মৃত্যুর মিছিল

ইজেল

শওকত হোসেন
17 July, 2020, 11:30 pm
Last modified: 18 July, 2020, 12:38 am
ধারাবাহিক স্পাই থ্রিলার

তারিকের শেষ গোপন মিশন, কিন্তু বিশ্বাসঘাকতা কঠিন বিপদে নিয়ে ফেলল তাকে। বেঁচে ফিরতে হলে জীবন বাজি রাখা ছাড়া কোনো উপায় নাই। কিন্তু চারিদিকে শত্রু কাকে বিশ্বাস করবে... 

৫.

এরপরের ঘটনা কেউ কখনো হিস্ট্রি চ্যানেল বা নোভায়ও দেখা ও সুযোগ পাবে না। ক্লেটনের ত্রুটিপূর্ণ প্যারাশেূট নামিয়ে আনল ওরা। ও জমিনে এসে পড়ার মুহূর্তে চারদিকে ছিটকে যাওয়া বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এক জায়গায় জড়ো করল। তারপর খুচরো যন্ত্রাপতিসহ ক্লেটনের লাশ লুকিয়ে রাখার যথাসাধ্য প্রয়াস পেল। হাতে সময় নেই, কাজটা তাই খুব একটা নিপুণভাবে সারা গেল না। তাছাড়া সদ্য খোঁড়া মাটি আবার একটা কিছু ঘটার চোখে পড়ার মতো আলামত হয়ে দাঁড়ায়। যেটুকু করার ছিল তাই করল ওরা। এবার ওকে রেখে যাওয়া জায়গাটার বিয়ারিং টুকে রাখল তারিক, যেন কোনো এক সময়, এই যুদ্ধ শেষ হলে শেষতক সব যুদ্ধই শেষ হয়, তাতে এক শো বছর লাগলেও ওকে দেশে  ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসতে পারে ওরা। 

যুদ্ধ ক্ষেত্রে কখনো কাউকে ফেলে না যাওয়ার ক্ষেত্রে ওদেও ভেতর এক ধরনের গভীর অনুভূতি কাজ করে। তবে এই ধরনের অপারেশনে বাস্তববাদী না হয়ে উপায় নেই। একে সাময়িক ব্যবস্থা ভাবতেই পছন্দ করে ও। কোনো একদিন মাটি খুঁড়ে ওকে আবার তুলে নিয়ে ওর প্রিয় ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরিয়ে নেয়া হবে। 
এছাড়াও আরেকটা কাজ করল তারিক। নোটবুক, পেন্সিল আর লাল লেন্সঅলা আলোর দরকার হলো। সেজন্যে।  কোঅর্ডিনেটগুলো কাগজে টুকে নিল ও। খোদা না করুন হ্যান্ডহেল্ড খোয়া যেতে পারে, গুলির আঘাতে চুরমার হতে পারে কিংবা অন্যকোনোভাবে হাতছাড়া হতে পারে। 

আবার যখন দলের সঙ্গে যোগ দিল ও, দেখা গেল ঘটনা নিয়ে জোর আলোচনা করছে ওরা। অবাক হলো না ও। বোরোযানকে জিজ্ঞেস করল শের, 'কিভাবে ঘটল ব্যাপারটা, অ্যাঁ? কি করেছিলে তুমি? কেন বারবার ও বেচারার বেঁচে থাকার কথা বলছিলে?'
