মৃত্যুর মিছিল

ইজেল

শওকত হোসেন
02 July, 2020, 01:55 pm
Last modified: 03 July, 2020, 11:33 pm
ধারাবাহিক স্পাই থ্রিলার

[প্রথম পর্ব]
 

এক

উত্তর ইতালি। আভিয়ানো ন্যাটো এয়ার ফোর্স বেসের দূর প্রান্তের একটা হ্যাঙার। তারিকের ডান হাতে গভর্নমেন্ট ইস্যু সিগ সওয়ার পি২২৬ এমএম পিস্তল, হ্যামার টেনে পেছনে নিয়ে আসা হয়েছে ওটার। ট্রিগারে অবিচল ওর তর্জনী।  ইন্টেলিজেন্স ফিল্ড অফিসার ডাল্টন দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। মনে মনে লোকটাকে গুলি করার জুৎসই মুহূর্ত আর কায়দা স্থির করতে চাইছে ও। 

ওর পুরো নাম তারিক আহসান। বাবা বাংলাদেশি, মা আমেরিকান। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসম সাহসের পরিচয় দিয়ে বিদ্রোহী সেনা বাহিনীর সদস্য হিসাবে সমুখ সমরে হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। কখনো কখনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে জান বাজী রেখে শত্রুশিবিরে হানা দিয়েছেন। তারপর ফিরে  এসেছেন বীরের মতো।

কিন্তু স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন বলে সৈনিকের পেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, ব্যবসার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নতুন দেশে, নতুন পেশায় কেন যেন ঠিক খাপ খাইয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাই পাড়ি জমান সুদূর মার্কিন মুল্লুকে। এখানে এসে থিতু হন। এক সময় ঘর বাঁধেন এ দেশেরই এক নারীর সঙ্গে।

ওদের সংসারে একমাত্র সন্তান তারিক। লেখাপড়া শেষ করে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেনাবাহিনীতে নাম লেখায় ও। কিছুদিন সক্রিয় পেশায় থাকার পর পেশাগত দক্ষতার সুবাদে বড়কর্তাদের নজরে পড়ে যায় ও, ওকে তুলে নিয়ে জুড়ে দেয়া হয় একটা বিশেষ গোপন সংস্থার সাথে। দেশেবিদেশে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় গোপন অপারেশন চালানো এই সংস্থার কাজ। কাজের জন্যে সংস্থার কাউকেই প্রচলিত আইনে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কেবল প্রেসিডেন্ট, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীসহ হাতে গোনা অল্প কজন ব্যক্তি এই সংস্থার অস্তিত্বের কথা জানেন। তারাই সরাসরি প্রয়োজনীয় কাজের হুকুম দিয়ে থাকেন। গোপন এই সংস্থার হয়ে দীর্ঘদিন অসংখ্য অ্যাসাইনমেন্টে বিভিন্ন দেশে গেছে ও। বহু গোপন, অজানা ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে আছে।

কিন্তু ইদানীং মনের কোথায় যেন বারবার বেজে যাচ্ছিল ভিন্ন এক  সুর: এবার না বলার সময় হয়েছে। নিজের মতো কিছু একটা করা দরকার। প্রথমে এই দেশেই থিতু হওয়া চেষ্টা করবে। দূরে কোথাও মনের মতো একটা জায়গায় থিতু হবে। হয়তো পরে এক সময় প্রাইভেট ডিটেক্টিভ এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে থেকেই দেশের জন্যেও কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তাই অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিল। কিন্তু সহসা বেশ উপরের মহল থেকে অনুরোধ এলো, শেষ একটা কাজ করে দিতে হবে। এটাই শেষ। তারপর যেখানে খুশি যেতে পারবে ও। এখন ওকে যেতে হবে সার্বিয়ায়, সেখানকার উগ্র জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়া বাহিনী নেতা যুদ্ধবাজ, অত্যাচারী দার্কো লিয়েসকে হত্যা করতে হবে। তাহলে জাতি সংঘের মধ্যস্ততায় আয়োজিত শান্তি চুক্তি এগিয়ে নেয়া অনেকখানি সহজ হয়ে উঠবে। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে সার্বিয়দের নির্বিচারে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্যাতন, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান কখনোই মেনে নিতে পারেনি ও। তাই সাতপাঁচ কিছুই না ভেবে রাজি হয়ে গেছে। পিছিয়ে দিয়েছে অবসরের ভাবনা। তারই ফল, এখন এখানে ডান্টনের মুখোমুখি ও। 

