দুর্লভ সফরনামায় উনিশ শতকের ঢাকা
(১)
পৌষের এক পড়ন্ত বিকেলে ভোলানাথ চন্দ্রের বজরা বাদাবনের ভেতর দিয়ে পূর্ব মুখে এগিয়ে চলল। প্রায় ছয় ঘণ্টা পর জোয়ারের দেখা মিলেছে। নদীর দুকূল ছাপিয়ে হু হু করে লোনাপানি ঢুকছে। জালের মতো জড়িয়ে থাকা নদ-নদী, খালে ভরা সুন্দরবনে নৌকা চলাচলের নিয়মটা একটু অদ্ভুত। এখানে সবকিছু নির্ভর করে জোয়ার ভাটার ওপরে। বামনঘাটা পেরোবার পরপর শুরু হয়েছিল ভাটা। সে সময়টা মাঝিরা কাটিয়েছে রান্নার কাজে। দুজন আবার ব্যস্ত ছিল কাসার ঘণ্টা নিয়ে; এখানে বন্য শূকর তাড়ানোর জন্য নিয়মিত কাসার ঘণ্টা বাজাতে হয়। জোয়ারের দেখা পেতেই তারা নোঙর তুলে নিল। সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। বনের এদিকটায় আঁধার নামে দ্রুত। চারপাশ থেকে ঘন বন ঘিরে ধরেছে সামনের জলপথ। মাঝির দল প্রাণপণ শক্তিতে বজরা ভাসিয়ে দিল, তাদের গন্তব্য ঢাকা।
উনিশ শতকের বাংলা নবজাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভোলানাথ চন্দ্র। পরিণত বয়সে এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন। ১৮৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ২১ দিনের নৌযাত্রা শেষে তিনি পৌঁছেছিলেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধান শহর ঢাকায়। ২১ বছরের তরুণ ভোলানাথ ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন মাত্র ৪ দিন। ঢাকা সফরের সে অভিজ্ঞতা চিঠির আকারে ১৮৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ছাপানো হয় ইংলিশম্যান পত্রিকায়। বিশুদ্ধ এবং সুললিত ইংরেজিতে লেখা এই সফরনামা সেকালে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। এই জনপ্রিয়তা ভোলানাথকে তাঁর পরবর্তী রচনা 'দ্য ট্রাভেলস অব এ হিন্দু' লিখতে উৎসাহ জোগায়। তবে দুই খণ্ডে প্রকাশিত বিশাল সেই গ্রন্থে ঢাকা সফরের কাহিনি সংকলিত হয়নি। উৎসাহী পাঠকের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ভোলানাথের ঢাকা সফরনামা। দুর্লভ সেই সফরনামা নিয়ে এই নিবন্ধ। উনিশ শতকের ঢাকার প্রকৃত চিত্র আবিষ্কারে বিস্মৃত সফরনামাটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
(২)
ভোলানাথের জন্ম ১৮২২ সালে, কলকাতার নিমতলা স্ট্রিটে তাঁর মাতুতালয়ে। হিন্দু কলেজে পড়ালেখার সূত্রে তিনি পেয়েছিলেন ঈর্ষণীয় সব সঙ্গ। ইংরেজি প্রবাদ 'Birds of a feather flock together' সত্য মেনে নিলে ভোলানাথ চন্দ্রের পরিচয় পাওয়া পাঠকের জন্য সহজ হবে। তাঁর বন্ধুতালিকায় ছিলেন বাংলা নবজাগরণের উজ্জ্বল সব নক্ষত্র—মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গৌরদাস বসাক, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। 'বেঙ্গল স্পেক্টেটর'-এ ইংরেজি সনেট ছাপানোর পর গোলদিঘীতে বসে সে আনন্দ মধুসূদন প্রথম ভাগ করে নিয়েছিলেন ভোলানাথের সাথে, 'শর্মিষ্ঠা' মঞ্চায়নের জন্য বন্ধুরা দলবেঁধে ছুটে গিয়েছিলেন বেলগাছিয়ার উদ্যানে, এমন কত স্মৃতি! ভোলানাথের স্মৃতিকথায় কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো জুড়ে আছে এসব নাম।
