। যেমন পাড়ায় যে পাঠাগার ছিল, সংগঠন ছিল, সেসব সংগঠনের যে দেয়ালপত্রিকা, আমি সেগুলোতে অলংকরণ করে দিতাম। লেখাগুলো হাতে লিখে দিতাম। তারপরে স্কুলে দেয়ালপত্রিকা ছিল, সেটায়ও আঁকতাম। এটা আমাদের স্কাউটিংয়ের। আমি আবার আমাদের স্কুলের যে বয়েজ স্কাউট ট্রুপ ছিল, সেটার ট্রুপ লিডার ছিলাম। তো ওই পাওয়ারটা খাটিয়ে আমি সব ছবিটবি করতাম। এটায় স্কাউটিং থেকে পুরস্কারও পেয়েছি অলংকরণের জন্য। জাম্বুরি বা নানা জায়গায় প্রদশর্নী হতো। তো পুরস্কারটা ট্রুপকে দেওয় হতো ভালো প্রদর্শনীর জন্য। তো এগুলোর মধ্য দিয়ে সবারই জানাজানি ছিল, আমি আঁকতে পারি। বাড়িতে, পাড়ায়, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বা স্কাউট গ্রুপে। আগ্রহ বা নেশা ঠিক না বা শখও না। আঁকতে দিলে এঁকে দিতে পারি এমন। মানে ছবি আঁকার হাতটা আছে। আমি যে খুব আর্টিস্ট হব বা আর্টিস্ট হতেই হবে আমাকে, লক্ষ্য থাকে না অনেকের, আমার সে রকম ছিল না। সবাই যেমন লেখাপড়া করে। আমিও তেমনই করছি। আর সবার যে রকম হবে সে রকমই হবে, সেটাই ভাবতাম। 

আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

আমি যখন পাস করে বেরোলাম, তখন আমাদের ক্লাসের প্রায় সবারই রেজাল্ট খুব ভালো হলো। স্ট্যান্ড করেছিল একজন আর প্রায় বিশ-পচিশজন ফার্স্ট ডিভিশন পেল। তো আমাদের সেই সময় প্রাইভেট পড়ার সুযোগ ছিল না, এখনকার মতো কোচিং ছিল না, স্কুলে যা করে দিত, তা-ই। অঙ্কটা একটু খারাপ হয়ে যাওয়ায় অল্পের জন্য আমার ফার্স্ট ডিভিশনটা মিস হয়ে গেল, মানে ফার্স্ট ডিভিশনটা হয় নাই। এই যে হয় নাই, এই না হওয়াটায় ভাগ্যটা আমার অন্য দিকে ঘুরে গেল। আমার বন্ধুরা কেউ নটর ডেম, জগন্নাথ বা অন্যান্য কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। আমার বাবা তখন বললেন, তুমি বরং ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হও। জয়নুল আবেদিন একটা কলেজ করেছে ঢাকায়, কলকাতার মতোই। আমি ভাবলাম ভালোই তো এত অঙ্কের চাপ থাকবে না। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, ভালোভাবে পাসও করলাম, ভর্তি হয়ে গেলাম। তারপর তো এই যে রেলগাড়ি চলছে, স্টিল নাও চলছে। একই প্রফেশন, আসলে প্রফেশন তো আমার দুইটা। একটা টিচিং, আরেকটা ছবি আঁকা নিয়ে থাকা। জুন মাসে ফাইনালি রিটায়ার্ড করলাম। একবার তো রিটায়ার্ড করেছি ২০১০ সালে। তারপর আবার সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। চারুকলায় যারা আমার ছাত্র ছিল, ওরা তো তখন টিচার, তাদের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে আবার সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক করা হলো।

এখন তো পুরোপুরি ছবি আঁকছি। আমি খুব ভাগ্যবান যে বাড়ি থেকেই ছবি আঁকার সূত্রপাত। বাবাকে দেখেছি আঁকতে আর কলকাতার কিছু বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা সংগ্রহে ছিল, আবার কিছু আসত। প্রবাসী, বসুমতি, ভারতবর্ষ এইসব ম্যাগাজিন বা পত্রিকা। সেই সময় ওখানে কিছু রিপ্রোডাকশন ছাপা হতো। নন্দলাল বসু, অবনিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর। আবার ভারতবর্ষের বাইরে বিদেশি আর্টিস্টদের রিপ্রোডাকশনও ছাপা হতো, সেইগুলো দেখতাম। এ রকম অনেকের ছবি দেখতাম এবং অবাক হতাম। একেকজনের একেক রকম ছবি, একেক রকম কালার। সবই আবার ভালো লাগছে। পিকাসোর ছবি যখন দেখছি, অবাক হয়ে ভাবছি, এ রকম ছবি এঁকে কী হয়। ছাপছে যখন নিশ্চয়ই এটা খুব ভালো ছবি। আবার যখন নন্দলাল দেখি, তখন ভাবি এটা কী করে এত সহজ রেখা। অবনীন্দ্রনাথের তো কোনো কথাই নাই, দেখলেই মনটা ভরে যায় এ রকম। তো এই রিপ্রোডাকশন দেখতাম। বাবা এগুলো ছাড়াও কিছু বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শিল্পীর ছবির কপি বাড়িতে সংগ্রহ করতেন। চাইনিজ ট্র্যাডিশনাল ওয়াটার কালারস, জাপানিজ ট্র্যাডিশনাল উডকাঠ প্রিন্টস এগুলো এনে রাখতেন। এই যে বাড়ির একটা গণ্ডি ছিল, বলা যায় বাড়ির একটা পরিবেশ তৈরি ছিল। আমি যে সচেতনভাবে সেসবের দিকে সব সময় খুব মনোযোগী ছিলাম, তা নয়। সেগুলো খুব দেখার চেষ্টা করতাম, নেওয়ার চেষ্টা করতাম—সে রকম ছিল না। বাবা ছবি আঁকছে, দেখি মাঝেমধ্যে এ রকম। 

