শিকারের ইতিকথা

ইজেল

03 September, 2022, 04:05 pm
Last modified: 03 September, 2022, 04:05 pm
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘Put your gun as you put your wife.’ এটা আমি সবসময় মেনে চললেও পুরোনো এয়ারগানটি বিক্রির মাধ্যমে এর ব্যত্যয় ঘটেছিল। পুরোনো হলেও পারতপক্ষে নিজের অস্ত্র হাতছাড়া করতে নেই।

কিছুকাল আগে এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে এয়ারগান ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি মনে করি, এটা আরও অনেক আগেই করা উচিত ছিল। তাহলে বেঁচে যেত বহু নিষ্পাপ প্রাণ। নিজের জীবনের কথাই ধরা যাক। দুরন্ত কৈশোরে সর্বপ্রথম ৫.৫ ক্যালিবারের একটি চাইনিজ এয়ারগান হাতে আসে। সে কী উন্মাদনা তখন চকচকে অস্ত্র হাতে নিয়ে! 

দিনমান সারা গ্রাম চষে বেড়াই এয়ারগান নিয়ে। তখনই একদিন গ্রামীণ পথে দেখা ফাইজুদ্দিন মিয়ার সঙ্গে। এই প্রবীণ ভদ্রলোককে বাবা সব সময় 'সোলজার' বলে ডাকতেন। শুনেছি তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। 

অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত এই প্রবীণ সৈনিক আমায় ডেকে বললেন, 'সামনে যেই পাখি পাইবা, সেইটারেই গুলি করবা। আগে নিশানা ঠিক করতে হইব।'

সেই অবোধ সময়ে সোলজারের কথাগুলো আমার কাছে কোনো সাত্ত্বিক সাধুর আপ্তবাক্য বলে মনে হয়েছিল।

শার্প শুটার হওয়ার এক অদম্য ইচ্ছায় শুরু হলো নিধনযজ্ঞ। একের পর এক গুলি চালিয়ে নিশানা একসময় নিজের নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। সুউচ্চ বৃক্ষের মগডালে বসে থাকা পাখিকে এক গুলিতে মাটিতে নামিয়ে আনা তখন কোনো ব্যাপারই না।

এয়ারগান নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় আমার মাথায় অন্য চিন্তা খেলে গেল, বড় প্রাণী শিকারের চেষ্টা করলে কেমন হয়। আমার আশপাশের এলাকায় তখন বড় প্রাণী বলতে শেয়াল, খাটাশ, সজারু আর বনবিড়ালের বাস। বিভিন্ন স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝোপের ভিতর ওত পেতে বসে রইলাম। একে একে প্রত্যেকেই শর্ট রেঞ্জ থেকে মাথায় গুলি খেল। কেউ কিছুটা আগে মরল, কেউ পরে। তখনই আমি বুঝলাম এয়ারগান কতটা মারণঘাতী অস্ত্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর আঘাত ক্ষমতা বন্দুক কিংবা রাইফেলের চাইতে কোনো অংশে কম নয়।

পরবর্তী জীবনে বন্দুকের চাইতে এয়ারগান আমার কাছে বেশি প্রিয় হয়ে উঠল। তখন পঁচিশ রাউন্ড কার্তুজের প্যাকেট পাওয়া যেত আটাশ টাকায় আর দুইশ পিস এয়ারগানের গুলি মিলত মাত্র পঞ্চাশ টাকায়। তাই বিশেষ সুবিধায় এয়ারগান হয়ে উঠল নিত্যসঙ্গী। 

তখন নিয়মিত একটি শটগান আর দুটি এয়ারগান ব্যবহার করে চলেছি। একসময় পুরোনো এয়ারগানটি বিক্রি করে দেয়ার কথা মাথায় আসে। আমাদের বাড়ির পাশের এক যুবকের শিকারি হওয়ার বড় শখ, সে মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে শিকারে যায়। নাম তার ইউনুস; ভীষণ রোমাঞ্চপ্রিয়। সে আমার কাছ থেকে পুরোনো এয়ারগান কিনে নেয়।

মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর ঢাকায় চলে গেলাম কিছুদিনের জন্য। এদিকে ইউনুস পুরোদস্তুর শিকারি হওয়ার আশায় মাঠে নেমে পড়ল। তার প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিল আমার বহু দিনের পুরোনো শিকারসঙ্গী জাকির। এই সাহসী যুবকের কথা বেশ কিছু শিকার কাহিনিতে উল্লেখ রয়েছে। আমি নিজ হাতে ট্রেনিং দিয়ে তাকে গড়ে তুলেছিলাম।

এখানে কিছু কথা না বললেই নয়। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, 'Put your gun as you put your wife.' এটা আমি সবসময় মেনে চললেও পুরোনো এয়ারগানটি বিক্রির মাধ্যমে এর ব্যত্যয় ঘটেছিল। পুরোনো হলেও পারতপক্ষে নিজের অস্ত্র হাতছাড়া করতে নেই। 

