একটা সাধারণ ডায়েরি

ইজেল

05 July, 2022, 09:40 pm
Last modified: 05 July, 2022, 09:39 pm
ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে যাঁদের হাঁসফাঁস লাগে, তাঁদের অবশ্যই অতি সম্প্রতি গাজীপুরের চৌরাস্তা বা আশপাশের রাস্তাগুলোতে ঘোরাঘুরি করা উচিত। পুরাই একটা মিক্সড ভেজিটেবলের ঘ্যাঁট। এমন এক ঘ্যাঁট যার থেকে আদি সবজি আর উদ্ধার সম্ভব নয়। তার সাথে খোঁড়াখুঁড়ি আর ভাঙাভাঙি মিলে চৌরাস্তার দিবাভাগের চেহারা সাধারণ মনুষ্যচোখে সহ্য করা কঠিন। তার মধ্যেই মোড়ে দীর্ঘ উরুর ওই ভাস্কর্যটা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ঢাকা বা বাংলাদেশের মোটের ওপর কুৎসিত ভাস্কর্যচর্চার মধ্যে এই ভাস্কর্যটা আমার বরাবরই ভালো লাগে। যদিও গড়ে বাংলাদেশে ‘দ্রোহের’ যে দৃশ্যরূপ মুঠো করে হা করে চেঁচাতে থাকা ধরনের—এই ভাস্কর্যটা তার গুরুতর লঙ্ঘন। এত বছর আমার যতই ভালো লাগুক, এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে ভাস্কর্যটিকে অসহায় দেখাচ্ছিল। এই ভয়ানক চেহারার মোড়টির থেকে বরং ১৫ তারিখের রাত্রিবেলা ফোন ছিনতাই সহজ অনুভূতি মনে হলো। 

ব্রাদার-ইন-ল তুষারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম শ্যামলী থেকে রওনা হয়ে গাজীপুর যাবার জন্য অতি সকালে কোন পথ ধরব—গাবতলী হয়ে বেড়িবাঁধ ধরে টঙ্গী ইত্যাদি নাকি আগারগাঁও হয়ে মহাখালী হয়ে ইত্যাদি? নাহ্, ব্রাদার-ইন-ল ভালো শোনাচ্ছে না, ভায়রাভাই-ই ভালো। তো, তুষারকে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বানানোর কারণ হলো, ও থাকে আব্দুল্লাহপুর আর সপ্তাহে বা দুই সপ্তাহে আমাদের এদিকে আসে। ওর থেকে বড় নিকটবর্তী এলাকার কোনো ভ্রমণকারীকে আমি মনে করতে পারিনি। তুষার দুই মিনিটের মধ্যে সাইবার কল করে বসল। আমার প্রস্তাবিত দুই রাস্তার বিষয়ে আলাপ না করে ওর এক কলিগের ফোন নম্বর পাঠিয়ে তাঁদের অফিসের গাড়িতে সরাসরি গাজীপুর নামতে সুপারিশ করে দিল। অবশ্য পারিবারিক বিষয়-আশয়ে তুষার মোটামুটি এ রকমই। একটা কোনো সুরাহা করেই ছাড়বে। আমি নিজে বের হলে সাড়ে ৬-এর মধ্যেই একটা বাসে ওঠার সংকল্প নিয়ে থেকেছিলাম। তুষারের আন্তরিক কলিগ আমাকে তুললেন ৭টার কিছু পরে শ্যামলী থেকে।