বন্ধু মধুসূদনের মতো ভোলানাথেরও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি ছিল বিপুল আকর্ষণ। ছোটবেলায় স্কটিশ এক ভদ্রলোকের কাছে ইংরেজি বর্ণমালায় হাতেখড়ি হয়েছিল। এরপর হিন্দু কলেজের দিনগুলোতে অধ্যক্ষ ডি এল রিচার্ডসনের সংস্পর্শে এসে তাঁর ইংরেজি চর্চা আরও শাণিত হয়। এ সময়ে হিন্দু কলেজে তাঁর কয়েকজন সহপাঠী মিলে 'হিন্দু পায়োনিয়ার' নামে একটি সাময়িকপত্র বের করেন, সেখানে তারা ইংরেজিতে কবিতা ছাপাতে শুরু করেন। সহপাঠীদের লেখা ছাপাতে দেখে ভোলানাথেরও লেখালেখির শখ জাগে। তবে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশে তখনো বেশ কয়েক বছর বাকি। হিন্দু কলেজ থেকে পাস করে বেরোবার পরে ভোলানাথ যোগ দেন ইউনিয়ন ব্যাংকে।
কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে জ্ঞাতিভাই মহেশচন্দ্রের সাথে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার পাশাপাশি মেসার্স হাওয়ার্থ হার্ডম্যান অ্যান্ড কোম্পানির চিনিকলের এজেন্টের কাজ নেন। এজেন্টের কাজে ১৮৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভোলানাথ চন্দ্রের ঢাকা সফরের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন এ অঞ্চলে রেললাইন বসেনি। ভোলানাথ তাই সুন্দরবনের ভেতরে দিয়ে দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান পূর্ব বাংলার প্রধান শহর ঢাকায়। কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছাবার বিস্তারিত বিবরণ তিনি রোজনামচা আকারে লিখে রেখেছিলেন। এরপর কেটে যায় প্রায় ৬বছর। এর মাঝে ছোটখাট আরও অনেক সফর করতে হয়েছিল ভোলানাথকে। সফরের নানান অভিজ্ঞতা ব্যবসার প্রসারে দারুণ কাজে লেগেছিল। ভোলানাথের লেখালেখির অভ্যাস আছে জেনে চিনিকলের মালিক হাওয়ার্থ তাঁকে ইংলিশম্যান ম্যাগাজিনের সম্পাদক ফেনউইকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফেনউইকের পত্রিকাতেই চিঠি আকারে প্রথম ছাপা হয় ভোলানাথের ঢাকা ভ্রমণের রোজনামচা।
(৩)
ভ্রমণবিমুখ বাঙালি 'সুখী গৃহকোণ' ফেলে নিতান্ত আমোদপ্রমোদের উদ্দেশ্যে ঘুরতে বেরিয়েছে এমন ঘটনা সেকালের সমাজে বিরল। কালেভদ্রে কাজের প্রয়োজনে যদিও বা বের হতো, সে ভ্রমণের দিনক্ষণ ঠিক করবার জন্য তারা স্থানীয় পণ্ডিত কিংবা পঞ্জিকার ওপর নির্ভর করত। শুভ-অশুভ সকল ঘটনার ব্যাখ্যা বাঙালি তখন পঞ্জিকার পাতায় খুঁজে বেড়াত। তাই যুগের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও ভোলানাথ পঞ্জিকার গণনা উপেক্ষা করতে পারেননি। পঞ্জিকা অনুযায়ী শুভদিন দেখে ১৮৪৩ সালের ডিসেম্বরের ৬ তারিখে কয়েকজন বন্ধুসমেত ঢাকার উদ্দেশে বজরা ভাসালেন ভোলাচন্দ্র। যাত্রাপথ চেনার প্রয়োজনে সাথে নিলেন টাসিনের তৈরি ১৮৩৭ সালের এক মানচিত্র। তাদের প্রথম গন্তব্য সুন্দরবনের পথে চিংড়িঘাটা।
