সেই ঢাকার পুরনো অক্ষর

ইজেল

30 October, 2020, 11:05 pm
Last modified: 31 October, 2020, 11:10 am
উনিশ শতকের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত ঢাকার বেশিরভাগ পণ্যের দোকানপাটে কোনো সাইনবোর্ডের ব্যবহার ছিল না। জন্সটন হফম্যানের তোলা ১৮৮০এর দশকের চকবাজারের আলোকচিত্রে কোনো দোকানের উপরেই সাইনবোর্ড দেখা যায় না। ঢাকায় বাণিজ্যিক সাইনের ব্যবহার প্রথম শুরু হয় মূলত সোনা-রূপার কারিগরদের হাত ধরে।

সেই ঢাকা আর পুরনো অক্ষর 

১. 

সাইন বোর্ড বা নির্দেশকের ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয় তার সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। প্রাচীন মিশরীয়, রোমান ও গ্রিক সভ্যতায় সাইনবোর্ডের ব্যবহার দেখা যায়। প্রজাদের জন্য তৈরি রাজকীয় নানান দিকনির্দেশনা বড় আকারের পাথরে কিংবা টেরাকোটায় লিখে তা ঘোড়া বা গাধার পিঠে চাপিয়ে পুরো জনপদ ঘোরানো হত। আদিকালের রোম নগরীতে এধরনের পাথরে লেখা সাইনগুলো দোকানের নামফলক হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেকসময় দোকানের পার্শ্ববর্তী দেয়াল সাদা রঙ করে সেখানে ব্যবসার সংক্ষিপ্ত পরিচয় লেখা থাকত।

৮ম শতকে  ইউরোপের সড়কে সরাইখানা ও পানশালার অবস্থান জানানোর জন্য পিপার ছবিযুক্ত সাইন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।চীনেও সাইনবোর্ডের প্রচলন হয় আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগে। সে সময়কার White Rabbit নামের একটি সুঁইয়ের বিজ্ঞাপনী সাইনবোর্ডের নমুনা পাওয়া যায়, তবে এটা তৈরি হয়েছিল তামার পাত খোঁদাই করে। এসবের তুলনায় ঢাকা কিংবা পূর্ববঙ্গে সাইনবোর্ড প্রচলনের ইতিহাস অনেকটাই নবীন। 

ব্রিটিশ ভারতে চা এর প্রচারের জন্য ব্যবহৃত সাইন বোর্ড

২.

উনিশ শতকের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত ঢাকার বেশিরভাগ পণ্যের দোকানপাটে কোনো সাইনবোর্ডের ব্যবহার ছিল না। জন্সটন হফম্যানের তোলা ১৮৮০এর দশকের চকবাজারের আলোকচিত্রে কোনো দোকানের উপরেই সাইনবোর্ড দেখা যায় না। ঢাকায় বাণিজ্যিক সাইনের ব্যবহার প্রথম শুরু হয় মূলত সোনা-রূপার কারিগরদের হাত ধরে। ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর প্রকাশিত তাঁর "A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca" বইতে উল্লেখ করেছেন যে ১৮৪০ সালেই ঢাকায় প্রায় ৩০০ঘর এরকম কারিগর ছিল। তাদের তৈরি অলংকার যেমন চুড়ি, বালা, গলার হার, কানের দুল আর সুক্ষ ফিলিগ্রি কাজের আতরদান ও গোলাপজল দানির সুনাম ছিল সর্বত্র।  ব্যবসার প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজনে স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে তারা নিজ নিজ দোকানের/ প্রতিষ্ঠানের নামে ছোট ছোট সাইনবোর্ড আঁকিয়ে নিতেন। সাহায্য নিতেন দেয়াল লিখনেরও।তবে এসব সাইনবোর্ডের শৈল্পিক দিকগুলোপ্রাথমিক ভাবে উপেক্ষিতই ছিল।

সাইনবোর্ডের উৎকর্ষতা আসে ঢাকায় আসা আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে।পুর্ববঙ্গে পাটচাষের সমূহ সম্ভাবনার কারণে বহু আর্মেনীয় ব্যবসায়ী ঢাকা এবং নারায়নগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। পাটব্যবসার পাশাপাশি আরো কিছু বৃহৎ ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ করেন জি এম শিরকোর, জে এ মিনাস, সি জে মানুক,  আনানিয়া প্রমুখ আর্মেনীয় ব্যবসায়ী। ঢাকার বাংলাবাজার, পাটুয়াটুলী, শাঁখারীবাজার এলাকায় তারা চালু করেন 'ডিপার্ট্মেন্টাল স্টোর' জাতীয় ব্যবসা। 'মেসার্স আনানিয়া এন্ড কোম্পানি' ছিল ঢাকার মদের দোকান। শাঁখারীবাজারের 'জি এম শিরকোর এন্ড সন্স' ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে উনিশ শতকের ঢাকার সবচেয়ে বড় ডিপার্ট্মেন্টাল স্টোর। এই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ঢাকাবাসী বহু নতুন পণ্যের সাথে পরিচিত হয়। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্যহল ঘোড়ার গাড়ি, সিগারেট, সুগন্ধি সাবান ও চা। নগরবাসীর কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের বৃহদাকার সাইনবোর্ডগুলো ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বেশিরভাগ সাইন বোর্ডেই কাঠের বড় ও উঁচু হরফে (wooden raised letters) প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা থাকতো।

