হিন্দু স্টুয়ার্টের মুসলিম বাংলা

ইজেল

আন্দালিব রাশদী
19 December, 2020, 08:25 pm
Last modified: 19 December, 2020, 09:36 pm
২৪ জুন অপরাহ্নে ইংরেজ সেনাবাহিনী সংক্ষিপ্ত একটি মহরৎ করল। পরদিন দুপুরের দিকে মুর্শিদাবাদের প্রান্তে মেদিনীপুর পৌঁছল। ক্যাম্প নির্মাণ শেষ হবার সাথে কর্নেল ক্লাইভ একশত সৈন্য নিয়ে ওয়াট ও ওয়ালশকে নির্দেশ দিলেন মীর জাফরকে সম্মান জানিয়ে আসতে হবে, যাতে জনগণের মনে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে যে মীর জাফর নবাব নন। এমনকি তার সেনাবাহিনীকে বুঝতে হবে যে তিনি তখন থেকে আগামীদিনের নবাব।

চালর্স স্টুয়ার্ট কোনো ভাবেই হিন্দু নন, এমন কি হিন্দু নারীর প্রেমে পড়ে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হবারও ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক কোনো সুযোগ নেই। তবুও স্টুয়ার্টের জীবনীকার ভি.সি.পি. হডসন  তাকে তার কোলকাতায় 'হিন্দু হডসন' হিসেবে যে পরিচিতি ছিল তা উল্লেখ করেছেন; হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে তার সখ্য এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি খ্রিষ্টিয় মিশনারিদের অবজ্ঞার দৃষ্টি খণ্ডন করে তিনি বইও লিখেছেন। 'হোয়াইট মোগল' গ্রন্থে উইলিয়াম ড্যালরিম্পলও সে কথা বলেছেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর্মির সেনা কর্মকর্তা চার্লস স্টুয়ার্টকে হিন্দুরা তো বটেই, ব্রিটিশ বন্ধুরাও তাকে হিন্দু স্টুয়ার্ট  নামে ডাকেন। তার জন্ম ১৭৫৮ সালে আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরে। তার বাবা টমাস স্মিথ লিমেরিকের এমপি এবং দাদি এলিজাবেথ ব্যারন স্যার টমাস প্রেনডার গাস্টের কন্যা।

উইলিয়াম ডালরিম্পলের দি হোয়াইট মোগল

তরুণ স্টুয়ার্ট নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী পরিবারে আরাম ও স্বস্তির জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাডেট সৈন্য হবার জন্য সাগর পেরিয়ে ভারতবর্ষে চলে এলেন। পেশাদার সৈনিকের মতো যথারীতি ক্যাডেট হিসেবে শুরু করে তখনকার সর্বোচ্চ পদ মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি কোম্পানির বিশাল সশস্ত্র বাহিনীর মাঠ পর্যায়ে কমান্ডার ছিলেন। তিনি ভারতেই রয়ে যান। কোলকাতার সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে তার সমাধি সুরক্ষিত আছে। ১৮২৮-এর ৩১ মার্চ তিনি প্রয়াত হন। ব্রিটিশ বিদ্বান, অধ্যাপক এবং ওরিয়েন্টালিস্ট হিসেবে তার যে পরিচিতি তা চার্লস স্টুয়ার্ট সেনাজীবনকে ম্লান করে ১৭৮১ থেকে ১৮০৮ পর্যন্ত তিনি বেঙ্গল আর্মি- সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেনা চাকরি বহাল রেখে তিনি ১৮০০ থেকে ১৮০৬ পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পার্শি ভাষার সহকারি অধ্যাপক ছিলেন। শেষ  দু'বছর  চাকরি বহাল রেখে ইংল্যান্ডের হেইলেবারি ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে পার্শি ভাষা,  আরবি এবং হিন্দুস্তানির অধ্যাপনা শুরু করে। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর  গ্রহণের পর ১৮২৭ সাল পর্যন্ত এই কলেজে অধ্যাপনা চালিয়ে যান।