এরপর ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান কাউন্সিল থেকে এখানে একটা এক্সিবিশন হলো বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমি তো তখন ছিল না, তখন ওটা ছিল বর্ধমান হাউস। সেই বাড়িতে চিফ মিনিস্টার থাকত আগে, নুরুল আমিন। সেটা তখন খালি ছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, একুশে ফেব্রুয়ারির পরে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য সরকারি ব্যবস্থাপনা অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। তো ওইখানে বড় একটা ন্যাশনাল প্রদর্শনী হয়েছিল। ন্যাশনাল বলতে পাকিস্তানি ন্যাশনাল। পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানের যত শিল্পী সবাইকে নিয়ে হয়েছিল। আমি তখন ছোট। ওই এক্সিবিশন বাবা আমাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন দেখলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরীসহ বাংলাদেশের সব বড় বড় শিল্পীদের ছবি। এককজনের একেক ছবি। আর তখন যারা উঁচু ক্লাসে পড়ত আর্ট কলেজে, সেসব ছাত্রদের ছবি ছিল। তো আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলাম। এইগুলো তো বটেই আর পাকিস্তান শিল্পীদের কিছু ছবি ছিল। ওখানকার বড় শিল্পী যাঁরা, যেমন আল্লাহ বক্স, সাকীর আলি, জোবেদা আগা, সাদেকাইন, আবদুর রহমান চুগতাই। আমাদের এখানে যেমন আবেদিন স্যাররা, ওইখানকার উনারা তেমন বড় শিল্পী। তো তাঁদের সবার কাজ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই প্রথম জানলাম ছবি আঁকলে পরে ওইটা আবার দেয়ালে টাঙিয়ে মানুষকে দেখানো হয়, মানে এক্সিবিশন হয়। এগুলো ছোট ছোট কিছু জিনিস আছে, যেগুলো দ্বারা আমি ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছিলাম নিজের অজান্তে। এত এত এক্সপেরিয়েন্স আসলে আমার ভেতরে জমা হচ্ছে বা দিনকে দিন যা আমাকে তৈরি হতে সাহায্য করেছে।

প্রশ্ন: ছাত্র অবস্থায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া এ রকম আরও বিখ্যাত শিল্পীদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন। তাঁদের নিয়ে কী বলবেন?

রনবী: আমি খুব ভাগ্যবান বা আমাদের সমসাময়িক যারা আমরা সবাই খুব ভাগ্যবান এই জন্য যে শিক্ষক হিসেবে আমরা দেশের সব বড় বড় শিল্পীদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, কাজী আব্দুল বাসেত, আব্দুর রাজ্জাক, কাইয়ুম চৌধুরী—তাঁদের সবাইকে আমরা পেয়েছি। একেকজন একেকভাবে বলতেন, একেকভাবে শেখাতেন।

ভর্তি হওয়ার পরে কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, আর্টিস্ট হতে গেলে শুধু আঁকলেই পুরোটা হয় না। তখন ওই যে এক্সপেরিয়েন্স সেগুলো আর এই যে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করলাম, সেগুলা মিলিয়েই কিন্তু আমার নিজেকে তৈরির ব্যাপারটা। এটা বুঝতে পারলাম, আবেদিন স্যারের একটা ক্লাসে, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন আমরা। উনি এমনি এসেছিলেন নতুন ছাত্রদের সাথে আলাপ করার জন্য। তো তিনি বললেন যে তোমরা কেন ভর্তি হয়েছ এখানে, সামনে তো ভবিষ্যৎ নেই। চাকরিবাকরি নাই, ইনকামের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। তো অধিকাংশ ছাত্র কিন্তু এত সহজে আমার মতো ভর্তি হয়েছিল, তা নয়—বাবা নিজে থেকে আর্টিস্ট হওয়ার জন্য দিয়ে গেলেন। এ রকম কিন্তু ছিল না। আমার ক্লাসমেট অলমোস্ট ফিফটি পারসেন্ট হবে বা আরও বেশি, যারা তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে ভর্তি হয়েছিল। তাদের কিন্তু আসল আর্টিস্ট আমি বলব। তাদের ইচ্ছাটা আমার থেকে অনেক বেশি। কারণ, তারা এ জায়গাটায় লড়াই করে এসেছে। আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়তেন একজন শিল্পী, উনার নাম আব্দুল মতিন। উনি তখন সেকেন্ড ইয়ারে। মতিন ভাই একদম গোঁড়া পরিবার থেকে আসা। উনি যেমন পরিবারের সবার সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে আর্ট কলেজে এসে ভর্তি হয়েছেন। উনার এতটাই আর্টিস্ট হওয়ার ইচ্ছে। তাতে করে কী হলো, পরিবার থেকে ব্রাত্য হয়ে গেলেন। প্রায় ত্যাজ্য করার মতো। এই মতিন ভাই যদ্দিন বেঁচে ছিলেন, সবকিছুর সাথে ফাইট করে কাজ করে গেছেন, ফাইট করে আর্টিস্ট হয়েছেন। এটা একটা ঘটনা ছিল। তখন তো আর্টিস্টদের ইনকামের এত সহজ ব্যবস্থা ছিল না।

