ব্যোমকেশ বক্সীর ৪০ বছর আগের বাস্তব গোয়েন্দা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

ইজেল

06 August, 2022, 10:15 pm
Last modified: 07 August, 2022, 10:54 am
কাচের জারে রাসায়নিকে ডোবানো এক নারীর মাথা নিয়ে কলকাতার শহরতলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গোয়েন্দা প্রিয়নাথ।কে এই সুন্দরী নারী? কী পরিচয় তার? কেন খুন হলো, টিনের ট্রাঙ্কে কলকাতার রাস্তায় তাকে মেরে ফেলে রেখে গেল কে বা কারা?

ঠিক রেনেসাঁ ঘটেনি, তবুও ব্যোমকেশ বক্সী ১৯৩৪ সালে প্রথম আবিভূত হয়ে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের একটি শুভ সূচনা করেছিলেন। সাথে আর কজন সমদক্ষ ও সমকৌতূহলী লেখক পেলে ব্যোমকেশ বক্সীর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অপরাধ ও গোয়েন্দা সাহিত্যের কেবল গোড়াপত্তনই নয়, রীতিমতো একটা রেনেসাঁ ঘটিয়ে দিতে পারতেন। তবে তারও ৪০ বছর আগে প্রায়োগিক জ্ঞান দিয়ে বাজার মাত করে দিয়েছিলেন গোয়েন্দা দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৫৫-১৯১৭)।

প্রিয়নাথ পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন বাঁকাউল্লা দারোগার প্রায় তিন দশক পর, চাকরি করেন ৩৩ বছর, অবসর নেন ১৯১১ সালে।  তবে ১৮৮৯ থেকেই 'দারোগার দফতর' নামের ধারাবাহিক রচনায় প্রকৃত ঘটনা লিখতে শুরু করেন। এসব এপিসোডের মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্ধ্যানুসন্ধান। প্রিয়নাথ নিজেই লিখেছেন কাহিনিগুলো তার কর্মকালের, যার কতগুলোর রহস্য তিনি উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন, কতগুলোর রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েছেন। বুদ্ধিজীবীভাবাপন্ন লেখকদের কাছে 'দারোগার দফতর' বটতলার সাহিত্য হিসেবে উপেক্ষিত হলেও এর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল।

ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের আদেশ তাকে প্রতিপালন করতে হয়েছে। পদাধিকার বলে আদেশ দেওয়া সহজ, কিন্তু বাস্তবায়নের গাইডলাইন তাদের অজানা ছিল। প্রিয়নাথ লিখেছেন: আমরা উপনিবেশে রূপান্তরিত জাতি। আদেশ পালন করা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।

প্রিয়নাথের রচনায় উঠে এসেছে তখনকার নানা বাস্তব সমাজচিত্র। তিনি বিচারব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। ১৮৯৪ সালে তার প্রকাশিত 'একটি দীর্ঘ কাটামুন্ডুর কাহিনী' সংক্ষেপে পুনরায় বিবৃত হচ্ছে:

কাহিনী কাটামুন্ডুর, কিন্তু শুরুতেই প্রিয়নাথ দুর্গাপুজার প্রথম দিন থেকে দশমীর বিসর্জন দিন পর্যন্ত উৎসবের বিশেষ করে সপ্তমীর বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন সবই তার চাকরি জীবনের পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। চাকরিতে নাম লেখানোর পর দুর্গাপুজা কেনো যেনোতেনো কোনো পুজাতেই পরিবার নিয়ে উদযাপনের ছুটি পাননি। তার দফতরের কেউই আসলে ছুটি পায় না। এ সময় কাজকর্ম সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যায়।

বহু বছর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার পর বহু কাটখড় পুড়িয়ে এক পাক্ষিকের ছুটি পেয়ে পুরোনো সব দুঃখ ভুলে গেলেন। ছুটি শুরু সপ্তমীর দুদিন আগে পঞ্চমী থেকে। তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। বহুবছর পর বন্ধু ও স্বজনদের নিয়ে উদযাপন করবেন।