সুন্দরবনের জলাজঙ্গলের ভেতর দিয়ে সফরের দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন ভোলানাথ। সে বিবরণে উঠে এসেছে বিচ্ছিন্ন কিছু জনপদের কথা, যেখানে কৃষিজাত পণ্যের বেচাকেনার জন্য নৌকাতেই বাজার বসে। ব্যবসায়ীরা দূরদূরান্ত থেকে নৌকাবোঝাই করে নিয়ে আসে লাকড়ি, ধান, চাল, সুপারিসহ নানান পণ্য। টানা চার দিন জোয়ার-ভাটার সাথে হিসাব কষে নৌকা চালিয়ে ডিসেম্বরের ১০ তারিখে পৌঁছালেন খুলনা। যশোরের পথে বেশ কিছু বজরা চোখে পড়ল। ভোলানাথের বজরা এগিয়ে চলল ঢাকার পথে। সুন্দরবনের অস্বচ্ছ খাল-নদীর বিপরীতে মধুমতির স্বচ্ছ জলধারা তাঁকে মুগ্ধ করল। পদ্মার শান্তরূপ দেখে তিনি অবাক হলেন। বর্ষায় এর প্রমত্তরূপের কথা কলকাতায় বহুলচর্চিত। তবে বিশালতায় কোনো কমতি দেখা গেল না, বিস্তীর্ণ জলরাশিজুড়ে হরেক রকম নৌকার সমাহার ভোলানাথকে মুগ্ধ করল। পূর্ব বাংলার নদীতে মাছের প্রাচুর্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ধলেশ্বরী নদীর এক জেলে প্রায় চল্লিশটা মাছ ধরেছিল, দাম চেয়েছিল মাত্র অর্ধেক পয়সা। খুচরা না থাকায় পুরো এক পয়সা দিয়ে সেই মাছ কিনে নেন ভোলানাথ। সাথে মন্তব্য জুড়ে দেন যে এর দাম কলকাতায় কম করে হলেও বিশ গুণ হবে।
ধলেশ্বরী থেকে বজরা গিয়ে পড়ল বুড়িগঙ্গায়। তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। বাড়তি বকশিশের আশ্বাসে হুকায় টান দিয়ে কাজে নেমে পড়ল মাঝির দল। সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। অবশেষে কলকাতা ছাড়বার ২১তম দিনে গোধূলিবেলায় দূর থেকে চোখে পড়ল ঢাকা। মসজিদ, মন্দির আর গির্জার সারি সারি চূড়ায় দিনের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে সূর্য তখন ডুবতে বসেছে। নদীতীরের কোলাহলের শব্দ এসে পৌঁছাল ভোলানাথের কানে। কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর মনে পড়ল মাতামহ নিতাইচরণ সেনের কথা। ৪০ বছর আগে এই শহরে ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠির দেওয়ান পদে কাজ করতেন নিতাইচরণ। আজ এ শহরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার অপেক্ষায় কোনো আপনজন নেই। ভোলানাথের বজরা ঘাটে ভিড়ল।
(৪)
ভোলানাথ তাঁর সফরনামা লিখেছিলেন রোজনামচা কায়দায়। ঢাকা ছিলেন মাত্র ৪ দিন। তারিখ উল্লেখ করে প্রতিটি দিনের ঘটনার বিবরণ গল্পচ্ছলে, আন্তরিক ভাষায় লিখে গেছেন তিনি। নিজ অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করেছেন বিশপ হেবারের দেখা ঢাকার। বিশপ হেবার ঢাকা এসেছিলেন ভোলানাথের ঢাকা সফরের প্রায় ১৯ বছর আগে, ১৮২৪ সালে। হেবারের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৮২৯ সালে প্রকাশিত হয় 'NARRATIVE OF A JOURNEY THROUGH THE UPPER PROVINCES OF INDIA'। ইতিহাস, ভ্রমণকথা আর কবিতা বিষয়ে ভোলানাথের বিপুল আগ্রহের কারণে ধারণা করা যায়, হেবারের লেখা বইটি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল এবং এ বই তাঁকে ঢাকা বিষয়ে আরও কৌতূহলী করে তোলে।
২৭ ডিসেম্বর সকালে ভোলানাথের বজরা নোঙর ফেলল বাবুবাজার ঘাটে। আগের রাতে যে এলাকায় ছিলেন, সেখানে দুর্গন্ধ আর কোলাহলে বিশ্রাম ঠিকমতো হয়নি। বাবুবাজারের এদিকটা বেশ পরিচ্ছন্ন মনে হলো। নদীতীরে দাঁড়ানো ইউরোপীয়দের বসবাসের দালানগুলো দেখতে চমৎকার। আকর্ষণীয় আর কিছু চোখে পড়ল না। ১৬ এবং ১৭ শতকের গৌরব তখন অনেকটা ম্রিয়মাণ। মীর জুমলা এবং শায়েস্তা খানের ঢাকার যে বিবরণ পর্যটকদের বর্ণনায় এসেছে, তার সাথে এই ঢাকার মিল পাওয়া দুষ্কর। বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরে যাওয়ায় ঢাকার আকার ক্রমে সংকুচিত হয়েছে; নদীর তীর ঘেঁষে এর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ মাইল, প্রস্থ ১ মাইলের বেশি হবে না। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহরে বাজারের সংখ্যা তিন-চার এ এসে ঠেকেছে। শহরে প্রধান সড়ক মাত্র দুটি। 'ঢাকা প্রাচীন গৌরবের এক ধ্বংসাবশেষ'—হেবারের এই মন্তব্য একদম সঠিক মনে হলো। বুড়িগঙ্গা বিষয়ে হেবার লিখেছিলেন, 'রেনেলের মানচিত্রে আঁকা গতিপথ অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে।' বিস্তীর্ন নদীপথে ভ্রমণের কারণে ভোলানাথের অভিজ্ঞতা ছিল একই রকম। পদ্মা এবং ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ ঘন ঘন বদলাবার কারণে বহু জনপদ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এত কিছুর পরও ঐতিহাসিক এই শহরের টিকে থাকার বিষয়টি বিস্ময়কর।
সকালটা নদীতীরে ইউরোপীয়দের অভিজাত দালানকোঠা দেখে কেটে গেল। তবে কলকাতার চৌরঙ্গীতে হোয়াইট টাউনে যেসব জমকালো বাড়ি চোখে পড়ে, তাদের পাশে এগুলো শ্রীহীন বলা যায়। বিকেলে স্থানীয়দের জনবসতি দেখতে বের হলেন ভোলানাথ। শহরের প্রধান সড়কটি নদীর সমান্তরালে লালবাগ থেকে ধোলাইখাল পর্যন্ত চলে গেছে। মাত্র দুই মাইল দীর্ঘ এ সড়কের দুপাশে চোখে পড়ল কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি আর পুরাতন ক্ষয়ে আসা কাঠামোগুলো। মথুরামোহন সেন কিংবা রূপলাল মল্লিকের প্রাসাদপম বাড়ির মতো কোনো দালান এখানে নেই। কলকাতার প্রধান সড়ক চিৎপুর রোডের বিপরীতে এই সড়ককে ভোলানাথের কাছে জৌলুশহীন মনে হলো। দোলাইরখালের জলধারা শুকিয়ে গেছে। এককালে যে এটি কর্মব্যস্ত জলপথ ছিল তা বোঝার উপায় নেই। ঢাকার অপর প্রধান সড়কটি নদীতীর থেকে উত্তর দিকে চলে গেছে, বড়জোর মাইলখানেক দীর্ঘ হবে। শহরের উত্তর প্রান্ত ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেছে, স্থানে স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু স্থাপনার দেখা মেলে। ঢাকার নায়েব নাজিম এর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ সে রকম একটি স্থাপনা। শহরের এই চিত্রটি বড় বিষাদময়।
ভোলানাথ স্থানীয়দের কাছে শায়েস্তা খানের তৈরি একটি বিশেষ ফটকের খোঁজ করলেন। শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। ১৬৮৮ সালে সুবেদারি শেষে ঢাকা ত্যাগের সময়ে এই সুখস্মৃতি অক্ষয় রাখবার জন্য তিনি একটি ফটক তৈরি করিয়েছিলেন। শায়েস্তা খান বের হয়ে যাবার পর ফটকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে লিপিতে উৎকীর্ণ ছিল—ভবিষ্যতে ঢাকার কোনো শাসক যদি চালের দাম এত কমিয়ে আনতে পারে, তবেই ফটক খোলা হবে, নচেৎ তা বন্ধই থাকবে। বহু খুঁজেও সেই ফটকের দেখা মিলল না। শহরের সবচেয়ে কর্মমুখর এলাকা হলো চকবাজার। কলকাতার বড়বাজারের মতো এখানে বিপুল লোকের আনাগোনা দেখা গেল। খোলা যে চত্বরে বাজার বসে, তা নিচু দেয়ালে ঘেরাও করা, চত্বরের ঠিক মাঝখানে উঁচু বেদিতে বসানো আছে আসাম অভিযানে ব্যবহৃত মীর জুমলার কামান।