ডাল্টন লোকটা হ্যাংলা গড়নের, মাথায় ঘন বাদামী চুল, চোখে গোল অয়্যাররিমড চশমা। চাঁছাছোলা একটা ভাব আছে ওর ভেতর। বিডিইউ, কেভলার ভেস্ট এবং ভারী বুট পরে আছে সে। 

'শোনো, তারিক,' বলল সে। 'আজ রাতের আবহাওয়া পূর্বাভাসে কি বলেছে তার তোয়াক্কা করি না, তুমি আর তোমার বন্ধুরা এই মিশনে "যাচ্ছ", ব্যস। জিনিভায় কূটনীতিকরা মহা ফাঁপড়ে পড়েছেন। তোমাদের অপারেশন সফল হলে হয়তো আলোচনা সন্তোষজনক কোনো পরিণতির দিকে ঝুঁকবে।'

চুপ থাকল তারিক। ডাল্টন ধরে নিয়েছে, ওর সতর্কবাণীর কথাই ভাবছে ও; কিন্তু আসলে ও ভাবছে ঠিক কোন জায়গায় ব্যাটাকে জুৎসইভাবে গুলি করা যায়। বুকের ঠিক মাঝবরাবর গুলি করলে পাঁজরের গোটা কতক হাড় গুড়িয়ে যাবে, চিৎপটান হয়ে উল্টে পড়বে সে; আবার ওর চকচকে কপাল বরাবর একটা গুলিই চূড়ান্ত এবং দেখার মতো কায়দায় কাজ দেবে। 

কিন্তু ওকে হত্যার মানে হবে প্রচুর কাঠখড় পোড়ানো, হাজারটা বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া। সেসবের ফুরসত ওর নেই।  

'ডান্টন,' বলল ও। 'অপারেশনাল কন্ট্রোল হয়তো তোমার হাতে থাকতে পারে, কিন্তু এই অপারেশনের ট্যাক্টিকাল কমান্ড কিন্তু আমার হাতে। যাব কি যাব না সেটা বলার পুরো এখতিয়ার আমার, তোমার নয়। কিংবা জিনিভারও কারও সেটা নেই। এমনকি ওয়াশিংটন বা ল্যাঙলিরও না।' 

'ডেপুটি ডিরেক্টর শাটনার স্পষ্ট বলে দিয়েছে-' বলতে গেল ডান্টন। 

'তুমিই তো বললে, সে ডেপুটি,' বাধা দিয়ে বলে উঠল তারিক। 'সাথে মানানসই পাঁচ কোণাঅলা তারা আছে তার?'

পেছনে দাঁড়ানো দলের বাকি চার সদস্য নীরব সমর্থন জানাচ্ছে, টের পেল ও। চোখ গরম করে ওর দিকে এক নজর তাকিয়ে গটগট করে হ্যাঙারের সাইডডোরের দিকে এগিয়ে গেল ডান্টন। 'ওয়েদার অফিসে যাচ্ছি,' বেরুনোর আগে গলা চড়িয়ে বলল সে। 'ফিরে এসে তোমাদের তৈরি অবস্থায় দেখতে চাই!'