চার্লস স্টুয়ার্টকে বুঝতে বেঙ্গল আর্মি সম্পর্কেও কিছুটা ধারনা থাকা প্রয়োজন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শুরু থেকেই 'লাঠিয়াল' পুষতে শুরু করে। প্রথমে ডাচ ও অন্যান্য ভাড়াটে  সৈন্যদের দিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করা হয়-- দুই.  প্রেসিডেন্সি সৃষ্টি হবার পর  প্রেসিডেন্সি আর্মি এবং ১৮৫৭  সিপাহি বিপ্লবের কারণে ইস্ট গবর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া এ্যাক্ট ১৮৫৮ এর সুবাদে  ক্ষমতা ব্রিটিশ ক্রাউনের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং তিন. প্রেসিডেন্সির সেনাশক্তি একীভূত হয়ে ইন্ডিয়ান আর্মি গঠিত হয়। ১৭৯৬-র পরে বেঙ্গল আর্মি দ্রুত বর্ধিত হয়। এ সময়ই চার্লস স্টুয়ার্ট মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।

চার্লস স্টুয়ার্ট

চার্লস স্টুয়ার্ট যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক তখন উইলিয়াম কেরি ম্যাথিও লামসডেন, জন গিলক্রিস্ট, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, তারিনী মোহনও সেখানে অধ্যাপনা করছিলেন। চার্লস স্টুয়ার্ট যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলেজের অধ্যাপক তখন প্রিন্সিপাল স্যামুয়েল হেনলি এবং যোসেফে ব্যাটেন। অধ্যাপকদের মধ্যে বাংলা পড়াতেন তিনজন : আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, ফ্রান্সিস জনসন এবং মনিয়ের উইলিয়ামস, চার্লস স্টুয়ার্ট পড়াতেন উর্দু এবং ফার্সি।

রেভারেন্ড ম্যালথাস জনসংখ্যা তত্ত্বের অন্যতম জনক, পড়াতেন অর্থনীতি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেছিলেন কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে উপযুক্ত মনে করেননি। সেনা ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় কীর্তিমান সৈনিকরা যে অবস্থানে থেকেই খ্যাতিমান হোন না কেন তাদের সেই পদবীটি সাথে রয়ে যায় -- এমনকি লেফটেন্যান্ট বা ক্যাপ্টেন হলেও। কিন্তু চার্লস স্টুয়ার্ট পান্ডিত্যে ও অধ্যাপনায় এতোটাই সফল যে তার মেজর জেনারেল পদবীটি উবে যায়।

তার বইপত্রের মধ্যে রয়েছে :

১. দ্য হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ফ্রম দ্য ফার্স্ট মহামেডান ইনভেশন আনটিল ১৭৫৭
২. মুলফুজাত তিমুরি বা মোগল সম্রাট তিমুরের আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথার ইংরেজি, অনুবাদ
৩. সম্রাট জাহাঙ্গিরের সচিত্র ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার অনুবাদ
৪. সম্রাট জাহাঙ্গিরের সচিত্র জীবনী পুস্তিকা
৫. আবু তালেব খানের ইউরোপ ও এশিয়া ভ্রমণ, অনুবাদ
৬. মহিসুরের টিপু সুলতান কাহিনী
৬. হোসেন কাশিফির অ্যান ইনট্রোডাকশন টু দ্য আনভারি সোহিলি।

চার্লস স্টুয়ার্টের দি হিস্টোরি অফ বেঙ্গল

ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতো ব্রিটিশ আর্কাইভে চার্লস স্টুয়ার্ট ভারতবর্ষের জন্য একটি জনপ্রিয় নাম।

চার্লস স্টুয়ার্টের প্রথম স্ত্রী স্যার উইলিয়াম গর্ডনের কন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রী রেভারেন্ড নিকোলাস রিডের কন্যা অ্যানি। স্টুয়ার্ট নিঃসন্তান ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ফিরে আসেন এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