আমাকে যিনি সমাদর করে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর সাথে প্রথম দেখা, ভায়া ভায়রাভাই। কোনো প্রশ্নই করার কথা নয়। তা-ও গাড়িতে উঠতে না উঠতেই না-জিজ্ঞাসা করে থাকতে পারলাম না। 'আমাদের মনে হয় সাড়ে ৯টা বাজবে।' তিনি আশ্বস্ত করলেন যে আমরা তার আগেই পৌঁছে যাব। আমি মনে মনে হিসাব করলাম। ১০টা নাগাদ থানা থেকে বের হয়ে ভুসভুস করে ১২টার মধ্যেই জাহাঙ্গীরনগরে পৌঁছে গিয়ে ক্লাস নেব। এই দুরূহ হিসাব না করলেও আমার চাকরি থাকত। কিন্তু এগুলাই বোধ হয় বাতিক। আমি আমার গাড়ির অধিকারীকে যদিও বলেছি যে আমার গাজীপুর চৌরাস্তা গেলেই চলবে, তিনি আতিথেয়তার কিছুমাত্র কম করলেন না। বস্তুত আমার জন্যই ভিন্ন রাস্তাও নিলেন টঙ্গী বাসস্টপের পর থেকেই। ঢাকা ও সন্নিকটের রাস্তাগুলো কোথার থেকে কোথায় যায় তা নিয়ে আমার খুব পাকা থাকতে ইচ্ছা করে। তাই আগেই ভেবেছিলাম যে একদম মাথাটাকে একদম সজাগ রাখব। কোথা থেকে কী রাস্তায় কোন দিকে যাচ্ছি একদম মুখস্ত করে ফেলব! কিন্তু টঙ্গী বাসস্ট্যান্ডের পর ডান দিকে তাঁদের গাড়িখানা সবুজ গাছগাছালি আর ঘাসের মধ্যে ঢুকে গেলে আমি একদম আর সজাগ থাকতে পারলাম না। এসব জায়গা চোখের জন্য অতি মনোরম আমি জানতাম। কিন্তু চোখের সামনেই সবুজ নরম দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে রাস্তার ম্যাপসতর্কতা আমার লুপ্ত হয়েছে। 

আমাকে একদম গাজীপুর পুলিশ দপ্তরের সামনে তাঁরা নামালেন। আমার গুগল অনুসন্ধানে এই থানা আমার সামনে হাজির হয়েছিল। কিন্তু থানা-পুলিশ বিদ্যার অভাবের মধ্যেও আমার আশঙ্কা হচ্ছিল যে এটাতে ডায়েরি হবে না। তবে নামার আগে আমার অতিথিপরায়ণ গাড়ির অধিকারীদের সেই অনুভূতি আমি বুঝতে দিলাম না। আমি চাইলাম, আমাকে সাহায্য করে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবার পুরো আনন্দসমেতই তাঁরা নিজ কাজে যান। সে জন্য তাঁদের চলন্ত গাড়ির দিকে পর্যাপ্ত হাত নেড়ে আমি মুখ ফিরিয়ে রাস্তার পাশের এই 'গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স' ভবনের দিকে যেতে থাকি। সিঁড়ির আগেই দেখতে পেলাম কয়েক সিঁড়ি ওপরে ভবনের প্রথম স্পেসটাতে একটা অভ্যর্থনা ডেস্ককে ঘিরে চারজন কর্তব্যরত পুলিশ রয়েছেন—একজন নারী ডেস্কধারী, অন্য তিনজন দাঁড়ানো। তাঁদের চোখ আমার দিকে নিপতিত হলে আমি সিঁড়ির দিকে চোখ নামাই। সিঁড়ি কয়েকটার আগে কাঠের একটা ফ্রেমের মধ্যে চট ভাঁজ করে রাখা দেখতে পেলাম। খুব ঠান্ডা মাথায় না ভাবলে এটাকে পাপোশের পরিবর্তে একটা মৃদু আর্ট-ইন্সটলেশনই মনে হবে। বিশেষত কাঠের ফ্রেমটার দৃঢ় ভঙ্গি আর চটের পরিচ্ছন্নতা ভাবলে। কিন্তু আমি মাটির দিকে চোখ রেখে নিবিড় মনোযোগ দিয়ে সেই চটের উপর দাঁড়িয়ে দুই জুতার তলা ঘষলাম। বেশ দর্শনীয় রকমের স্পষ্ট করে। আমার ওপর নিপতিত চোখগুলো তখন অনুভব করতে পারছি। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আবার আমি চোখ তুলি। এ দফা চারজনের জন্য একটা কমন সালামও দিই। ওঁরা চারজন যেভাবে অভিবাদন জানালেন, এ রকম উষ্ণ অভ্যর্থনা আমি কোনো বিয়েবাড়িতেও পাইনি। তবে এ কথা ঠিকই যে বিয়েবাড়িতে গাদা গাদা লোক থাকেন। আর সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ এই হেডকোয়ার্টার্সে আমি ছাড়া বাইরের কেউ আসেননি। অত্যন্ত কোমল আচরণে আমাকে তাঁরা জানালেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে ডায়েরি করা হয় না। এবং মনোযোগ দিয়ে আমাকে রাস্তার নির্দেশনাও বুঝিয়ে দিলেন যে আমার কোথায় যেতে হবে। আমি যেহেতু বেশ মিনিটখানেক আগেই এটা জানতাম, আরামের সাথে তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে, রাস্তা পার হয়ে একটা শরিকি ব্যাটারি গাড়িতে উঠলাম। এবার আর ওই আর্ট-ইন্সটলমেন্টটার সাথে কোনো যোগাযোগ করিনি। 

