রোদের ঘ্রাণ আর বাতাসের রঙ

ইজেল

16 January, 2021, 09:40 am
Last modified: 16 January, 2021, 12:31 pm
আলেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ানরা যদি এখনো বেঁচেও থাকেন তাঁদের আগের গানের গলা নিশ্চয়ই আর অবশিষ্ট নেই। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিনোদনের হাজারোটা উপায় বের হয়ে যাওয়া, মানুষের রুচির পরিবর্তন আমার পালা গানের জগতটিকে অলঙ্ঘ্যনীয় দূরত্বে নিয়ে গেছে।

সারা রাত চলে একি রঙের খেলা

আমাদের দেশ বৃষ্টিপ্রধান বলে খোলা জায়গায় আয়োজন করতে হয় এমন অনুষ্ঠানের অনেকগুলোই শুকনো মৌসুমের জন্য তুলে রাখা হয়। যে সময়ে আজকের মতো সারা বছর ধরে বিনোদনের হাজারোটা উপায় খোলা ছিল না তখন আমরা হেমন্তের জন্য অপেক্ষা করতাম যখন থেকে একটার পর একটা বড় বড় অনুষ্ঠান শুরু হবে। এসব অনুষ্ঠানের কোনটি আগে আর কোনটি পরে আয়োজন করা হতো সেসব আর স্পষ্ট মনে নেই, তবে সেগুলোর অনেক কিছুর কথা মনে আছে। হেমন্তে ধান কাটা শেষ হলে দেশজুড়ে যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ, পালা গান শুরু হয়ে যেত। অনেক জায়গায় স্থানীয় লোকজন নিজেদের উদ্যোগে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। কোথাও কোথাও ওয়াজ মাহফিল আর ওরশ আয়োজন করা হতো। সরকারি উদ্যোগে জেলায় জেলায় 'স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও পরিবার-পরিকল্পনা' বিষয়ক প্রদর্শনী হতো যেটি আসলে এখনকার মীনা বাজারগুলোর সাথে তুলনীয় একটা আয়োজন। আমরা সেটাকে বলতাম 'এক্সিবিশন'। ঢাকার শেরে বাংলা নগরে 'রপ্তানী মেলা' হতো যেটি আজকের সারা জাগানো 'ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা'র পূর্বসুরী। সারা দেশে স্কুল-কলেজে 'জাতীয় বিজ্ঞান সপ্তাহ' নামে বিজ্ঞান মেলা হতো যেখানে সর্বসাধারণ বিভিন্ন প্রজেক্ট দেখতে যেতেন।

যাত্রার সিরাজ আনোয়ার হোসেন

শহর ও গ্রাম দুই অঞ্চলেই যাত্রা পালার প্রদর্শনী হতো। শহুরে যাত্রা পালায় অমলেন্দু বিশ্বাস, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, সর্বরী দাশগুপ্তের মতো যাত্রার প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছাড়াও প্রায়ই চলচ্চিত্রের নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করতেন। রেডিওতে বা সংবাদপত্রে যাত্রার বিজ্ঞাপনে বলা হতো – 

যাত্রা! যাত্রা!! যাত্রা!! 
আজ রাত এগারোটায় কলাবাগান লেকসার্কাস ময়দানে 'অমুক' অপেরার যাত্রাপালা
'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'