'দেখো, আবার হারিয়ে যেয়ো না,' বলে ওকে আরেকটু উস্কে দিতে চাইল ও।

দড়াম করে আটকে গেল পাল্লাটা। এক মুহূর্ত শব্দ করে হাসল ওর দলের সদস্যরা। এবারের মিশন সফল হওয়ায় এদিক ওদিক সরে গেল ওরা। এখনও বৃষ্টি ঝরছে। জঘন্য আবহাওয়ার দিকে নজর স্থির রেখে আলগোছে হ্যামার নামিয়ে পিস্তলটা সাইড হোলস্টারে রেখে দিল তারিক। চূড়ান্ত আবহাওয়া রিপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ওরা। তখন বোঝা যাবে এমনি বৃষ্টি ভেজা রাতে ভিন দেশে কাউকে খুন করার কাজে বেরোবে কিনা, যেদেশে আগে কখনও পা ফেলেনি ওরা। 

ওর দলের অন্য সদস্যদের একজন সার্বিয় বংশোদ্ভুত আলীয়া বোরোযান। অনেক বছর আগেই ওর বাবা মা সার্বিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন আমেরিকায়। তখন বেশ ছোট ছিল ও। কিন্তু ওদের ছিমছাম বসত বাড়ির কথা এখনো মনে পড়ে ওর। তারিকের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি মিশনে যোগ দিয়েছে ও আগে। দলের মেডিকেওর দায়িত্বও থাকে ওর কাঁধে। দেশের উপকারে আসবে জেনে এবারের মিশনে নাম লেখাতে রাজি হয়েছে ও। অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ হয়তো অকাল মৃত্যু আর অমানুষিক নির্যাতন থেকে রেহাই পাবে। তারপর রয়েছে মাইকেল শের, খাঁটি মার্কিন নাগরিক। তারিকের পুরোনো বন্ধু, সহযোদ্ধা। অতীতে বহু অ্যাসাইনমেন্টে একসাথে মিলে মৃত্যুকে কাঁচকলা দেখিয়ে ফিরে এসেছে।  ওর শেষ মিশনে স্চ্ছোয় নাম লিখিয়েছে ও। এরপর  লেবানী খালিদ জাহাঙ্গীর। সাবেক আল-ফাতাহ গেরিলা। ফিলিস্তিনীদেও পক্ষে বিভিন্ন গোপন মিশনে বেশ কয়েকবার ইসরায়েলের বুকের ভেতর গিয়ে সফল অপারেশনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু শেষমেশ অবিরাম ইসরায়েলি নিপীড়নের মুখে ফিলিস্তিনি নেতাদের ক্রমাগত নতি স্বীকারের বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশান্তরী হয়েছে। এবং সব শেষে ক্লেটন, এও মার্কিনী নাগরিক। এমনি অপারেশনের বিপুল অভিজ্ঞতার সুবাদেই জায়গা করে নিয়েছে এই দলে। এখন যে যার মতো কাজ করছে ওরা। খোশ গল্প করছে, কিংবা সিগারেট ফুঁকছে, কিংবা জীর্ণ পাতার পেপারব্যাক উপন্যাসে মন দিয়েছে। বৃষ্টি দেখছে তারিক, মুষলধারে পড়েই চলেছে। রানওয়ে বরাবর প্রবল হাওয়া বইছে। কিছু ভাবতে চাইছে না ও, কেবল শেষ মিশনটা শেষ করতে হালনাগাদ আবহাওয়ার রিপোর্টের অপেক্ষা করছে।  

ওদের সবার পরনে মোটামুটি একই রকম লেবাস: কাস্টমস হেলমেট, ক্যামোফ্লাজড বিডিইউ, ভারী বুট, নী-প্যাড ও এলবো প্যাড, বডি আর্মার, ফ্ল্যাশলাইট, ছুরি, সারভাইভাল প্যাক, কম্পাস, এনক্রিপটেড হ্যান্ডহেল্ড বিভিন্ন ডিভাইসসহ মোল্লে ভেস্ট এবং হোলস্টারে ঠাসা পিস্তল। শূন্য হ্যাঙারের এক কোণে সযত্নে রাখা ওদের অ্যাসল্ট প্যাক এবং প্যারাশূট।  সবার কাঁধে ১০ ইঞ্চি লম্বা ব্যারেলের একটা করে হেকলার অ্যান্ড কচ এইচকে ৪১৬ রাইফেল ঝুলছে। 