আর্টিস্ট হতে আসাটা একটা ইমোশনালি ব্যাপার। তো সবাই সেটাই বলল, স্যার আপনারা যেমন শিল্পী, আমরাও তেমন হব। আমিও তা-ই বলেছি। উনি বললেন, এই যে কথাটা শিল্পী। আমরা কিন্তু শিখিয়ে-পড়িয়ে তোমাদের শিল্পী বানাতে পারব না। এটা একটা ইনার ফিলিংস। আমরা তোমাদের গ্রামারটা শিখিয়ে দিতে পারব। তার মধ্যে কী রস তুমি দিতে পারবে, তা তোমার নিজের প্রচেষ্টা। ড্রয়িংয়ের রসটা তোমার হাত দিয়ে কী করবে না করবে তা তোমার বিষয়। এটা করতে হলে প্রচুর ছবি দেখতে হবে। আদি থেকে শুরু করে বড় বড় আর্টিস্টদের কাজ দেখতে হবে। কোন পেইন্টিং কেন বিখ্যাত, কেন সেটার মূল্যায়ন করা হয়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। গুহায় থাকা মানুষ কী করে এত সুন্দর ছবি এঁকে গেছেন, যেটা দেখে আমরা এখনো অবাক হই। কেন অবাক হই, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। আর সবচেয়ে বড় যেটা, শুধু ছবি আঁকলে চলবে না, দেশ নিয়ে ভাবতে হবে। 

আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

তখন দেশে খুব করুণ অবস্থা চলছিল। নানান রাজনীতি, পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ। আইয়ুব খান জিতে অবস্থা আরও খারাপ হলো। স্বৈরাচারী শাসন। বাঙালিয়ানা নিয়ে নানা টানাপোড়েন। ব্যাপারটা ছিল এ রকম, আগে রবীন্দ্রনাথ হটাও। এতে ভাষা আন্দোলনের যে আফটার ইফেক্ট সেই আন্দলোন তো চলছেই, তার সাথে শুরু হলো আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাংলা ভাষা, তারপর বাঙালি সংস্কৃতি, তারপর হলো যে আমাদের বাঙালি হওয়ার জন্য স্বাধীন দেশ দরকার। প্রথমত স্বাধিকার আন্দোলন ছিল ষাট দশক পুরোটা। তারপর আস্তে আস্তে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে চলে গেল। তো ফাইনালি একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধে আমরা জয়ী হলাম এবং আমরা বাংলাদেশ পেলাম। আমরা সেই সময়ের আর্টিস্টরা তখন এখান থেকেই মূলত শিক্ষাটা পেলাম। বা এই যে স্যারদের কথা দেশপ্রেম বা ইনার ফিলিংস, সবকিছু মিলিয়ে আমরা কখন যেন ইনভলড হয়ে গেছি বাঙালিয়ানা বা বাঙালি আন্দোলনের পক্ষে। রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে কার্টুন আঁকছি অসংখ্য, স্যাটায়ার করে কার্টুন আঁকছি। ছবির মধ্যেও ব্যক্তব্য দিয়ে আঁকছি, তারপরে পোস্টার আঁকছি, ফেস্টুন আঁকছি। এই যে এত কিছু হলো, এর মধ্যে কিন্তু আমরা নিজের অজান্তে নিজেদেরও তৈরি করছি। আমি অন্তত নিজের ব্যাপারে সেটা মনে করি যে সমস্ত কিছুর ভেতর দিয়ে নিজেকে একটা পর্যায়ে তৈরি করেছি। সেটা যে খুবই বিশাল উল্লেখযোগ্য কিছু একটা হয়েছে, সেটা আমি মনে করি না। কিন্তু একটা অবস্থান তো তৈরি করেছি। তারপর তো চর্চার মধ্য দিয়ে থাকতে থাকতে কখনো ভালো কখনো মন্দ। শেষ পর্যন্ত একটা স্থিতির মধ্যে আসা। আঁকার ব্যাপারে বা শিল্পচর্চায় খুব স্যাটিসফাইড একটা অবস্থানে পৌঁছে গেছি, এটা বলা যাবে না। 

প্রশ্ন: অতৃপ্তি এখনো আছে!

রনবী: হ্যাঁ, ওটায় পৌঁছালে তো বোধ হয় শেষ। শুধু শিল্পী বলে না, যারা ক্রিয়েটিভ বিষয় নিয়ে আছেন, সবারই বোধ হয় এই অবস্থা। কবি-সাহিত্যিকেরা একটা লিখে স্যাটিসফাইড হন না বলে আবার একটা লেখেন। তো তাঁরাও একটা লিখে স্যাটিসফাইড হন না বলে আবার একটা লেখার চেষ্টা করেন। সেটা আমাদের ছবির বেলাতেও। ছবি আঁকতে থাকি একটার পর একটা কিন্তু স্যাটিসফ্যাক্টরি যে একটা ব্যাপার থাকে, এখনো সেটা হয়নি। ওই হলো কিছু একটা কিন্তু যা চাচ্ছিলাম সে রকম তো হলো না। শুরু করি একরকম, যখন শেষ হয় ছবিটা, তখন হয়তো আরেক রকম। 