এই 'অমুক' অপেরার মধ্যে নিউ গণেশ অপেরা, বাবুল অপেরা, সোনালী অপেরার নাম মনে পড়ে। কলাবাগানে 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' মঞ্চস্থ হলে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে নবাবের চরিত্রে খোদ চলচ্চিত্রাভিনেতা আনোয়ার হোসেন অভিনয় করবেন। এসব যাত্রাপালার কোথাও কোথাও বিজ্ঞাপনের নিচের দিকে 'বিশেষ নৃত্য পরিবেশনায় ০০৭ প্রিন্সেস লাকী খান'-এর উল্লেখ দেখা যেত। এই ব্যাপারটি কী সেটি জানতে অনেক বছর লেগে গিয়েছিল। বিশেষ নৃত্যের শিল্পীদের কেন 'প্রিন্সেস' বলা হতো সেকথা যেমন কখনো জানতে পারিনি তেমন লাকী খানের নামের আগে কেন জেমস বন্ডের মতো '০০৭' ব্যবহার করা হতো সেই রহস্যও কোনদিন ভেদ করতে পারিনি। যাত্রা পালা রাত এগারোটা বা তারও পরে শুরু হয়ে ভোর রাত পর্যন্ত চলতো বলে আমাদের পক্ষে যাত্রা দেখতে যাবার উপায় ছিল না। তাছাড়া কী কারণে যেন যাত্রা সম্পর্কে একটা ভিত্তিহীন খারাপ ধারণা ছিল।  আমরা বড়দের বলতে শুনতাম 'যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে'। এই 'ফাত্রা' মানে কী না জানলেও সেটি খারাপ কিছু হবে বলে ধারণা করতাম। অথচ এমন কথা বলিয়ে বড়দের অনেকেই যাত্রা দেখতে যেতেন। এক তুতো ভাই আলাউদ্দিন ভাইয়ের সহায়তায় আমি প্রথম বার যাত্রা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম – তাও ঢাকার বাইরে, দাউদকান্দিতে। আলাউদ্দিন ভাই ও সেখানকার অন্যান্য দর্শকেরা অবশ্য পালাটিকে 'যাত্রা' বলতে নারাজ, তাঁদের ভাষায় ওটি হচ্ছে 'বই'।  সেখানে আমরা 'পাগলা রাজা' পালা দেখেছিলাম। যেদিন আমরা যাত্রা পালা বা 'বই' দেখি তার আগের দিন বহুল জনপ্রিয় 'গুনাই বিবি'র পালা ছিল। সেটি দেখতে না পাবার জন্য কিঞ্চিত আফসোস ছিল, কারণ সেখানে সবার মুখে মুখে ফেরা একটি গান ছিল।

"দাদা আর যাব না ঐ ইশকুলেতে
ঐ ইশকুলেতে যেতে গেলে দাদা
দাদা সম্মান বাঁচে না।
ঐ ইশকুলের তোতা মিয়া
দাদা গো দিল মোরে গালি রে
দাদা আর যাব না ঐ ইশকুলেতে"॥

আমি অবশ্য প্রথম বারের মতো যাত্রা দেখার উত্তেজনায় উত্তেজিত ছিলাম। চারপাশে টিনের বেড়া, উপরে চট আর ত্রিপলের অতি উঁচু চাঁদোয়া দেয়া যাত্রার প্যান্ডেল দেখতে বিশাল একটা তাঁবুর মতো। ঢোকার আগে টিকিট ঘর তারপরে বাঁশ দিয়ে গোলকধাঁধার মতো করে প্রবেশ পথ — যেন হুড়মুড় করে ঢোকা না যায়। ভেতরে নানা শ্রেণীর দর্শকদের বসার ব্যবস্থা — চেয়ার, বেঞ্চি, মাদুর, চট এবং ঘাসের মাঠ। তিন দিক খোলা মঞ্চ, গ্রীন রুম, সেখান থেকে মঞ্চে ওঠার ব্রিজ, গ্রীন রুমের পেছনে যাত্রার লোকজনের থাকার অস্থায়ী কক্ষ, শৌচাগার পর্যন্ত আছে। মঞ্চের একপাশে বাদক দল বসেন —ট্রাম্পেট, ক্ল্যারিনেট, ব্যাগ পাইপ, বাঁশী, হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোলের মতো নানা রকমের তালবাদ্য, বেহালা, দোতারা, সিম্বাল কী নেই সেখানে! মঞ্চের চারধারে আর দর্শকদের আসনের জায়গায় জায়গায় হ্যাজাক লাইট লাগানো। সে হ্যাজাকের তেলের ট্যাংকটা নিচের দিকে নয়, উপরের দিকে। ফলে ম্যান্টেলঢাকা চিমনিটা নিচের দিকে থাকায় দেখতে লাইট বালবের মতো মনে হতো, যার সাদা আলোর তেজ হাজার ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাল্বের চেয়ে বেশি। হ্যাজাকগুলো দড়ি আর কপিকল দিয়ে টেনে ছাদের কাছাকাছি উঁচুতে তুলে রাখা হতো। একজন মানুষ কিছুক্ষণ পরপর দড়ি ঢিলে করে দিয়ে হ্যাজাক নামিয়ে পাম্প করে আলোর তেজ বাড়িয়ে দিতেন বা তাতে কেরোসিন ঢালতেন। নিঃসন্দেহে কাজটি অতি বিপদজনক। আমাদের কপাল ভালো যে আমরা কোন দুর্ঘটনায় পড়িনি। যে আমলে সিনেমা হলে গিয়ে দশ টাকার চেয়ে কমে সিনেমা দেখা যেত, খুব বোধগম্য কারণে সেই আমলে যাত্রা দেখতে তারচেয়ে বেশি টাকা লাগতো।