ইজিবাইকটাতে আমার জায়গা হয়েছে ড্রাইভারের ডান দিকে। আমার নাজুক বাম হাঁটু কয়েকবার বাড়ি খেল। এসব পরিস্থিতিতে এসব যে বাড়ে, তা তো সকলেই জানেন। ড্রাইভার সাহেবের পায়ের যন্ত্রচালনাতে আমার জুতা কয়েকবার মাড়ানোও হলো। যদিও জুতা পরে থাকার কারণে আমারই তখন বিব্রত লাগছিল, কিন্তু আমাদের কোমলমনা কুড়ি-বাইশ বছরের আচকান পরিহিত ড্রাইভার প্রতিবারই অতিশয় বিব্রত হচ্ছিলেন। একটা কারণ হতে পারে, আমি যখন গাড়িতে উঠবার আগে 'সদর থানা' যেতে চাইলাম, তখন তিনি 'চিনি না' বলে বসেছিলেন। পিছনের যাত্রীদের একজন তাঁকে দুই শব্দে কিছু একটা ক্লু দেবার পরই তিনি বিব্রত হয়ে আমাকে তোলেন। দেখা গেল, গাড়ি কোনো একটা ট্রেন-সংকেতের রাস্তায় আটকে পড়লে, আমি একাই তাঁর যাত্রী আছি। ততক্ষণে হাঁটু বাঁচাতে খালি ইজি বাইকের পিছনে গিয়ে বসেছি। ট্রাফিকে তিনি বিনীত পরামর্শ দিলেন। বললেন যে হাঁটলেই বরং আমার সময় বাঁচবে। ততক্ষণে মাথাতে রাস্তার রাডার বানানোর ইচ্ছা গত হয়েছে। বাস্তবে জাহাঙ্গীরনগরে আবার যেতে পারার পরিকল্পনাটা ফিকে হতে শুরু করেছে। ফলে তাঁর গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে থানার হদিশ নেবার আগে আমার চোখে হোটেল-রেস্টুরেেন্টর বিজ্ঞাপনগুলো পড়ল। জাগতিক দুনিয়ায় এসব প্রথম চোখে পড়াকে আমি প্রায় ঐশীসংকেত বলেই মানি। ফলে আমি কয়েক কদম পিছিয়ে বরং হোটেলে ঢুকে ছোলার ডাল আর রুটি নিয়ে বসলাম। এতে ছোলা-রুটি খাবার সুবিধা ছাড়াও আরেকটা সুবিধা হলো থানার সঠিক হদিশটা পাবার জন্য আমি সঠিক স্থানীয় লোকের সাথে পেশাগতভাবে আলাপ করতে পারলাম। এই হোটেলের খাবার সরবরাহকারী ওয়েটার। এমনিতে ৪০ বা আশপাশের বয়সের ওয়েটার তামাম দেশেই কম বোধ হয়। ইনি দৃঢ় হাসিমুখ ব্যক্তিত্বের একজন ও রকম হবেন। আমাকে ঠিকানা বুঝিয়ে দিলে, আমি আরাম করে চা খেয়ে বেরোই। তখনও সাড়ে ১০-এ থানার কাজ শেষ করার কথা ভাবছি। টিপটিপ বৃষ্টি হবে হবে ভাব। মিনিট তিন-চারেক হাঁটা পথে থানা। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর অপসৃয়মান হতে শুরু করাতে শান্তি বেশি হতে শুরু করল। 

