স্টার ওয়ারসের অনুপ্রেরণা ছিল সত্যিকারের যুদ্ধ

ইজেল

03 October, 2020, 12:45 am
Last modified: 03 October, 2020, 12:52 am
১৯৭৭ সালের গোড়ার দিকে, পরিচালক জর্জ লুকাস তার নতুন সিনেমা দেখাবার জন্য জনা কয়েক বন্ধু এবং সহকর্মীকে নিমন্ত্রণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পরিচালক জন মিলিয়াস, ব্রায়ান ডি পালমা ও স্টিভেন স্পিলবার্গের মতো চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। সিনেমাটির দৈর্ঘ্য বেশি, অভিনয়ও দুর্বল—তার ওপরে বিষয়বস্তুটাও ‍ছিল উদ্ভট। সঙ্গীদের সমালোচনার হুলে বিদ্ধ হতে লাগলেন লুকাস। ঠাট্টায় মেতে ওঠেন সুপারহিট সিনেমা ক্যারি-র পরিচালক ডি পালমা। একবার তো মাত্রা ছাড়িয়ে ডার্থ ভেডারের কণ্ঠস্বর পর্যন্ত নকল করে ইয়ার্কি করতে থাকেন।

জর্জ লুকাসের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগের বছর। শৈশব থেকেই যুদ্ধ নিয়ে মুগ্ধতা ছিল তার। সেই মুগ্ধতাকে পরবর্তীতে রূপ দেন এক মহাকাশ মহাকাব্যে।

স্টার ওয়ারস ফ্র্যাঞ্চাইজির স্পেস ফ্রেইটার মিলেনিয়াম ফ্যালকন সৃষ্টি হয়েছিল বি-৯৯ বোমারু বিমানের প্লেক্সিগ্লাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে। স্পেশাল ইফেক্ট শিল্পীরা পোস্ট-প্রোডাকশনে স্রেফ নীল পর্দাটি বদলে নিয়েছিল। শুটিংয়ের সময় অভিনেতারা গ্রহ-নক্ষত্র সামনে আছে কল্পনা করে নিয়ে অভিনয় করেছিলেন।

১৯৭৭ সালের গোড়ার দিকে, পরিচালক জর্জ লুকাস তার নতুন সিনেমা দেখাবার জন্য জনা কয়েক বন্ধু এবং সহকর্মীকে নিমন্ত্রণ করেন। প্রথমে তার পরিকল্পনা ছিল সিনেমাটি বানাবেন বাচ্চাদের জন্যে। তখন এর নাম ছিল 'অ্যাডভেঞ্চারস অফ দ্য স্টারকিলার, এপিসোড ওয়ান: দ্য স্টার ওয়ারস'। জর্জ লুকাস তার বে এরিয়ার বাড়িতে যাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তারা তার মতো লোকই ছিলেন। সবাই ছিলেন সফল চলচ্চিত্রনির্মাতা। কারও বয়সই পঁয়ত্রিশের বেশি ছিল না। এদের মধ্যে ছিলেন ১৯৭৩ সালে লুকাসের সঙ্গে 'আমেরিকান গ্র্যাফিতি'-তে কাজ করা দুই চিত্রনাট্যকার হুইক ও গ্লোরিয়া ক্যাটজ, পরিচালক জন মিলিয়াস, ব্রায়ান ডি পালমা ও স্টিভেন স্পিলবার্গ।

বি-২৯ যুদ্ধবিমানের ভেতরটা ছিল এরকম

সিনেমা শেষ হওয়ার পর অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে ঘরে। সিনেমাটির দৈর্ঘ্য যেমন বেশি, অভিনয়ও তেমনি দুর্বল—তার ওপরে বিষয়বস্তুটাও উদ্ভট। সঙ্গীদের সমালোচনার হুলে বিদ্ধ হতে লাগলেন লুকাস। প্রিন্সের লেইয়া-র চুল নিয়ে ঠাট্টায় মেতে ওঠেন সুপারহিট সিনেমা ক্যারি-র পরিচালক ডি পালমা। একবার তো মাত্রা ছাড়িয়ে ডার্থ ভেডারের কণ্ঠস্বর পর্যন্ত নকল করে ইয়ার্কি করতে থাকেন। সিনেমার শুরুতে ভেসে ওঠা ছয় অনুচ্ছেদের প্রারম্ভিক লেখাটাও রেহাই পায়নি তার সমালোচনার তির থেকে। পরে অবশ্য তিনিই সেটাকে তিন অনুচ্ছেদে নামিয়ে আনতে সাহায্য করেন। উপস্থিত অন্য কেউ অমন নির্দয়ভাবে সিনেমাটির সমালোচনা করেনি। অভ্যাগতদের মধ্যে সিনেমাটি নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী ছিলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। তবে একটা ব্যাপারে উপস্থিত সবাই একমত হন—মুক্তির আগে স্টার ওয়ারসে ব্যাপক পরিবর্তন-পরিমার্জন ও সংশোধন প্রয়োজন।