মাঝেমাঝে এয়ার ফোর্সের লোকজন হাজির হচ্ছে, পরক্ষণে এখানে থাকা ঠিক না মালুম করতে পেরে ঝটপট কেটে পড়ছে। ওদের পরিচয় জানে ওরা, তাই ওদেও সাথে এক জায়গায় থাকার তিলমাত্র ইচ্ছা নেই কারো: কাজ করতে প্রস্তুত ঠাণ্ডা মাথার একদল ঘাতক।

সাদার্ন কার্নিক আল্পস থেকে ধেয়ে আসা শীতল হাওয়া কামড় বসাচ্ছে চোখে-মুখে, নিজেকে বাঁচাতে কিছুক্ষণ পায়চারি করে বেড়াল ও। ওর বিডিইউ'র নেম ট্যাগে নাম লেখা: আহসান। হ্যাঁচকা টানে খসিয়ে ফেলা সম্ভব ওটা। তো বেআইনিভাবে সার্বিয়ায় পা রাখামাত্র এই কাজটাই করবে ও। কিন্তু ও অহত, নিহত বা বন্দী হলে ওটাই হতো ওর পরিচয়ের একমাত্র প্রমাণ হতো।  

কিন্তু কারা ওরা? তারিক ও ওর চার সঙ্গী? সিল টিম-সিক্স, রেঞ্জার, মেরিন রিকন স্পেশাল ফোর্স, ডেল্টা ফোর্স এবং অন্যান্য গোপন এলিট বাহিনীর কথা প্রায়ই শোনা যায়। বেশ, ওদের কেউ নয় ওরা। বাইরের দুনিয়ায় নামই যদি জানা থাকবে তাহলে আর এলিট ফোর্সের মাজেজা থাকে কোথায়? 

সামনে এসে দাঁড়াল ওদের একজন ক্রু। ক্লেটন। চেহারা আর হাবভাব দেখে ক্যালিফোর্নিয়ার কোনো মামুলি সার্ফার বলে মনে হবে। কথাটা অবশ্য সর্বাংশে সত্যি। 

'কি মনে হয়?'

চমকে সংবিৎ ফিরে পেল তারিক। 

'সব ঠিক হয়ে যাবে,' বলল ও। 'ডাল্টন চাপে আছে। ওর বস শাটনারচাপে আছে। তার বসের মাথায়ও চাপ আছে। সব চাপ নেমে আসছে আমাদের উপর। তুমি তো জানো- পানি নিচের দিকেই গড়ায়।'

'তবে কিনা চাপটা শেষে মাথায় নিতে সবসময় হাজির থাকতে পারছি জেনে ফুর্তি লাগছে।'

দড়াম করে দরজা খুলে গেল। একটা কাগজ হাতে ফের হাজির হলো ডান্টন। ক্লেটন বলে উঠল, 'কি মনে হয়? জানি লম্বা লম্বা কথা বলে ব্যাটা, কিন্তু আদতেই কি সে সিআইএ? কিংবা ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি? ন্যাশনাল রিকনইস্যান্স অফিসের লোক?'

