মৃত্যুর মিছিল

ইজেল

শওকত হোসেন
24 July, 2020, 10:55 pm
Last modified: 24 July, 2020, 11:05 pm
ধারাবাহিক স্পাই থ্রিলার

তিলমাত্র দ্বিধা করল না তারিক। ঝুপ করে নিচু হয়ে গেল ও। আলীয়ার সাহায্যে শেরের কলার জাপ্টে ধরে টেনে-হিঁচড়ে গাছপালার ভেতরে নিয়ে এলো ওকে। নিজেকে জমিনের সাথে মিশিয়ে দিল খালিদ, যেদিক থেকে গুলি এসেছে সেদিক নিশানা করে গুলি চালাল, একবার, দুবার । দ্রুত সরে পড়তে শুরু করল ওরা। 

জঙ্গলে ঢোকার পর ওদের পেছনে রইল খালিদ। বামহাতে শেরের কলার ধরে রেখেছে তারিক, হাঁপাচ্ছে ও। ওর ডান হাতে এইচকে৪১৬। একই কাজ করছে আলীয়াও। শেরকে টেনে নিয়ে চলল ওরা। থামা দরকার, বুঝতে পারছে তারিক, ও কতটা মারাত্মক চোট পেয়েছে দেখাটা জরুরি। কিন্তু আবার গাঢাকা দেয়ার মতো একটা জায়গা খুঁজে বের করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

পেছনে গোলাগুলি থেমে গেছে। দুসেকেন্ডের জন্যে পেছনে চোখ ফেরাল ও। ওদের পেছন পেছন বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে খালিদ। ওদের ছয় ধাওয়াকারী বা আততায়ীর কাউকে দেখা যায় কিনা খেয়াল করছে। কিছু না বলে ঘড়ির কাঁটার নয়টার অবস্থান নিল তারিক। জানে বোরোযান রয়েছে ঘড়ির কাঁটার তিনটায়।

আগে বাড়ো। সামনে চলো। বামে ঘুরল ও। ওদের অনুসরণ করা হতে পারে কিংবা সামনে হয়তো অ্যাম্বুশ পাতা আছে।

তবে পথ পরিষ্কার আছে বলেই মনে হলো।

শেরের শ্বাসপ্রশ্বাস কষ্টকর, অনিয়মিত। আলীয়ার সঙ্কেতের অপেক্ষা করছে ও, যাতে থেমে ওর শুশ্রূসার ব্যবস্থা করেত পারে। কিন্তু ও কিছু বলার আগেই বোরোযান বলল, 'এখন!'

থেমে চারপাশে তীক্ষ্ন নজর চালাল তারিক।

গাছপালা, ঝোপঝাড়, উপড়ে পড়া গাছের গুড়ি। ছুটে আসছে খালিদ।

'কেউ তোমার পিছু নিয়েছে?' জানতে চাইল ও।

'নাহ। ওদিকে কিছুই নেই। শেরের কি অবস্থা?'

'বোরোযান দেখছে ওকে,' হাতের ইশারা করে বলল ও। 'ওদিকটায় নজর রাখো। এদিকটা আমার।'

'বুঝেছি, ওস্তাদ।'

একটা উপড়ে পড়া পাইনের গুড়ির আড়ালে এক হাঁটু গেড়ে বসল তারিক, দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। বোরোযানের কাজের খুটখাট শব্দ কানে আসছে। ফার্স্ট এইড প্যাকেজ টেনে ছেড়ার সময় শেরের উদ্দেশে ফিসফিস করে কথা বলছে। গাছপালার ভেতর নজর চালাল ও। ঝড়ের বেগে ভাবনা চলছে ওর মনের ভেতর।

অ্যালেক্স বেঈমানি করেছে।

কিংবা অ্যালেক্স আসলে অ্যালেক্সই নয়।

অ্যাম্বুশে ফেলা হয়েছে ওদের। 

মনে রাখতে হবে, কেউ একজন ওদের অবস্থান এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল ছিল। 

শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো ওর। বোরোযানের দিকে তাকাল। ওর পাজোড়া ছড়িয়ে আছে। পিছিয়ে এলো ও। ওর সাথে যোগ দিল খালিদ। যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে বোরোযান ও শেরের দিকে এগিয়ে গেল। 