সিনেমাটির অসম্পূর্ণ সংগীতই পরবর্তীতে জন উইলিয়ামসকে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড এনে দেয়। প্রকৃতপক্ষে স্টার ওয়ারসের প্রায় সব বিশেষ আবহই অসম্পূর্ণ ছিল। সিনেমায় ইম্পেরিয়াল স্পেস স্টেশনে যে বিখ্যাত মহাকাশযুদ্ধটি দেখা যায়, সেটার অবস্থাও শোচনীয় ছিল প্রথমে। 

প্রথম কাটটি একত্র করার জন্য যুদ্ধের সময়কার বেশ কয়েক ঘণ্টার নিউজ-রিল ও সিনেমার ফুটেজ রেকর্ড করেন লুকাস। তারপর টুকরো অংশগুলো ১৬ মিলিমিটার ফিল্মে স্থানান্তরিত করেন। সিনেমায় মহাকাশযোদ্ধাদের দৃশ্যে জুড়ে দেন এই ভিন্টেজ শটগুলো। এর প্রতিক্রিয়া হলো মিশ্র। বহুদিন পরে এক সাক্ষাৎকারে হুইক বলেছিলেন,'এক মুহূর্তে উকিদের স্পেসশিপের দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল তো পরমুহূর্তে দেখা যাচ্ছিল টোকো-রি'র ব্রিজ-এর দৃশ্য। সবমিলিয়ে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা।'

প্রদর্শনীর পর আয়োজিত লাঞ্চে বসে ডি পালমা ঠাট্টা করে বলেন স্টার ওয়ারস বড়জোর ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার কামাতে পারবে। কিন্তু স্পিলবার্গ ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ছবিটি ১০০ মিলিয়নেরও বেশি আয় করবে। তিনি বলেছিলেন সিনেমাটিতে সারল্য আর আনাড়িপনার চমৎকার সমাবেশ ঘটিয়েছেন লুকাস। সে কারণেই দর্শক ছবিটি পছন্দ করবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেকটি দৃশ্য যা হুবুহ স্টারওয়ারসে অনুকরণ করা হয়েছে। যুদ্ধের প্ল্যানিং দৃশ্য

আজ আমরা জানি স্পিলবার্গ ঠিক ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন। আসলে তিনিও চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে বেশ কমিয়েই মন্তব্য করেছিলেন। এখন পর্যন্ত সিনেমাটি গোটা বিশ্বে ৭৭৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে। এরপর এর সিকুয়েল, স্পিন-অফ মিলিয়ে গত চার দশকে আয় করেছে আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার।

লুকাসের বাড়িতে মুক্ত-পূর্ব প্রদর্শনীতে সিনেমাটি কাউকে মুগ্ধ করতে পারেনি। অবশ্য দর্শকদের মুগ্ধ করা সেই প্রদর্শনীর আসল উদ্দেশ্য ছিল না। লুকাসের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সিনেমাটির দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করা। 

যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময়কার একটা ভিডিওর নিউজ-রিল ব্যবহার করা হয় স্টার ওয়ারসের একটি অ্যাকশন দৃশ্যে। বিদ্রোহীদের ডেথ স্টারে হামলা চালানোর দৃশ্যটি ভিডিওর ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৪০ সালে যেভাবে বিমান উড়ত, প্রায় একইভাবে পর্দায় উড়ে বেড়ায় কাল্পনিক স্পেসশিপগুলো।