'নির্ঘাত সফটঅয়্যারের ঝামেলা। কিংবা সিস্টেমের কোনো ভেজাল। খোদার কসম, আমি এমন কিছু ঘটতে দিয়েছি ভাবছো নকি?' বলল বোরোযান।
'বেচারা উল্কার মতো মটিতে পড়ামাত্র মারা পড়েছে,' বলল শের। 'অথচ তোমার হ্যান্ডহেল্ড খালি জানাচ্ছিল ও বেঁচে আছে।'
'ঠিক,' পাল্টা ফিসফিস করে বলল বোরোযান। 'আমি রিচেক করেছি। এক ধরনের ডায়াগনস্টিক। এখনও ওটা বলছে-'
'রাখো,' বলল তারিক। 'বহুত বাজে আলাপ হলো, কিন্তু এভাবে তো আর অবস্থা বদলাচ্ছে না। হয়েছে।'
আরবিতে ফিসফিস করে কিযেন বলল খালিদ। 'ফিরতি পথ ধরার সময় হয়েছে,' পাত্তা না দিয়ে বলল ও। 'অ্যলেক্সের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। দার্কো লাতোসের সামনে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুভেচ্ছা জানাতে হবে। বোঝা গেছে?'
'বুঝেছি, ওস্তাদ,' বলল খালিদ। 'কিন্তু বোরোযানের হতচ্ছাড়া জাপানি ঝামেলার কারণে একটা মরা লাশের খোঁজ করতে গিয়ে একটা ঘণ্টা নষ্ট হলো-আমার মাথা বিগড়ে যাচ্ছে: খারাপ কিছু বোঝাচ্ছি না কিন্তু।'
'এমন হয়,' বলল তারিক। 'এবার, ভুলে যাও ওসব। কাজে নামো।'
আবার পাথুরে ঢিবি আর গাছপালার ভেতর দিয়ে উল্টো পথ ধরে এগোল ওরা। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে আগে বাড়ছে। অগভীর একটা কবরে সহযোদ্ধাকে ফেলে যেতে হচ্ছে,  আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হয়ে থাকবে জায়গাটা। 

দলকে চাপ দেয়ার সাহস হচ্ছে না ওর, তাড়াহুড়ো করলে শব্দ বেড়ে যাবে, চোখে পড়ার আশঙ্কা বাড়বে, ধরা পড়ে যাওয়ার অন্যান্য ঝুঁকিও বাড়বে। তবে অবিরাম এগিয়ে চলছে ওরা। আবার সেই হতচ্ছাড়া রাস্তার কাছে এসে হাজির হলো। এদিক ওদিক নজর চালাল ওরা। সামনে-পেছনে দেখল। ইশারায় সবাইকে আগে বাড়তে বলবে, এমন সময় চোখের কোণে ক্ষীণ একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল তারিকের। নিমেষে সবাইকে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার ইঙ্গিত করল ও। পাথরের মতো স্থিও হয়ে গেছে ওরা। নড়াচড়ার ক্ষীণ একটু অওয়াজ উঠল। কে বা কারা আসছে বোঝার জন্যে মাথা উঁচু করে রেখেছে তারিক।  
রাস্তার শেষমাথায় ক্রমশ বাড়তে বাড়তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল একটা আভা। 
হেডলাইট এগিয়ে আসছে। 
এঞ্জিনের শব্দ। 
চারটে গাড়ির একটা কনভয় সাঁই সাঁই করে চলে গেল। ওগুলোর সামনে একটা ২০এমএম কামান আর একটা ৭.৬২ এমএম মেশিন গানে সজ্জিত একটা ট্র্যাক্টড বিভিপি এম-৮০ ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল। অন্তত ছয়জন পদাতিক সৈন্য বহন করতে পারে ওই জিনিস-চেপেচুপে বসলে আটজনও। দ্রুত বেগে ওটাকে অনুসরণ করছে দুটো কালো রংয়ের টয়োটা পিকআপ ট্রাক-অজানা অশুভ কোনো কারণে সারা দুনিয়ার বিদ্রোহীদের পছন্দের গাড়ি। ওগুলোর রিয়ার বেডে হয় নিয়মিত সার্ব বাহিনী কিংবা ওই দূষিত আবহাওয়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য প্যারামিলিটিরি ইউনিটের কেউ থাকে। দুটো পিকআপ ট্রাকের ঠিক পেছনে একটা ফোর-হুইল্ড আর্মার্ড পার্সেনেল ক্যারিয়ার-একটা বিওভি-ওটার ছাদে নিজস্ব ৭.৬২ এমএম মেশিন গান লাগানো। হেডলাইটের কর্কশ আলোয় নিরীহ ভঙ্গিতে নাচছে ঝরে পড়া তুষার কণা। 
গাড়িগুলো রাস্তা ধরে উধাও হলো। তারপরও আরও কিছুসময় অপেক্ষা করল ও। ঘড়ি পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার জানান দিলে উঠে সদলবলে রাস্তা পেরিয়ে বনের আপেক্ষিক নিরাপত্তায় পা রাখল ও। 
ইট বিছানো রাস্তা এজন্যেই ঘৃণা করে ও। 
ঠিক।  

৬. 

বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ড্রপ যোনের পাথর আর বোল্ডারের পাহাড় পাশ কাটিয়ে সামনে এগোল ওরা। জোর করে ক্লেটনের চিন্তা মন থেকে সরিয়ে রেখেছে ও। তাই বলে কঠিন মনের মানুষ নয় ও। (অতীতেও ওর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে), আসলে মিশনের দিকেই পুরো মনোযোগ দিতে চাইছে, বাঁচতে চাইলে এছাড়া গতি নেই। হয়তো সামনে কোনো এক সময় একাকী এবং দলের বাকি সবাইকে নিয়েই ওর জন্যে শোক করবে ও। তখন প্রচুর রসিকতা, পান আর গল্পগুজব চলবে। যেসব গল্পের বেশিরভাগ শুরু হবে 'ক্লেটন আর আমি এরপর কি করেছি বললে বিশ্বাস করবে না...' জাতীয় কোনো কথা দিয়ে। তারপর আরও পান চলবে, গ্লাস ভাঙবে, হয়তো দুই এক দফা হাতাহাতিও। 
কিন্তু এখন নয়। ক্লেটনকে নিয়ে সমস্ত ভাবনা মজবুত একটা বাক্সে ঠেসে রেখে মনের পেছনে কোথাও কোনো তাকে তুলে রেখেছে ও। ওটার আবার ঠাসাঠাসি অবস্থা। 
রাস্তা ছেড়ে আসার আনুমানিক ঘণ্টাখানেক পর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে জিরিয়ে নিল ওরা। এই ফাঁকে সবাইকে কোঅর্ডিনেটগুলো আবার যাচাই করে দেখতে বলল ও । মুখে না বললেও বোরোযানের ডিভাইসের ঘাপলার কথা ভোলেনি ও। ভুল ডেটা যুগিয়েছে ওটা। অথচ এমন কিছু ঘটার কথা ছিল না। তো অন্ধকার বনের ভেতর বৃত্তাকারে ঘন হয়ে বসে জিপিএস কোঅর্ডিনেটগুলো পরখ করল ও। পাশাপাশি পাহাড়ী এলাকা এবং ওদের কম্পাসের সাথে টপো ম্যাপ মিলিয়ে দেখার উপরও জোর দিল। 
সবকিছু পরখ করা হলো। এখন ০১১০ ঘণ্টা, ফের পথে নামল ওরা। ০২০০ ঘণ্টায় পয়েন্ট কিউ-তে গাইড অ্যালেক্সের সাথে যোগ দেয়ার কথা। পঞ্চাশ মিনিটের ভেতর মাঝের দূরত্ব পেরুতে হবে, কিন্তু আসলে মাত্র তিরিশ মিনিট সময় লাগার কথা। 
'ঠিকাছে, স্যাডল আপ,' ফিসফিস করে বলল ও। তখনই কানে এলো শব্দটা। 
জায়গায় জমে গেল ও। বাকি সবাই।  
থেকে থেকে জোরালো হাওয়া দিচ্ছে। তখনই চড়ে উঠছে শব্দটা। এঞ্জিনের গর্জন। অনেকগুলো। 
'কি মনে হয়, ওস্তাদ?' জানতে চাইল খালিদ। 
'আর্মার্ড আউটফিট হতে পারে, কিংবা স্রেফ কোনো ট্রান্সপোর্ট ইউনিট,' বলে আরও ভালো করে শোনার জন্যে সামান্য সরে এলো ও। 
'হ্যাঁ,' বলল আলীয়া বোরোযান। 
আরও জোরালো হলো আওয়াজটা। তারপর একটু কমল, যে দম নিচ্ছে। 
'রেকি করতে যাচ্ছি আমরা,' বলে উঠ দাঁড়াল তারিক। 
'বস,' জানতে চাইল শের, 'আমাদের হাতে সময় আছে তো?'