'খুব সম্ভবত এনএসএ হবে, বাছা,' ক্লেটনকে বলল তারিক। 'ওইরকম কোনো এজেন্সি নেই।'

সামনে এসে দাঁড়াল ডান্টন। কাগজটা বাড়িয়ে ধরল তারিকের দিকে। আগামী ছয় ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনিশ্চিত আবহাওয়ার কথা বলছে; ওটা দেখে ম্যাপের দিকে নজর ফেরাল ও। । দলনেতা হিসাবে এখন ওর উপর নির্ভর করছে সিদ্ধান্তের ভার। এটাই ওর শেষ মিশন, একে সফল করে তুলতে চায় ও। কিন্তু মন্দ আবহাওয়া ওদের জোর করে অড্রিয়াটিক সি বা কার্পেথিয়ান পাহাড়ে নামতে বাধ্য করতে পারে। এক সেকেন্ডে নেয়া সিদ্ধান্তের কারণে নিজের এবং বাকি এমনকি সবার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে ও। 

 শেষ অপারেশনই বটে! এমনকি এটা ঠেকালেও শেষ হয়ে যাবে ও, পরে কোনো এক সময় আবার আকাশে উড়াল দিতে হবে ওর সঙ্গীদের। অন্য কথায়, শেষমেশ নিরাপদ থাকবে ও, কিন্তু ওরা নয়। 

'তো, কি বলো?' জানতে চাইল ডান্টন। 

কাগজটা দুমড়েমুচড়ে ওর বুকে ঠেসে ধরল ও। 'আমরা যাব।'

ওদের গিয়ারের দিকে পা বাড়াল ও, মুখ বাঁকাল ডান্টন। ওর পেছনে ছিল ক্লেটন। শান্ত কণ্ঠে বলল, 'একটা প্রশ্ন করি?'

'ঝেড়ে কাশো।'

'ডাল্টন শেষদফা আবহাওয়া রিপোর্ট আনতে যাওয়ার আগে ওর বুকে পিস্তল তাক করেছিলে। সত্যি গুলি করতে নাকি?'

অ্যাসল্ট প্যাক আর প্যারশূট তুলে নিল ও। 'সেটা কোনোদিনই জানতে পারব না আমরা, তাই না?'

দাঁত বের করে হাসল ক্লেটন। এই বিমল হাসিটুকু একটা চমৎকার স্মৃতি হয়ে থাকবে ওর। কারণ আগামী তিন ঘণ্টার মধ্যেই প্রাণ হারাবে ক্লেটন।  

 

দুই

বিপদে ঝাঁপ দেয়ার আগে শেষ মুহূর্তের ব্রিফিংয়ের পালা। একটা হেলিকপ্টার থেকে শূন্যে ঝাপিয়ে পড়তে হবে এরপর। এত বেশি ট্রেনিং পেয়েছে ওরা, এত অসংখ্যবার ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়েছে, এর কোনো দরকার ছিল না,  কিন্তু নিয়ম বলে কথা। কামরাটা ছোট, ফাঁকা, এই কাজেরই উপযুক্ত। হোয়াইট বোর্ডগুলোর একটায় পাকা দাড়িঅলা এক লোকের অনেকগুলো ছবি সাঁটানো। ছবিগুলোর পাশে একটা বিশাল টপোম্যাপ, ওদের গন্তব্যের মানচিত্র; যদি না আর্মির ১৬০ তম স্পেশাল অপারেশন্স এভিয়েশন রেজিমেন্ট- সচরাচর নাইটস্টকার্স নামে পরিচিত- ভজঘট করে মনাকো বা রিভিয়েরায় ফেলে না আসে! 

অবশ্য সবকিছু ভেবে দেখলে সেটাও নেহাত মন্দ হবে না। 

ওর চার সহযোগী স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসরুমে চেয়ারে বসার পর মাঝখানের ছবিতে থাবড়া বসাল তারিক। 'তোমাদের মোটা মাথায় শেষ একটা কথা ভালো করে গেঁথে নাও। এটাই আমাদের আজ রাতের টার্গেট: দার্কো লিয়েস। বলকান্সের যুদ্ধ  ফের শুরু হওয়ার পর থেকে এই লোকটাই আরও কয়েকজন যুদ্ধবাজ সর্দারের সাথে হাত হাত মিলিয়ে ঘৃণা উষ্কে দিচ্ছে। প্রথম দফা বলকান্স যুদ্ধেও সময়ই সারায়েভোর পাহাড় চূড়ায় স্নাইপারদের একটা প্যারামিলিটারি ইউনিট চালিয়েছিল সে। তখন থেকেই মোটামুটি বদনাম কুড়িয়েছিল সে। এমনকি নিষ্পাপ ফুলের মতো শিশুদেরও মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে বদমাশগুলো।'