মুখ তুলে তাকাল বোরোযান। 

'তো?' জানতে চাইল তারিক। 

'মারা গেছে,' বলল ও। 'একটামাত্র গুলি, ওর গলা চিরে ঘাড়ের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। প্রফেশনাল, ঠিক জায়গামতো লাগিয়েছে। কোনো সুযোগই ছিল না ওর।'

একটা ব্যান্ডেজ র‌্যাপার দুমড়ে ফেলল ও। 'কোনো সুযোগই ছিল না।'

শেরের মৃতদেহ নিয়ে যা করা উচিত তাই করল ওরা: ঝটপট লুকিয়ে ফেলল। দুটো পাইন গাছ পাশাপাশি উল্টে পড়ে আছে, এমন একটা জয়গায় খুঁজে বের করল ওরা। খালিদ, বোরোযান এবং তারিক মিলে প্রায় নিঃশব্দে কাজ করে চলল। অজানা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে ওর মনের ভেতর। কথা বলে উঠছে একটা কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বরই কিন্তু পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়ানো অবস্থায় শূন্যে ঝাপ দিতে উস্কানি দেয়।  

আনুমানিক ০২৩০ টায় কণ্ঠস্বরটা ওকে বলছিল, 'ভালো দেখিয়েছ, বুড়ো খোকা। এই অপারেশন শেষ হবে যখন, আবার সভ্য জগতে পা রাখবে তুমি, চড়া বেতনের কনসালট্যান্ট হিসাবে সরকারী চাকরিতে ঢুকতে পারবে আবার। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ভাষণ দেবে, হতচ্ছাড়া অ্যাম্বুশের কথা জানা থাকার পরেও সেই ফাঁদে পড়ে দলীয় সদস্যের লাশের গতি করার কায়দাকানুনের হাতে কলমে সবক দেবে।

ওদের কাজ শেষ হয়ে গেল। ফের এগোতে শুরু করল ওরা। কেউ কথা বলছে না।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো এলোমেলোভাবে এগোনোর পর হাতের ইশারায় ওদের থামতে বলল তারিক। খালিদ আর বোরোযানকে কাছে ডাকল। প্রবল তুষারপাত হচ্ছে এখন। ঝোপঝাড়, কাঁটাগাছের ঝোপের একটা তেকোণা জায়গায় এসে পড়েছে ওরা।

অপারেশনে নামার অর্থ রক্ত গরম করা বুলি কপচানো না হয়ে থাকলে এই ধরনের আলাপের সময় অবশ্যই নয় এটা।

'তোমাদের কারো ১৯৯৯ সালে কসোভো বম্বিংয়ের কথা মনে আছে?' জানতে চাইল ও। 

চতুর উত্তর আশা করছিল ও-যেমন 'না, আমি আসলে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম'-কিন্তু শ্রেফ ঘোঁৎ জাতীয় একটা শব্দ শুনতে হলো। ভালো লক্ষণ নয়। খেই ধরল ও। 

'আমাদের মতো একই জায়গা থেকে ন্যাটোর বেশিরভাগ বম্বিং রেইডই শুরু হয়েছিল-আভিয়ানো। সার্ব এবং অন্যরা গেটের বাইরে বিনোকিউলার, সেল ফোন এবং কম্পাস হাতে সিভিলিয়ানদের দাঁড় করিয়ে রাখত। এয়ারক্র্য্যাফট টেকঅফ করতে দেখতে পেত ওরা, সেগুলোর ডিরেক্শন হিসাব করে অড্রিয়াটিকের অপর পারের বন্ধুদের সেই খবর জানিয়ে দিত।'

ক্লান্ত কণ্ঠে কথা বলে উঠল আলীয়া রোরোযান। 'ফ্লাইট টাইম জানা থাকায় ঠিক কখন বোমা বর্ষণ শুরু হবে ঠিক বুঝে যেত ওরা।'

'ঠিক,' বলল ও। 'খালি চোখে আমাদের চপারের আকাশে ওঠার সময় দেখে আর আমাদের যুদ্ধবাজ বন্ধু দার্কো ইদানীং খবরে ফিরে এসেছে জানা থাকায় একটা অভ্যর্থনা কমিটি রেডি রাখা খুব একটা কঠিন হয়নি।'

তুষারের বুকে থুতু ফেলল খালিদ। 'এখন কি, ওস্তাদ?'