পরদিন সকালে ভোলানাথ বের হলেন মসলিন তাঁতির খোঁজে। ঢাকার এককালের বিখ্যাত রপ্তানি পণ্য মসলিন তখন মৃতপ্রায় এক শিল্প। দুই হাজার বছর আগে প্রাচীন রোমে রপ্তানি হতো এই মসলিন। মসলিনশিল্পের সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষের কাল ছিল মুঘল আমল। ইউরোপীয় রমণীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে ছিল মসলিন। মিহি মসলিনে তৈরি সেসব পোশাক বিয়ের আংটির ভেতর দিয়ে খুব সহজে গলিয়ে নেওয়া যেত। 'আবে রাওয়া' নামে যে সূক্ষ্ম মসলিনের জন্ম হয়েছিল, এ শহরে তা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। এক তাঁতি পরিবারের দেখা পেলেন ভোলানাথ, যাদের পূর্বপুরুষেরা এককালে মসলিন বুনতেন। সে সময়ে মেঘনার অববাহিকায় বিশেষ তুলার চাষ হতো, ভোরের আলো ফোটার আগে সে তুলা থেকে সুতা বানানো হতো। কাল পরিক্রমায় সেই সুদিন হারিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভোলানাথের মন্তব্য, 'Othello's occupation is gone.' ভোলানাথকে তাঁতি পরিবার জানাল যে তাদের নিজস্ব কোনো পুঁজি নেই। অর্ডার পেলে অগ্রীম নিয়ে তাঁত বোনে। মসলিন বুননের বিশেষ তুলা আর চাষ হয় না। ফলে আগের মতো মিহি সুতা তৈরি হয় না। শত শত বছরের কারিগরিতে কোনো নতুনত্ব চোখে পড়ল না। মুঘল এবং নবাবদের বিদায়ের পর মূল্যবান মসলিনের চাহিদা নেই বললে চলে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বরাবরই সীমিত। বাজার ছেয়ে গেছে শান্তিপুরের তাঁত আর ম্যাঞ্চেস্টারের সস্তা কাপড়ে। টিকে থাকার প্রয়োজনে, সাধারণের চাহিদার কথা মাথায় রেখে তাঁতিরা এখন মোটা সুতার ধুতি, শাড়ি তৈরি করে। কলকাতার পূজার বাজারে ঢাকায় উৎপাদিত এসব পণ্যের আলাদা চাহিদা আছে।
মসলিন কোনোরকমে তাঁত আকারে টিকে থাকলেও বিলুপ্ত হয়েছে চীনামাটির তৈজসপত্র রাঙানোর শিল্প। এককালে সোনারগাঁ থেকে চীনের রাজদরবারে উপহার পাঠানো হতো রঙিন সব তৈজস; কালের গর্ভে বিষয়টা লোকের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে। ঢাকায় ভালোভাবে টিকে আছে দুটা শিল্প—রুপার ফিলিগ্রি কাজ আর শঙ্খশিল্প। ঢাকায় এসে পরিচয় হয়েছিল এক মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তির সাথে। সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেলেন ভোলানাথ। বাড়িতে চলছে বিয়ের উৎসব। এক বাইজিকে বিয়ের আসরে নাচতে দেখা গেল। নাচের ঘূর্ণনে বাইজির পরনের রংবেরঙের জামাটা ঠিক যেন একটা ফুলের তোড়ার মতোন দেখাচ্ছিল। মুসলিম বাইজির নাম 'বসন্ত' জেনে তিনি অবাক হলেন।
২৯ ডিসেম্বর সকালে ভোলানাথ গেলেন লালবাগ দুর্গ দেখতে। শহরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই দুর্গকে ভোলানাথ নিজ সফরনামায় ঢাকার সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁকে সঙ্গ দিলেন আগের রাতে যার বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন সেই বন্ধু। শায়েস্তা খানের কালে দুর্গের কোল ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে ২০০০ফুট দীর্ঘ আর উত্তর-দক্ষিণে ৮০০ ফুট প্রশস্ত এক মনোহর মুঘল উদ্যান তৈরি করা হয়েছিল। চারপাশ ঘিরে থাকা প্রাচীরের মাঝে মাঝে ছিল চমৎকার কয়েকটি ফটক।