থানার প্রধান ফটকে অনুমতি বা দিকনির্দেশনা নিলাম এক নারী পুলিশ থেকে। ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো, আমার স্বহস্তলিখিত দরখাস্ত বা ডায়েরিটাতে মেরামতি লাগবে। অন্তত একজন কর্তব্যরত পুলিশকে আমি ভুল থানার নামে দরখাস্ত দিতে চাই না। আবার আদ্যোপান্ত এই বস্তুটা আবার লেখার কথা ভাবতেই গা শিরশির করতে লাগল। বাস্তবে গুগলের কাছে যখন জানতে চাইলাম, তখন গাজীপুর চৌরাস্তার নিকটবর্তী থানা হিসেবে গুগল জয়দেবপুর থানার নাম সুপারিশ করেছে। ওদিকে আদাবর থানাতে যখন গেছিলাম, যে এলাকাতে আমি থাকি, ১৫ জুন সকালে, সেখানকার কর্তব্যরতও এই নামটি বললেন বলে আমার মনে পড়ে। ফলে আমার দরখাস্তে লেখা 'ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জয়দেবপুর থানা, গাজীপুর।' হেডকোয়ার্টার্সে ডায়েরি করা গেলেও আমার কাটাকুটি করা লাগত। ফলে গাজীপুর সদর থানাতে অপেক্ষমাণ সময়টাতে আমি ব্যাগ থেকে বুদ্ধি-করে-বয়ে-আনা একই কলম বের করে কেটে আবার লিখি: 'গাজীপুর সদর থানা।' আদাবর থানাতে ডায়েরি করতে না চাইবার সময় আমি হতাশ বা খুশি বা কিছুই হইনি। এমনকি এটাও বলিনি 'বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে আমি' ইত্যাদি। এ দফা কর্তব্যরতা ডিউটি অফিসার বললেন 'চৌরাস্তায় ফোন হারালে এখানে হবে না; ওটা বাসন থানায় পড়েছে, বাসন থানায় যান।' তখনো আমি বেড়ালমুখে বের হবার উপক্রম হয়েছি। আসলে আজ সকালে আমি তীর্থযাত্রার সংকল্প নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু পাশে বসা অফিসার একটা বার্তা বাড়তি খরচ করলেন; নিরিখ করে চিন্তা করলে ওটা আসলে বাড়তি আদর করেই তিনি বলেছিলেন। তাঁর ভাষ্য ছিল 'আসলে যে থানার অধীনে ঘটেছে সেখানেই করতে হবে।' গত তিন দিনের হতাশাতেই বোধ হয় আমি বলে বসলাম: 'বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে নিশ্চয়ই আমার যেকোনো থানাতেই করতে পারার আইন আছে।' আমার বলার কোমলতাতে আমি নিজেই খানিকটা চমকে গেছিলাম। তিনিও ততধিক কোমল গলায়, বা সম্ভবত উদাস গলায়, বললেন: 'আইনে থাকতে পারে, কিন্তু আমরা নিই না।' আমাদের দুজনের কোমলতার পাল্লাপাল্লিতেই, হতে পারে, ডিউটি অফিসার, কাগজ থেকে মুখ তুলে বাসন থানাতে যাবার উপায়ও বলে দিলেন, আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে। 

বাংলা ভাষাতে 'নিশ্চয়'/'নিশ্চয়ই' একটা দুর্দান্ত অনন্বয়ী অব্যয়। এত রকম প্রয়োজনে ও ভাবে এটা ব্যবহার করা যায় যে নিশ্চিত পরিত্রাণের রাস্তা থাকে নিশ্চয়ইয়ে। এমনিতে অব্যর্থতা বা সার্টেনিটির প্রতিশব্দ বলে আমরা ধারণা করে বসতে পারি, কিন্তু বাস্তবে এর ব্যবহারে উল্টা পরিস্থিতি তৈরি করা যায় বেশি। এই আমার বাক্যটাতেই 'নিশ্চয়ই'-এর প্রয়োগ বরং আমার পরিত্রাণের জন্যই। এখানে এটার অর্থ প্রায় 'সম্ভবত' কিংবা 'আশা রাখি' ধরনের। এই শব্দটা না থাকলেই বরং তাঁরা আমাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন 'কোন আইনে?' আর আমি কিন্তু ভারী বিপদে পড়ে যেতাম। এখানে আমার বাক্যে ডেলিকেটলি 'নিশ্চয়ই'-এর ব্যবহার নিশ্চিত সর্বনাশের সম্ভাবনা থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে। এবং আমার শ্রোতাকুলও 'নিশ্চয়ই'-এর এই অর্থ সম্বন্ধে সম্যক সজাগতা তখন দেখিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে, আপনি বরং অনিশ্চয়তার সিলমোহর দিয়ে দিতে পারবেন 'নিশ্চয়'-এর প্রয়োগে। সারাক্ষণ বাহাদুরি করেন এমন কোনো বন্ধুর কোনো দাবির সামনে দ্বিত 'নিশ্চয়' উচ্চারণ করে এই ফল পেতে পারেন। যা হোক, একটা সমাদরমূলক বিদায়ের পর আমার আরও ভোগান্তি ও সফর হবে জেনেও মাথায় জজবা চলে আসল। এ দফা আমার গাজীপুরের সেই চৌরাস্তা ডিঙিয়ে আরেক দিকে যেতে হবে। একজন কোমল এবং একজন নির্লিপ্তা অফিসার আমাকে বুঝিয়েছেন যে আমার একটা যান ছেড়ে চৌরাস্তা পার হয়ে আরেকটা যান নিতে হবে, বাসন থানায় যেতে। যান বলতে হয় অটো না হয় ইজিবাইক। 

ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে যাঁদের হাঁসফাঁস লাগে, তাঁদের অবশ্যই অতি সম্প্রতি গাজীপুরের চৌরাস্তা বা আশপাশের রাস্তাগুলোতে ঘোরাঘুরি করা উচিত। পুরাই একটা মিক্সড ভেজিটেবলের ঘ্যাঁট। এমন এক ঘ্যাঁট যার থেকে আদি সবজি আর উদ্ধার সম্ভব নয়। তার সাথে খোঁড়াখুঁড়ি আর ভাঙাভাঙি মিলে চৌরাস্তার দিবাভাগের চেহারা সাধারণ মনুষ্যচোখে সহ্য করা কঠিন। তার মধ্যেই মোড়ে দীর্ঘ উরুর ওই ভাস্কর্যটা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ঢাকা বা বাংলাদেশের মোটের ওপর কুৎসিত ভাস্কর্যচর্চার মধ্যে এই ভাস্কর্যটা আমার বরাবরই ভালো লাগে। যদিও গড়ে বাংলাদেশে 'দ্রোহের' যে দৃশ্যরূপ মুঠো করে হা করে চেঁচাতে থাকা ধরনের—এই ভাস্কর্যটা তার গুরুতর লঙ্ঘন। এত বছর আমার যতই ভালো লাগুক, এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে ভাস্কর্যটিকে অসহায় দেখাচ্ছিল। এই ভয়ানক চেহারার মোড়টির থেকে বরং ১৫ তারিখের রাত্রিবেলা ফোন ছিনতাই সহজ অনুভূতি মনে হলো। 

'ছিনতাই' বললাম বটে, তবে আমার দরখাস্তে আমি লিখে এনেছি 'চুরি'। গত কদিনে আমি বুঝতে পারছিলাম ঘটনাটাকে ছিনতাই বলে শ্রোতাদের হতাশার জন্ম দিচ্ছিলাম। হ্যাঁচকা টানে যা নেয়া হয়েছে তা ছিনতাই—এ রকম একটা সোজাসাপটা বোঝাবুঝি থেকে আমি শুরু থেকেই ঘটনাটিকে ছিনতাই মেনে এসেছিলাম। ১৫ জুন রাতে ত্রিশালের জাককানইবি থেকে ফিরবার কালে আমার মোবাইল ফোনটি গাজীপুর/চান্দনা/জয়দেবপুর চৌরাস্তার মোড় থেকে জানালার অতি ছোট ফাঁক করা কাচের জানালা থেকে জনৈক হাত ঢুকিয়ে নিয়ে নেন। হয়তো আধা সেকেন্ডে বা তার কম সময়ে। এমনকি তিনি দৌড় দেবারও দরকার মনে করেন না। আসলেই দৌড় তখন নাটকীয় ও অহেতু ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারত তাঁর জন্য। তিনি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রায় হাঁটতে থাকেন। অবশ্যই আমি তাঁর পিছনে জানালা খুলে লাফ দেবার কথা ভাবিনি। কিন্তু লোকের কল্পনাতে 'ছিনতাইকারী' গুরুতর একটা বিষয় দেখলাম। দৌড়াদৌড়ি, চাকুফাকু না থাকলে এই ক্যাটাগরিতে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হন না সংশ্লিষ্ট 'ছিনতাইকারী'। বিবরণকারী আমি ও ছিনতাইকারী তিনি দুজনেই জনস্বীকৃতির অভাব পাই, আমি লক্ষ করেছি। ফলে দরখাস্তের ভাষাটা আমার একটা সুচিন্তিত সম্পাদনাই মানতে হবে।