আরও একটি বহুল প্রচলিত বিখ্যাত বাক্য, 'Man behind the gun.' অস্ত্র নয়, আসল ক্ষমতা থাকে অস্ত্রের পেছনের মানুষটির কাছে। বরাবরই ঠান্ডা মাথায় নিজের অস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছি।

আমি জন্ম শিকারি। এটা ভালো করেই জানা ছিল, শিকার যাত্রায় অস্ত্র কখনও হাতছাড়া করতে নেই। কিন্তু ইউনুস তা পারল না। সে দল বেঁধে শিকারে যাওয়া শুরু করল, এয়ারগানটা একেক সময় একেক জনের হাতে থাকত। 

সেদিন তিনজনে মিলে শিকারে বেরিয়েছিল। জাকির, ইউনুস আর সালামত। একটা সাধারণ হিসেব হচ্ছে, একেবারে অন্তিম মুহূর্ত ছাড়া অস্ত্র লোড করতে নেই অথবা হাঁটার সময় লোড করা অস্ত্রের ব্যারেল মাটির দিকে তাক করে রাখতে হয়; হোক সেটা আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা এয়ারগান।

লোডেড এয়ারগানটা তখন সালামতের হাতে। তিনজন হেঁটে চলছিল গ্রামের মেঠোপথ ধরে। তখন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আট-দশ বছর বয়সি একটা মেয়ে। ওদের দেখে মেয়েটা ভয় পেয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।

বিষয়টাতে সালামত বেশ মজা পেল। মেয়েটাকে আরও ভয় দেখানোর জন্য সে তার দিকে এয়ারগান তাক করে বলে উঠল, 'তরে গুল্লি কইরা দিমু।'

ছোট্ট মেয়েটা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দৌড় দেয়ার সাথে সাথে সালামতের অনভিজ্ঞ আঙুল তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল। মুহূর্তের মধ্যে এয়ারগানের নল থেকে ছুটে যাওয়া ৫.৫ ক্যালিবারের তীব্র গতির সিসার টুকরো মেয়েটির পিঠ ভেদ করে ঢুকে পড়ল। সাথে সাথে সে মাটিতে পড়ে গেল। তবে ওরা পালিয়ে না গিয়ে মেয়েটির কাছে গেল। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাচ্ছিল নিষ্পাপ শিশুটি।

ওরা ধরে নিল মেয়েটি মারা যাচ্ছে, বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল তিনজনে। আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসে ওদেরকে আটক করে ফেলল।

আহত মেয়েটিকে প্রথমে পাঠানো হলো থানা সদরে, তারপর নরসিংদী সদর হাসপাতালে। তখন তার নাকমুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। সেখানেও ডাক্তাররা তাকে রাখতে সাহস পেল না। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলো। সেখানে এক্স-রে করার পর দেখা গেল গুলিটি ডান ফুসফুসের গভীরে আটকে আছে।

দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন ল্যান্ডফোনে জাকিরের মাধ্যমে খবরটা জানতে পারি। সে আরও জানায়, ঘটনার জন্য এলাকার লোকজন আমাকে দোষারোপ করছে। কারণ তখন আমিই এলাকার একমাত্র বন্দুকবাজ, অস্ত্র আর শিকারের জগতটা একান্তই আমার দখলে। সবার ধারণা আমি ঢাকা যাওয়ার আগে এয়ারগানটা ইউনুসকে দিয়ে গেছি শিকার করার জন্য।

এরপর সে যে কী নিদারুণ অবস্থা, একদিকে পরীক্ষার চাপ অন্যদিকে আহত মেয়েটির জন্য দুশ্চিন্তা।

এই দুর্ঘটনায় আমার সারা জীবনের অর্জন ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। কত সাবধানে সারাটা জীবন অস্ত্র চালিয়েছি, অথচ আজ কী নিদারুণ অপবাদ এসে পড়ল ঘাড়ে!

সেই দুর্বলতম সময়ে রাজ্যের দুশ্চিন্তা এসে ঘিরে ধরল আমায়। কেন ঘটল এই ঘনা? তবে কি নিরীহ জীবজন্তুর অভিশাপ এসে লেগেছে? শঙ্কিত মন কত কিছু ভাবে। তবে এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ানো।

খবর নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছুটে গেলাম ঢাকা মেডিকেলে। অবস্থা এখনও তেমন একটা ভালো নয়। গুলিটি ফুসফুসের এতটা গভীরে আটকে আছে যে অপারেশন করতে গেলে মেয়েটির জীবন সংশয় দেখা দিতে পারে।

বেশ কিছুদিন তার চিকিৎসা চলল। আশার কথা এই যে অসম্ভব কিছু মেধাবী চিকিৎসকের অসীম প্রচেষ্টায় মেয়েটি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠল। আর দুঃখের কথা হলো, বিশেষ অপবাদ নিয়ে ইতি ঘটল আমার শিকারি জীবনের।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.