হাসানের রোদ্দুরে

ইজেল

ইমতিয়ার শামীম
21 November, 2021, 01:00 pm
Last modified: 21 November, 2021, 01:19 pm
আজ 'সন্ধিলগ্ন ফিরিছে সগৌরবে' চিরজন্মের স্বাদ নিয়ে মৃত্যুর দরজা পেরিয়ে আজ তিনি উপহাস করছেন চিরমৃত্যুকে। আজ আমরা না হয় তাঁর শুরুটাকেই বোঝার চেষ্টা করি। কেন তিনি অনায়াসে তাঁর সমসাময়িকদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন, তা বোধ করি লুকিয়ে আছে ওই শুরুর মধ্যিখানেই।
ছবি: প্রণবেশ দাস

কেবলমাত্র ছোটগল্পকে সঙ্গী করে কথাসাহিত্যে তাঁর রাজত্বকালের শুরু। নানা গদ্যও লিখেছেন তিনি, কখনো নিজের পাঠ-অনুভূতি জানাতে; কখনো বা যা তাঁকে জীবন-সংসার-সমাজ-রাজনীতির চরম-পরম আস্বাদ দিচ্ছে, তা জানাতে। শেষের দিকে এসে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন বটে; কিন্তু তা-ও দেড় যুগ হয়ে গেছে মেঘে মেঘে, তা ছাড়া এখনো তিনি আদৃত মূলত তাঁর ছোটগল্পের কারণে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক-সামাজিক ভূমিকার কারণেও তিনি দ্রষ্টব্য বটে, কিন্তু মূল শক্তির প্রকাশ তাঁর ঘটেছে ছোটগল্পেই; প্রৌঢ়ত্বে লেখা উপন্যাসগুলো দিয়ে আমাদের চোখেমুখে মুগ্ধতা আর হঠাৎ-ঝলকানির আলো জ্বাললেও ওই উপসংহারটিই যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ধেয়ে এসেছে। বেঁচে থাকার ৮২টি বছরে আর লেখালেখির মোটামুটি সাড়ে ছয় দশকে (১৯৫৭ সালে লেখা 'শামুক'কে বিবেচনায় নিয়ে) তিনি আমাদের ঝুলিতে অনেক মণিমানিক্যই তুলে দিয়েছেন, কিন্তু পাঠকেরা বোধ করি তাঁর কাছে বরাবরই ছোটগল্পই প্রত্যাশা করেছে। 

মনে আছে, দীর্ঘ বিরতির পর আশির দশকের শেষের দিকে হাসান আজিজুল হকের 'আমরা অপেক্ষায় আছি' প্রকাশের কথা জেনে আমরা ভীষণ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম, এবার বোধ হয় আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হবে, দীর্ঘদিন পরে আবারও আমরা আমাদের প্রিয় লেখককে দেখব জ্বলে উঠতে; কিন্তু বড় বেশি অতৃপ্তিরই জন্ম হয়েছিল ওই গল্পগ্রন্থ থেকে। বয়সে তরুণ তখন আমরা সবাই; মনে আছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে মন্টুর দোকানে বসে প্রতিদিনই এই অতৃপ্তি নিয়ে সবাই খুব ক্রুদ্ধ হতাম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তখন তাঁর ফিলিপস পুরস্কার গ্রহণ বিতর্ক। আমাদের ছোট কাগজ 'বৈশম্পায়নে' মাহমুদুল হকের 'কালো বরফ' লিখতে গিয়ে তখন হাসান আজিজুল হকের প্রসঙ্গও এনেছিলাম এক লাইনে। কয়েক দিন পর, মন্টুর দোকানেই, হঠাৎ পাশের টেবিল থেকে কচি ভাই (শামসুল কবির, পরে যিনি 'ইচক দুয়েন্দে') গলা বাড়িয়ে বললেন, 'ইমতিয়ার, আপনার আপত্তি না থাকলে আমার প্রথম গল্পের বইয়ের রিভিউটা আপনি লিখবেন।' আমি হকচকিয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে আবার বললেন, 'স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম। বললাম, এই ছেলে তো আপনাকে এক লাইনেই শুইয়ে দিয়েছে।' বলেই আবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর প্রথম বইয়ের সমালোচনা লিখতে হবে। 

