রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ
সময়টা ছিল বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিউটি পারলার, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট আর কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে ওঠার। পাড়ায় পাড়ায় ভিসিআর, রঙিন টেলিভিশন আর ভিএইচএস ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া দেবার জন্য ভিডিও ক্লাব আর ভিডিও গেমসের দোকানও গড়ে উঠছিল অগণিত হারে। সংখ্যায় খুব অল্প হলেও এই সময়ে দেশে আরেকটা জিনিস চালু হয়—সেটা আইসক্রীমের দোকান।
দেশে কাঠির ওপর শক্ত রঙিন বরফ লাগানো আইসক্রীম আর পাতলা কাগজের প্যাকেটের ভেতরে কাঠি লাগানো একটু নরম দুধ-মালাই আইসক্রীমের বাইরে কাপে করে বিভিন্ন স্বাদের-রঙের সত্যিকারের আইসক্রীম নিয়ে আসে 'ইগলু'। 'পোলার' আসে আরও পরে। ইগলুরা নয়াপল্টনে একটা আইসক্রীমের দোকান দিয়েছিল 'IGLOO 21' নামে। আমাদের এক সহপাঠী সেটাকে বলেছিল 'ইগলুহা'। ব্যাস্!সেই থেকে আমাদের কাছে ঐ দোকানের নাম হয়ে গেলো- ইগলুহা।
আশির দশকের শুরুতে ইগলুর একচেটিয়া রাজত্বে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী আসলো কোন্ আইসক্রীম। ছোটছোট দোকানে আইসক্রীম ভেন্ডিংমেশিন বসিয়ে মূলত চকোলেট, ভ্যানিলা আর স্ট্রবেরি ফ্লেভারের নরম কোন্ আইসক্রীম বিক্রি করা হতো। কোন কোন দোকানীকে বলে একটাই মিক্সড ফ্লেভারের কোন্ আইসক্রীম পাওয়া যেতো। কোন্আইসক্রীমের দোকানের একটা ব্রান্ড ছিল 'স্নোহোয়াইট'। পরে অবশ্য তারা অন্যসব আইসক্রীমও এনেছিল।
স্নোহোয়াইটের একটা দোকান ছিল মগবাজার মোড়ের কাছাকাছি নিউ ইস্কাটন রোডের ডানপাশে, আরেকটা মনে পড়ে সোবহান বাগমসজিদ মার্কেটের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। ইস্কাটনের স্নোহোয়াইটে তিনটা মেশিন ছিল। যেখানে সারা সপ্তাহ দুইটা মেশিনে ভ্যানিলা আর চকোলেট আইসক্রীম বেচা হতো। আরেকটা মেশিনে রোববারে স্ট্রবেরি, মঙ্গলবারে অরেঞ্জ আর শুক্রবারে পিস্তাচু ফ্লেভারের আইসক্রীম বেচা হতো। আমরা কোন্ আইসক্রীম খেতে পেতাম কালেভদ্রে। যেখানে স্কুলের সামনে ১০, ২৫ আর ৫০ পয়সা দামের আইসক্রীম পাওয়া ,যায় সেখানে ১০টাকা দামের কোন্ আইসক্রীম কে খাওয়াবে!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে 'ভিসিআর' নামটা প্রথম শুনতে পাই। সেটা কী জিনিস দেখা দূরে থাক, ধারণাও ছিল না। কেবল জানতাম ভিসিআরে হিন্দী সিনেমা দেখা যায়। অবশ্য ফৌজী এলাকার সিনেমা হলগুলোতেও হিন্দী বা ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখা যেতো।
একবার বোনেরা বড়মামার সাথে গিয়ে 'বৈজুবাওরা' দেখে এসেছিল। ফৌজী এলাকার সিনেমা হলগুলোর জন্য আইনটা বোধকরি ভিন্ন রকমের ছিল। একবার মায়ের সাথে শপিং-এ গিয়ে দেখি এক লোক একটা ছোট টুলে বসে জোরে জোরে কী এক অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করছে। তার হাতে ছোট ছোট সাদা কাগজের টুকরো, তাতে নীলরঙের সীল মেরে কী সব যেন লেখা।
মা'কে জিজ্ঞেস করতে জানা গেলো মার্কেটের তিনতলা না চারতলাতে ভিসিআরে হিন্দী সিনেমা দেখানো হবে, লোকটা সেই টিকিট বিক্রি করছে। আমি ভয়ে ভয়ে লোকটাকে টিকিটের দাম জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে ৮০টাকা শুনে বুঝলাম টিকিট কেটে ভিসিআরে হিন্দী সিনেমা দেখার আবদার করা- আমার পক্ষে দুঃস্বপ্নেও সম্ভব না।
ভিসিআরে হিন্দী সিনেমা দেখার সুযোগ পেতে পেতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে গেছি। তখন ভিসিআর ভাড়া দেয়া হতো, সাথে তিনটা ক্যাসেট। দাম বোধকরি দুই বা আড়াইশ' টাকা হবে। সাথে রঙিন টেলিভিশন নিলে পাঁচশ টাকা। তখন ঘরে ঘরে ফিলিপস্ বা ন্যাশনাল প্যানাসনিকের ২০ ইঞ্চি বা ২৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি। পাঁচশ টাকা খরচ করে রঙিন টেলিভিশনের বিলাসিতা করা সম্ভব না, তাই বাসার সাদাকালো টিভিই সই!