১৯৬০এর দশকে জিন্নাহ এভিন্যু (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিন্যু) এবং সেখানকার বাণিজ্যিক সাইনবোর্ড

৩.

চা এর প্রচারের জন্য শুরু থেকেই অভিনব সব সাইন বোর্ডের ব্যবহার দেখা যায়। টি বোর্ড গঠন করে ইংরেজরা চায়ের বিপনন কৌশলে ব্যাপক নতুনত্ব আনে। ভারতবর্ষের সর্বত্র বিভিন্ন ভাষায় চায়ের বিজ্ঞাপন সম্বলিত সাইনবোর্ড ছড়িয়ে দেয়া হয়। টিনের তৈরি এসব হাতে আঁকা সাইনবোর্ডে স্থান পেতো চায়ের উপকারিতা নিয়ে নানান তথ্য, এমন কি নানান ছড়াও।একটি সাইনবোর্ডের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়- উজ্জ্বল হলুদ রঙের এই সাইনবোর্ডের উপরে লেখা 'গরম চা', মাঝে চা পানরত ঘোমটা দেয়া এক বধূ, আর একদম নিচে ছড়া: "যাহাতে নাহিক মাদকতা দোষ, কিন্তু পান করে চিত্ত পরিতোষ।"

আরেকটি সাইনবোর্ডে চায়ের কাপ হাতে এক যুবকের ছবি, সাথে ছড়া- "থাকলে মায়ের, বাপের আশীর্ব্বাদ, ভাল চা আর কাপড় যায় না বাদ।" এই সাইনবোর্ডগুলো সাধারণত বসানো হত রেল স্টেশন আর শহরের চৌরাস্তাগুলোয় যেখানে বিনামূল্যে চা খাওয়ানোর সরকারি ব্যবস্থা থাকত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ঢাকার কোতোয়ালি, সুত্রাপুর আর লালবাগ এলাকায় এরকম 'চা-ওয়ালা' দেখা যেত। প্রতিদিন বিকালে তারা দুধ, চিনি দিয়ে চা বানিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বিতরণ করতেন।

১৯৬৭ সালে তোলা আলোকচিত্রে বায়তুল মোকাররম মসজিদ সংলগ্ন মার্কেটে নিওন সাইনের ব্যবহার

৪.

পাকিস্তান আমলে টিনের তৈরি সাইনবোর্ডের পাশাপাশি স্টিলের পাতের উপর সাইন লেখার প্রচলন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিকেন্দ্রিক কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঢাকাতেও ব্যবসা সম্প্রসারণ লেখার করে। এদের সাইনবোর্ডগুলোতে করাচির সাইনকেই অনুসরণ করা হত, তবে মূল নকশা অক্ষুন্ন রেখে উর্দুর পরিবর্তে বাংলায়/ইংরেজিতে প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হত।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার দাবীতে ছাত্রসমাজ তুমুল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ভাষা আন্দোলন মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডঃ মমতাজ উদ্দিন আহমেদের দেয়া তথ্যমতে এসময় ছাত্ররা অনেক ইংরেজি সাইনবোর্ডে আলকাতরা মেখে দিয়েছিলেন। বায়ান্নর পর থেকে ব্যাপক হারে বাংলা অক্ষরেই সাইনবোর্ড লেখা হতে থাকে। এসময় ঢাকায় সাইনবোর্ড লেখার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে; মিল্লাত, চালচিত্র, চ্যাম্পিয়ন, নেপচুন, এভারগ্রিন, রূপায়ন, প্রফুল্ল আর্ট তাদের অন্যতম। 

ঢাকাবাসীরা এই পেশাজীবী শ্রেণীকে 'আর্টিস্ট' নামেই চিনতেন। এসময়ে তৈরি সাইনবোর্ডগুলো আকারে বেশ বড় হতো। হাতে আঁকা এসব সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠানের নামের পাশাপাশি পণ্যের ছবিও স্থান পেতো। চশমার দোকানের সাইনে চশমা, চোখ, স্পিরিট ল্যাম্প, ঔষধের দোকানে চাঁদ কিংবা অন্য মেডিকেল চিহ্ন, রেকর্ডের দোকানে কলের গানের ছবি, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের কিংবা তার সারাইয়ের দোকানে রেডিও কিংবা চার পাসহটেলিভিশনের ছবির উপস্থিতি ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