কোনোরকম রাতটা পার করে পরদিন বেরোতে যাচ্ছেন এমন সময় ঘরের দরজায় ডাকপিয়ন, হাতে টেলিগ্রাম, তার নামেই। রাগ ও ক্ষোভ দুটো মিলিয়ে টেলিগ্রামটা পড়লো: 'অদ্ভুত পরিস্থিতিতে একটি মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে আপনার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। টেলিগ্রাম পাওয়া মাত্র কলকাতায় চলে আসুন। গোয়েন্দা বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নামে পাঠানো টেলিগ্রাম, 'আমি যে পদত্যাগ করবো তারও উপায় নেই। আমার পরিবার তাহলে উপবাসে মৃত্যুবরণ করবে।' স্বগতোক্তি প্রিয়নাথের।

নিরুপায় প্রিয়নাথ কলকাতা হাজির হলেন। বড় কর্তা বললেন, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর। তোমাকেই রহস্য উদঘাটন করতে হবে। সফল হলে পনের দিন কেনো পুরো মাসের ছুটিই পাবে।

প্রিয়নাথ জানেন, এ হচ্ছে কথার কথা। ছুটি তার ভাগ্যে নেই।

তার কাজ শুরু হয়ে গেল। থানায় গিয়ে একটি বাক্স দেখতে পেলেন। গার্ড বলল, গতরাতে যখন এলাকা পাহারা দিচ্ছিলাম বাক্সটা চোখে পড়ে। ভোর চারটা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও কেউ এটা নিতে আসেনি। সে সময় আমাদের একজন বড়কর্তা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন, তার পরামর্শ চাইলে তিনি এটা সবচেয়ে কাছের থানাতে জমা দিতে বললেন। কাজেই কুলি ডেকে এটা থানায় নিয়ে আসি। প্রিয়নাথ এবার থানার একজন অফিসারকে বললেন, এটা কি তখন ঠিকঠাকভাবে থানা গ্রহণ করেছে?

অফিসারের জবাব:  থানার বড় কর্তা বললেন, আগে বাক্স খুলে ভেতরের জিনিসপত্রের তালিকা করো, সাক্ষীদের সই নেও, পরে যেন কেউ বলতে না পারে ভেতরে আরো অনেক সোনাদানা ছিল। অনেক চেষ্টা করেও বাক্সটা খোলা যাচ্ছিল না। পরে কামার ডেকে আনতে হয়। অনেক চেষ্টার পর ডালা খুলে কামার চিৎকার দিয়ে উঠে। এগিয়ে আমি দেখি ভেতরে বাধা, ঠেলে ঠুলে ঢুকানো এক নারীদেহ। তারপর তো জমা দেবার প্রশ্নই আসে না।

তারপর পোস্ট মর্টেমের জন্য মর্গে পাঠানো হলো। ডোমের সাহায্য নিয়ে ডাক্তার টেনে দেহটা বের করলেন। পুরো দড়ি দিয়ে বাধা। উপর থেকে মনে হয়েছে এটা মস্তকশূন্য দেহ। কিন্তু দড়ি আলগা হবার পর নোয়ানো মাথাটা দেখা গেল। ডাক্তার বললেন, গলায় পেচানো দড়িতে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে। চিফ পুলিশ অফিসার বললেন লাশ সনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত মাথাটা সংরক্ষণ করতে হবে। অমনি ডোম মাথাটা এক কোপে ধর থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি কাচের কনটেইনারে ঢুকায় এবং ডাক্তার এটি সংরক্ষণ করার তরল ঢেলে কনটেইনার সিলগালা করে দেন।

যে দড়িটা ব্যবহার করা হয়েছে তা সাধারণ দড়ি নয়। কাধের দুপাশে বহন করা সিকায় ভারী জিনিস ঝোলাবার জন্য যে বিশেষ দড়ি ব্যবহার করা হয় এটা সে ধরনের। এ ধরনের দড়ি জোড়ায় বিক্রি হয়, দুপাশের জন্য।

তদন্তের জন্য বাক্স দড়ি ইত্যাদি প্রিয়নাথের কাছে হস্তান্তর করা হলো। প্রশ্ন করে জানলেন, দেহটি সম্পূর্ণ নগ্ন ছিল, কোনো অলংকার এমনকি তামার চুড়িও ছিল না, হিন্দু না মুসলমান বোঝার উপায় নেই, মাথায় সিঁদুরের চিহ্নও দেখা যায়নি। তবে শরীরের আকার দেখে মনে হয়েছে বাঙ্গালি, হয়তো হিন্দুও হতে পারে।