চার্লস স্টুয়ার্ট অনুভব করেছেন মুসলমান পরিবারে পর্দা প্রথা থাকলেও পারিবারিক জীবনে তারা খোলামেলা, তাদের জীবন-যাপন বিশ্বাস, ভাবনা এসব আবিষ্কার করতে কৌতুহলী গবেষকের বেশি সময় লাগে না, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজের অবগওণ্ঠন খুলে তার ভেতরটা দেখে আসা রীতিমত বড় আবিষ্কার -- অবগুণ্ঠনের নিচে তিনি পেয়েছেন সংস্কৃতির অঢেল উপাদান। কলকাতার হিন্দুজীবনে এর অনুসন্ধানই তাকে পরিণত করে হিন্দু স্টুয়ার্টে, কিন্তু যখন রচনা করলেন তা করলেন মুসলমান শাসনাধীন বাংলার। চার্লস স্টুয়ার্টের বইটি ১৭৫৭ সালে -সিপাহি বিদ্রোহের বছর প্রকাশিত হয়, বহু বছর ধরে এই বই ভারত ও ইউরোপের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নিক বা নাই নিক। তিনি স্বীকার করেই নিয়েছেন তার লেখা বিশেষ করে বাঙ্গালি পাঠকদের ধারণা দেবে, এতোদিন তারা নিজ দেশের যে ইতিহাস জেনে এসেছেন তার সাথে চার্লস স্টুয়ার্টের বাংলার ইতিহাস সাংঘর্ষিক। তার আরও আহ্বান ছিল, কেউ যদি মনে করেন হিন্দু স্টুয়ার্টের লেখা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গিয়েছে তারা যেন প্রয়োজনীয় প্রমাণ দাখিল করে তার লেখা সংশোধনের দাবি জানান। যুক্তিযুক্ত হলে, তিনি সংশোধন, পরিবর্তন, বর্জন, পরিবর্ধন সব করতেই রাজি। গ্রন্থের প্রথম দুটি অধ্যায়ে তুর্কি হাবসি এবং ঘোরি শাসনের বর্ণনা দিয়ে তিনি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের বর্ণনার শুরুতে বলেন: তিনিই 'বাংলার সমতল উর্বর ভূমিতে নবী মোহাম্মদের পতাকা রোপন করেন। সময়টা ১২০৩-৪ (হিজরি ৬০০); প্রাচ্য দেশিয় পাঠকদের সুবিধের জন্য তার বইয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হিজরি সাল ব্যবহার করেছেন, বন্ধনী বা টিকায় ইংরেজি বছর। কুৎসিত দর্শন এই মানুষটির জন্ম আফগানিস্তানের উত্তরের একটি জেলা শহরে খিলজি গোত্রে। তিনি গজনীর সুলতান মোহাম্মদ ঘুরির কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। তিনি প্রাদেশিক গভর্নর ওঘুল বেগের অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেন এবং সাহস দক্ষতা ও কাজের মধ্যে দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন। তার আমন্ত্রণে অনেকেই তার অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়; তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সাফল্যের সাথে সম্পাদন করেন। মুসলমানদের সাম্রাজ্য বিস্তার চলতে থাকে, তারা বাংলার সীমান্তে হিন্দু রাজার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বাংলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে, অধীনস্ত সৈন্যদের নদীয়ার সীমান্তের বাইরে জঙ্গলে সৈন্যদের লুকিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে মাত্র সতেরজন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দূতের ছদ্মবেশে রাজাকে সম্মান জানাতে যাবার কথা বলে রাজপ্রাসাদে ঢোকার অনুমতি নিয়ে রাজপ্রহরীকে হত্যা করেন, রাজপ্রাসাদে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। জ্যোতিষ নির্ভর রাজা পূর্বাপর ঘটনাক্রম মিলিয়ে তার করণীয় তাৎক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করেন, তিনি রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। পরিণতি আচ করে তিনি বাস্তবিকই কোনো ধরনে প্রতিরোধের চিন্তা না করে এতোদিনের শাসিত রাজ্য থেকে রাজপ্রাসাদের গোপন দরজা দিয়ে দ্রুত নদীর ঘাটে পৌঁছে নৌকায় ভাটির দিকে পালিয়ে গেলেন। সেই রাজা লক্ষণ সেন, স্টুয়ার্ট বলেছেন প্রিন্স লছমনিয়া। মুসলমান সৈন্যদের হত্যাকান্ড ও বর্বরতার কাহিনী তার কানে পৌছে, তিনি জগন্নাথ মন্দিরের দিকে রওয়ানা হন, মন্দিরের পাশেই তার মৃত্যু ঘটে। খিলজির সৈন্যরা বহু মন্দিরে লুটপাট চালায়, ভাঙচুর করে এবং মন্দিরের সামগ্রী দিয়েই সেখানে মসজিদ তৈরি হয়। তিনি গৌড় অধিকার করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি বুদ্ধিমত্তার সাথে কুচ উপজাতির প্রধানকে ইসলামে দীক্ষিত করে তাকে উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।