খুব না হোক, একটু গর্ব সেই দিন নিশ্চয়ই হয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝি, 'রাইটার্স ব্লক বলে যে একটা ব্যাপার আছে, একটা ব্যাপার ঘটে, সেটাই আসলে বুঝতাম না, জানতাম না। অনেক পরে পুনরায় আমরা তাঁকে ঝলসে উঠতে দেখি 'বিধবার কথা' গল্পে। তত দিনে জেনে গেছি, তাঁর যে অভিযাত্রা, তাতে এমন বড় বড় প্রতীক্ষা আর অপেক্ষাই আমাদের নিয়তি। তাই ব্যক্তি নির্মাণযজ্ঞের এক ঈর্ষণীয় আখ্যান 'আগুনপাখি'র পরও আমরা চেয়েছি ছোটগল্পই লিখুন তিনি। 'বাংলা ছোটগল্প মরে যাচ্ছে' বলে এ অপেক্ষা নয় বরং তাঁর কাছ থেকে তৃপ্তি-অতৃপ্তি দুটোই আমরা আমাদের জন্যে অবধারিত করে নিতে চাই বলে।

কেন এই তৃপ্তি-অতৃপ্তি, সেদিকে যাওয়া সেটা অবশ্য আজকের প্রসঙ্গ নয়। আজ 'সন্ধিলগ্ন ফিরিছে সগৌরবে' চিরজন্মের স্বাদ নিয়ে মৃত্যুর দরজা পেরিয়ে আজ তিনি উপহাস করছেন চিরমৃত্যুকে। আজ আমরা না হয় তাঁর শুরুটাকেই বোঝার চেষ্টা করি। কেন তিনি অনায়াসে তাঁর সমসাময়িকদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন, তা বোধ করি লুকিয়ে আছে ওই শুরুর মধ্যিখানেই। এইখানে সোজাসাপটা একটি ধারণা গত কয়েক দশকে দাঁড়িয়ে গেছে; আর তা দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই বোধ হয় একটু-আধটু ভূমিকাও আছে হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে সমালোচক-আলোচকদের সাধারণ ভাষ্য এমন, মানিক চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রাণিত হয়ে তিনি এত দূর এসেছেন। কেউ কেউ আরও একটু এগিয়ে তাঁকে বলে থাকেন, 'জগদীশচন্দ্র গুপ্ত ও মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গোত্রজ গল্পকার'। জগদীশগুপ্ত যে 'দিবসের শেষে' লিখে বাংলা ছোটগল্পে নিয়তিবাদকে মহিমান্বিত করেছিলেন, হাসানের 'আমৃত্যু আজীবন'কে সেটার সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে আমাদের এমনতর ভাবনার শুরু হয়েছিল। তাঁর ভাষা যতই তীক্ষ্ণ, সতর্ক, নির্মেদ, ভাবালুতাবর্জিত, তীব্র হয়েছে, মাঝেমধ্যে মধ্যবিত্তের ঘরে হানা দিলেও যত বেশি নিম্নবিত্ত মানুষের বলয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেছে, ততই তাঁকে মানিক গোত্রের দিকে আমরা ঠেলে দিয়েছি নিতান্তই আমাদের ভালো লাগা থেকে। কেননা আমরা আসলে মানিকের উত্তরাধিকার খুঁজেছি। একজন সাহিত্যিকের উত্থানে আরেকজন সাহিত্যিক কতটুকু ভূমিকা রেখেছে, কতটুকু রাখতে পারে, তা নিয়ে নানা মাত্রিক আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু বড় কথা হলো, সবকিছু ভেদ করে হাসানকে আমরা আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হতে দেখেছি, আবার তাঁর স্বকীয়তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও সাধারণভাবে গোত্রবদ্ধ হওয়ার অভিমতটিও বলা চলে মেনে নিয়েছি।