পয়সা ওসুল করার জন্য সারারাত জেগে পরপর তিনটা সিনেমা দেখা হতো। কুরবানি, মুকাদ্দার কা সিকান্দার, শোলে, নিকাহ্, ইনসাফকা তারাজু…। সারা রাত সিনেমা দেখে পরদিন ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে বসে ঢুলতে হতো। একবার তো মাসুম ক্লাসের লো-বেঞ্চে শুয়ে ঘুমিয়েই পড়লো। শেষে ছুটির পরে তার ঘুম ভাঙে। সেই ঘুমও ভাঙতো না। নিতান্ত শাকিলের পরামর্শ মোতাবেক মাসুমের প্যান্টটা খুলে নিতে গেলে, বিপত্তিটা হয়ে যায়।
এক বাসায় ভিসিআর চললে বাইডিফল্ট প্রতিবেশীরাও সেখানে আমন্ত্রিত থাকতেন। আবার মাস শেষে ২৫ টাকা বা ৩৫ টাকা টাকা জমিয়ে, সেসব সিনেমার গানের ক্যাসেট কেনা হতো। বড়দের কেউ কখনো উলটোরথ, আনন্দলোক, ফিল্মফেয়ার, স্টারডাস্ট বা সিনেব্লিৎজ পত্রিকা নিয়ে আসল্ গোপনে সেগুলোর ছবি দেখা হতো। কিন্তু পত্রিকা গোপনে দেখতে হবে কেন? ওমা, একি কথা! সিনেমার পত্রিকা পড়লে বাচ্চারা খারাপ হয়ে যাবে না!
ভাড়া করা ভিসিআরে সিনেমা দেখার কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় আছে। প্রথমত, ভিসিআরের সাথে একজন অপারেটর আসতেন, যিনি বাসার কাউকে ভিসিআরে হাত দিতে দিতেন না। কেউ কোন গান বা মারামারির দৃশ্য রিওয়াইন্ড করে দেখতে চাইলে অপারেটর তার মর্জি মতো প্রায়ই অমন আবদার নাকচ করে দিতেন। ভিএইচএস ভিডিও ক্যাসেটগুলো আসতো ইউএই'র 'আল মনসুর ভিডিও' বা 'কিংস ভিডিও' থেকে। সেই ক্যাসেটের পিকচার কোয়ালিটি সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য।
দেখা গেল, স্ক্রীনের উপরের দিকে ছবিগুলো কয়েক ধাপে বেঁকে কেমন যেন গলে গেছে। ফলে অমিতাভ বচ্চনের মাথা গলে গিয়ে ধর্মেন্দ্র'র প্রেমিকা হেমা মালিনীর মাথার সাথে মিশে এক অসৈরণ অবস্থা সৃষ্টি করছে। অথবা স্ক্রীনের নিচের দিক থেকে একটা চওড়া কালো ব্যান্ড উপরের দিকে উঠতে উঠতে মাঝ বরাবর এসে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
ফলে রজনীকান্ত আকাশের দিকে সিগারেট ছুঁড়ে কোমরের কাছ থেকে গুলি করে তাতে আগুন ধরানোর কালে গুলিলক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর দশ সেকেন্ড পর আবার নিচ থেকে কালো ব্যান্ডটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করতো। কপাল খারাপ হলে সিনেমা দেখার মাঝপথে ইলেকট্রিসিটি চলে যেতো। এতে ডাবল আফসোস। এক, তিনটা সিনেমা দেখা হলো না। দুই, পয়সা পুরোপুরি ওসুল করা গেলো না।
প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় কয়েকটা ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে ফিরতেন। এর বাইরে বাণিজ্যিকভাবে দেশে ভিডিও ক্যাসেট আনার জন্য সোবহানবাগের 'ফিল্মফেয়ার ভিডিও' আর বনানীর 'রোজভ্যালি ভিডিও' বিখ্যাত ছিল। পাড়ায় পাড়ায় কেরোসিন কাঠের সরু ফালি উলম্ব সারিতে সাজানো এক অদ্ভুত ইন্টেরিয়রের ভিডিও ক্লাব ছিল। শ'দুয়েক টাকা খরচ করে সেটার সদস্য হলে দশ টাকায় একটা ক্যাসেট ২৪ ঘন্টার জন্য ভাড়া আনা যেতো। কিন্তু ক্যাসেট ভাড়া করবে কয়জন! তখনো তো 'আকাই' বা 'ফুনাই' ব্রান্ডের সস্তার ভিসিপি বাজারে আসেনি। তবু কোন উপায়ে ভিসিআর জোগাড় করে ক্যাসেট ভাড়া আনা হতো।
দিলু রোডের ভেতরে কয়েকটা ভিডিও ক্লাব ছিল, যেগুলোর নাম মনে নেই। সেগুলো কিছুদিন পরপর সদস্যদের জমার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যেত। পরে অন্যকেউ আবার নতুন নামে সেটা শুরু করতো। তখন নতুন করে ফী দিয়ে সদস্য হতে হতো। সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারের কাছে থাকা 'টিভোলি' ভিডিও টিকে ছিল অনেক দিন—যত দিন না ফাস্টফুড ব্যবসা এসে ভিডিও ক্লাবের ব্যবসাকে ব্যাকডেটেড বানিয়ে ফেলে। টিভোলি উঠে গিয়ে সেখানে ফাস্টফুডের দোকান 'ফুডশপি' দেয়া হয়। সেসবের গল্প অন্য কোন একদিন করা যাবে।