'ভালো প্রশ্ন। আমাদের অ্যালেক্স লোকটা হয় উল্টে গেছে নয়তো অক্কা পেয়েছে। তার মানে আশপাশে আমাদেও কোনো বন্ধু নেই। এটা পাঁচজনের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। এখন তিনজন আছি আমরা। আমাদের ধাওয়া করা হচ্ছে। গোটা এলাকাই বোধ হয় সতর্ক হয়ে আছে। ঠিক এই অবস্থা এখন আমাদের।'

এখন একটানা ঝরছে তুষার। কিন্তু তবু উষ্ণ এবং স্বস্তি বোধ করছে দেখে অবাক হলো তারিক। নিশ্চয়ই রক্তে অ্যাড্রেনালিন আর নানারকম রাসায়নিক বস্তুর আনাগোনার কারণেই হবে। 

আহারে, শেষ অপারেশন! 

'ঠিক আছে, বেলগ্রেডের স্মার্ট হ্যাকাররা আমাদের সিস্টেমই ট্যাপ করে থাকতে পারে, তো আমরা উনিশ শতকে ফিরে যাবো। সেল ফোন, হেডহেল্ড'-ঘাড়ের পেছনে টেলিমেট্রি প্যাচ ধরে হ্যাচকা টান লাগাল ও,'আর এটা ফেলে দিচ্ছি। এখন।'

এক মিনিটের মধ্যেই বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের একটা ছোটখাটো ঢিবি তৈরি হয়ে গেল। এবার মোল্লে ভেস্ট থেকে একটা জিনিস উপড়ে নিয়ে ঢিবির উপর ফেলল ও।  
'হায় খোদা, ওস্তাদ,' বলে উঠল খালিদ। 'ওটা আমাদের স্যাট-ফোন।'

'তোমার নজর বেশ কড়া,' বলল তারিক। 'আগামী ইভ্যালুয়েশনে তোমার ভালো নম্বর পাওয়া নিশ্চিত করব আমি।'

'স্যাট-ফোন ছাড়া এক্সট্রাকশনের জন্যে খবর দেবে কিভাবে?' জানতে চাইল বোরোযান। 

'সহজ,' বলল তারিক। 'ফোনঅলা ফাঁকা কোনো বাড়ি খুঁজে বের করে লং ডিস্টেন্স কলের ব্যবস্থা নেব। অ্যাভিয়ানোর অপারেশন্স সেন্টারকে কোত্থেকে আমাদের তুলতে হবে জানিয়ে দেব। গ্রেনাডায় এই কায়দা কাজ দিয়েছিল।'

'গ্রেনাডায় কাজটা কি ছিল?' জানতে চাইল খালিদ। 

'ঠিকাছে, তুমি তো আবার অপারেশনাল ইতিহাসে দুর্বল, তো তোমার ইভ্যালুয়েশনের সময় ভালো কথা ভুলে যাব আমরা।' বলল তারিক। '১৯৮৩ সালে গ্রেনাডায় আক্রমণ। কয়েকজন সীল সদস্য গভর্নর জেনারেলের ম্যানশনে আটকা পড়ে যায। ওদের রেডিও গিয়ারের ব্যাটরির চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল। ম্যানশনের ল্যান্ডলাইন ব্যবহার করে ফ্লোরিডায় স্পেশাল অপস কমান্ডে যোগাযোগ করে ওরা। এভাবে ওদের এয়ার সাপোর্ট দিতে বেশ কয়েকটা এসি-১৩০ যোগাড় করতে পেরেছিল।'

'হ্যাঁ, তাই তো,' বলল আলীয়া বোরোযান। 

'তো তোমার কি মনে হয়, ওস্তাদ?' জানতে চাইল খালিদ। 

'আমরা আগে বাড়ব,' বলল তারিক। 'আমরা দার্কোকে পাকড়াও করলেই বালকান্সে শান্তির নহর বয়ে যাবে, ওইসব ছেঁদো কথায় বিশ্বাস নেই আমার। তবে লোকটা খারাপ, অনেক সময় সঠিক মন্দলোকটাকে খুঁজে বের করে কপালে একটা টিপ পরিয়ে দেয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। তাতে অন্য বদমাশরা একটু খামোশ খেয়ে যায় আরকি।'

'এখন তো আমরা মাত্র তিনজন,' বলল আলীয়া বোরোযান। 'এখন ধরা পড়াটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা বেশ বিগড়ে আছি, সেটাও আমাদের পক্ষেই যাচ্ছে। ক্লেটন আর শেরকে হারিয়ে লেজ গুটিয়ে ঘরে ফেরার চিন্তা মোটেই পছন্দ না আমার। আমি বদলা নিতে চাই। আজ রাতেই।'