'আছে,' বলল ও। 'এদিকটায় কোনো আর্মার্ড কোম্পানি টহল দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে থাকলে, সেটা এখনই জানতে চাই আমি, পরে না। আগে বাড়ো।'
ওদের অনীহাটুকু টের পাচ্ছে তারিক। তবে  ছড়িয়ে পড়ে সাবধানে সামনে এগোতে লাগল ওরা। তারিকের মনে আবার খুঁতখুতানি বেশি, যেজন্যে বহুবার টিটকারির মুখে পড়তে হয়েছে বটে, কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেছে ও। বছরের পর বছর আরও অনেকের প্রাণও রক্ষা পেয়েছে। ওদের বামদিকে একটা কিছু ঘটছে। সামনে বাড়ার আগেই সেটা কি জানতে চায় ও। 
আরও জোরালো হয়ে উঠল আওয়াজটা, তারপর আবার ক্ষীণ। দুবার চিৎকার কানে এলো ওদের। একটা জায়গায় এসে কড়া আলো জ্বলছে দেখে চোখের পলকে জমিনে লুটিয়ে পড়ল ওরা। কনুই আর পেটে ভর দিয়ে আগে বাড়ল। আগের চেয়ে ঢের ধীরে এগুচ্ছে। আলো এখন ভীষণ জোরালো, এনভিজি মাথার উপর তুলে দিল ও। হালকা ঘাস, নিচু কিছু ঝোপ আর অবিরাম ঝরতে থাকা তুষার ভেদ করে সামনের ঘটনা দেখতে লাগল ও। 
একটা ছোট নগ্ন মাঠের ছোট একচিলতে জমিনের মৃদু ঢালের উপর রয়েছে ওরা। ওটার ওধারে একটা ফুটবল মাঠ, দুপাশে কাঠের তৈরি দর্শকদের আসন। কাছের প্রান্তে সৈনিক এবং প্যারামিলিটারিদের একটা জটলা। একটা সাধারণ টয়োটা পিকআপ ট্রাক এবং দুটো ট্র্যাক্ড 'ট্রান্সপোর্ট ভেহিকল দাঁড়িয়ে আছে। 
মাঠের দূর প্রান্তে একটা হলদে ভলবো এক্সেভেটর, নিথর। এককালের সবুজ ঘাসে ভরা ফুটবল মাঠটা ট্রেঞ্চের কারণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। 
ওকে খোঁচা দিল শের। ডানে গোটাকতক নিচু দালানের পাশ দিয়ে যাওয়া একটা অ্যাক্সেস রোড দেখা যাচ্ছে, ফুটবল মাঠে ঢোকার পথ ওটা-লকার রুম? নাকি রিফ্রেশমেন্ট স্ট্যান্ড? ওই রাস্তা ধরে দুটো মিনিউসিপ্যাল বাস এগিয়ে চলেছে, যেন ছুটিতে আছে ওগুলো। বেড়া কেটে তৈরি করা একটা ফোকর গলে বেরিয়ে এসে একসারিতে দাঁড়াল ওগুলো। ওগুলোর পাশে লেখা রয়েছে এলএএসটিএ। গাড়িগুলোর ছাদ নীল, নিচের অংশও নীল, তবে মাঝবরাবার চওড়া ডোরা দাগ।  
পিছলে খুলে গেল দরজাগুলো। 
কেউ বেরিয়ে এলো না। 
আরও চিৎকার চেঁচামেচি। 