সকলেই সপ্তমী উদযাপনে ব্যস্ত, মর্গে এ সময়ে কী অনাচার, বিরক্ত সবাই। ডাক্তারকে নিয়ে কাচের সিলকরা পাত্রে রাখা মুন্ডুটা দেখতে এলেন প্রিয়নাথ। তার মনে হলো এটা সুন্দরী কোনো বাঙ্গালি তরুণীরই। তদন্তের এক পর্যায়ে একজন কুলির সাক্ষাৎ পেলেন।

কুলির ভাষ্য: রাত দুটোর মাল টানার জন্য যখন জাহাজঘাটের দিকে যাচ্ছিলাম দেখি ঘোড়ার গাড়ি থেকে একটি বড় বাক্স নামানোর চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না, কাজটা করছে একজনই। গাড়োয়ানকে ঘোড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে হচ্ছে তার পক্ষে নামা সম্ভব হচ্ছে না। লোকটি এই কুলিকে ডাকলো, দুজনে মিলে নামালো। ঘোড়ার গাড়ি উল্টোদিকে চলে গেল। লোকটি গঙ্গার দিকে। কুলি জানায়, লোকটিকে দেখলে চিনতে পারবে।

এবার টার্গেট ঘোড়ার গাড়ি। শহর চষে সনাক্ত করা গেল না, শহরের বাইরে কাশীপুর গোয়ালে গিয়ে পাওয়া গেল গাড়ি। কুলি যে কথা বলেছে গাড়ির গাড়োয়ানও অবলীলায় তাই বলল তবে বাক্সটি কোনো বাড়ি থেকে আনেনি, যে লোকটি সাথে এসেছে সেই গাড়ি ঠিক করে কাশীপুরের কাছাকাছি রাস্তা থেকে বাক্সটা গাড়িতে তোলে, সেখানে বাক্স নিয়ে একজন দাঁড়িয়েছিল। তাদের কথা থেকে কুলি জানতে পারে অপেক্ষমান লোকটি কলকাতা যাবে।

পরের পদক্ষেপ: বাক্সটা রাস্তা পর্যন্ত কেমন করে এলো। এদিকে সপ্তমীর রাতটা কাটলো কাচের বাক্সে রাখা মুন্ডুটা আশেপাশের মানুষকে দেখিয়ে যদি কেউ চিনতে পারে তাহলে মামলাটা সহজ হয়ে আসবে।

অষ্টমীর দিন সকালে একজন বলল, দেখে তো মনে হচ্ছে কাশীপুরের গোপাল বিশ্বাসের মেয়ে।

তারপর গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি। তাকে আনা হলো, মন্ডু দেখে তিনি বললেন, স্যার এ তো আমারই মেয়ে। মেয়ে আর জামাতার মধ্যে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছিল। তবুও অনেকদিন বাবার বাড়িতে থাকার পর জামাই যখন নিতে এলো গোপালই মেয়েকে যেতে অনেকটা চাপ দিলেন। কদিন আগে তারা চলে যায় কিন্তু এখন পর্যন্ত মেয়ে পৌঁছেছে কিনা সে খবরও পাননি। বিয়ের সময় মেয়েকে তিনি ৫০০ টাকার বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার দিয়েছেন।

গোপাল বিশ্বাসকে নিয়ে প্রিয়নাথ যখন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছেন, শুনলেন তারা আসেনি। কোথায় আছে তাও জানা নেই। প্রিয়নাথ বাড়ি তল্লাসি করতে গিয়ে ঘরের ভেতর স্বাভাবিকের চেয়ে একটু উঁচু মাটির মেঝে দেখে সন্দিহান হন, মাটি খোঁড়া হলো। মাটি খুঁড়ে পিতলের একটি পাত্র পাওয়া গেল, তার ভেতরে অলঙ্কার, গোপালের অলঙ্কারের বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে গেছে, প্রিয়নাথের কাছে মামলা ততক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: হত্যাকান্ড এই জামাই করেছে।

পরদিন সকালে গোপাল বাবুকে নিয়ে যখন কলকাতা রেলস্টেশনে নামলেন প্রিয়নাথ, হঠাৎ গোপালবাবু তার কাছে ফিসফিস করে বললেন, ঐ দেখুন, ওখানে ওই লোকটাই আমার মেয়ের জামাই। অর্থাৎ খুনির দেখা মিলল।