১৯৭৫ সালে তোলা আলোকচিত্রে শাঁখারীবাজারের একটি গলি, পাশের দেয়ালে রেডিও মেরামতের বিজ্ঞাপন সম্বলইত সাইনবোর্ড, সাথে রেডিওর ছবি।

প্লাস্টিক কিংবা এক্রেলিককাটালেটারবসানো সাইনেজ সাইনবোর্ডের বাজারে এনেছিল নতুনত্ব।অনেক প্রতিষ্ঠানই সন্ধ্যার পর সাইনকে আলোকিত রাখবার জন্য মার্কারি ভেপার ল্যাম্পের ব্যবহার শুরু করে। প্রথমে মৃদুভাবে জ্বলতে শুরু করলেও অল্পসময়েই পুরো সাইনবোর্ড মার্কারি ল্যাম্পের আলোতে ভেসে যেত। বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য প্রসারের জন্য  নিওন সাইন আসে আরো পরে। লাক্স, কোকাকোলা প্রভৃতি পণ্যের বিজ্ঞাপনে বিলবোর্ড আকারে নিওন সাইন ব্যবহৃত হয়। পরবর্তীতে রমনা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং স্টেডিয়াম সংলগ্ন মার্কেটে অবস্থিত দোকানপাটের সাইনবোর্ডেও নিওন সাইনের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষায়িত কিছু দোকান গড়ে ওঠে যারা নিওন সাইন তৈরিতে ছিল দক্ষ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ওয়ারির ফোল্ডার স্ট্রিটের 'নিওন সাইন' এবং তৎকালীন জিন্নাহ এভিন্যু (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিন্যু) এর 'নিওন মারকারস'। 

দেশ স্বাধীনের পর সাইন তৈরির অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে; এদের কয়েকটির নাম- ওয়ান্ডার, মুক্তি আর্ট, উত্তরণ, উদয়ন, সাইনেজ ইত্যাদি। সাইনের ধরনেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। একসময় যে পুরানো ঢাকায় হাতে আঁকা টিন সাইনবোর্ড ছাড়া আর কোনো ধরনের সাইন দেখা যেতো না, এ যুগে সেখানেই ডিজিটাল প্রিন্টে তৈরি ভিনাইল কিংবা এলইডি সাইনের ছড়াছড়ি। নতুন ঢাকাতে সাইনের রকমফের আরো বেশি- ঝলমলে নিওন সাইন থেকে শুরু করে মেটালস্ট্রিপ সাইন, চ্যানেল সাইন, এরকম কত কি!

নওয়াজেশ আহমেদের ক্যামেরায় ঢাকার ইসলামপুর, ১৯৭০, দু’পাশে হাতে আঁকা সাইনবোর্ড

৫.

পুরাতন সাইনবোর্ড নিঃসন্দেহে নগর ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারক। কিন্তু ক্রমাগত বদলে যাওয়া আমাদের এই  নগরেশতবর্ষী কোনো বাণিজ্যিক সাইনের কি দেখা পাওয়া সম্ভব? পাঠক মাত্রই জানেন – এটা অনেকটা অসম্ভব। বিগত একশত বছরে এই ভূখণ্ড তার পরিচয় পাল্টেছে দু'বার- ব্রিটিশ-ভারতের পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ। বহু ব্যবসার মালিকানা বদলেছে, বদলেছে ব্যবসার ধরন।

জন্সটন হফম্যানের তোলা আলোকচিত্রে ১৮৮০এর দশকের চকবাজার

বদলে গেছে ঠিকানা, আদি স্থাপনা যে ভবনে ছিল তাও হয়তো ভেঙে পড়েছে। সাথে বাতিল হয়েছে পুরাতন সাইনবোর্ডগুলো। চমৎকার বাংলা নামধারী কিছু প্রতিষ্ঠান হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে, সাথে হারিয়েছে পুরাতন সাইনবোর্ডে পরম মমতায় আঁকা অপূর্ব সব বাংলা লিখনশৈলী। হারানো কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম এখনো হয়তো টিকে আছে কিছু মরচেধরা পরিত্যাক্তসাইনবোর্ড কিংবা দেয়াল লিখনে। ইসলামপুর সড়কের এক দেয়ালে উৎকীর্ণ সাইন "লায়নে চলিতেছে" আজও তাই পথচলতি মানুষকে নিয়ে যায় তার হারানো সময়ে, যেখানে স্মৃতি হয়ে দিব্যি টিকে আছে আমাদের 'লায়ন সিনেমা'।

দেয়াল জুড়ে ও এখন বিজ্ঞাপন থাকে, সাইনবোর্ড পাল্টে গেছে...

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.