মেরি ফ্রান্সেস ডানহাম: বাংলাদেশের এক পরম সুহৃদের প্রয়াণ
বাংলাদেশ তার এক পরম সুহৃদকে হারাল! মেরি ফ্রান্সেস ডানহাম, যাঁর জন্মও হয়েছিল ঠিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের তারিখটিতে, ২৬ মার্চ ১৯৩২ সালে, ফ্রান্সের এক পাড়াগাঁয়ে, অক্টোবরের ১১ তারিখে ৮৯ বছর বয়সে নিউইয়র্কে তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশভূমিতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ১৯৫১ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিশ্বপর্যটক মেরির সঙ্গে মহাসমুদ্রের বুকে ভাসমান এক প্রমোদতরীতে পরিচয় হয়েছিল একজন সুদর্শন স্থপতি ড্যানিয়েল ডানহামের। পরবর্তীকালে যা প্রণয়ের পথ বেয়ে পরিণয়ে গড়ায় এবং তাঁরা ১৯৬০ থেকে ৬৭, এই দীর্ঘ সাতটি বছর কাটান স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরে। ড্যানিয়েল তখন তৎকালীন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগ চালু করা ও সেখানে শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন নির্মীয়মাণ কমলাপুর রেলস্টেশনের অন্যতম স্থপতি হিসেবেও কাজ করছিলেন। সেখানে তখন তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন আরেক বিখ্যাত মার্কিন স্থপতি রবার্ট বুঘি, যাঁর বাঙালি স্ত্রী কবি ফরিদা মজিদ, কবি গোলাম মোস্তফার দৌহিত্রী, মাত্র কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন এই ঢাকাতেই।
ড্যানিয়েল যখন মগ্ন ছিলেন বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যশিক্ষার ভিত্তিটুকু মজবুত করে তৈরি করার কাজে, মেরি তখন ব্যস্ত ছিলেন বাংলা শেখার কাজে, পাশাপাশি বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর রাজনীতি-অর্থনীতির অভিনিবিষ্ট অধ্যয়নে। সেই সঙ্গে তৎকালীন ঢাকার বাসিন্দা কজন বিদেশি বান্ধবী মিলে ঘুরে ঘুরে ঢাকার অলিগলি চিনছিলেন, জানছিলেন ঢাকার লোকেদের খাদ্যাভ্যাস, বাজারহাটের ঠিকানা, বিনোদনের মাধ্যমগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছিলেন, করছিলেন ঢাকা ও আশপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলোর সুলুকসন্ধান। এই করতে করতে একপর্যায়ে তিনি একজন ছোটখাটো ঢাকা-বিশেষজ্ঞই হয়ে উঠলেন, এতটাই যে কিছুদিনের মধ্যেই মূলত তাঁরই উদ্যোগে ও আগ্রহে সেই বিদেশি বান্ধবীদের সঙ্গে প্রকাশ করে ফেললেন ঢাকার ওপর লিখিত ইতিহাসের প্রথম নির্দেশিকা-পুস্তিকা তথা গাইডবই, Living in Dacca। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। বাংলাদেশের গ্রামীণ সংগীত, নাটক, সংস্কৃতির মাধুর্য ও শক্তিমত্তায় আকৃষ্ট হয়ে সংগীত-নৃতত্ত্বে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ শেষে তারই আলোকে রচনা করেন বাংলাদেশের জারিগান নিয়ে গবেষণামূলক মহাগ্রন্থ Jarigan: Muslim Epic Songs of Bangladesh। বস্তুত এই কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন কবি জসীমউদ্দীনের প্রেরণায়। তিনি নিজে তখন জারিগান নামে একটি বই লিখেছিলেন এবং মেরিকে অনুরোধ করেছিলেন সেই গানগুলোর স্বরলিপি করে দিতে। মূলত এই স্বরলিপির কাজ করতে করতেই জারিগান বিষয়ে তাঁর এতটাই অনুরাগ জন্মাল যে তিনি এই নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাতেই হাত দেন, যার ফসল এই অদ্বিতীয় গ্রন্থখানি। এ ছাড়া ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত বিষয়েও তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি আরও একটি ব্যতিক্রমী সংগীতবিষয়ক গ্রন্থ 'Ravi Shankar: Learning Indian Music, A Systematic Approach' রচনা করেন, যার সঙ্গে তাঁর তৈরি একটি নির্দেশিকামূলক ক্যাসেটও সংযুক্ত ছিল।