দার্কোর ফোটোর পাশের সাঁটানো ম্যাপের উপর  হাত রাখল ও। 'ওর প্রায় প্রাসাদের মতো বাড়ির লাগোয়া এই অয়্যারহাউস বরাবর দুটো সাপোর্ট বিল্ডিং রয়েছে-এটা আর এটা। উত্তর ক্যারোলিনায় আমদের মহড়ায় যেমন দেখানো হয়েছিল। পুরোনো কায়দায় রুটিরুজির ব্যবস্থা কওে লোকটা। ড্রাগ এবং কমবয়সী বলকান যৌনদাসীদের ট্রাকে করে জার্মানি, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামে চালান করে। এখন আবারো তার প্রিয় বিষয়ে ফেরার মওকা মিরেছে তার: নিরীহ মানুষ হত্যা। কিন্তু আজ রাতে ওকে আমরা ঠেকাব। ০২০০ ঘণ্টায় আমাদের অনুপ্রবেশের পর পয়েন্ট কিউ নামের এই জায়গায় এক ইন্টেলিজেন্স আপরেটিভের সাথে দেখা হবে বলে স্থির হয়েছে। তার সাঙ্কেতিক নাম অ্যালেক্স। আমাদের দার্কোর আস্তনায় পৌঁছে দেবে সে। কোনো প্রশ্ন?'

এই পর্যায়ে কিছু জিজ্ঞেস না করার কথা ভালো করেই জানে ওর সতীর্থরা। যথেষ্ট আক্কেল রাখে ওরা। 

'পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আগেই যুদ্ধ থামানো জিনিভা আলোচনা চালানোর উদ্দেশ্য। কিন্তু কথা হলো আলোচনা খুবই নাজুক দশায় পড়েছে। আমরা আগে দার্কোকে পাকড়াও করব, ফলে তার এলাকায় অপারেশনে বিপত্তি দেখা দেবে, শান্তি আলোচনায় আরও খানিক গতি যোগ হবে তাতে। আলোচনা ব্যর্থ হলে বালকান্স যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। শেষবার এমন ঘটার সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে একটা ভুলবোঝাবুঝি দেখা দিলে সত্তর লক্ষ লোক জান দিয়েছে।'

শের বলল, 'আমাদের ঘাড়ে এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানোর দায়িত্ব এসে পড়েছে, বিরাট ঝামেলা।'

ওর পায়ে লাথি কষে হাসল খালিদ জাহাঙ্গীর। 'আরে, সেজন্যেই পথে নামছি আমরা, এসব কাজে আমরাই সেরা।'

সামনে ঝুঁকে খালিদের পুরু কাঁধে চাপড় কষল আলীয়া। 'তাহলে এখানে এসে হাজির হলে কোন দুঃখে?'

আরও কয়েক দফা হাসি আর রসিকতা শেষে খালিদ বলল, 'অন্তত আমি তো প্রথম দফা শারীরিক পরিক্ষায় উৎরে গেছি, নিনিতা।' আবারও হাসির হররা বইল, তবে স্রেফ রসিকতার হাসি। স্প্যানিশে নিনিতা মানে ছোট্ট মেয়ে, কিন্তু বোরোযান মোটেই পিচ্চি নয়। দুর্দান্ত ফর্মে আছে সে। কোনো রেয়াত ছাড়াই আছে যতরকম পরীক্ষা আছে সবগুলোয় কেবল উতরে যায়নি, বরং বেশ ভালো ফল করেছে ও। বেশ কিছু বিশ্রী পরিস্থিতিতে তারিকের পিঠ বাঁচিয়েছে। 