কয়েকজন সশস্ত্র লোক উঠে পড়ল বাসে। ঠেলতে ঠেলতে বের করে আনা হলো লোকজনকে। বেশিরভাগই তরুণ, তবে এখানে-ওখানে জনা কয় বয়স্ক লোকও আছে। জোর করে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে কুচকাওয়াজ করে ট্রেঞ্চের কাছে নিয়ে আসা হলো ওদের। মাথার উপর তুলে রাখা হাতগুলো থরথর করে কাঁপছে। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাথাক্কির গোলমেলে কয়েকটা মিনিট পেরিয়ে গেল। হাঁটু ভাজ হয়ে বসে পড়ল দুজন বয়স্ক লোক, হাত জোর করে কাকুতিমিনতি করতে লাগল ওরা। কিন্তু হ্যাচকা টানে আবার দাঁড় করানো হলো ওদের, ফের এক ধাক্কা মেরে লাইনে ফিরিয়ে দেয়া হলো। 
ময়দান থেকে বেরিয়ে গিয়ে চক্কর দিতে শুরু করল টয়োটা পিকআপ ট্রাক দুটো। 
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ অবিরাম গর্জন ছাড়তে লাগল। প্রথমে এক সারি, তারপর অন্য সারির লোকগুলো অদৃশ্য কাঁচির ঘায়ে কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মেশিন গানের গুলি বন্ধ হলো। 
একে ৪৭ হাতে ট্রেঞ্চের কিনারা বরাবর এগোতে শুরু করল সশস্ত্র লোকগুলো। একটু পর পর থামছে।
টাশ, টাশ, টাশ, টাশ। 
আহতদের নিকেশ করছে ওরা। 
মাঠের উপর দিয়ে কোণাকুনিভাবে বিদায় হলো বাসগুলো। ওগুলো মাঠ পেরিয়ে যেতেই আরও দুটো মিনিউসিপ্যাল বাস বধ্যভূমির দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। পরস্পরের  দিকে হেডলাইট জ্বেলে হর্ন বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে। 
যথেষ্ট।
আজ রাতের অপারেশনের গুরুত্বেও কথা ওদের মনে করিয়ে দেয়ার দরকার ছিল না, কিন্তু রিপোর্ট পড়া এক জিনিস আর আসল ঘটনা নিজের চোখে দেখা, তার গন্ধ পাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। 
হাতের একটা ইশারা করল তারিক। অকুস্থল থেকে পিছলে সরে এলো ওরা।  কয়েক মিনিট পর ঠিক পথে চলছে কিনা যাচাই করতে আবার একসাথে হলো। এবার আরেক দফা মেশিন গানের করকর গুলির আওয়াজ কানে এলো। এরপর একটামাত্র গুলির শব্দ।  
ওর পাশে এসে দাঁড়াল শের। 'আরে, বস, আভিয়ানোতে ডা-ার ডগায় গেঁথে দার্কোর লাশ নিয়ে যাওয়ার কথা। বলেছিল ডান্টন, মনে আছে? আমাদের নামে কোনো ডাণ্ডা বরাদ্দ না হওয়ার কথা বলেছিলাম আমি।'
'হ্যাঁ, মনে আছে।'
'মনে হচ্ছে আশপাশ কোথাও থেকেই একটা ডাণ্ডা যোগাড় করে নিই।'
'নিশ্চয়ই,' বলল ও। 'তুমি না পারলে আমিই তোমাকে সাহায্য করব।'

৭.