তবে বখতিয়ার খিলজিকে কামরূপ জয়ের বাসনার খেসারত দিতে হয়েছিল। বহুসংখ্যক অশ্বারোহীও সাধারণ সৈন্যদের খরস্রোতা নদীতে ডুবে। স্টুয়ার্ট বখতিয়ার খিলজির অন্তিম পরিণতির দুটি সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরেছেন : তিনি উচ্চাশার অভিযানে ব্যর্থ হয়ে ফেরার পথে দেওকোটে অসুস্থ হয়ে পড়েনÑ তার জয়ের তৃষ্ণা মেটাতে যে সৈন্যদের মান দিতে হয়েছে তাদের বিধবা ও এতিম সন্তানদের অভিশাপে তার মৃত্যু হলে ১২০৫-৬ এ কোনো সময় তাকে বিহারে সমাহিত হয়।

কলকাতায় চালর্স স্টুয়ার্টের সমাধিফলক

দ্বিতীয় চিত্রটি অনুমেয় : নিষ্ঠুর গভর্নর আলী মর্দান খিলজি রোগ শয্যায় অচেতন বখতিয়ারকে হত্যা করে। যেহেতু চার্লস স্টুয়ার্ট বাংলার ইতিহাস রচনা করেছেন, কোনো স্মৃতিকথা লিখেননি, এ ধরনের দু'একটি ঐতিহাসিক ঘটনা তার সাড়ে পাচ শতাধিক পৃষ্ঠার গ্রন্থ থেকে তুলে ধরা হবে।

চার্লস স্টুয়ার্টের গ্রন্থের শেষ দৃশ্যটি স্মরণীয়

পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। এবার পলায়ন পর্ব। তিনি পবিারের সদস্যদের নিয়ে নৌকায় রাজমহলের উল্টোদিকে ছানা শাহ নামের এক দরবেশের আস্তানায় ক্ষুধাকাতর নারী ও শিশুদের নিয়ে অবতরণ করেন এবং খাবার যোগার করে দেবার অনুরোধ জানান। এর আগে সিরাজ ছানা শাহকে অপমান করেছিলেন। ছানা শাহ একদিকে এই বিপন্ন নবাব ও তার পরিবারবর্গের জন্য খিচুড়ির আয়োজন করেন অন্যদিকে অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাজমহলে সেনা নেতৃত্বে থাকা মীর জাফরের ভাই মীর কাশিমকে গোপনে সিরাজের সিরাজের উপস্থিতির বার্তা পাঠান। তখনই তার বাহিনী এসে নবাবকে বন্দী করে প্রথমে রাজমহল ও পরে মীর জাফরের বাড়িতে নিয়ে যায়, মীর জাফর অনুপস্থিত থাকায় নবাবকে তার পুত্র মীরনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চার্লস স্টুয়ার্ট মীরনকে হীন চরিত্রের ব্যক্তি আখ্যা দেন। নবাবকে হত্যা করার জন্য তিনি অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করলেও তার অনুগত ভৃত্যরা এগিয়ে আসেনি, কিন্তু নবাবের নানা আলীবর্দী খানের বাড়িতে লালিত মোহাম্মদ বেগ সে দায়িত্ব নেয়। চলতে তাকে হত্যা পরিকল্পনা।

 ২৪ জুন ১৭৫৭ কর্ণেল ক্লাইভকে তার ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জন্য স্ক্র্যাফটন সাহেব ও আমীর বেগকে পাঠালেন। নতুন কোনো ফাদে পা দিতে যাচ্ছেন কিনা এ নিয়ে, মীর জাফর সংশয়ে ছিলেন। এ আমন্ত্রণ এড়ানো আরো নতির কারণ হতে পারে মনে করে তিনি ক'জন অনুসারী এবং পুত্র মীরনসহ দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় ক্লাইভের ক্যাম্পের সামনে হাতির পিঠ থেকে নেমে আসেন। ঠিক তখনই ক্লাইভের গার্ড-বাহিনী তাকে স্যালুট করে সম্মান জানাতে এগিয়ে আসে। কিন্তু মীর জাফর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পিছিয়ে যানÑ তিনি এটাকে তার হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা মনে করে থাকবেন। তার বিব্রতাবস্থা দেয়ে কর্নেল ক্লাইভ নিজে এগিয়ে গেলেন। তাকে এক হাতে ধরে অন্য বাংলা বিহার উড়িষ্যা তিন প্রদেশের নবাব মেনে নিয়ে তাকে তাকে স্যালুট করবেন। তারপর নবাব মীর জাফরের আতঙ্ক কাটে। তারা এক ঘন্টা ধরে কথা বলেন, কর্নেল তাকে দ্রুত মুর্শিদাবাদ গিয়ে সিরাজউদ্দৌলাহ ধরতে এবং কোষাগার লুণ্ঠনের সম্ভাবনা এড়াবার জন্য ব্যবস্থা করতে বললেন, মীর জাফর নিজের ক্যাম্প ফিরে সরাসরি শহরের দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি সন্ধ্যায় পৌছলেন। কিন্তু সিরাজের পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তিনি পৌছার ছয় ঘন্টা পর পরাজিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রাসাদ ত্যাগ করলেন।