তো স্যারেরা তো ছিলেন সব মস্ত বড় শিল্পী। শিল্পকলার জগতে তাঁদের যে খ্যাতি, তা বিশ্বব্যাপী। তাঁদের ছাত্র আমরা। তাঁদের যেসব কথাবার্তা, যেসব চিন্তাভাবনা, শিক্ষাদীক্ষা যা কিছু, তাঁরা অনেককাল থেকে চর্চা করে আসছেন, আমরা সেসব শুনেছি, দেখেছি। সেইগুলাই এত দিন ধরে, বলা যায় ওইটার ওপর নির্ভর করেই কিন্তু আমরা চলছি। আমি এখনো মনে করি, এটা একটা বিশাল ব্যাপার। তাঁরা তো ছিলেন আমাদের শিক্ষক কিন্তু তাঁদের বাইরেও আমাদের আইডোলজিক্যাল শিক্ষা নিতে হয়, যা ইতিহাস থেকে নেওয়া। দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, রেমব্রা, বতিচেল্লি, কত কত আর্টিস্ট। তাঁদের ছবি আমরা দেখেছি, তাঁদের সম্পর্কে পড়েছি, জেনেছি। এখান থেকে নিজেদের একটা আইডিয়াল তৈরি হয়। তাঁরা তো সম্মুখে এসে শিক্ষা দেননি কিন্তু তারা ছিলেন। তাঁরাও আমাদের একরকম শিক্ষক। বলা যায় তাঁরা আমাদের পথপ্রদর্শক। চেতনা তৈরির শিক্ষক। এ রকম আরও অনেক শিল্পী ছিলেন—যাঁরা আমাদের শিক্ষক ছিলেন না কিন্তু বড় শিল্পী। যেমন আমাদের সুলতান ভাই, এস এম সুলতান। তাঁর কাজের তো বিশাল ব্যাপকতা। তাঁর সাথেও আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনিও তার মতো করে তাঁর ফিলসোফি বলতেন। আবেদিন স্যাররা তাঁদের মতো করে বলেছেন। এই যে বলা, সবকিছু মিলিয়ে কারও তো আর ফলোয়ার হওয়া যায় না। শিল্পের এই জায়গাটায় আসলে এককভাবে কারও ফলোয়ার হওয়া যায় না। কিন্তু একটা সমৃদ্ধি তৈরি হয়। সবকিছু নিয়ে একটা একক ঘটনা ঘটে। সেটা হলাম আমি। এখান থেকে আমি তৈরি হলাম। আমি বলতে আমিই না, আরও সব শিল্পী যারা। এত কিছুর মধ্য থেকে নিয়ে নিয়েই নিজেদের একটা নিজস্বতা তৈরি হয়। এর মধ্যে তাঁদের থেকে শিক্ষা, প্রকৃতি থেকে শিক্ষা বা আরও যাবতীয় যা কিছু আছে সবকিছু থেকে নিয়েই কিন্তু আমাদের তৈরি হতে হয়। সেখান থেকেই কেউ রফিকুন নবী, কেউ অন্য আরেকজন।

প্রশ্ন: সবকিছু মিলিয়ে যে আপনি রফিকুন নবী, শিল্পী রফিকুন নবী। তৃপ্ত তো কখনোই হওয়া যায় না, একজন শিল্পী বা একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কখনোই তৃপ্ত হতে পারেন না। কিন্তু আপনার নিজস্ব যে একটা ছবির ভাষা, যেমন আপনার লাইন আপনার কথা শোনে। এখানে নতুন করে আপনার আর কোনো স্ট্রাগল নেই। এই বিষয়টা আপনাকে কীভাবে ভাবায়?

রনবী: তৃপ্ত হলে তো শেষ, এটা হয় না। অন্য শিল্পীদের কথা বাদ দিলাম। পাবলো পিকাসো এত এত ছবি এঁকেছেন, এত সফল একজন শিল্পী। সারা পৃথিবী জানে যে হি ইজ ওয়ান অব দ্য বেস্ট পেইন্টার্স। তার নানা রকম কর্মকাণ্ড আছে। মাঝেমধ্যেই নিজেকে চেঞ্জ করেছে। তারপরেও পিকাসো পিকাসোই। যতই চেঞ্জ করুক, না জেনেও কিন্তু বলে দেওয়া যায় এটা পিকাসোর কাজ। এই এত কিছু, তারপরেও মারা যাওয়ার আগে বলে যে হলো না। অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম, কিছুই হলো না। এটা পরবর্তীকালে আবেদিন স্যারও তাই বলেছেন। উনিও বলেছেন অনেক কিছু রয়ে গেল, হলো না করা। আমিও বলি এখনো তো কিছুই হয়নি। এটা বলার জন্য বলা, তা না। এটা আসলেই আসে না। এটা যদি এসে যায়, দ্যাট উইল বি দ্য ফাইনাল ডে স্টপ ইউর পেইন্টিংস বা ড্রয়িং বা যা-ই হোক। তখন একটা অহংকার হবে, গর্ব হবে। এগুলো হলেই তো শেষ। কোনো আর্টিস্টই আসলে ওইভাবে ভাবে বা বলে—আমার মনে হয় না। আমাদের পূর্বসূরি যাঁরা, তাঁরাও ভাবেননি, আমরাও ভাবি না। আমাদের পরবর্তী এখন যারা কাজ করছে, তারাও নিশ্চয়ই এমন ভাবে না। সৃষ্টিশীলতা এমন একটা ব্যাপার, কোথাও এর শেষ নাই, অশেষ একটা ব্যাপার।

প্রশ্ন: আমি যে প্রশ্নটা করতে চাইছি—আপনার যে জার্নিটা, তৃপ্ত ঠিক ওই ব্যাপারটা না। কিন্তু আছে না, আমি এই জায়গাটা ধরতে চাই, একটা জায়গায় পৌঁছানোর একটা ব্যাপার আছে না। একটা ভালোবাসার জায়গা, একটা ইন্টিমেসি। ওর সাথে আমার একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। আমরা এখন একজন একজনকে বুঝি। এইখানেই তৃপ্ত হওয়ার ব্যাপারটা থাকে। সেটা তো আর হচ্ছে না। এটা ভাবাও কঠিন।