শীতের রাতেই হতো জমজমাট যাত্রাপালা

পালার শুরুতে দেখা গেল একদল মেয়ে লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পরে খোঁপায় গাঁদা ফুলের মালা জড়িয়ে একটি দেশাত্মবোধক গান গাইলেন — এটি বোধকরি উদ্বোধনী সঙ্গীত। এরপর উচ্চ নিনাদে নানা রকমের বাঁশি, তালবাদ্য বেজে উঠল। বাজনা থেমে যেতে মূল পালা অভিনয় শুরু হলো। কাহিনী অনুযায়ী মঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রবেশ করতে বা প্রস্থান করতে লাগলেন। দুটো দৃশ্যের মাঝখানে চলচ্চিত্রের চটুল ও কিঞ্চিৎ আদিরসাত্মক গানের সাথে নৃত্যশিল্পীরা একক বা যুগল নৃত্য পরিবেশন করেন। সেই নাচের ফাঁকে ফাঁকে কৌতুকের স্কিট থাকে। এই সময়ে আমি আশেপাশের দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। কেউ কেউ গান-নাচের তালে উদ্বেলিত হয়ে নিজেরা নাচ জুড়ে দিলেন বা দাঁড়িয়ে নানা অঙ্গভঙ্গী শুরু করলেন, আরেক দল এইসব 'বাজে' জিনিস দিয়ে 'বই' নষ্ট করা হচ্ছে বলে উষ্মা প্রকাশ করতে লাগলেন। যাই হোক, আবার অভিনয় শুরু হলে সবাই শান্ত হয়ে বসে পড়েন। করুণ দৃশ্যে যখন পাত্রপাত্রী মর্মান্তিক সুরে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান গেয়ে ওঠেন -  

"সালাম পৃথিবী, তোমাকে সালাম
দুনিয়াকে করেছ, টাকার গোলাম"
অথবা
"শূন্য হাতে আজ এসেছি নেই যে কিছু আর
অশ্রু ভেজা এ'গান আমার দিলাম উপহার"

তখন কাউকে কাউকে 'আহা! আহা!' বলতে আর কাউকে কাউকে চোখ মুছতে দেখলাম। কাহিনীর কঠিন দৃশ্যগুলোতে হঠাৎ করে একজন মানুষ হাজির হয়ে অতি উচ্চস্বরে খোঁনা গলায় "এই মতলব তুই ছাড় রে বেভুল, এই মতলব তুই ছাড়" জাতীয় গান গেয়ে উঠে পালার অত্যাচারী বা লম্পট চরিত্রকে নিবৃত্ত করেন। এই শীতের মধ্যেও তিনি খালি গায়ে, পরনে হাঁটুজোকা একটা কাপড় লুঙ্গীর মতো করে পরা। গায়ে ছাই বা মাটি জাতীয় কিছু লাগানো আছে। তিনি কাহিনীর কোন চরিত্র নন্‌, পরে জানলাম তাকে 'পালার বিবেক' বলা হয়। কাহিনী ঘন্টা দুয়েক চলার পরে লোকজনের যখন খিদে পেয়ে গেল তখন একজন শিল্পী মঞ্চে উঠে চমৎকার কণ্ঠে মাইজভাণ্ডারীর গান গাওয়া শুরু করলেন।