তিন গুণী- বাঁ থেকে সনৎ কুমার সাহা, গোলাম মুরশিদ ও হাসান আজিজুল হক। ছবি: এলিজা মুরশিদ

তবে এত দিনে অন্তত আমার মনে হয়, হাসান আজিজুল হকের বিশেষত শুরুর বিন্দুটি নতুনভাবে ভাবা প্রয়োজন। আমার ক্ষেত্রে এই ভাবাভাবির সূত্রপাত ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রছাত্রী সংসদ রাকসুর সাহিত্য সপ্তাহে তিনি যে আলোচনা করেন, তা শোনার পরে। আর দীর্ঘদিন পর গত ২০১৫ সালে এসে তাঁর একেবারে শুরুর দিকের রচনা 'শামুক' গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেলে সেটি পড়ে এই ভাবনা একটি পরিণতি পেয়েছে। দীর্ঘ কয়েক যুগ পর এ উপন্যাসকে পাঠকের সামনে পুনরুদ্ধারকারী লেখক চন্দন আনোয়ার 'শামুক' সম্পর্কে লিখেছেন, 'বিভূতিভূষণের প্রকৃতি, শরৎচন্দ্রের প্রেম, রবীন্দ্রনাথের সংলাপ, আর শেষে মানিকের বাস্তবতা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে উপন্যাসে।' তিনি এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কিশোর মুনীরের চরিত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন বিভূতিভূষণের মানিকের। কিন্তু একবার ভালো করে দেখা যাক, 'শামুক' উপন্যাসটি কোনখান থেকে প্রাণ পাচ্ছে, কোনখানে এসে সেই প্রাণতার হঠাৎ-বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমার মনে হয়, সেটি ঘটনাপ্রবাহের এই ক্ষণে এসে : 

'রাত্রে মুনীর বাইরে বেরুতে গিয়ে দেখল মাটির বারান্দায় বুবু চুপ করে বসে আছেন। জ্যোৎ¯œায় বুবুকে মনে হচ্ছে পাথরের মূর্তি। মুনীর বুবুর কাছে যাবে কিনা ভাবছিল, হাসান দুলাভাই বেরিয়ে এসে তাঁর কাছে গিয়ে আশ্চর্য মৃদুকণ্ঠে অপূর্ব স্নেহের সঙ্গে ডাকলেন, মিনা।

বুবুর নাম তাহমিনা। নামটা প্রায় ভুলে গিয়েছে মুনীর। কারণ তাঁকে নাম ধরে কেউ ডাকে না। কিন্তু কোনো নামই যে অত সুন্দর করে, শ্রদ্ধার সংগে উচ্চারণ করা যায় মুনীরের ধারণা ছিল না। হাসান দুলাভাইকেও আর কিছুতেই চেনা যাচ্ছিল না।
বুবু যেন চমকে উঠলেন ডাকটা শুনে, তারপর ফিরে তাকালেন হাসানের দিকে। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে, আশংকার সংগে, প্রীতির সংগে, আনন্দের সঙ্গে, মর্চে পড়া অতীতের উজ্জ্বল স্মৃতি মনে করে তিনি যেন আগাগোড়া থরথর করে কেঁপে উঠলেন।
তাঁকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরলেন হাসান দুলাভাই। আর বুবু বললেন অস্ফুটকণ্ঠে, আমি বুঝতে পারি না।
হাসান দুলাভাই বললেন, আমিও ঠিক বুঝি না।
তুচ্ছতা, দারিদ্র্য এবং অপমান ছাপিয়ে মহৎ উত্তরণ হোল তাঁদের।
অনন্তকে যেন পেলেন হাতের মুঠোয়।' 