বস্তুত সুচিন্তিত ছাড়া এ দফা কিছুই ঘটেনি। কেবল আমার মোবাইল 'চুরি'টা আমার নিজের দ্বারা চিন্তিত ছিল না। এর পরের সবগুলো কাজ সুচিন্তিত। পরদিন সকালে ডায়েরি করতে যাব, সেটাও একদম পাকাপাকি ভেবে নিয়েছিলাম। আমার মোবাইল হারানো নৈমিত্তিক ঘটনা। আমি রাতে এটাও ভাবতে চেষ্টা করলাম যে এতবার মোবাইল হারিয়েও যখন ডায়েরি করিনি, এ দফা বিশেষত্বটা কী। আমার হারানোগুলো ভ্যাবলা ধরনের। চা খেতে খেতে রাস্তার পাশের দোকানের বেঞ্চে ফোন রেখে চলে এসেছি; পরে মনে পড়াতে ফিরে গিয়ে আর পাইনি। পাঞ্জাবির অতিশয় ঢিলা পকেটের ফোন রিকশায় উঠতে গিয়ে হ্যাভারসেকের খোঁচায় পড়ে থাকতে পারে—এই বাস্তবতা মিনিট দশেক পরে আবিষ্কার করেছি। এই ধরনের আরকি। এসবেও ডায়েরি করার বিধান আছে। কিন্তু করা হয়নি। হয়তো এই জীবনে প্রথম একজন জ্যান্ত মানুষ ডিরেক্ট যোগাযোগ করে মোবাইলহীন বানিয়েছেন আমাকে, সেটার প্রভাবে হতে পারে। আবার এই মুহূর্তের বাংলাদেশের বাস্তবতাতে আইনের শাসনের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধও হতে পারে। জেনেছেন এমন কয়েকজনই জিডি করার বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি, অথবা কৌতুক বোধ করেছেন। থানায় যাবার আগেও একটা সুবিধাজনক বিবরণী যাতে দিই, সে রকম পরামর্শ পেয়েছিলাম। আদাবর থানায় যখন এই জিডি নেয়া হলো না, তাঁদের ভাষ্য ছিল: 'ঘটনার আশপাশের থানায় জিডি করতে হবে।' তখনো 'বানিয়ে বানিয়ে' হারিয়ে যাবার জায়গাটা নির্ধারণ করতে পরামর্শ ইনবক্সে দু-চারজন দিয়েছেন। আমি কোনো প্রস্তাবেই সম্মত হতে পারিনি। 

এখানে গুরুতর সব কনসেপচুয়াল এবং মেথডোলজিক্যাল গোলযোগ হয়েছে। আমার এই অসম্মতিকে পরামর্শকেরা ভেবেছেন 'সত্যনিষ্ঠা'। বাস্তবে আমার জন্য ছিল 'মিথ্যাপ্রচেষ্টা'তে পাকিয়ে ফেলার সম্ভাবনা। এসব পরামর্শকেরা ভাবছিলেন জিডির প্রয়োজন দ্রব্যটাকে উদ্ধার করতে। আমি আসলে মাঝারি দামের পুরাতন এই বস্তুটির পেট তথ্যশূন্য অবস্থায় এর প্রাপ্তিযোগ ভেবে উত্তেজিত হতে পারছিলাম না। আমার জিডি করা জটিল সব কারণে, এমনকি নিছকই কারণহীন এক ব্রতে। ওদিকে, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে, যদি আমার পরামর্শকেরা বস্তুটির উদ্ধারের কথাই ভাবেন, তখনই বরং দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার আমাকে যন্ত্রটা ফেরত দিতে দিতে বলতে পারতেন, 'খুব যে কইছিলেন আদাবরে হারায়েছেন; আপনি তো হোয়াটসঅ্যাপে গাজীপুর বইয়াও টেক্সট লিখছেন।' আমার ব্যাক্কলের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকত না ওই চিত্রনাট্যে। সব মিলে তিন দিন পরে হলেও আমি কথিত 'নিয়ম' অনুযায়ী ঘটনার কাছাকাছি থানাতেই যেতে চেয়েছি।       