'আমিও,' সুর মেলাল খালিদ। 

তারিক ঘড়ি দেখল। পয়েন্ট-কিউ গড়বড় হয়ে যাওয়ায়, এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে বলে একটা ঘণ্টা হাতছাড়া হয়ে গেছে। 

'ঠিকাছে। দশ মিনিটের বিরতি। তারপর আবার রওয়ানা হব আমরা।'

'বিশ্রামের গুল্লি মারি, ওস্তাদ,' বলল খালিদ। 'আমি এখনই আগে বাড়তে রেডি আছি।'

'আমিও একমত,' বলল বোরোযান। 

এক মুহূর্ত কিছু বলতে পারল না তারিক। বোরোযানের কাছাকাছি আছে ও। তো অন্ধকারে তুষারপাতের ভেতর ওর পিঠে আলগোছে হাত রাখল ও। 

'ঠিক আছে, আমরা রওয়ানা হচ্ছি,' বলল ও। 'কিন্তু খালিদ, চোখা কোনো ডাণ্ডা চোখে পড়ল্ইে আমাকে জানাবে।'

'কিসের জন্যে?'

'সূর্য ওঠার আগেই ওটার মাথায় গাঁথা হবে একজনের মুণ্ডু।'

১০

টপো ম্যাপ জরিপ করতে গড়ে পনেরো মিনিট অন্তর থামছে তারিক। জিনিসটা বিশদ, বেশ কাজে লাগছে। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতিহীন একমাত্র এই জিনিসটা ওদের মাথা পরিষ্কার রেখে সামনে কি অপেক্ষা করছে জানিয়ে দিচ্ছে। এটা পাথুরে ক্লিফ, অসংখ্য গোর্জ, এবড়োখেবড়ো বন্ধুর এলাকা। এসবের ভেতর দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে ওদের। যারপরনাই ঠাণ্ডা পড়েছে। মাঝরাত এখন। এখনও প্রবল বেগে তুষার ঝরে চলেছে।

ওদের প্রতিপক্ষ, প্যারামিলিটারি বা যাই হোক, আপন ভূমিতে কিভাবে সক্রিয় থাকতে পারে, ভালো করেই জানে ও। ভোরের দিকে ভীষণ ক্ষোভে অশুভ আমেরিকান দানোদের খুঁজে বের করে বন্দী বা জয়ের আনন্দে খতম করতে ব্যাকুল থাকবে ওরা। 

বেশ কিছুটা সময় সক্রিয় থাকবে এই তাড়ণা, তারপর ঠাণ্ডা চেপে ধরবে ওদের। শীতল হাওয়া এবং গলন্ত তুষার ওদের ঘাড়ের বেয়ে গড়াতে শুরু করবে। উল্টাপাল্টা রাস্তায় হোঁচট খেয়ে বেড়াবে, পথ হারাবে। তারপর কোনো একটা পাথুরে গোর্জের দেখা পেয়ে ওটার দিকে চোখ রেখে 'গোল্লায় যাক সব' বুলিটার সার্বিয় ভাষ্য আউড়ে রাতের মতো ক্ষান্ত দিতে কোনো উষ্ণ গোলাবাড়ি বা খামারবাড়ি খুঁজে নেবে।  

ওদের দোষ দেয় না তারিক। তবে ব্যাপারটাকে নিজেদের সুবিধায় কাজে লাগাতে চায়। 

কঠিন পথ চলা, তবে এই সময়ই আসলে প্রশিক্ষণের সুফল মেলে। সীলে ওদের বন্ধু ও সহযোদ্ধাদের ভেতর একটা কথা চালু আছে: 'সবকিছু শ্রেফ গতকালই সহজ ছিল।' উচিত কথাই বলে ওরা। 

একটা পাথরের বেরিয়ে থাকা অংশের উপর ম্যাপ বিছিয়ে আবার পরখ করল ও। বাতাস এখন রীতিমতো চাবুক কষছে। 'আমরা এই পাহাড় থেকে নেমে আনুমানিক দুই কিলোমিটার আগে বাড়লেই এই ঝর্নার কাছে পৌঁছে যাব। ওটা পেরুনোর মতো একটা জায়গা খুঁজে বের করব। তারপর আর মাত্র কিলোমিটারের মতো সামনে বাড়লেইপৌঁছে যাব দার্কোর আস্তানায়।'