"দেখে যারে মাইজভাণ্ডার, দেখে যারে
দেখে যারে মাইজভাণ্ডার, হইতাছে নূরের খেলা
নূরী মাওলা বসাইলো, প্রেমের মেলা"।।
অথবা
"দুই কুলে সুলতান ভাণ্ডারীর দুই কুলে সুলতান
এ'সংসারে কে আছে আর এমন দয়াবান"।।

আমরা খেতে তাঁবুর বাইরে এসে দেখি খাবারের আয়োজন আসলে বিশেষ কিছু নেই - চা, পুরী, ঝালমুড়ি, মুরলী, বাদাম ভাজা, বনরুটি, কলা। একটা জায়গায় দেখি বেশ ভীড়। কেন ভীড় আমি দেখতে চাইলে আমার মহাজন আলাউদ্দিন ভাই প্রবল আপত্তি জানালেন। আমি জোরাজুরি করায় তারপর দেখতে দিলেন ঘটনা কী। দেখি কিছু লোক মাটিতে বিশাল একটি অয়েলক্লথ বিছিয়ে রেখেছে যাতে ছয়টি ঘর আঁকা। একেক ঘরে একেক ছবি – ময়ুর, ঘোড়া, বাঘ, নর্তকী এমন সব। পাশে একজন শক্ত বোর্ডের বিশাল একটি ডিস্ক নিয়ে বসেছেন। ডিস্কটিতে কেন্দ্রাভিগ রেখা টেনে বোধকরি ছত্রিশটি ঘর আঁকা (মোট ৩৬০ ডিগ্রী হিসাবে আন্দাজে বললাম), প্রত্যেকটি ঘরে ঐ অয়েলক্লথের কোন না কোন ছবি এক বা একাধিকবার আঁকা। ডিস্কের পরিধি বরাবর ছোট ছোট পেরেক গাঁথা। ডিস্কটিকে তার কেন্দ্রে গাঁথা শ্যাফট-বিয়ারিং-এর সাহায্যে ঘুরালে পরিধির পেরেকগুলো বাইরে থেকে বাড়িয়ে দেয়া হাতের মতো একটি ইস্পাতের পাতকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।  লোকজন দেখি অয়েলক্লথের ছবিগুলোর একেকটির ওপর টাকা ফেলে বাজি ধরছে। বাজির টেনশনে খেলোয়ারের একের পর এক সিগারেট বা বিড়ি ধরিয়ে চারপাশ ধোঁয়াচ্ছন্ন করে ফেলেছেন। বাজি ধরা শেষ হলে ডিস্কটি প্রবল বেগে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ডিস্ক একসময় থেমে যায়, পাতটি যে ঘরে থামে সেই ঘর বিজয়ী। সেই ঘরে যে ছবি যত সংখ্যক বার আছে ঐ ঘরের লোকজন তাদের বাজীর ততগুণ টাকা পাবে। অনেকটা রুলেতের মতো ব্যাপারস্যাপার। লোকজন দেখি এটিকে 'কান্নিমেল' (কার্নিভ্যাল) বলছে। আমি গোটা ব্যাপারটি কয়েক বার দেখেই ধরে ফেলতে পারলাম, কিন্তু লোকজন যাত্রা পালা ফেলে রেখে এই সৃষ্টিছাড়া খেলা কেন খেলছে সেটি বুঝতে পারলাম না। জানা গেলো এই 'কান্নিমেল'-এর সাথে যাত্রার লোকজনের কোন সম্পর্ক নেই, স্থানীয় কতিপয় 'যুবক' নিজ উদ্যোগে এই ব্যবস্থা করেছে। এসব 'যুবক'দের ঠেকানোর ক্ষমতা যাত্রার লোকদের নেই তাই নির্বিঘ্নে 'কান্নিমেল' চলছে। ভোর হতে হতে খেলোয়ারদের কারো ফসল বেচা, কারো দুধ বেচা, কারো মাছ বেচা, কারো ক্ষেতমজুরীর, কারো ঘরের জিনিস বেচা টাকা 'কান্নিমেল'-এর উদ্যোক্তাদের পকেটে চলে যায়। 