অবশ্যই মেয়ে ও। ওর নজর ভীষণ কড়া। পৃথিবীর বেশিরভাগ সেনাবাহিনী মেয়েদের এই ধরনের স্পেশাল অপারেশনে পাঠাতে চায় না, কিন্তু এটা সাধারণ সেনাবাহিনী। কেউ কাজ জানলে, সে ছেলেদের বাথরুমে যাচ্ছে নাকি মেয়েদেরটায় পা রাখাছে কেয়ার করে না ও। 

'ঠিকাছে,' বলল ও। 'রওয়ানা হওয়া যাক,'  বলে ফোটো আর ম্যাপ খসাল ও। কামরার এক কোণের একটা ধাতব ওয়েইস্টবাস্কেট রয়েছে। ওয়াটার প্যাকের হোস খসিয়ে ওয়েইস্ট বাস্কেটের তলাটা খানিক পানিতে ভরল। তারপর ফোটো আর কাগজপত্র ফেলল ওটায়। মাত্র চার সেকেন্ডেই দুর্বোধ্য আবর্জনায় পরিণত হলো সেগুলো। 

ব্যস। কোনো প্রমাণ রইল না। ওরা ফিরে না এলে ওদেরও তেমনি কোনো চিহ্ন থাকবে না। 

বাইরে বৃষ্টি এখন আরও চেপে এসেছে, কিন্তু দৌড়াতে গেল না ওরা। এমনিও ভিজতে হবে, অমনিও ভিজতে হবে, তো দৌড়াদৌড়ি করে কি লাভ? দরজার বাইরে হালকা কমলা ছাতার মাথয় দাঁড়িয়েছিল ডান্টন। বুড়ো আঙুলের ইশরায় সব ঠিক থাকার সঙ্কেত দিল সে। এক সারিতে এয়ারস্ট্রিপের উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা, পথে মাইকেল শেরকে কি যেন বলল ডান্টন। শেরের সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেল তারিক। 'ব্যাটা কি বলল শুনি?' জানতে চাইল ও। 

'দার্কোর মাথাটা একটা ডাণ্ডার ডগায় গেঁথে নিয়ে আসা নিশ্চিত করতে বলল,' ছোট করে ছাঁটা দাড়ি চুলকে বলল শের। 

'তুমি কি বললে?' 

হেলিকপ্টারের এঞ্জিনের ক্রমশ বেড়ে ওঠা গুঞ্জন ছাপিয়ে  গলা চড়াল শের। 'বলেছি এসব মামুলি সরকারি বাজে আলাপ। আমাদেও কারো নামেই ডাণ্ডা বরাদ্দ করা হয়নি।'

ওরা আরো কাছাকাছি হলে শেরের হেলমেট পরা মাথায় চাটি মারল তারিক। ইনভিজিবল হক নামেই বেশি পরিচিত অত্যন্ত গোপনীয় স্টিলথ ইউএইচ-৮০ হেলিকপ্টারের রোটর ইতিমধ্যেই পাক খেতে শুরু করেছে। চপারের খোলা দিক দিয়ে উঠে পড়ল তারিক। কয়েক বছর আগে পাকিস্তানে চালানো ওর নৌবাহিনীতে বন্ধুদের একটা অপারেশনের কথা মনে পড়ে গেল। এক ও অদ্বিতীয় ওসামা বিন লাদেনকে ওরাই খতম করে। আসলে এটা ছিল সরকারী ভাষ্য। কিন্তু বেসরকারী এবং অতি ভয়ানক কাহিনী হচ্ছে, দুটো মিশন ছিল ওই রাতে: একটা ওই ওসামা বিন লাদেনকে কতল করেছে। অন্যটিকে ওই কম্পাউন্ডে একটা 'দুর্ঘটনায়' পড়তে হয়-চীনা এবং রাশিয়ানরা যাতে হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ কব্জা করতে পারে, হালনাগাদ স্টিলথ প্রযুক্তি হাত করে ফেলেছে ধরে নেয়। 