চৌরাস্তা কুঁতেমুতে পার হবার পর আবারো ব্যাটারিগাড়ি ভাড়া করি। এবারও শরিকি। 'বাসন' যাতে 'বাসনা' না হয়ে পড়ে, এই সময়টা আমি মনে মনে রিহার্সাল দিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবে যে গাড়িতে চড়লাম, তাঁর চালককে 'বাসনা থানা'ই বললাম। তিনি অবিচলিতভাবে 'বাসন' বুঝে নিয়েছিলেন। 'বাসন থানা'র কয়েক গজ আগেই তিনি নামিয়ে দিলেন। এ দফা ঢুকবার মুখে গেটে হাসিমুখ এক পুলিশ পেয়ে, যেন কত দিনের পরিচিত, যেন বা আমার বিবরণীই ডায়েরি এমন ভঙ্গিতে সংক্ষেপে প্রায় পুরা ঘটনাটিই বলে ফেললাম। তবে কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলাম আমার এই প্রগলভতার হেতু হচ্ছে পরম এক সন্তোষ যে 'অবশেষে আমার তীর্থযাত্রার সংকল্প পূরণ হতে যাচ্ছে।' এই থানাতে ডিউটি অফিসারকেই বরং অভ্যর্থনাকারী ধরনের একটা টেবিলে বসে থাকতে দেখা গেল। কিছু লিখে আনিনি বিবেচনায় ভিতরে পাঠানো হলো আমাকে। লিখে এনেছি জেনে এই কর্তব্যরতের জায়গায় আবার পাঠানো হলো। 

আমার পত্রখানি তিনি নিবিড় ও শান্ত মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। মাঝেমধ্যে মাথা নাড়াতে থাকলেন। সম্ভবত আমার বিবরণীর দৃশ্যগুলোকে তিনি ভালোমতো দেখতে পাচ্ছিলেন। তারপর তিনি এক বাক্যে সেটটা খুঁজে বের করবেন সেই ঘোষণাও দিলেন। তবে এরপরে একটা-দুটো মৃদু পরোক্ষ প্রশ্ন করাতে, আমি এক বাক্যেই এটার দাম তাঁকে বলে দিয়ে তাঁকে প্রশমিত করলাম। আসলেই তাঁকে প্রশমিত দেখাল। তারপর তিনি ড্রয়ার থেকে হোয়াইটনার বের করতে করতে বললেন, 'চুরি কথাটা না লেখেন, চুরি ঝামেলার জিনিস; হারানোই লেখেন।' সাদা কালি শুকানো পর্যন্ত যত্ন করে তিনি অপেক্ষা করলেন। সাদা কালির কলমটার উল্টা দিক দিয়ে ঘষে ঘষে সাদা জায়গাটা মসৃণ করলেন। তারপর আমার দিকে এগিয়ে দিলেন 'হারানো' কথাটা লিখতে। থানার নাম বদলানো নিয়েই তিনি বরং তেমন কিছু বললেন না। সাদা কালিও লাগালেন না। সাধারণ কলমের দাগে কেটে লিখতে বললেন। 

একটা 'আসল' ঘটনার বিবরণী আসল 'নিয়ম' অনুযায়ী প্রকৃত থানায় করবার সকল চেষ্টাই করলাম। লোকজনের গ্রহণযোগ্যতার কথা ভেবে 'ছিনতাইকারী'র মর্যাদাও রক্ষা করেছিলাম 'চুরি' বলে। তবে 'চুরি' ঝামেলার জিনিস বলে এই অফিসার যখন আমাকে পরিমার্জন করে লিখতে বললেন, আমি আর মানা করতে পারলাম না। তা ছাড়া আসলেও মৃদু আলো-অন্ধকারে ওই 'ছিনতাইকারী' কিংবা মর্যাদাবদলে 'চোর'-এর চেহারা আমার মনেও পড়ছে না।

আদাবর। ১৯ (২০) জুন ২০২২। রাত্রি ১:০৫
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.