রনবী: আমি তো লেখক না। আমি বলি না যে আমি লেখক। যখন ভালো লাগে লিখি। উপন্যাস লিখেছি, ছোটদের বই লিখেছি। শিশুসাহিত্য শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছে। যখন ভালো লাগে বা যখন ইচ্ছে হলো, লিখলাম। কখনো কখনো পাবলিশাররা যখন খুব চাপ দেয়, একটা বই দেন বা কেউ বলেও দেয়, ছোটদের জন্য একটা উপন্যাস দিবেন। এগুলো বললে পরে সময় পেলে লিখে দেই। এগুলো খুব স্ট্যান্ডার্ড ব্যাপারস্যাপার ঘটে, লেখকদের মতো তা না, কিন্তু আমার নিজের ভালো লাগে মাঝেমধ্যে লেখতে।

প্রশ্ন: সবকিছুতে তো সময় দেওয়ার একটা ব্যাপার থাকে। আপনি তো ওখানে খুব একটা সময় দেননি, যতটা ছবি আঁকায় দিয়েছেন। এটা হয়তো আলাদা একটা ভালো লাগা বা আঁকাআঁকি, মাঝখানে একটা ব্রেক নেওয়া। আপনি নিয়মিত লেখালেখি করলে ওখানেও হয়তো আমরা আপনাকে ওভাবেই পেতাম, রফিকুন নবীকে বিখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবেও...

রনবী: ওই যে ছবি আঁকি, তার ফাঁকে ফাঁকে যখন ভালো লাগে লিখি। এটা সাময়িক ভালো লাগা, আবার হবিও না। যেমন কবিতা লিখিনি আমি, ছড়া লিখেছি বেশ কিছু। 

রফিকুন নবী। আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

সবকিছু যে আমি এত চিন্তাভাবনা করে করি, তা না। কিন্তু একটা জিনিস আছে, যে পেইন্টিংই করছি, যেমন এখন অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে কাজ করছি। একসময় মনে হলো কিছু অয়েলে কাজ করি। দুটোর মধ্যে ডিফারেন্স আছে। আবার মনে হলো কিছু উডকাঠ করে দেখি আবার ফিরলাম পেইন্টিংয়ে। আবার সাহিত্যিক বন্ধুরা এসে বলল, একটা প্রচ্ছদ করে দিন বা ভেতরের ইলাস্ট্রেশন। তো লেখা যদি ভালো লাগে করে দেই। তো সেসবও করতে ভালো লাগে। এই যে নানান দিকে যাওয়া, এটা সব আর্টিস্ট যে করে তা না। আমি বলি যে সাধারণ কিছু ডাক্তার আছে না—সবই পারে, করে। সার্জারি বাদ দিয়ে সবই করে। জ্বর, মাথাব্যথা, পেট খারাপ সবকিছুরই চিকিৎসা করে। আবার কেউ আছে স্পেশালিস্ট। সেই স্পেশালিস্টরা যে যেটাতে আছে, সেটাতে এক্সপার্ট। তো আমাদের আর্টিস্টদের মধ্যেও সে রকম। সবাই সবটা করতে চায় না। যিনি হার্ট স্পেশালিস্ট, তিনি কী অন্য চিকিৎসা করতে পারবেন না, তা তো না। একটা সাধারণ লেখাপড়া তো সব মেডিকেলেই পড়ানো হয়। তারপর স্পেশালাইজড হয়। আমাদেরও সে রকম, সবটাই করার মতো প্রাথমিক শিক্ষাটা আমাদের থাকে। ব্যাপার হচ্ছে ভালো লাগাটা। আমার সব করতেই ভালো লাগে।

প্রশ্ন: একটা ব্রেকও হয়। আবার ভিন্ন একটা স্বাদ নেওয়া।

রনবী: পেইন্টিং থেকে সরে গিয়ে কয়েকটা ইলাস্ট্রেশন করলাম বা প্রচ্ছদ করে দিলাম কোনো বইয়ের জন্য, তো ওটা ছাপার পর নিজের কাছেই ভালো লাগে, অন্যরা বললে তো লাগেই। এ রকম সবকিছু করে দেখি। এটা ভালো না মন্দ জানি না, ভালো লাগে। যেমন আমার জীবনের একটা বড় অংশ হলো কার্টুন।

প্রশ্ন: আপনি তো এখন আর কার্টুন আঁকেন না। আর 'টোকাই' থেকেও আমরা বঞ্চিত।

রনবী: প্রেক্ষিত বদলে গেছে। যেসব কারণে একসময় টোকাই করেছিলাম, করতাম, সেই প্রেক্ষিত এখন আর নেই। কিন্তু টোকাইরা এখনো আছে। এখনো পথশিশু আছে। আমাদের যে সোশিওপলিটিক্যাল একটা বিষয়, একই রকম আছে। যেগুলো নিয়ে কার্টুন করা যায়, সবই একই রকম। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যা ছিল, তখনো মূল্যবৃদ্ধি হতো, তখনো পকেটমার ছিল, তখনো দুর্দিন ছিল, তখনো মানুষ ঘুষ খেত। চলে গেছে কি সেসব? যায়নি। সেটার একটা ধারাবাহিকতা চলছে। তো আমি দেখলাম, কেমন একটা মনোটোনাস হয়ে যাচ্ছে। সোশিওপলিটিক্যাল, সোশিওইকোনোমিক এইগুলো নিয়েই ঘাটতে হয় বেশি কার্টুনে। আবার এগুলো থেকে আমার পেইন্টিং একদম আলাদা। এগুলোর সাথে আমার পেইন্টিংয়ের কোনো মিল রাখিনি। 

এ রকম নানান দিকে কাজ করা। তাতে করে যেটা হয়েছে, সত্যি করে বলতে বড় শিল্পী হওয়ার যে একটা ব্যাপার থাকে, সেটা হয়ে ওঠেনি। সবকিছুই ছুঁয়ে দেখা, কী হয়। হয়তো একটা নিয়ে থাকলে অন্য রকম কিছু ঘটত।