আসলে মোটেও তেমন কিছু ঘটেনি। অবশ্য জীবনেও কাজে লাগাত পারবে না এমন একটা জিনিস নকল করার পেছনে অনেকগুলো বছর এবং গবেষণার পেছনে অযথা কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচের অজুহাত যুগিয়েছিল। কিন্তু যত মনোহরই মনে হোক, ইতিমধ্যে জটিল হয়ে ওঠা অপারেশনকে আরও জটিল করে তুলেছিল সেটা। ফুড চেইনের উপরের দিকের লোকজন যখন রাজ্যের সব আনন্দ লুটতে চায়, তখনই এমন হয়। 

দলের বাকিরাও হেলিকপ্টারে উঠে পড়ল। প্রয়োজনের চেয়ে দুসেকেন্ড বেশি ওর হাত ধরে রইল আলীয়া বোরোযান। তাতে আব্যশ্য আপত্তি করল না ও। ওই অনুভূতি ভালোই লাগছে। সব শেষে উঠল খালিদ। ক্রুজিং স্পিডে পৌঁছানোর পর স্টিলথের চপার এঞ্জিনের আওয়াজ খানিকটা কমে এলো। এঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে ওর কানের কাছে ঝুঁকে চেঁচিয়ে খালিদ বলল, 'একটা সমস্যা হয়ে গেছে, ওস্তাদ!'

'কি রকম?'

'বাঙ্কে সৌভাগ্যের তাবিজটা ফেলে এসেছি।'

মাথা নাড়ল তারিক। 'এখন আর ওটা আনার সময় নেই।'

'কিন্তু ওটা যে আমার সৌভাগ্যের তাবিজ! ওটা বাদে কোথাও যাই না!'

'সবসময়ই প্রথমবার বলে একটা কথা আছে!' পাল্টা চেঁচিয়ে বলল তারিক। 

উড়াল দিল স্টিলথ চপার। রানওয়ের আরও শ'খানেক মিটার দূরে ওদের ব্যাকআপ হেলিকপ্টারের রোটরও চালু হয়েছে। ওদের অনুসরণ করে ইতালি পেরিয়ে অড্রিয়াটিকের উপর দিয়ে উড়ে যাবে, কোনও কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে কোথাও নামতে বাধ্য হলে কাজে আসবে ওটা। 

যেভাবেই হোক,আপনমনে ভাবল তারিক, এটাই ওর শেষ মিশন।  যেভাবে পারে সফল করবেই।

উড়তে শুরু করেছে স্টিলথ হেলিকপ্টার। একটা ক্যানভাস সিটে বসে লিড পাইলটের সাথে কথা বলতে হেডগিয়ার আর মাইক্রোফোন তুলে নিল ও। আচমকা দিনের আলোর মতো আলোকিত হয়ে উঠল হেলিকপ্টারের অভ্যন্তর। সোজা সামনের দিকে ইশারা করল কেউ একজন। 

চট করে ফিরে তাকাল ও, রানওয়ে বরাবর পেছনে একটা হলদে ঝলক দেখা দিয়েই নিমেষে আবার মিইয়ে আসতে দেখল। 

ওদের ব্যাকআপ স্টিলথ হেলিকপ্টার, ওটার চারজন ক্রু এবং বাকি সমস্তকিছু চোখের নিমেষে পুড়ে ছাই আর অঙ্গারে পরিণত হয়েছে। 

কিছুই বলল না ওর তিন সঙ্গী,  খোলা দরজা পথে তাকিয়ে রইল। কিন্তু কাছে এসে চিৎকার করে বলে উঠল খালিদ: 'বলেছিলাম না, ফিরে যাওয়া উচিত ছিল!'

(চলবে)

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.