প্রায় ৪৫ শট পর জেক পর্কিন্সের এক্স-উইং যোদ্ধা প্রথম দুর্ঘটনায় পড়ে। স্টারফাইটারের মৃত্যুর দৃশ্যটি ৩০ বছরেরও আগে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা জাপানি বিমান হামলার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। সে আক্রমণের ভিডিও ধারণ করেছিলেন ইউ.এস. নেভির এক ক্যামেরাম্যান। একটি জাপানিজ জিরোর পুড়ে যাওয়ার অন্তিম মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন তিনি। ভিএফএক্স শিল্পী পল হাস্টন পরবর্তীতে 'স্টার ওয়ারস স্টোরিবোর্ডস: দ্য অরিজিনাল ট্রিলজি' বইয়ে বলেন, জাপানি বিমানটির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখিয়ে সে অনুযায়ী দৃশ্য সাজাতে বলা হয়েছিল তাকে। 

১৯৫০-এর দশকে জর্জ লুকাসের যৌবন গড়ে উঠেছিল যুদ্ধের সিনেমা এবং হট রড অটোমবিলগুলোর প্রভাবে। এসবের প্রতি আগ্রহই তাকে স্টার ওয়ারস বানাতে উৎসাহ দেয়। ছবির ক্ল্যাইম্যাকটিক সিকোয়েন্সের এক্স-উইং ও ওয়াই-উইংয়ের যুদ্ধটি ব্রিটেন টিমের বিখ্যাত যুদ্ধ থেকে অনুপ্রাণিত। ১৯৪০ সালের সে যুদ্ধে সুপারমেরিন হকফায়ার ও হকার হারিকেন দিয়ে যুদ্ধ করেছিল ইংল্যান্ড। ১৯৬৯ সালে রুপালি পর্দায় আবার সেই যুদ্ধ ফিরিয়ে আনেন লুকাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের এসক্সে একটি যুদ্ধের পরিকল্পনা রুম

এই সিনেমার এক্স-উইং শিপটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কনসেপ্ট আর্টিস্ট কলিন ক্যান্টওয়েলের সঙ্গে আলোচনা করার সময় লুকাস তাকে বলে দিয়েছিলেন শিপটিকে যেন চিকন, চকচকে ও দ্রুতগামী দেখায়। এক্স-উইংয়ের মডেলটি নকল করা হয় ১৯৬০-এর দশকের রেভেল ১/১৬-এর ড্র্যাগস্টার মডেল কিট থেকে। রেভেল ১/১৬-এর ককপিট সিনেমায় মহাজাগতিক কোর্সেয়ার ফাইটারে পরিণত হয়। এর অদ্ভুত ডানাগুলোর নক্সা করেন ক্যান্টওয়েল। 

দশকের পর দশক ধরে লাঞ্চবক্স ও টি-শার্টে দেখা যায় ফটোজেনিক এক্স-উইংয়ের ছবি। যুদ্ধের সময়কার ম্যাগাজিনে ছাপা যুদ্ধরত বিমানের ছবিগুলো যেরকম জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, এক্স-উইংয়ের জনপ্রিয়তা তারচেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। ওয়াই-উইংও সমান জনপ্রিয়তা লাভ করে।

দ্বিতীয় স্টারশিপটি তুলনায় বেশ পুরনো, ধীরগতি এবং বড়। ভারী ওয়াই-উইংকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এই শিপটিকে উপস্থাপন করা হয়েছিল ১৯৪০-এর দশকের দ্রুতগতিসম্পন্ন বোমারু বিমানগুলোর আদলে। 

ওয়াই-উইংয়ের যমজ শিপের ককপিট বানানো হয়েছিল ৩০ বছর আগের পি-৩৮ লাইটনিংসের আদলে। লুকাসের সিনেমার প্রাণ ছিল ফাইটারগুলো। '২০০১' বা 'স্টার ট্রেক'-এর মতো স্টার ওয়ারসের স্পেসশিপগুলো অত চকচকে, নিখুঁত ছিল না। এ সিনেমার স্পেসশিপগুলো ছিল তোবড়ানো, ঝলসে যাওয়া। দেখতে অনেকটা ফ্রান্স আক্রমণে ব্যবহার করা পি-৪৭-এর মতো। পি-৪৭ কিছুদিনের মধ্যেই কাদা লেগে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। ওয়াই-উইংকে দেখতে যুগপৎ ভবিষ্যতের এবং মান্ধাতার আমলের স্পেসশিপের মতো লাগত। মনে হতো ভেনিস বিচের কোন টিনেজারের শখের তুবড়ে যাওয়া গাড়ি স্পেসশিপের রূপ নিয়ে মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছে বুঝি।