প্রশ্ন: আপনি সবকিছুকে ছুঁয়ে দেখেও বড় শিল্পী।

রনবী: ওই যে সবকিছু করার যে একটা আনন্দ, সেই আনন্দটা আমি পাই। একটা সময় ছিল, যখন কার্টুন নিয়ে ভাবতাম। রিকশায় যাচ্ছি হয়তো মাথায় কার্টুনের সাবজেক্ট ঘুরছে। একটা প্র্যাকটিসের মধ্যে থাকছি। ফিরে এসেই ওটা রেখে পেইন্টিংয়ে ঢুকলাম একদম জাম্প করে। এখন আমি নিজেই ভাবি, এগুলো না করলেও হতো।

প্রশ্ন: হয়তো অনেককিছুর ভেতর আছেন বলেই আপনার কাজ অনেক বেশি বোধগম্য হয়েছে মানুষের কাছে।

রনবী: অন্যদের জন্য সুবিধা হলো, সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে, নিয়েছে কিন্তু আমি নিজে যখন ভাবি, তখন মনে হয়—এই দিকটা না হলেও ক্ষতি হতো না। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে আমি সব সময় চেয়েছি ভালো কিছু হোক, ভালো একটা পযার্য়ে পৌঁছাক। ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিক সবাই এবং তা-ই নিয়েছে। আমি খুবই ভাগ্যবান। কারও যদি বৈরী মনোভাব থেকেও থাকে আমার কার্টুনের ব্যাপারে, কেউ কখনো কিছু বলেনি এ পর্যন্ত। এখন যেমন নানা কিছু হয়। আমি একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে চেষ্টা করি, আমাদের সমাজের সহ্যশক্তি কতখানি, আমাদের পলিটিশিয়ানদের সহ্যশক্তি কতখানি বা আমাদের আশপাশের মানুষদের সহ্যশক্তি কতখানি। সেই ব্যাপারটা আগে যাচাই করে লেভেলটা ঠিক করে নিতে হয়। তারপর কাজ করতে হয়। নট টু হার্ট এনিবডি। আমাদের এখানে ফান করা বোঝে না কেউ। একজনকে নিয়ে ফান করা হলে সেটাতে বিদেশে খুশি হয়। একজন বড় আর্টিস্ট বা বড় কার্টুনিস্ট কাউকে নিয়ে কার্টুন করলে, যাকে নিয়ে করল, সে কিন্তু গর্বিত হয়ে যাবে। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় ডেভিড লর কার্টুন হিটলার এমনভাবে স্টাডি করতেন, হিটলার বলতেন যে আমার শক্তিমত্তার কোনো অভাব নাই। সবই আছে, প্ল্যান-প্রোগ্রাম সবকিছুই ভালো। কিন্তু আমার যদি একজন ডেভিড ল থাকত, তাহলে আমি দেখিয়ে দিতাম। ডেভিড ল আমার অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম আগে থেকে বলে দেয়। সমালোচনার মধ্য দিয়ে হিটলারকে নিয়ে যেসব কার্টুন করত, সেখান থেকে হিটলার নিজেকে আবার কারেকশন করে নিত। উনি গর্ব বোধ করতেন, ডেবিড ল আমাকে নিয়ে কার্টুন করত। তো কার্টুনিস্টরা যে ফান করে, মজা করে, তো একজনকে নিয়ে মজা করল, তিনি যদি সেই মজাটা না বুঝে রিঅ্যাক্ট করে, তাহলে তো আর হলো না। তিনি যদি মজা পায়, কনগ্র্যাচুলেট করে, তখন বেশ ভালো। এটা আমাদের দেশেও কখনো কখনো হয়েছে কিন্তু। শিশির ভট্টাচার্য, ও তো সরাসরি পলিটিক্যাল কার্টুন করত, নেতাদের কার্টুন করত। অনেক সময় তারা আবার বলত, এই তোমার কার্টুন তো ভালো হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের সহ্যশক্তি কম। 

আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আসাদ

আমাদের যে দিনকাল, আমাদের যে মানুষজন—আমার মনে হয় পৃথিবীর কোনো দেশের সঙ্গে মিলবে না। এখন এমন একটা আধুনিক যুগ, পৃথিবীর সবকিছু ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছে। চারিদিকে কত কিছু হচ্ছে, বিজ্ঞানের কত কত আবিষ্কার! আমাদের দেশের কোনো মানুষ এগুলো নিয়ে ভাবেও না, চিন্তাও করে না। জীবনে লড়াই করতে করতেই এদের চলে যায়। জীবনযাপনে যুদ্ধ করতে করতে এরা আসলে ক্লান্ত। গ্রামের দিকে যদি যাই, এই মানুষগুলো সারাটা জীবন ধরে ভোররাত থেকে সারা দিন ধরে মাঠে কাজ করছে। তাদের এত কিছু ভাবার সময় কোথায়? কোথায় কী আধুনিক হচ্ছে না-হচ্ছে। শিল্প বা সাহিত্যে কোথায় কী হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, এদের নিজেদের একটা নিজস্ব লোকজ শিল্প আছে, লোকগান আছে। গ্রামের কেউ ভাউয়াল গায়, ভাটিয়ালী গায়, বাউলসংগীত করে। তাদের নিজেদের একটা শিল্পসমাজ আছে। এখন হয়তো টিভি দেখে কিন্তু কোথায় কী হচ্ছে, এটা নিয়ে ওভাবে মাথা খাটায় না।

প্রশ্ন: তুলনামূলক শহরের মানুষ থেকে গ্রামের মানুষ একধরনের শান্তিতে আছে। শহুরে জীবনের মতো অস্থিরতা নেই। 