যাঁরা সোমেন চন্দের 'ইঁদুর' পড়েছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে হবে সেটির কোনো এক অংশের সঙ্গে এটির অন্তর্গত মিল রয়েছে। বাবা তীব্র ক্ষোভে কদর্য ভাষায় মাকে গালাগালি করেন, আবার রাতে এসে অনুচ্চ স্বরে 'কনক' 'কনক' বলে ডাকেন, ছেলে তখন এই মাধুর্যের সন্ধান পায়, বাবাকে তার নিজের বয়স ফিরে দেয়। হাসানকে তার তারুণ্যে, মাত্র ১৮ বছর বয়সে, সোমেন চন্দ কী করে, কতটুকু প্রভাবিত করেছিল সেটির উজ্জ্বল সাক্ষী 'শামুক' বিশেষত এ অংশটুকু। দগদগে কাঁচা বয়সের লেখা তাঁর; কিন্তু তিনি যে কোন পথে এগুবেন, সেটির স্পষ্ট ইঙ্গিতও এখানেই। তিনি তাঁর ভালো লাগার লেখকদের প্রভাবকে তখন অতিক্রম করতে চাইছেন নিজের মতো করে তাই এ রূপান্তর। তাঁর লেখায় ভিক্টোরিয়ান শুচিতার প্রবল উপস্থিতির শুরুও বোধ করি এখান থেকেই। কেননা 'ইঁদুর'-এর শৈল্পিকতায় বাবা-মায়ের অন্তরঙ্গতা সুস্পষ্টভাবে উঠে এলেও হাসানের 'শামুকে' তা স্তব্ধ হয়েছে 'অনন্তকে হাতের মুঠোয়' তুলে দিয়ে। বোধ করি মাত্র দুবার তাঁর গল্পকে আমরা এ সীমা ভাঙার চেষ্টা করতে দেখি, একবার 'একটি আত্মরক্ষার কাহিনী'তে, আরেকবার 'মন তার শঙ্খিনী'তে। কিন্তু 'একটি আত্মরক্ষার কাহিনী'তে রাহেলার ঘুমভাঙা চার বছরের বাচ্চা মেয়ের চিৎকার হাসানের গল্পের সংবিৎ ফিরিয়ে আনে, 'মন তার শঙ্খিনী'তে সংবিৎ ফেরে সন্তানকে পেটে ধারণের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে মানবিকতা আছে, মানুষের শাশ্বত আকাক্সক্ষার অনুভূতি আছে, সমাজ-সংসারের কাছে যৌনতার পরাজয় ঘটেছে সেই অর্থে বাস্তবতাও আছে। কিন্তু তিনি যে বলেন, যা দেখেননি, যে বিষয়ে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি, তা তিনি কখনো লিখতে পারেন না সেই ভাষ্য তাঁর গল্পে বোধ করি খানিকটা অনুপস্থিতও হয়ে পড়ে। কারণ, আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে অবক্ষয়ের অবশেষ হিসেবে যৌনতার সংযুক্তি প্রবল, নিম্নবিত্ত সমাজেও এর উপস্থিতির প্রকাশ প্রচণ্ডভাবেই ঘটে থাকে। কিন্তু হাসানের ছোটগল্পে বলতে গেলে তা অনুপস্থিত অথবা উপস্থিত পেট ভরার পর। সাধারণ পাঠ থেকে এই উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ধরন আলাদাভাবে উপলব্ধি করা যায় না, কিন্তু তাঁর গল্পসমগ্রের দিকে ফিরে তাকালে নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন জাগবে। কেননা ছোটগল্পে তাঁর পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত জগদীশগুপ্তের উজ্জ্বল উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে শুধু নিয়তিবাদকে মহিমান্বিত করেই নয়, এই জাগতিক অনুভূতিকে বিবেচনায় নেয়ার কারণে; আর মানিক বন্দোপাধ্যায়েও আমরা বিভিন্নভাবে উদ্ভাসিত হতে দেখি কি মধ্যবিত্তের, কি নিম্নবিত্তের যৌনতার মনস্তত্ত্বকে। তাই সামগ্রিকতার বিবেচনায় কখনো কখনো সংশয় হয়, তিনি কি সচেতনভাবেই যৌনতার প্রসঙ্গ উপেক্ষা করেছেন? আবার যেখানে এনেছেন, সেখানে কি সচেতনভাবেই এনেছেন, যাতে বিবমিষা জাগে?