যাকে গোপালবাবু দেখালেন গোয়েন্দা দারোগা প্রিয়নাথ আর দেরি করলেন না। আকস্মিক আক্রমনে তাকে ধরাশায়ী করে বললেন, 'তোমাকে গ্রেফতার করা হলো, তুমি খুনের আসামী।'

'খুন! আমি! নিশ্চয়ই কিছু ভুল করেছেন।'

'সময় নষ্ট করা যাবে না, তোমাকে যেতে হবে।'

আসামী বলল, আমার উপায় নেই। আমার সাথে একজন মহিলা আছে, আগে তাকে নিরাপদে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন।'

'সে কে?'

'আমার স্ত্রী।'

আড়াল থেকে গোপালবাবু শুনে সামনে এসে বললেন, 'তোর কটা স্ত্রী? আমার মেয়েকে খুন করেছিস। এটা কে?'

'আমার একটাই স্ত্রী। কেনো আপনি কি নিজের মেয়েকে চেনেন না?' 

লোকটা ডাকতেই এক তরুণী কাছে এলো, গোপালবাবু চিৎকার করে উঠলেন, 'আরে! আমার মেয়ে খুন হয়নি, বেঁচে আছে।

গোয়েন্দা দারোগা জামাইকে ছেড়ে দিলেন এবং খুব বিব্রত হয়ে সেই বাড়ি থেকে তুলে আনা অলঙ্কারও তার কাছে হস্তান্তর করে মাথা নিচু করে রইলেন। মেয়ে ও জামাইকে নিয়ে গোপালবাবু ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে কাশিপুর রওয়ানা হলেন।

ভীষণ লজ্জিত গোয়েন্দা দারোগা থানায় এসে শুনলেন গনেশ নামে একজন দাবি করছে, নিহত নারী তার স্ত্রী। মাস খানেক আগে ষড়যন্ত্র করে তার স্ত্রী একজনের সাথে পালিয়ে গেছে। গনেশও চায় পুলিশ তার স্ত্রীর হত্যাকারীকে ধরুক। গনেশের সন্দেহ অনুযায়ী তার স্ত্রীর সম্ভাব্য হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হলো। খুনের কথা শুনে তারাই ঘাবড়ে গেল এবং গনেশের স্ত্রীকে অপহরনের কথা স্বীকার করল, কিন্তু খুন করেনি, আর এটা ঠিক অপহরণও নয়, স্বেচ্ছায় সে এসেছে এবং কোথায় আছে তাও জানিয়ে দিল। গনেশের স্ত্রী উদ্ধার হলো। ভুল সনাক্ত করার জন্য দারোগার বকাঝকা শুনে বলল, কেবল মুন্ডু দেখে তার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, মনে হয়েছিল এটাই তার স্ত্রী।

খুনের কোনো সুরাহা হলো না। 

নবমীর দিন অপরাহ্নে থানার প্রায় সকলেই ছুটিতে চলে গেল, কাল প্রতিমা বিসর্জন। গোয়েন্দা দারোগা আবার বাক্সটা পরীক্ষা করতে বসে গেলেন। এটা ঝকঝকে মনে হলেও খুটিয়ে দেখে বুঝলেন আসলে পুরোনো, সদ্য রং করা হয়েছে। চোখে লেন্স লাগিয়ে বাক্সের রঙের আড়ালে অস্পষ্ট একটি শব্দ বের করলেন, নিমতা। খুঁজে বের করলেন কাশীপুরের কাছেই ছোট গ্রাম নিমতা। ট্রাঙ্ক কি সেখান থেকে এসেছে? তিনি সেখানে পৌঁছলেন। চার পাঁচ ঘর ব্রাহ্মণ, অন্যরা ভিন্ন গোত্রের। তেমন কিছু তার চোখে পড়ল না, কেবল রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পুরোনো মাটির হাড়ি পাতিল তার মনে কৌতুহল জাগালো। দুর্গা পুজার সময় হিন্দুদের পুরোনো তৈজসপত্র প্রত্যাখ্যান করার কথা থাকলেও দারোগা তার জীবনে কখনো কোনো হিন্দুকে তা করতে দেখেননি। তবে কোনো ঘরে অস্বাভাবিক ঘটনা, মৃত্যু ইত্যাদি ঘটলেও অশুভ বিসর্জন দিতে পুরোনো জিনিস ফেলে দেবার নজির আছে। কজনকে জিজ্ঞেস করে জানলেন গোরাচাঁদ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে এগুলো ফেলা হয়েছে। তিনি সে বাড়িতে গিয়ে সরাসরি গোড়াচাঁদকে বললেন, আমি পুলিশ অফিসার! আমি কোন অপরাধের তদন্ত করতে এসেছি আশা করি তা বুঝতে পেরেছ?