'শয়তানের বাচ্চাটা মনে হয় এখন নরম-গরম বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে বাচ্চা আর মেয়েদের খুনের স্বপ্ন দেখছে,' বলল খালিদ। 

'বেশ, ওর জন্যে বিশেষ রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা করব আমরা,' বলল তারিক। 'আমাদের হাতে এখনো অন্ধকারে কাজ সেরে সটকে পড়ার মতো সময় আছে।'

'তোমার তাই মনে হয়, বস?' বলল বোরোযান। 

ম্যাপটা সাইড পকেটে চালান করল ও। 'কি বলতে চাও?' জানতে চাইল। 

'আমরা পাঁচ সদস্যের অ্যাসল্ট টিম হিসাবে ট্রেনিং পেয়েছি। এখন মাত্র একজন ওখানে যাওয়ার পর কি করব?'

'বরাবর যা করি,' বলল তারিক। 'একটা কিছু উপায় খুঁজে বের করব। খাপ খাওয়াব। সামলে নেব। মেমো পাওনি তুমি?'

'মেমো-টেমো না পড়ার চেষ্টাই করি আমি,' বলল ও। 'সাধারণত ওসব আমার সময় নষ্ট করে। রিক্লাইকিং আর ট্রেনিংয়ের স্পর্শকাতরতা নিয়ে কথা বলে।'

হাসল খালিদ। 'ওহ, এখানেই তোমার কুত্তী স্বভাবের কারণ বোঝা যায়, সেনসিটিভিটি টেস্টে নাম লেখাতে চাও না।'

খালিদ, একটা ছাগল আর তিনটা অ-কোষ নিয়ে অশ্রাব্য, অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়ে পাল্টা সাড়া দিল বোরোযান। অন্ধকারে, তুষারপাতের ভেতর হাসল তারিক। ওদের তর্ক করতে দেখে ভালো লাগছে। 

নাংগা পাহাড় থেকে নেমে আগে বাড়ল ওরা। বাতাসের ধাক্কা না থাকায় তুষারের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে ভালো লাগছে। কিন্তু ওই ভালো অনুভূতি ঝর্নাধারা পর্যন্ত পৌছানো অবধিই টিকে রইল। 

মোটেই ঝর্না নয়, রীতিমতো খরস্রোতা একটা নদী। 

হাঁটু গেড়ে বসল ওরা। ম্যাপ জরিপ করল তারিক। নদী তীরের এবড়োখেবড়ো পাথর আর আবর্জনার দিকে নজর ফেরাল। নদীর ওপারেও একই রকম লম্বা পাইনের সারি, নাংগা পাথর আর গাছের গুড়ি। 

গাছপালা এখন আর ভালো লাগছে না ওর। 

'ম্যাপে তো এটাকে ছোট একটা ঝর্নার মতো মনে হয়েছে,' বলল ও।  

'সবই পাল্টে যায়,' বলল বোরোযান। 

'হ্যাঁ,' বলল ও। 'বোরোযান, এক শো মিটারের মতো ভাটির দিকে যাবে তুমি, পেরুনোর মতো কোনো জায়গা আছে কিনা দেখবে। খালিদ, তুমি উজানে যাও। স্রোত ধীরে বইছে আর নদীটা চওড়া হয়ে গেছে, এমন কোনো জায়গা আছে হয়তো। আমরা হয়তো পায়ে হেঁটেই পেরিয়ে যেতে পারব। যত জলদি পার, ফিরে আসবে।'

বোরোযান বলল, 'তুমি কি করবে?'

'কমান্ডের দায়দায়িত্বে কথা ভাবব,' বলল ও। 'যাও, আগে বাড়।'

ওর লোকজন মাত্র দুজন!পিছলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। টপো ম্যাপ বের করে এনভিজির ভূতুড়ে সবুজ আলোয় আরও একবার জরিপ করল ও। এখানে আসা ভুল হয়ে গেল কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। অবশ্যই এটা প্রথম ভুল হবে না। 

'কমান্ডের দায়দায়িত্বের' কথা বলার সময় মোটেই রসিকতা করেনি ও। এমন অবস্থাই হয় শেষ পর্যন্ত- ক্রুরা ওর নৈপুণ্য, অভিজ্ঞতা, বিচারবুদ্ধির উপর ভরসা করছে, অথচ ওদের সমস্ত যন্ত্রপাতি ফেলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও নিজেই। 