রনবী: শহরের থেকে অনেক ভালো আছে গ্রামের মানুষ। ঠিক সাতটা-সাড়ে সাতটায় উঠে হয়তো কাজে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে চায়ের দোকানে বসে হয়তো একটু আড্ডা দিচ্ছে। পৃথিবীর সব গ্রামের চিত্রই প্রায় এ রকম। নিজস্ব একটা ব্যাপার আছে।

আমাদের সবকিছু খুবই নিজস্ব। মানুষজন সব সহজসরল, সহজসরল ভাবনা, সব সহজ। কিন্তু চটে গেলে সেটা আবার মারাত্মক।

প্রশ্ন: হ্যাঁ, এই অস্থির একটা সময়! মানুষ জানে না আসলে কী করবে। এই খাওয়াদাওয়া, ঘুম, কাজে যাওয়া আবার কাজ থেকে ফেরা। পরের দিন আবার সেই একই রকম রুটিন।

রনবী: হ্যাঁ, এখন মানুষ একটা কাজ যেটা করে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো—ছেলেপেলে পড়াশোনা হয়তো করে না বা পড়ানোর অতটা সামর্থ্য নেই অথবা পড়াশোনা শেষ করেও চাকরির অতটা নিশ্চয়তা নেই, তো জায়গা জমি বিক্রি করে হলেও কোনোরকমে বিদেশে কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই একটা কালচার তৈরি হয়ছে। এতে অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছে; কিন্তু দেশের বা সংস্কৃতির কী লাভ হচ্ছে?


 

টোকাই নিয়ে দু'ছত্র আলাপ

পথবাসী ছন্নছাড়া এই রসিক বালকটির নাম টোকাই। এ নামেই সবাই ওকে চেনে। ওর এই নামটি রেখেছেন একজন চিত্রশিল্পী—তার নাম রফিকুন নবী, কার্টুন আঁকার সময় লিখতেন রনবী। টোকাইয়ের সাথে মিলেমিশে থাকতেই তার নামের এই সংক্ষিপ্তকরণ। 

শিল্পী রফিকুন নবীর আঁকা এই শিশুর বয়স এখন ৪৪। তবে বয়স বাড়লেও টোকাই এখনো শিশু। ৪০ পেরোলেও ওর কথাবার্তা চালশে হয়নি। সমাজ, রাষ্ট্রের অন্যায়-কপটতা লক্ষ করে সে এখনও ছুড়তে পারে বিদ্রুপের বাণ। রনবীকে প্রশ্ন ছিল—

প্রশ্ন: টোকাইয়ের নাম টোকাই কেন?

রনবী: টোকন, টোকাই, টোকা এ রকম ট-বর্গের মধ্যেই কিন্তু ছিলাম। বেশি করিনি, বাচ্চার নাম রাখার মতোন অবস্থা। তারপর দেখলাম যে যদি টোকন দেই, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের বাচ্চার কথা মনে হবে। তারপরে যদি টোকা দেই, হঠাৎ শব্দটা থেমে যায়—কমপ্লিট মনে হয় না। এ রকম অনেক ভাবনাচিন্তা চলে। একাই ভাবি বসে বসে। অনেক নামটাম ঠিকঠাক করি, তারপর এই টোকার সাথে হঠাৎই 'ই' দিলাম। টোকাই হলো, তকাজ হলো, এতে করে যা হলো কোনো কাউকে নির্দিষ্ট করা হলো না। 

প্রশ্ন: টোকাইয়ের কথায় বেশ রস থাকে, খুব আকর্ষণীয়। এবং কেউ কেউ বলেন যে টোকাই যে ধরনের কথা বলে, আপনারও কথা।

রনবী: প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে হোক, আমার ভেতর থেকেই বের হয় তো। উইট কার্টুন করলে সেখানে একটা মজা তো থাকতেই হবে। কার্টুন করলেই সাবজেক্টে কিছু হিউমার থাকতে পারে, তারপর স্যাটায়ার থাকতে হবে। আমি স্যাটায়ারকে বেছে নিয়েছিলাম। স্যাটায়ার থাকবে, সেটা হিউমারাস হতেও পারে, না-ও হতে পারে। সিরিয়াস ঘটনা সিরিয়াসলি প্রকাশ করা হলো—কিন্তু টোকাই এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল, সবার ধারণাই ছিল যে এর পেছনে নিশ্চয়ই একটা স্যাটায়ার আছে। কিছু কিছু পাঠক নিজেদের যুক্ত করে নিত এটার সাথে। সেই জন্যই হয়তো সবার ধারণা, আমি যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই টোকাইয়ের মুখে ওই কথাটা যায়।

দুইজন থাকে আমার ইস্যুতে, মিনিমাম দুইজন—টোকাইয়ের কথোপকথনে থাকত আরকি, এখনো করলে তাই করি। একজন প্রশ্ন করে বা কোনো একটা মন্তব্য করে। সেটা প্রশ্ন হলে উত্তর দেয় টোকাই। আর প্রশ্ন যদি না হয়—এমনি কেউ একটা মন্তব্য করল, হতাশাব্যাঞ্জক কোনো একটা মন্তব্য বা খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু একটা মন্তব্য করল; সেটার আবার পুনর্মন্তব্য আরেকটা করল এবং আবার এর মধ্যে যুক্ত করল। এই দুই রকমের ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। সেটা দেখলাম পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো, পাঠক পছন্দ করে।

প্রশ্ন: তার মানে পাঠক আপনার চিন্তায় থেকেছে?