হাঁড়ি-পাতিল ফেলে দেবার ব্যাপারটাও গোড়াচাঁদ অস্বীকার করল। যখন তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল অপর দুই ভাই এগিয়ে এলো, তাদেরও খুব উদ্বিগ্ন মনে হলো।

গোয়েন্দা দারোগা সঙ্গে আসা পুলিশকে ইঙ্গিত দিলেন দ্রুত থানায় গিয়ে আরো লোকবল নিয়ে চলে আসার জন্য।

এর মধ্যেই দারোগা আরো জানলেন, গোড়াচাঁদের অকাল প্রয়াত এক ভাইয়ের স্ত্রীও এ বাড়িতে থাকে, তবে তার চরিত্র নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। চৌকিদারকে বললেন, সেই বিধবা ভাতৃবধুকে নিয়ে এসো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুজি করে চৌকিদার এসে বলল, চারপাঁচদিন আগে তাকে শেষ দেখা গেছে। এখন কোথায় কেউ জানে না।

তিনি নিশ্চিত গোড়াচাঁদ ও তার ভাইয়েরা এই নারীকে হত্যা করেছে তবুও গোপালবাবু তাকে যে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে তিনি তার পুনরাবৃত্তি চান না।

আরো আটজন পুলিশ আসার পর তিনি সাহসী হয়ে উঠলেন, গোড়াচাঁদের বাড়িটা ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিলেন যেন কেউ পালাতে না পারে।

গোড়াচাঁদকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্রাহ্মণ তোমরা তো চার ভাই, আর একজন কোথায়?

সবচেয়ে ছোটজন অনেক আগে মারা গেছে।

তার স্ত্রীর তো স্বামীর বাড়িতেই থাকার কথা, এখন সে কোথায়?

এই প্রশ্নেই ভাইদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে উঠল। অপর ভাই রূপচাঁদ বলল, আমাদের সাথেই ছিল, চারপাঁচদিন আগে বাপের বাড়ি গেছে। তিনি ঘর তল্লাশির সিদ্ধান্ত নিলেন। তার লক্ষ্য একটি জিনিস-সিকার অপর দড়ি। একটি ব্যবহার করা হয়েছে হত্যাকান্ডে, অপরটি কোথায়?

ঘরের ভেতর চিরুনি অভিযানে তা মিলে গেল। তিন ভাইকেই গৃহবন্দী করলেন। দ্রুত থানায় খবর দেয়া হলো। আলামত ও কয়েকজন মানুষ এসে হাজির। বাড়ির কাজের মেয়ে দুজন জানালো ট্রাঙ্কটা এ বাড়িতেই তারা দেখেছে। তবে খুনোখুনির কোনো বিষয় তারা দেখেনি।

কুলি এসে রূপচাঁদকে সনাক্ত করল।

তিন ভাইকে আসামী করে মামলা রুজু হলো। খুনের মামলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে সেশন কোর্টে পাঠানো হলো। 

প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় আফসোস করলেন বিচার বিভাগের খামখেয়ালি নিয়ে। ভ্রাতৃবধূকে খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিন ভাইয়ের মধ্যে গোড়াচাঁদ অব্যহতি পেল, কেবলচাঁদ মৃতদেহ লুকানোর জন্য ২ বছরের কারাদন্ড পেল আর তাকে সহায়তার জন্য রূপচাঁদের ১ বছরের কারাদন্ড হলো। 

দারোগা গোয়েন্দা প্রিয়নাথ মনে করেন, হতভাগ্য নারী সুবিচার পায়নি; ঈশ্বরই বিষয়টি দেখবেন।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.