বেসামরিক লোকদের গাড়িতে লাগানো জিনিসের তুলনায় পাঁচ গুণ নির্ভুল ওদের জিপিএস সিস্টেমও। ওটা ঠিকঠিক ওদের অবস্থান জানিয়ে দিত, ভুলে সম্ভাবনা বড়জোর আধমিটারের মতো হতো হয়তো। 

কিন্তু এখন পুরোনো আমলের কৌশলের উপর নির্ভর করছে ও। বোরোযান আর খালিদের কাছে স্বীকার না করলেও, মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। 

ডান-বামে নড়াচড়া। ওর লোকজনকে জোড়া বেঁধে কাজ করতে দেখে ভালো লাগছে। ওদের ভেতর এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায় দুজনই আগেভাগে ওর কাছে এসে হাজির হতে দ্রুত ছুটছে। 

বোরোযানই এলো আগে। 'সরি বস,' বলল ও। 'ওদিকের অবস্থা আরও খতরনাক। আরেকটা ঝর্না এসে মিশে আরও গভীর আর খরস্রোতা করে তুলেছে।'

খোশ মেজাজে আছে খালিদ। 'এবং জয় লাভ করেছে খালিদ, ওস্তাদ।'

'কি পেলে?' 

'কাঠের ফুটব্রিজ, এই ধরো পঞ্চাশ মিটার সামনে। নিখুঁত।'

ম্যাপ সরিয়ে রাখল তারিক। 'চলো দেখা যাক।'

সামনে অবস্থান নিল খালিদ। মাঝখানে আলীয়া বোরোযান, পেছনে রইল তারিক। তুষারপাতের ভেতর ওর ঘাড়ের পেছনে ভিন্ন কিছু সুরসুরি দিচ্ছে। কেন জানে না, একটা কিছু খোঁচাচ্ছে ওকে। অথচ বেখাপ্পা কিছুই চোখে পড়ছে না। গভীর বনে থাকার সময় যেকোনো কিছুই-কিংবা অস্ত্রের মতো কোনো সরল রেখা-বেখাপ্পা ঠেকতেই পারে। প্রকৃতি সোজা রেখায় কাজ করে না। 

ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর পার। খালিদের কথামতো জায়গামতোই আছে কাঠের ফুটব্রিজ। নদীর এপার থেকে ওপারে চলে গেছে। নিখুঁত। তরতাজা কাঠের গন্ধ পেয়ে উজানে নজর বোলাতে এগিয়ে গেল ও। 

অল ক্লিয়ার।

নদীর ওপারে তাকাল ও। 

অল ক্লিয়ার। 

প্রত্যাশার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে খালিদ আর আলীয়া। 

'তো?' জানতে চাইল খালিদ। 

'না,' বলল তারিক। 'ওপারে যাচ্ছি না আমরা।'

১১

'ধুশ শালা!' খিস্তি করে উঠল খালিদ। 

'না কেন, বস?' জানতে চাইল আলীয়া। 

দীর্ঘ সেতু খা-খা করছ। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওদের। 

'বলতে পারছি না, তবে আমার কাছে কেন যেন সুবিধার ঠেকছে না,' বলল তারিক। 'তোমাদের তো জানা আছে আমাদের ম্যাপগুলো কেমন নিখুঁত হয়। আমাদের হাতে থাকা ম্যাপে কিন্তু ওই সেতুর চিহ্ন নেই।'

'ম্যাপ ভুল হতেও পারে,' বলল আলীয়া। 'সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না।

'কিংবা...কিছু মনে করো না, ওস্তাদ, আমরা হয়তো ভুল পথে এসে পড়েছি।'

তারিকের বয়স আরেকটু কম হলে হয়তো খালিদেও এই কথায় মেজাজ খিঁচড়ে যেত ওর। কিন্তু  এখন সে বয়স নেই, তাই কথাটা অগ্রাহ্য করল। 'হতে পারে আমাদের হাতে ভুল ম্যাপ এসে পড়েছে, আমরা হারিয়ে গিয়েও থাকতে পারি, কিন্তু যাই হোক, আপাতত ওই ব্রিজ কাজে লাগাচ্ছি না আমরা। আমার কাছে সুবিধের ঠেকছে না।'