আমরা 'কান্নিমেল' রেখে চা-পুরী খেয়ে আবার পালা দেখতে গেলাম। পালার শেষাংশে নাচ-গান-কৌতুক আর নেই। যেহেতু 'বই'য়ের কাহিনী দর্শকদের প্রায় সবার জানা তাই যাদের বাড়ি অনেক দূরে তারা পালা শেষ হবার আগেই উঠে পড়লেন। সেদিন শেষ রাতের কিছু আগে পালা শেষে গোয়ালমারী বাজারের কাছ থেকে আলু ক্ষেতের ওপর দিয়ে গাবুরাকান্দির দিকে হেঁটে যেতে যেতে 'নক্ষত্রের রূপালী আগুনভরা' আকাশে সম্ভবত কালপুরুষ আর ক্যাসিওপিয়া দেখেছিলাম। কুয়াশার পাতলা চাদর ভেদ করে তারার আলোও যে পথ আলোকিত করতে পারে সেটা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এমন তারাভরা আকাশ আরও অনেক পরে ফরিদপুরে আর নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপে দেখেছিলাম। সেদিনের যাত্রা পালার কথা মনে হলে আজো আমার কড়া মেকআপ দেয়া ঝলমলে পোশাকপরা নায়ক-নায়িকার বদলে চাদর দিয়ে কান-মাথা-শরীর ঢাকা পালার দর্শকদের ক্ষেতের আল ধরে 'চলমান অশরীরি'র মতো কুয়াশায় মিলিয়ে যেতে দেখার দৃশ্য মনে পড়ে।

যাত্রা শিল্পী হিসেবে অমলেন্দু বিশ্বাসের কিংবদন্তীতূল্য খ্যাতি ছিল

শীত যখন ঠিক জাঁকিয়ে বসতো না সেই সময়টিতে এককালে সারা রাত ধরে এক রকমের গান হতো যেখানে মূলত দুজন গায়ক পালাক্রমে গাইতেন। প্রত্যেক গায়কের সাথে তার নিজস্ব বাদক দল থাকত। বাদকেরা আবার গানের মধ্যে ধুঁয়াও ধরতেন। গায়ক সাধারণত দোতারা বাজাতেন। বাদক দলে একতারা, হারমোনিয়াম, খঞ্জনী, ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র থাকত। গায়কের দলে প্রায়ই তার পরিবারের সদস্যরাও থাকতেন। গান হতো বিষয়ভিত্তিক। সাধারণত আয়োজকরা আগেভাগে বলে দিতেন কোন বিষয়ে গান হবে। কখনো কখনো গায়কদের একজন উঠে তিনটি বা চারটি অপশন শ্রোতাদের সামনে পেশ করতেন। শ্রোতাদের কণ্ঠ ভোটে বিষয় নির্ধারিত হতো। গানের বিষয় হতো দ্বন্দ্বমূলক। কারণ, এই পালা গান আসলে গানের মাধ্যমে বিতর্ক যা সাধারণত রাত ন'টা-দশটার দিকে শুরু হয়ে ভোরে ফজরের আজান দেবার আগ পর্যন্ত চলত।