২৪ জুন অপরাহ্নে ইংরেজ সেনাবাহিনী সংক্ষিপ্ত একটি মহরৎ করল। পরদিন দুপুরের দিকে মুর্শিদাবাদের প্রান্তে মেদিনীপুর পৌঁছল। ক্যাম্প নির্মাণ শেষ হবার সাথে কর্নেল ক্লাইভ একশত সৈন্য নিয়ে ওয়াট ও ওয়ালশকে নির্দেশ দিলেন মীর জাফরকে সম্মান জানিয়ে আসতে হবে, যাতে জনগণের মনে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে যে মীর জাফর নবাব নন। এমনকি তার সেনাবাহিনীকে বুঝতে হবে যে তিনি তখন থেকে আগামীদিনের নবাব।

কোম্পানির ক্ষতিপূরণ বাবদ  কোটি ৫ লক্ষ পাউন্ড স্টার্লিং আদায় করতে একটু সময় লেগে গেল। তিনি অপেক্ষা করলেন দুইশত ইউরোপিয় এবং তিনশত সিপাইর একটি মিছিল নিয়ে ২৯ জুন সকালে কর্নেল ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ শহরে পৌছলেন: তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মুরাদবাগ গার্ডেন হাউস, তার আবাসিক ঠিকানা।

তখনই মীর জাফরের পুত্র মীরণ তার অপেক্ষায় ছিলেন, যিনি তাকে মুনসুরগঞ্জ রাজপ্রাসাদের ভেতর নিয়ে যান। সেখানে মীর জাফর তার কর্মকর্তা ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কর্ণেল সাহেবের প্রতীক্ষায় ছিলেন। হলের এক প্রান্তে রাখা ছিল সিরাজউদ্দৌলার মসনদ মীর জাফর তা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাকে নিজে হাতে টেনে এই মসনদে বসিয়ে দেন এবং বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাবকে অভিনন্দন জানান।

চার্লস স্টুয়ার্ট ফার্সি ভাষার অন্যতম প্রধান পন্ডিত। তিনি তার গ্রন্থটি রচনায় যেসব কার গ্রন্থ অনুসরণ করেছেন তাদের সর্বশেষটির প্রকাশকাল, বাংলার ইতিহাস চর্চায় এই বইগুলি উত্তম সূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে বলে নাম উল্লেখ করছি।