একটা কিছু বলল খালিদ, কিন্তু সেদিকে কান নেই তারিকের; কি যেন শোনার চেষ্টা করছে ও। ঘণ্টার মতো ক্ষীণ টুংটাং এক ধরনের শব্দ। হাতের ইশারায় ওদের সতর্ক করল ও। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল ওরা। 

টুংটাং শব্দটা আবার ফিরে এলো। হাতের ইশারা করল তারিক। নদীর উজনের দিকে পা বাড়াল ওরা। ধীর পায়ে, চারদিকে তীক্ষ্ন চোখে নজর বোলাতে বোলাতে এগিয়ে চলল। খানিক পরেই পরিচিত পশুর ডাক কানে এলো। স্বস্তি বোধ করলও। বামদিকের জমিনটা একটু উঁচু, জায়গাটা কুপিয়ে সমান করা হয়েছে। লাকড়ির ধোঁয়া আর নাদিও কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মাথা নুইয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে কাঁটাতারে ঘেরাও করা একটা খোঁয়াড়ের কাছে হাজির হলো ওরা। ওটার ভেতর অগুনতি ভেড়া গিজগিজ করছে। খোঁয়াড়ের ওধারে একটা খামার বাড়ি, ওটার ছাদে চিমনি থেকে অলস ভঙ্গিতে তুষারপাতের ভেতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। 

'ভেড়ার মাংসের রোস্টের কথা ভাবছ?' ফিসফিস করে বলল খালিদ। 

'না,' কাঁটাতারে ঘেরা খোঁয়াড়ের ওপাশে নজর চালিয়ে পাল্টা ফিসফিস করে জবাব দিল তারিক। 'অন্তত এখন না।'

কথা বলে উঠল আলীয়া বোরোযান। 'তাহলে, বস, কি ভাবছ তুমি?'

থুতনি চুলকাল তারিক। 'মুক্তি। মুক্তির কথা ভাবছি আমি।'

কি করতে চায় অল্প কথায় ওদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল তারিক। তবে বাকি দুজনের হাবভাবে মনে হলো বুঝি নিরেট দেয়ালে বারবার মাথা ঠুকে ভেতরে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছে ও। তবে তর্কে গেল না কেউই। 

সেতুর কাছাকাছি এসে অপেক্ষা করতে লাগল ও। এদিক খামারে গিয়ে কাজে লেগে গেল খালিদ এবং আলীয়া। ঘড়ির দিকে নজর রাখছে ও। মিনিটের পর মিনিট পেরিয়ে গেলেও গা করছে না। শীতল, ধারাল বাতাসে শ্বাস টানল ও। ক্রমাগত ঝরে চলা তুষারপাত দেখছে। এই ফাঁকে ক্ষণে ক্ষণে ক্লেটন এবং শেরের কথা মনে পড়ছে। 

অনেক নড়াচড়া, অনেক হাঁকডাক। ভেড়ার ডাক। 

নদীর কিনারা বরাবর ছুটে আসছে সাত থেকে আটটা ভেড়া। ওগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে আসছে খালিদ আর বোরোযান। ভেড়ার রাখালগিরি করা ওদের কাজ ছিল না কখনও, ভাবল তারিক, তবে কাজটা ভালোই করছে ওরা। হাত মেলে দিল ও। ডান হাতে এইচকে৪১৬ ধরা। শিস বাজাতে লাগল ও। ভেড়াগুলো যাতে আরো দূরে যেতে না পারে, তাই ওগুলোর পথ রোধ করে দাঁড়াল।

ওগুলোর বামে পাথরের ঢিবি আর ঝোপ; বামে উন্মুক্ত সেতু। বামে ঘুরল সর্দার ভেড়াটা, ওটাকে অনুসরণ করল বাকিগুলো। বনের গাছপালায় ঠিকরে যাচ্ছে ওগুলোর ক্ষুদে খুরের আওয়াজ। ওর সাথে যোগ দিতে ফিরে এলো খালিদ আর বোরোযান।

'তো,' বলল বোরোযান। 

'ধেৎ, কি জঘন্য গন্ধ!' বলল খালিদ। 

কি বলবে বুঝতে পারল না তারিক, কিন্তু ভেড়াগুলো সেতুর মাঝামাঝি পৌঁছাতেই আলোর একটা ঝলকানি তুলে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো ওটার মাঝখানটা। চমকে উঠল ও।

(চলবে)

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.