ইংল্যান্ডের পাইন উড স্টুডিও, এখানেই ফ্যালকনের ককপিট বানানো হয়। এই স্টুডিও এর আগেও সিঙ্ক দি বিসমার্কের সেট হিসেবে ব্যবহার হয়েছে

বিপরীতে ইম্পেরিয়াল শিপগুলো ছিল পরিষ্কার, মিশমিশে কালো এবং চোখা। তাদের চমৎকার টুইন আয়ন ইঞ্জিনের (টিআইই) নক্সা করা হয়েছিল লাফটওয়াফির মেসার্চমিট বিএফ 109-এর আদলে। এই মডেলের অসংখ্য বিমান তৈরি করেছিল জার্মানি। সিনেমায় ইম্পেরিয়াল শিপগুলো আক্রমণ করত অতর্কিতে, প্রবল গর্জনে, ঠিক যেভাবে জার্মানরা রয়্যাল এয়ার ফোর্সের পাইলটদের ওপর হামলা চালাত। 

ডেথ স্টারে আক্রমণের দৃশ্যগুলো চিত্রায়িত করা হয়েছে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের সিনেমাগুলোর মহাকাব্যিক মহাকাশযুদ্ধগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৯৫৪ সালের কোরিয়ান সিনেমা দ্য ব্রিজেস অ্যাট তোকো-রি-তে দেখা যায়, নেভি পাইলটরা উত্তর কোরিয়ার সুরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলোর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র দ্য ড্যাম বাস্টারস-এ আ এএফ ল্যাঙ্কাস্টার পাইলটদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁধের ওপর হামলা করতে দেখা যায়। ১৯৬৪ সালের সিনেমা ৬৩৩ স্কোয়াড্রন-এ আরএএফ মোস্কুইটো পাইলটরা নরওয়েতে একটা জার্মান রকেটের ওপর হামলা করে। এসব যুদ্ধ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই স্টার ওয়ারসের মহাকাশযুদ্ধগুলোর দৃশ্য সাজান জর্জ লুকাস।

রেবেল উইংয়ের আক্রমনে স্টার ওয়ারসের এক্স-উইং ফাইটার। এটাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে অনুপ্রাণিত

ডেথ স্টার অভিযানের অনেকটাই চিত্রায়িত হয়েছে ৬৩৩ স্কোয়াড্রন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ডেথ স্টারে হামলা ও রেডিও যোগাযোগের কৌশল ধার নেওয়া হয়েছিল দ্য ড্যাম বাস্টারস থেকে। বিদ্রোহী শিপগুলো জড়ো হওয়ার পর লুক স্কাইওয়াকার বাকিদের সাথে গলা মিলিয়ে নিজের অবস্থান জানায় 'রেড ফাইভ স্ট্যান্ডিং বাই' বলে। দ্য ড্যাম বাস্টারসে ল্যাঙ্কাস্টার পাইলটরা রেডিওতে বলে,'হিয়ার লিডার।' তারপরই, দুটো সিনেমায়ই, একজন অভিনেতা লক্ষ্যবস্তুর আকার দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে।

দুটো সিনেমাতেই, পরের দৃশ্যে স্কোয়াড লিডাররা লক্ষ্যের দিকে বাহন ছোটান। দ্য ড্যাম বাস্টারসে গাই গিবসন তার বন্দুকবাজকে জিজ্ঞেস করে,'ওদের কাছে কতগুলো বন্দুক থাকতে পারে, বলো তো, ট্রেভর?'

ট্রেভর জবাব দেয়, 'গোটা দশেক তো হবেই। কয়েকটা মাঠে আর কয়েকটা টাওয়ারগুলোতে।'

স্টার ওয়ারসে রেড লিডার ওয়াই-উইংয়ের পাইলটকে জিজ্ঞেস করেন,'কতগুলো বন্দুক থাকতে পারে বলো তো, গোল্ড ফাইভ?' 