এই সংশয়ের নিবৃত্তি হোক বা না হোক, এককথায় বলতে গেলে হাসান যে গুরুত্বপূর্ণ, এসব কারণেই। তিনি পরিতৃপ্তি জাগান, কিন্তু অতৃপ্তিও জাগান, শিল্পের অনন্ত জিজ্ঞাসাকে ধারণ করেন কিন্তু জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে। তাই তাঁর গল্পগুলো পড়তে গিয়েও দেখি, মানুষগুলো এক বিরামহীন জীবনযুদ্ধের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে। আর এত দারিদ্র, এত উৎকট মধ্যবিত্তপনা, এত ক্ষত, এত নিরাশা, এত কদর্যতা তারপরও কোথায় যেন একটু আলো জ্বলে, কোথায় যেন জীবনের জন্যে মায়া জেগে থাকে। এই যে এই বই খুলতেই পেয়ে যাওয়া অংশটুকুতে একটু চোখ বুলানো যাক : 

পূর্বদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ। শ্যামলা রঙের ছিপছিপে কিন্তু পুষ্ট দেহটি। এত তাজা, মনে হয় জ্যান্ত। আমি হয়তো তাই মনে করতাম যদি না দেখতাম দেহটি উলঙ্গ। ঘন নীল রঙের মোটা কাপড়টি ঘরের এক কোণে জড়ো করা। কালো চুলের গোছা মাথার পিছন দিকে ছড়ানো। মেয়েটির তরুণ শরীরে কোথাও কোনো খুঁত দেখতে পেলাম না। তার সারা শরীরে রোদ। শুধু একটিমাত্র খুঁত। মেয়েটির কোনো যোনি নেই। যোনির জয়গায় বিরাট একটি গহŸর। সেই জায়গাটিতে রোদ যেতে পারেনি। কালো, ঘন কালো বিরাট গর্ত। অনেক গোলাপ বা অনেক পাথর চাপা দিয়েও গহ্বরটি বোজানো যাবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু এটা কোনো কথাই নয়। সেই মেয়ের পুষ্ট স্তন দুটির একটি ছোট হাতের মুঠো দিয়ে টিপে ধরে অন্যটি চুষছে বছরখানেক বয়সের হৃষ্টপুষ্ট একটি শিশু। ছোটো ছোটা হাতে থাবড়া মারছে, মুখ ঘষছে, গরুর বাছুরের মতো ঢু মারছে মাঝে মাঝে। হঠাৎ সে মুখ তুলে আমাদের দিকে চেয়ে একটুখানি হাসলো। তার ছটি দাঁত, উপরে চারটি, নিচে দুটি। উপরের দুটি দাঁত একটু বড়ো। চোখ কুঁচকে ছটি দাঁত বের করে সে আমার দিকে চেয়ে হাসলো। তখনো একটুখানি রোদ ছিল। 

এই যে এত নির্দয়তা আর নিঃস্ততার মধ্যেও একটু রোদ হঠাৎ সমস্ত নৈরাশ্যের মধ্যে চোখে আটকায় এখানেই তাঁর বড় শক্তি, এই তাঁর বড় সৃষ্টি। এখানেই আমরা মুগ্ধ ও থির হই। তিনি আমাদের ছোটোগল্পের রোদ্দুর হয়ে ওঠেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটি যুগের আপাত অবসান ঘটল। অবসান ঘটল সেই যুগের, যে যুগ থেকে কেউ কেউ নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা চালান 'পূর্ববাংলার ভাষাতত্ত্ব' হাজির করে, অথচ যে যুগ তার নিরবচ্ছিন্ন প্রাণশক্তিরই প্রকাশ ঘটায় ভাষার প্রবহমানতার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।

০৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৮
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.