পয়েন্ট কিউ-র কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। সঙ্গীদের নিয়ে রীতিমতো গর্ব হচ্ছে তারিকের। নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছে ওরা। এখানেই ওদের গাইডের সাথে দেখা হওয়ার কথা। সাধারণ মানুষ ওর গর্বের কারণ ধরতে পারবে না। কিন্তু ওদের এপর্যন্ত আসার ব্যাপারটা মাথায় রাখলে- বৈরী বিজন বিভুঁইয়ে পিছলে এগোনো, ক্লেটনের খোঁজ করতে গিয়ে ওর লাশের দেখা মেলা, ওর লাশ এবং সরঞ্জামের গতি করা, এই রক্তাক্ত প্রান্তরে চোখের সামনে দম নগদ হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করা- বেশ, আগেভাগে পৌঁছানোকে বড় ধরনের সাফল্যই বলতে হবে। 
অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। আসলে ওদের কাজের একট বড় অংশ জুড়ে আছে অপেক্ষার পালা। এখন আরেকটা রাস্তার কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা, এটা বেশ সংকীর্ণ, হাজারো খানাখন্দে ভরা, এখানে-ওখানে আস্তরণ উপড়ে গেছে। এটা একটা ক্রসরোড, আরেকটা রাস্তা এসে ওটার উপর দিয়ে চলে গেছে। প্রচুর গাছপালা রয়েছে, কিন্তু ফার্মহাউস, দোকানপাট কিংবা সবচেয়ে বড় কথা গাড়িঘোড়ার নিশানা চোখে পড়ছে না। 
মোড় লাগোয়া একটা স্মৃতি সৌধ দেখা যাচ্ছে। রট আয়রনে ঘেরা একটা চৌহদ্দীর ভেতর সুবেশি পাথরের মূর্তি। এটাই পয়েন্ট-কিউ। 
'ওই পাথরের টুকরোটা কিসের?' ফিসফিস করে জানতে চাইল আলীয়া বোরোযান। 
'সমাধিফলক হবে আরকি,' বলল তারিক। 'কিংবা যুদ্ধের স্মৃাতিসৌধ। দুনিয়ার এদিকটায় স্মৃতিসৌধের অভাব নেই। প্রচুর রক্ত ঝরেছে। কেউ না কেউ ব্যাপারটা মনে রাখতে চায়, তাই বিদ্বেষ দীর্ঘমেয়াদী হয়ে উঠতে পারে বৈকি।'
ওদের মাথার উপর এয়ারক্র্যাফটের ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল। মেঘ আর শিথিল ভঙ্গিতে ঝরতে থাকা তুষারের কারণে দেখা যায় না। ফের তুষারপাত শুরু হয়েছে। কিন্তু এমনকি অন্ধকার এবং মেঘের পর্দা সত্ত্বেও উত্তর দিগন্তের কাছে দানবীয় ফ্ল্যাশবাল্বের মতো আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। জ্বলছে, নিভছে। 
গমগমে বিস্ফোরণের একটা আওয়াজ ভেসে এলো। শরীরের ভার বদল করল তারিক। মাথার ভেতর কোথাও যেন সন্দেহের একটা ঢেউ খেলে গেল ওর। এই শিহরণ জানিয়ে দেয় আসলেই কত বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ অবস্থায় আছ তুমি।
'বেড়ে বলেছ,' ফিসফিস করে বলল বোরোযান। 'ওই পাইলটরা যুুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্টোনকাটারদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।'
'কাউকে না কাউকে তো ওদের কথাও ভাবতে হবে নাকি।'
'হাহ,' কাঁধ দিয়ে তারিককে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল বোরোযান। 'লেকে তোমার সাথে দেখা হবে, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে।'
'আমি অপেক্ষায় থাকব,' বললল তারিক। 
'তোমাকে কিন্তু দূরের কোনো লেকের ধারে কল্পনা করা কঠিন।'
'শান্তিপ্রিয় পড়শী হওয়ার কথা ভাবছি। নিরিবিলি, একঘেয়ে।'
ফের ধাক্কা। 'এটাও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।'
পিছলে সরে গেল ও। এবার এগিয়ে এলো খালিদ। 'একটা কথা, ওস্তাদ। কেউ নেই ওখানে।'
'সে তো দেখতেই পাচ্ছি।'
'কতক্ষণ অপেক্ষা করব আমরা?'