ভোলানাথ যে লালবাগ দুর্গের দেখা পেলেন, সেখানে মুঘল আমলের জৌলুশ মৃতপ্রায়। পুরো বাগান জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। ফটকগুলোর মাঝে শহরমুখী উত্তর ফটকটি কেবল অক্ষত দেখা গেল। ময়লা-আবর্জনা ঠেলে বহু কষ্টে দুর্গের শীর্ষে পৌঁছালেন তিনি; দেখলেন অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি দুর্গকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। সেখান থেকে নেমে দেখতে গেলেন একটি হলঘর, এর চারপাশ ঘিরে ছিল কারুকাজ করা পাথরের স্তম্ভ। এই স্থাপনাটি দরবার কক্ষ হিসেবে ব্যবহার হতো বলে জানা গেল। অদূরে একটি ছোট সুন্দর মসজিদ চোখে পড়ল। তবে পুরো বেষ্টনীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা হলো পরী বিবির সমাধিসৌধ। পলিমাটির এই দেশে পাথরে নির্মিত এমন কাঠামো বিরল।
পরী বিবি ছিলেন মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের আদরের কন্যা এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহম্মদ আজমের স্ত্রী। সম্রাজ্ঞী নুরজাহান এবং মমতাজ মহলের উত্তরসূরি পরী বিবি বংশপরম্পরায় সৌন্দর্য্য আর আভিজাত্যের সবটুকু পেয়েছিলেন। এই তিন মুঘল নারী যেন ছিলেন একই মালায় গাঁথা তিনটি ফুল; অবশ্য মৃত্যুর পর তাঁদের ঠাঁই হয়েছিল তিনটি ভিন্ন শহরে—লাহোর, আগ্রা এবং সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে, ঢাকায়। পরী বিবির সমাধিসৌধের বিস্তারিত বর্ণনা লিখেছেন ভোলানাথ। বর্গাকার সৌধের বহির্ভাগ চুনার থেকে আনা বেলেপাথরে তৈরি, আর ভেতর ভাগ তৈরি করা হয়েছে মর্মর পাথরে। সমাধি বিষয়ে তথ্যাদি পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালে যুক্ত দুটি শিলালিপিতে লেখা আছে। মূল সমাধিটি ঠিক মাঝের গম্বুজযুক্ত কক্ষে অবস্থিত, একে ঘিরে আছে আটটি কক্ষ। মর্মর পাথরের দেয়ালে ঘেরা পরী বিবির সমাধিকক্ষের দরজাগুলো চন্দন কাঠে তৈরি, এর মেঝেজুড়ে আঁকা রয়েছে কমলা, বেগুনি, নীল আর সবুজ পাথর বসানো লতাপাতার নকশা। তামায় মোড়ানো গম্বুজের ঔজ্জ্বল্য ম্রিয়মাণ।
ঢাকা শহরের ক্ষয়িষ্ণু, বিষণ্ন রূপ ভোলানাথকে আহত করেছিল। শুধু ঢাকা কেন, গোটা পূর্ব বাংলাই তখন পশ্চিম বাংলা থেকে শিক্ষাদীক্ষা, বিত্তবৈভবে পিছিয়ে। একজন কলকাতাবাসী হিসেবে তাঁর মনে হয়েছে এই অনগ্রসরতার মূল কারণ এ অঞ্চলে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লেখক, দার্শনিক এবং ধর্ম প্রচারকের অভাব। ক্ষুদ্র শিল্পে এ অঞ্চলের খ্যাতি থাকলেও এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তীর্থস্থানের যে প্রাচুর্য পশ্চিম বাংলায় দেখা যায়, তা পূর্ব বাংলায় বিরল। চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথের মন্দির তো বহুদূরের পথ, সে যেন অন্য এক দেশ। একমাত্র ব্যতিক্রম ব্রহ্মপুত্রের তীরে আয়োজিত মেলা, যেখানে বছরে একবার দুই বাংলার পুণ্যার্থীদের সমাগম হয়।
ভোলানাথ ভেবেছিলেন ঢাকা সফর শেষে সঙ্গীসাথি নিয়ে সোনারগাঁ এবং বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) সফরে বের হবেন। কিন্তু সে সুযোগ তাঁর হয়নি। শিগগিরই ফেরার তাগাদা দিয়ে কলকাতা থেকে চিঠি এল। ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ বিকালে ঢাকা ছাড়লেন তিনি। যশোরের কেশবপুরে স্বল্পকালীন অবস্থান শেষে ২১ জানুয়ারি, ১৮৪৪ এ ভোলানাথের বজরা নোঙর ফেলল হুগলিপারের কলকাতায়।