গায়ক-বাদকদের মাথায় থাকতো ঝাঁকড়া লম্বা চুল। পরনে নাইলন বা সিল্কের পাঞ্জাবী, লুঙ্গী, গলায় গামছা। নারী সদস্যদের পরনে রঙিন শাড়ি, হাতে মাথায় ফুলের গহনা। গানের ফাঁকে ফাঁকে চলতো চা – পান – সিগারেট।  গানের শুরুতে দীর্ঘ ভণিতা, প্রার্থনা, দেশ বন্দনা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, আর ক্ষমা প্রার্থনা থাকতো। একজন গায়কের গোটা গানের সুর মোটামুটি একরকম থাকলেও অস্থায়ী আর অন্তরাতে তালের হেরফের হতো। মুগ্ধ শ্রোতাদের কেউ কেউ গানের মাঝখানে উঠে গায়কের কণ্ঠে টাকার মালা পরিয়ে দিতেন। লাল-হলুদ-সাদা-সবুজ-নীল জরির মালাতে পাঁচ টাকা বা দশ টাকা গেঁথে সেই মালা বানানো হতো। গানের এই আয়োজন চলত দুই বা তিন রাত ধরে। বড় খোলা মাঠে বাঁশ-ত্রিপল-কাপড় দিয়ে ম্যারাপ খাটানো হতো। উঁচু স্টেজ বানানো হতো কাঠের চৌকি অথবা বাঁশের ফ্রেমে কাঠের পাটাতন বসিয়ে। শ্রোতাদের জন্য মাঠের ঘাসের উপর ত্রিপল, ছেঁড়া তাঁবুর ক্যানভাস আর অয়েলক্লথ বিছিয়ে দেয়া হতো। কেউ কেউ বাসা থেকে চাটাই-মাদুর-পাটি-হোগলা-চাদর-কাঁথা নিয়ে আসতেন। গানের আয়োজনের জন্য গণহারে চাঁদা তোলা হতো না। অল্প কিছু জন চাঁদা দিয়ে পুরো অনুষ্ঠান নামিয়ে দিতেন। গায়ক-বাদক দল এলাকার কোন অবস্থাপন্ন লোকের বাসায় থাকতেন, খেতেন, গান চর্চ্চা করতেন।

এই প্রকার পালা গানকে আমরা বলতাম 'বৈঠকী গান'। আরও পরে জেনেছি বৈঠকী গান আসলে ভিন্ন জিনিস। আমাদের ছোটবেলায় অমন পালা গানের বড় গায়ক ছিলেন আলেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, কানা আবুল, করিম বয়াতী। এই গান যেহেতু সারা রাত ধরে চলে তাই সেটি হচ্ছে বড়দের শুনবার জিনিস। যে আমলে রাত ন'টায় রেডিও বাংলাদেশে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'উত্তরণ' শুরু হতে না হতে আমাদের শুয়ে পড়তে হতো সে আমলে সারা রাত ধরে চলা পালা গান শুনতে চাওয়া দশম মাত্রার অপরাধের সমান।  বড় চাচীর ভাই জাহিদ মামা, ইনু মামার কাছে মানিকগঞ্জ অঞ্চলের পালা গানের খ্যাতির গল্প শুনে আমার মনে হলো এই গান না শুনলে জীবন বৃথা। আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে আব্বু ঠিক করলেন কার্তিকের শুরুতে বাসার কাছে গানের যে আয়োজন করা হতো সেখানে নিয়ে যাবেন।