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের দুই কীর্তিমান লেখক আহমদ ছফা ও সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গেও তাঁর গভীর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তিনি আহমদ ছফা ও সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে মিলে প্রথমোক্তজনের অনন্য গ্রন্থ পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ঘটনাচক্রে তাঁর কন্যা- স্থপতি ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাথরিন ডানহামের সৌজন্যে এর পা-ুলিপিটি কয়েক বছর আগে আমার হাতে আসে। আমি সেটি ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাগে প্রকাশের উদ্যোগ নিই। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কয়েক কিস্তি ছাপানোর পরই সর্বগ্রাসী করোনার আকস্মিক আগ্রাসনে সেটির প্রকাশ স্থগিত হয়ে যায়। আশা করি, ঢাকা ট্রিবিউন এটি পুনঃপ্রকাশের উদ্যোগ নেবে। এখানে উল্লেখ্য, আহমদ ছফার সঙ্গে মেরি ফ্রান্সেসের আদান-প্রদান করা অসংখ্য চিঠিপত্র ও আনুষঙ্গিক আরও অনেক কাগজপত্রের বিশাল এক সংগ্রহ ছিল তাঁর কাছে। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে তাঁর গুণী কন্যার একনিষ্ঠ সহযোগিতার কল্যাণে অবশেষে এই দুই সপ্তাহ আগে সেগুলোকে বাংলাদেশে আনা সক্ষম হয়েছে। এই মহামূল্যবান দলিলপত্রসমূহ এই মুহূর্তে সলিমুল্লাহ খানের জিম্মায় তাঁর কর্মস্থল ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে সংরক্ষিত রয়েছে, যেগুলো সন্দেহ নেই ভবিষ্যতের গবেষকদের খুবই উপকারে আসবে।
মেরি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তাঁর অবসরের দিনগুলোতে। সেটি হচ্ছে তাঁর ঢাকাবাসের দিনগুলোর ওপর পাঁচ খণ্ডের একটি অমূল্য স্মৃতিকথা Some Weep, Some Laugh: Memoirs of an American Family in Dhaka 1960 - 1967। তাঁর কর্তব্যপরায়ণ কন্যা এটিকেও খুব যত্নসহকারে তাঁদের পারিবারিক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাধ্যমতো এর সংরক্ষণ ও প্রচারণার কাজ করে আসছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, গ্রন্থটির গুরুত্বের কথা ভেবে বাংলাদেশেরই কোনো সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রকাশনা সংস্থার এগিয়ে আসা উচিত আমাদের সামাজিক ইতিহাসের এই আকর গ্রন্থটির আশু প্রকাশনা এবং দ্রুত বাংলা অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণে। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব কালের অমিত সম্ভাবনাময়, অগ্নিগর্ভ ও ঘটনাবহুল সময়টার যে নৈর্ব্যক্তিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও বিশ্লেষণ রয়েছে এই বইয়ে, তা-ও দুজন অত্যন্ত জ্ঞানী, সংবেদনশীল, দায়িত্ববান ও বিবেকবান মানুষের বয়ানে, সেটির মূল্য অপরিসীম। প্রকৃত ইতিহাস জানা ও তাকে সমুন্নত রাখার খাতিরেই আমাদের প্রত্যেকের তা পাঠ, তার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত বলে মনে করি।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ডানহাম দম্পতির বীরোচিত ভূমিকার কথাও এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। মুক্তিযুদ্ধের গোড়া থেকেই তাঁরা দুজন তাঁদের প্রিয় বাংলাদেশ ও প্রিয়তর বাঙালি বন্ধুদের দুর্দশার কথা ভেবে খুবই বিচলিত বোধ করছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদী সভাগুলোতে অংশগ্রহণ করে আসছিলেন। একপর্যায়ে মেরি ডানহাম খোদ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি কড়া চিঠি লেখেন। এর কথা আমি মেরির মৃত্যুর পর মাত্র সেদিনই কেবল জানতে পারি, তাঁর কন্যা ক্যাথরিনকে লেখা সুলেখক সলিমুল্লাহ খানের একটি মর্মস্পর্শী শোকলেখা থেকে। আমরা জানতে পারি, ১৯৭১ সালের ২৪ মে মেরি ফ্রান্সেস মার্কিন প্রেসিডেন্ট বরাবর অন্য আরও অনেক কথার সঙ্গে এই কথাগুলোও লেখেন, 'Peace and universal love have been a tradition in Bengali culture from high to low, from great poets and philosophers to illiterate boatmen. The tremendous losses which East Bengal has suffered, is suffering, and will suffer for a long time are a loss to the world at large of a highly cultivated people. There are few areas that can boast the level of culture we are in danger of losing even before it has been properly