রনবী: আমি সব সময় পাঠকের পালস দেখার চেষ্টা করতাম; কারণ, এটা করতে হতো। এবং সেভাবে পাঠক তৈরিই হলো, টোকাইয়ের পাঠক, তারাও কিন্তু অনেক সময় আমাকে সাজেস্ট করত যে অমুক বিষয় নিয়ে তো কথা হচ্ছে, সেটা নিয়ে কিছু আপনি বললেন না? এ রকম সাজেস্ট করত। আমি সেটা কিন্তু সম্মান করতাম।

আমি যেভাবে কথা বলি, তার মধ্যে কী নির্ধারিত, আমি জানি না; কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় টোকাই কথা বলে তো।

আঞ্চলিক ভাষা, বিশেষ করে ঢাকার ভাষা—ওর মধ্যে কিন্তু এমনিতেই উইট থাকে। আমি যদি ঢাকার পাবলিকের মধ্য থেকে নেই, তার মধ্যে কিন্তু উইট থাকে। এই যে উইট এটাকে ব্যবহার করেছি।

প্রশ্ন: শুনেছি যে একসময় আমাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ এই টোকাই নিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন। আপনার কি মনে আছে?

রনবী: টোকাই এমন একটা সাবজেক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেটা এখনো তাই। সবার কথা বলে—মানে মানুষের চেনা কথাগুলো শোনা কথাগুলোই বলে। পাবলিক মিটিংয়ে হঠাৎ করে উনি বললেন, এই যে রনবী 'টোকাই' করেন—কেন টোকাই? হোয়াই? টোকাই বলে সম্বোধন করবেন না। এদেরকে সুন্দর করে এই বলেন, সুন্দর একটা নাম দেন। পরে বলল, আমি ঠিক করেছি, পথকলি নাম দেওয়া হোক। পরোক্ষভাবে আমার টোকাইয়ের জন্য তো ভালোই হলো, কারণ, এটা তখন সবার কাছে আরও বেশি গৃহীত হলো। একটি দেশের প্রেসিডেন্ট যখন কিছু বলে, তার মানে এর ভেতরে কিছু একটা আছে।

প্রশ্ন: ১৯৭৮ সালে বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর শিল্পী রফিকুন নবীকে নিয়ে বলতে গিয়ে এভাবে বলেন—পত্রিকায় টোকাই কার্টুন আঁকলেও আগে থেকেই তিনি কমবেশি কার্টুন আঁকতেন। উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে ১৯৭৫-পরবর্তী পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। সে সময় ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকার কাজটি খুব সহজ ছিল না। শাহাদাত চৌধুরীর কথা—

রনবী: সময়টা ছিল খারাপ। আমাদের ৭৫-এর মর্মান্তিক যে ঘটনা, বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে ওই সময়ের পর থেকে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশে; পরিষ্কার করে কেউ কোনো কথা বলে না, কোনো রকম অভিব্যক্তিহীন অবস্থা। নতুন এক চরিত্র তৈরি হয়েছে মানুষের। কী রকম একটা সন্দেহপ্রবণ, আবার কিছু লোককে দেখি খুব আনন্দিত। কেন আনন্দিত, সেটা আবার কেউ জানে না। সেসব দিন পার করে তবুও এগিয়েছি। 

প্রশ্ন: টোকাইয়ের সঙ্গে আপনার কথোপকথন কল্পনা করা যায়? কেমন হবে টোকাইয়ের সাথে আপনার কথা?

রনবী: আমার এক ছাত্র বলল, তোদের তো স্যার একটা ভালো নাম দিয়েছে—টোকাই।

শুনে টোকাই চেতে গেল, রেগে গেল—কেন, আমাদের টোকাই কেন?

আমাদের নিজের নাম নাই?

ওর নাম অমুক, ওর নাম অমুক, আমার নাম অমুক—আমাদের

টোকাই বলবেন কেন?

কিন্তু এই টোকাই নিয়ে উনি ছবি আঁকেন, পত্রিকায় ছাপা হয়।

কয়, আমরাও আঁকি। কী আঁকি? পরে বলল, এই যে খাঁড়াইলাম আমি, এখানে খাঁড়াইলাম। ওই যে ওখানে সূর্য দেখতে পাইতেছেন, এইটার আলো আমার এখান দিয়া এই যে ছায়াটা পড়ছে না—কত বড় লম্বা হইছে।

আউটলাইন দেখিয়ে বলে—এইটার এদিক দিয়ে দাগ দিয়া ছায়াটা আঁকি, তারপর চোখমুখ দিয়া দেই। এটাও তো ছবি, আমগো ছবি না?

প্রশ্ন: টোকাইকে নিয়ে ভুলভাল কথা, খারাপ কিছু—

রনবী: কিছু মানুষ যারা সব সময় খারাপ চিন্তা নিয়ে থাকে, তারা এটাকে অন্যভাবে ব্যবহার করেছে। সন্ত্রাসীদের নাম খুবই আদরণীয় করার জন্য হয়তো টোকাই অমুক নাম দিয়ে দিল। এ রকম খুব বড় সন্ত্রাসীদের নামের সাথে এটা ব্যবহার করা শুরু করল। জিগাতলার ওখানে একটা বেকারি—নতুন একটা দোকান খুলেছে; তার খুব টোকাই পছন্দ, বেচারা সাইনবোর্ডে লিখেছে টোকাই কনফেকশনারি। তখন আমি একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। একি! নেগেটিভ লাইনে সবাই একে ব্যবহার করা শুরু করেছে কেন? এটা তো ঠিক না। অনেকে গেঞ্জির মধ্যে ড্রয়িং লাগিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিল। জনপ্রিয় হচ্ছিল যত, তত তারা এটাকে আরেকটা খারাপ দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এগুলো আমি দেখেছি।

[এই সাক্ষাতকারটির অংশবিশেষ টিবিএস মাল্টিমিডয়ায় প্রচারিত হয়েছে]

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.