যথা সময়ে আম্মু আমাকে উলের মোজা, ফুলপ্যান্ট, ফ্ল্যানেলের শার্টের উপরে সোয়েটার, তার উপরে জ্যাকেট পরিয়ে কান-মাথা মাফলারে ঢেকে সারা রাত ধরে গান শুনতে যাবার জন্য রেডি করে দিলেন। গানের আসরে গিয়ে দেখি দিনের মতো গম গম করছে। চারদিক উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট লাইটের টিউবে আলোকিত। নানা রকমের খাবারের পসরা বসিয়ে একটা মেলা মেলা ভাব আনা হয়েছে। আব্বু আমাকে সেমাইয়ের মতো দেখতে এমন এক রকমের কটকটি কিনে দিলেন – আমরা বলতাম 'গাঠ্‌ঠা মিঠাই'। আমি মহানন্দে গাঠ্‌ঠা খেতে খেতে ত্রিপলে বসে গান শুনতে লাগলাম। দেখি গানের ভণিতা চলছে তো চলছেই শেষ আর হয় না। আমার আর ধৈর্য্য থাকে না। আমার অসহিষ্ণুতা দেখে আব্বু বললেন, যে গান সারা রাত ধরে চলবে তার ভণিতা তো একটু লম্বা হবেই। অবশেষে গান শুরু হলো। ও বাবা! গানে যে গল্প বলে তার উপস্থাপনা এখনকার টিভি সিরিয়ালগুলোকে পর্যন্ত হার মানাবে। একজন গায়ক অতি অল্প একটু কাহিনী বলে, সেটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বহু বার গেয়ে শেষে একটা প্রশ্ন রেখে যান। অন্য গায়ক এসে সেই প্রশ্নের ঝটপট উত্তর না দিয়ে নানা উপায়ে না-হক কূটতর্ক জুড়ে দেন, আবারও অতি অল্প কাহিনী বলেন, বহু বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে, শেষে আরেকটা প্রশ্ন রেখে যান। মূল কাহিনী স্থির হলেও বাকি গান, ভণিতা, কূট তর্ক এর সবই জায়গায় দাঁড়িয়ে সাথে সাথে বানানো — অবাক করা বিষয় সেখানেই। আমি সোজাসাপ্টা মানুষ, কোন ঘোরপ্যাঁচ আমার পোষায় না। যে গান এক ঘন্টায় শেষ হয়ে যাবার কথা তাকে সারা রাত ধরে টানার মানে কী! আমি ধৈর্য্য হারিয়ে একসময় আব্বুর কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আব্বু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমার অবস্থা দেখে ঘুম থেকে তুলে বললেন, বাবু চলো বাসায় চলে যাই। আমি সুড়সুড় করে সুবোধ বালকের মতো আব্বুর হাত ধরে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি।

খালেক দেওয়ান

পরদিন সকাল হতে আমার মন আফসোসে ভরে যায়। আহা! আমি আরেকটু ধৈর্য্য ধরলাম না কেন? তাহলে তো গোটা গল্পটা শুনতে পেতাম। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে সারা রাত জেগে গান শোনার বাহাদুরিটা বন্ধুমহলে জারী করতে পারতাম। এখন যে কেলোর কীর্তি করেছি তাতে ইহজীবনে আর সারা রাত ধরে পালা গান শোনার বায়না ধরা যাবে না। 

যে বয়সে পৌঁছালে সারা রাত নিজ উদ্যোগে পালা গান শোনা যায় সেই বয়সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার আর পালা গান শোনার মনটা অবশিষ্ট থাকেনি। তাছাড়া আমার ধারেকাছে পালা গানের আয়োজন এখন আর হতে দেখি না। আলেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ানরা যদি এখনো বেঁচেও থাকেন তাঁদের আগের গানের গলা নিশ্চয়ই আর অবশিষ্ট নেই। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিনোদনের হাজারোটা উপায় বের হয়ে যাওয়া, মানুষের রুচির পরিবর্তন আমার পালা গানের জগতটিকে অলঙ্ঘ্যনীয় দূরত্বে নিয়ে গেছে। 

"আমি মরিলে যেন পাই তোমারে গো
পুনর্জন্ম লইয়া
আমি মরলে এই করিও
আমার মরা না পোড়াইও
না গাড়িও, না দিও ভাসাইয়া
বন্ধু বন্ধু বন্ধু বলে
কান্দিস আমার কর্ণমূলে গো
তমাল ডালে রাখিও বান্ধিয়া"।।

  • ২৩ ডিসেম্বর ২০২০

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.