জবাব আসে,'গোটা বিশেক হবে। কিছু মাটিতে, কিছু টাওয়ারে।'

বিদ্রোহীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়, আক্রমণ আরেকটু হলেই বিফল হতে বসেছিল। তাদেরকে বাঁচিয়ে দেয় মিলেনিয়াম ফ্যালকন। শিপটি আচমকা সূর্যের আড়াল থেকে উড়ে এসে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই কৌশলটিও বাস্তব বিমানযুদ্ধে বহুলচর্চিত। ফ্যালকন স্টারফাইটারদের তুলনায় অনেক ভারী ও বিশাল মেশিন। আর হ্যান সলোর সঙ্গে থাকা সবাই-ই জানত যে এটি তাদের স্পেসশিপের মতো দ্রুতগামী নয়। ফ্যালকনের ককপিট দেখতে অনেকটাই বোয়িং বি-২৯-এর কাচের নাকের মতো। এর আক্রমণের ধরনও অনেকটা বি-২৯-এর মতো।

১৯৪৫ সালে জাপানি কামিকাজি যুদ্ধ জাহাজে মার্কিন হরনেটের হামলা, যা মিলে যায় এক্স-উইংয়ের আক্রমণের সঙ্গে

১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে গিলবার্ট দ্বীপপুঞ্জের হামলায় অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের আঘাতে একটা জাপানি 'জিল টর্পেডো'তে আগুন ধরে যায়। জর্জ লুকাস এই আক্রমণের ছবিটি স্টার ওয়ারসে কাজে লাগান। 

স্টার ওয়ারস যেরকম বিষয়বস্তুর সিনেমা, সে তুলনায় ১১ মিলিয়ন বাজেট ছিল একেবারেই অপ্রতুল। ২০২০ সালের হিসেবে এই বাজেট ২০ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। বিপরীতে স্টার ওয়ারসের সর্বশেষ সিকুয়েল, ২০১৯-এর দ্য রাইজ অফ স্কাইওয়াকার-এর বাজেট ছিল ২৭৫ মিলিয়ন ডলার। টাকা বাঁচানোর জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার হথর্ন কোম্পানির বাতিল যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৭৬ সালের সিনেমায়। যাদের নজর কড়া, তারা একটু ভালোমতো লক্ষ করলেই বুঝতে পারবেন ফ্যালকনের বডি বানানো হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বিমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে। 

ফ্যালকনের আওয়াজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিমানের ইঞ্জিন থেকে ধার নেওয়া হয়েছিল। সাউন্ড ডিজাইনার বেন বার্ট ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি মোজাভে-তে এয়ার রেস দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে কয়েকটা বিমানের আওয়াজ রেকর্ড করার অনুমতি চান তিনি। অনুমতি পেয়েও যান। তার মাথার মাত্র ১৫ ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বিমানগুলো। বাহনগুলো এত দ্রুতগতিতে উড়ছিল যে বার্ট স্রেফ ওগুলোর ঝাপসা অবয়ব দেখতে পাচ্ছিলেন। স্টার ওয়ারসে ফ্যালকনসহ প্রায় সমস্ত স্পেসশিপের আওয়াজই মোজাভে থেকে রেকর্ড করে আনা বিমানগুলোর আওয়াজ থেকে নেওয়া হয়েছে। মহাশূন্যের আবহ সৃষ্টির জন্য বার্ট পি-৫১ মাস্টাংয়ের ইঞ্জিনের শব্দের গতি মন্থর করে দেন। সাথে যোগ করেন বজ্রপাতের শব্দ ও সিংহের গর্জন।

দি ড্রাম বাস্টার ছবির অনেক কিছু স্টার ওয়ারসে ব্যবহার করা হয়েছে

এসব খুঁটিনাটি উপস্থাপনের প্রতিদান পেয়েছিলেন জর্জ লুকাস। অ্যাকাডেমি পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্র সম্পাদক পল হার্শ তার স্মৃতিকথায় বলেন, স্টার ওয়ারসের প্রদর্শনী ছিল তার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর প্রদর্শনী।

তিনি স্মরণ করেন, ফ্যালকন যখন আলোকবেগে মহাশূন্যে ছুটছিল, উত্তেজনায় তখন দর্শকরাও লাফাচ্ছিল। এমন দৃশ্য তিনি এর আগে-পরে আর কখনোই দেখেননি। 

লুকাস তার সম্পাদককে বলে রেখেছিলেন সিনেমাটিতে আরও পরিবর্তন আনতে হতে পারে। কিন্তু সেই রাতে দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখে মৃদুভাষী লুকাস সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। 

হির্শ বলেন, স্টার ওয়ারসের বিশাল এক অংশ জুড়ে রয়েছে ১৯৪০-এর দশকের নৈতিক ধ্যান-ধারণাগুলো। সে কারণেই এমন অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে ছবিটি। কারণ কি বাস্তবে, কি কল্পনায় সিনেমার পর্দায়ও আমরা ভালো মানুষদের বিজয়ই দেখতে চাই।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.