recorded.' (বাঙালি সংস্কৃতিতে উচ্চ থেকে নিচ, বড় বড় কবি-দার্শনিক থেকে একেবারে নৌকার মাঝি পর্যন্ত শান্তি ও সর্বজনীন ভালোবাসার বোধটুকু বিদ্যমান। সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান যে বিপুল ক্ষতির ভেতর দিয়ে গেছে, যাচ্ছে এবং আরও দীর্ঘদিনই সম্ভবত যাবে, তা বিশ্বজোড়া সত্যিকার সংস্কৃতিমান মানুষের বৃহত্তর সমাজেরই ক্ষতি। পৃথিবীতে খুব কম অঞ্চলই রয়েছে, যারা এমন উচ্চ সংস্কৃতির গর্ব করতে পারে, যা কিনা নথিবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই ধ্বংসের হুমকিতে আজ।) তবে, শুধু এটুকু করেই তাঁরা তৃপ্ত হননি, মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁরা ভারতে চলে যান এবং সেখানে টানা কয়েক মাস অবস্থান করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে সাধ্যমতো ত্রাণকাজে অংশ নেন। মেরির এক সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি যে এরই মধ্যে একফাঁকে ড্যানিয়েল ডানহাম সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেও দেশের নিপীড়িত, মুক্তিকামী জনতার পক্ষে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। জানি না বাংলাদেশ সরকার গভীর মানবিকতায় ভাস্বর আমাদের এই নায়কোচিত বন্ধু দম্পতিকে অদ্যাবধি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা স্বীকৃতি প্রদান করেছে কি না। যদি না করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি এই লেখার মাধ্যমেই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে জোরালো দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে তাঁদের যথাযথ মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়ে হলেও আমাদের জাতিগত ব্যর্থতার লজ্জা ও গ্লানিটুকু অপনোদন করার জন্য।
সবশেষে মেরি ফ্রান্সেসের আরেকটি বিশিষ্টতার কথা বলে এই প্রয়াণলেখার সমাপ্তি টানব। সেটি হচ্ছে, ছোটবেলা থেকেই তিনি মনেপ্রাণে একজন সাইকেল অনুরাগী মানুষ, কালক্রমে যেটা তাঁর জীবনচর্যা ও দর্শনেরই অংশ হয়ে ওঠে। এই অভ্যাসটিকে তিনি তাঁর পরিবেশবাদী আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবেও খুব সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হন। সত্তরের দশক থেকে যখন পেট্রোলচালিত যানবাহনের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণের ক্ষতিকারক ভূমিকার বিষয়ে মানুষ সচেতন হতে শুরু করে, তখন মেরি ট্রান্সপোর্টেশন অলটারনেটিভস নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে যান্ত্রিক গাড়ির বিপরীতে সাইকেল চালনাকে জনপ্রিয় করে তোলার আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন এবং অমৃত্যু তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। আশির দশকের শেষ নাগাদ যখন নিউইয়র্ক শহরের মেয়র ম্যানহাটন ডাউনটাউনে সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ করেন, তখন মেরি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে সেই মামলায় জিতে সাইকেল আরোহীদের অধিকার ফিরিয়ে আনেন। তাঁদের ঢাকাবাসের সময়টাতেও তিনি সুযোগ পেলেই তাঁর বিখ্যাত ভাঁজ করা ডাহোন সাইকেলে চড়ে ঢাকার রাজপথে চলাচল করতেন এবং প্রায় নিয়ম করে ঢাকার সংবাদপত্র ও অন্যান্য সরকারি অফিসে গিয়ে সাইকেলের পক্ষে প্রচারণা চালাতেন। অন্তর্জালে লভ্য একটি ছবিতে দেখা যায়, তাঁর ধানমন্ডির বাড়ির লনে তিনি এমনকি তাঁর একেবারে কোলের শিশুকন্যা কেইটকেও সাইকেল চালানো শেখাতে উদ্যত হয়েছেন! মানুষ ও প্রকৃতি, জীব ও জগৎ, সর্বোপরি এই সুন্দর পৃথিবীর প্রতি তাঁর এতটাই দরদ ও দায় ছিল যে তিনি তার জন্য তাঁর সমস্ত কায়মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন এবং যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। তাই শুধু কথা নয়, কাজ দিয়েই আমাদের এই অকৃত্রিম বাংলাদেশ অনুরাগী, মহীয়সী নারী ও তাঁর সুযোগ্য জীবনসঙ্গীর অপরিসীম ঋণ পরিশোধের উদ্যোগ নিতে হবে। মেরি ফ্রান্সেস ডানহাম, আপনি আমাদের সকলের আনত অভিবাদন গ্রহণ করুন।