'যতক্ষণ একঘেয়েমিতে না পেয়ে বসছে,' বলল তারিক। 'কেমন মনে হচ্ছে কথাটা?'
'দারুণ, ওস্তাদ।' চুপ করে গেল সে। ওর কথার মানে ঠিকই বুঝেছে। সাহায্য করার জন্যে স্থানীয় কাউকে বিশ্বাস না করে সব সময় অন্যের ভরসায় না থেকে একাকী আগে বাড়াই ভালো। অ্যালেক্স লোকটার অস্তিত্ব সত্যি সত্যি থাকতে পাওে, ওদের সত্যিই হয়তো সাহায্য করতে চায় সে; আবার ডাল্টন বা তার বসের দেখানো সোনা কিংবা বিটকয়েনের লোভে পড়ে কাজটা করছে, তাও হতে পারে। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক সময় অ্যালেক্সের মতো লোকজন ঘাবড়ে যায়, কিংবা আরও বেশি মালদার কারো দেখা পায়। 
ঘড়ি দেখল ও। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে। এটা তেমন গুরুতর কিছু না হলেও ওর মাথায় অপশন-বি রয়ে গেছে: আরো পাঁচটা মিনিট দেখবে, তারপর সটকে পড়বে ওরা। দার্কোর আখড়ায় পৌঁছানোর নিজস্ব পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে ও, সেটা কঠিন হলেও, গত্যন্তর নেই। 
আবার ঘড়ি দেখল ও। তিন মিনিট বাকি। 
তবে কোথায় প্যারামিলিটারিরা গিজগিজ করছে, কোথায় মাইন ফিল্ড বসানো হয়েছে, কিংবা ট্রিপ অয়্যার পেতে রাখা হয়েছে, এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল স্থানীয় কোনো লোক পক্ষে থাকলে বাড়তি ঝুঁকি নেয়া পুষিয়ে যায়। 
আবার ঘড়ি দেখল ও। দুই মিনিট বাকি। 
প্লেনের গুঞ্জন ফিরে এলো। আরো বোমা আনতে ফিরে যাচ্ছে? কেন নয়?
এক মিনিট বাকি। 
শরীরের ভার বদল করল ও। 
খালিদ বলল, 'নড়াচড়া, ওস্তাদ। রাস্তা পেরুচ্ছে।'
তারিকও দেখতে পেয়েছে। রাস্তার উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ছায়া। পাথরের সৌধের পেছনে গাঢাকা দিয়ে আছে একজন। ওর বুকের উপর থেকে চাপ সামান্য কমল। কিন্তু আরেকটা জিনিস বাকি রয়ে গেছে। 
ওর মতোই অপেক্ষা করতে লাগল বাকি সবাই। 
আরো নড়াচড়া। 
একটু বাদেই ওদের দিকে আলোর ঝলক ধেয়ে এলো। ইনফ্রারেড লাইট, কেবল ওদের নাইট ভিশন গ্লাসেই ধরা পড়বে। 
একটা ঝলক।
একটা ঝলক। 
আরো একটা। 
এটাই সঙ্কেত।
ইনফ্রারেড সিগন্যাল লাইট বের করে তিনটা প্রলম্বিত সঙ্কেত পাঠাল তারিক। বিরতি। 
দুবার ঝলক পাঠাল সে। 
'ঠিকাছে,' বলল তারিক। 'আমরা ঠিক আছি। শের, তুমি সামনে থাকো। তোমার পেছনে থাকছি আমরা।'
অন্ধকারে খালিদের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। 'ঠিক হ্যায়, বস।'
'চলো অ্যালেক্সের কাছে যাই।'
ধীর পায়ে পজিশন ছেড়ে বেরিয়ে এলো ওরা। সবার আগে শের, হঠাৎ পাথরের সৌধের কাছে থেকে আলোর ঝলকনি দেখা দিল, পরক্ষণে কমলা লেবুর মতো প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লাগার দশা হলো। চিৎ হয়ে জমিনে লুটিয়ে পড়ল মাইকেল শের।
(চলবে)
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.