১. তাজ আল মুয়াসিব। নিশাপুরের হুসেইন নিজামি ১২০৬ থেকে ১২২০ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে অবস্থানকালে গ্রন্থটি রচনা করেন এতে সুলতান মুহম্মদ ঘুরির স্মৃতি ও কীর্তি বর্ণিত হয়েছে যার সূচনা ১১৯১ সালে ভারত অভিযান দিয়ে, শেষ ১২০৬ সালে তার মৃত্যুতে।
২. তাবশত নাসিরি : ১২৫৮-৯ সালে মিনহাজ সিরাজ আদদীন ওমর আল গির্জনি। এটি মূলত প্রাচ্যে মুসলমানদের ইতিহাস যার সমাপ্তি হালাকু খানের খেলাফত ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, ১২৫৮ সালে। চার্লস স্টয়ার্ট এই বইটিতে ভাবালুতা বর্জিত একটি নিরপেক্ষ রচনা মনে করেন।
৩. তারিখ আলুফি : ষোড়শ শতকের শেষদিকে পন্ডিত আবুল ফজলের ভূমিকা সহ মওলানা আহমদ ও আকবরের পন্ডিত সভার কজন সদস্য সংকলিত এই গ্রন্থে মুসলমানদের শ্রম সহস্র চন্দ্রবর্ষের ইতিহাস ধারন করা হয়েছে।
৪. তাবকাত আকবরি : বাদশাহ আবাবরকে উৎসর্গীকৃত হেরাতের নিজাম আদদীন আহমদের রচিত ভারতবর্ষের ইতিহাস, এর পঞ্চম অধ্যায়টি বাংলা নিয়ে।
৫. তারিখ-ই-ফেরিশতাহ : মুহাম্মদ কাজিম ফেরিশতাহ রচিত ২২ অধ্যায়ের ভারতবর্ষের ইতিহাস। কর্নেল ডাও এবং স্কট অনূদিত ইংরেজি ভার্সনে চার্লস স্টুয়ার্ট সপ্তম অধ্যায়ে চীনা সংযোজন করেছেন।
৬. আকবর নামা, ষোড়ষ শতকের শেষভাগে প্রকাশিত আবুল ফজলের গ্রন্থ; সম্রাটের  বছরের ভারত শাসনের ইতিহাস।
৭. জুবদাত আল তওরিখ : নূর-উল হক মেরেকি রচিত দিল্লির মুসলমান শাসকদের ইতিহাস, আকবরের আমলে এসে শেষ হয়েছে। তাছাড়া মালওয়া, দাক্ষিপাত্য, কাশ্মীর গুজরাট, সুলতান, বাংলা জৌনপুর ও যাট্টার মুসলমান রাজাদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
৮. জাহাঙ্গির নামা : মুতিমেদ খান রচিত সম্রাট জাহাঙ্গিরের শাসনকাল ১৬০৫ থেকে ১৬২৭-এর  বিস্তারিত বর্ণনা।
৯. শাহজাহান নামা : ১৬৫৯ সালে সম্রাট শাহজাহান আওরঙ্গজেবের হাতে গৃহবন্দী হবার পর মুহাম্মদ বিন সালে গ্রন্থটি রচনা করেন। স্টুয়ার্ট মনে করেন এটি একটি চমৎকার ইতিহাস গ্রন্থ।
১০. আলমগির নামা : ১৬৮৮-৮৯ সালে মীর্জা মোহাম্মদ কাজিম রচিত আওরঙ্গজেবের প্রথম দশ বছরের শাসনকালের ইতিহাস।
১১.  মাওসির আলমগিরি : মোহাম্মদ মাকি মুস্তায়িদ খান ১৭১০ সালে আওরঙ্গজেবের শাসনকালের ইতিহাস ১৭০৭ সালে সম্রাটের মৃত্যু পর্যন্ত টেনে আনেন।
১২. মুনতাখান আল লেবাব কিংবা তারিখে কাফি খান : ১৭৩২ সালে মোহাম্মদ হাসেম কাফি খান রচিত ভারতবর্ষের ইতিহাস, শুরুটা বাবরের আক্রমণ দিয়ে। স্টুয়ার্ট এটিকে 'এক্সিলেন্ট' গ্রন্থ বলে প্রশংসা করেছেন।
১৩. মুয়াসির আল ওমরাহ আত তিমুরিয়া : ১৭৭৯ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটি তৈমুর বনভ এর কাহিনী; নিজামের দরবারের পন্ডিত আবদুল হাই নওয়াজ খান এবং তার পুত্র সামসুম আদ দৌলা বইটি রচনা করেছেন।
১৪. রিয়াজ আস সালাতিন : গৌড়ের জর্জ উডনি সাহেবের মুনশি গোলাম হোসেন সেলিমির বইটি ১৭৮৭-৮ সালে লিখিত বাংলার ইতিহাস। এই বইটির অনেক সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করলেও চার্লস স্টুয়ার্ট তার গ্রন্থ রচনার জন্য এই বইটির অনুপ্রেরনাই কাজ করেছে বলে লিখেছেন।
১৫. সিয়ের মুতাখেরিন : ১৭৮৩ সালে সমাপ্ত সৈয়দ গোলাম হোসেন খানের গ্রন্থ। ভারতবর্ষের শেষ শত সম্রাটকে নিয়ে লিখা।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.