মধ্য যুগের পেঁয়াজ
'আমরা ভালোবাসি রসুন, অনিয়ন, এবং লিক'
জেওফ্রি চসার, দি ক্যান্টারব্যারি টেলস (১৩৮৭-৯৫)
উত্তর ইউরোপে এলিয়াম সেপা, অর্থাৎ পেঁয়াজের আমদানি হয় রোমানদের হাত ধরে। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সম্রাট শার্লমেন—যার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল উত্তর ইউরোপ থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত—একটি হুকুমনামা প্রস্তুত করেন। তাতে তিনি সাম্রাজ্যের বাগানগুলোতে ৯০ ধরনের ফলমূল ও সবজি চাষের আদেশ দেন। রসুনসহ বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজের নাম ছিল তার তালিকায়। সম্রাট শার্লমেনের কল্যাণে গোটা ইউরোপে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলে পেঁয়াজ। বড় বড় মঠগুলোর সবজি বাগানে ফলানো হতো এ উদ্ভিদ।
মধ্যযুগে ইউরোপে সবচেয়ে জনপ্রিয় সবজিগুলোর একটি ছিল পেঁয়াজ। উচ্চফলনশীল এই উদ্ভিদটি যে খুব সহজেই ফলানো ও সংরক্ষণও করা যায়, তা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। কয়েক স্তরের খোসায় মোড়ানো পেঁয়াজকে শুকনো অবস্থায় সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখলে ছয় মাস পর্যন্ত তাজা থাকে। রেফ্রিজারেটরবিহীন সে যুগে কৌশলটি দারুণ কার্যকর ছিল। অন্যান্য অনেক বড় আকারের সবজি বা ফলগাছের খুব সামান্য অংশই ভক্ষণযোগ্য, কিন্তু পেঁয়াজের প্রায় পুরো গাছটাই খাওয়া যায়। এমনকি পেঁয়াজ পাতাও খাওয়া যায় রান্না করে। আর (সম্ভবত) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, পেঁয়াজ ঠান্ডা আবহাওয়া ও তুষারের অত্যাচার সহ্য করেও খুব ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। সেজন্য উত্তর ইউরোপের ঠান্ডা আবহাওয়ায়ও এর চাষ করা যায়।
মধ্যযুগের প্রথমদিকে ব্রিটেনে ছয় ধরনের পেঁয়াজ খাওয়া হতো—ক্রপলিয়াক (এই জাতটিই বোধহয় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে), গার্লিয়াক (রসুন), পোর্লিয়াক (বাগানে চাষ হতো), ইনিওলিয়াক, হলিয়াক ও ব্রেড-লিয়াক। সেই আমলে খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদগুলো দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—'তৃণ' এবং 'মূল'। 'তৃণ' দলভুক্ত উদ্ভিদ মাটির ওপরে জন্মাত, আর 'মূল' দলভুক্তরা জন্মাত মাটির নিচে। পেঁয়াজ-রসুন ছিল 'তৃণ' দলভুক্ত। অনেকেই পরিবেশনের সময় খাবার সাজানোর জন্য কাটা পেঁয়াজ ব্যবহার করত।
মধ্যযুগে পেঁয়াজের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ ছিল এর বহুমুখিতা। একে স্যুপ ও স্ট্যুতে ব্যবহার করা যেত। ব্যবহার করা যেত মিষ্টি বা সুগন্ধ বাড়িয়ে সাধারণ কোনো খাবারের স্বাদ বাড়াবার জন্যও। মধ্যযুগে ঝোল বা সেদ্ধ তরকারি ছিল সর্বজনীন এক খাবার। খাবারটি রান্না করা হতো সেদ্ধ খাদ্যশস্য (যেমন, বার্লি) দিয়ে। মাঝেমধ্যে সবজিও দেওয়া হতো এতে। খাবারটির স্বাদ ও সুগন্ধ বাড়াবার জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করা হতো। সাধারণ মানুষের ঘরে তখন অভেন ছিল না। তবে আলু যেমন খোসাসহ পুড়িয়ে খাওয়া যায়, তেমনি পেঁয়াজও গরম ছাইয়ে পোড়ানো যেত। এ কারণেই সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ভাজা পেঁয়াজ বহু মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে ছিল। খানিকটা জমি হলেই যে-কেউ পেঁয়াজ চাষ করতে পারত। মধ্যযুগে সবাই তা-ই করত। ব্রিটেনে আজও তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার অধিকারী এ উদ্ভিদ। সে জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্রিটেনে পেঁয়াজ, পেঁয়াজের বীজ ও রসুন আমদানি করা হতো নেদারল্যান্ড ও স্পেন থেকে।
আখ্যানধর্মী কবিতা দ্য ভিশন অফ পিয়ার্স প্লাউম্যান-এ (১৩৬০-৮৭) উইলিয়াম ল্যাংল্যান্ড মধ্যযুগের ইংরেজ কৃষকদের প্রধান খাদ্যের একটা ধারণা দেন:
All the poor people then their peascods fetched,
Beans and baked apples they brought in their laps,
Onions and chervil and many ripe cherries,
And proffered Piers this present wherewith to please Hunger.
Meat had they not; but they certainly had onions.
গরিবের মাংস পেঁয়াজ
গরিবদের খাদ্যতালিকায় পেঁয়াজ যোগ করার আরেকটা সুবিধা ছিল—এটি খাবারের সুগন্ধ বাড়িয়ে দিত। সে সময় অভাবীরা মাংস বলতে খেতে পেত শুধু প্রাণীর নাড়িভুঁড়ি, কলিজা, ফুসফুস, অন্ত্র ও অন্যান্য ফেলে দেওয়া অংশ। তাদের সে 'মাংসের' স্বাদ বাড়াত পেঁয়াজ। এ কারণেই বোধহয় কলিজা ভুনায় সবসময় পেঁয়াজ দেওয়া হয়। জার্মান বই 'বুশ ফন গাটার স্পাইস'-এ ('বুক অফ গুড ফুড', ১৩৫৪) হাঁসের মাংসের সাথে পেঁয়াজ দিয়ে কলিজা রান্না করে পরিবেশন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সাথে ডিম আর আপেলও দিতে বলা হয়েছে। ব্রিটেনে এখন অবশ্য হাঁসের মাংস ও কলিজার সাথে ডিম আর আপেল তেমন একটা খাওয়া হয় না।
চসারের 'দ্য ক্যানটারবেরি টেলস'-এর প্রারম্ভিকায় গির্জার আদালতের এক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কথা বলা হয়েছে। সে ছিল ভীষণ ঝগড়াটে। ফুসকুড়ি পড়া লাল মুখ তার। পেঁয়াজ, রসুন খেতে খুব পছন্দ করত। আর সারাক্ষণই মাতাল হয়ে থাকত। ভুরভুর করে পেঁয়াজ, রসুন আর মদের বিশ্রী গন্ধ আসত তার গা থেকে। লোকটার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে:
With black and scabby brows and scanty beard;
He had a face that little children feared.
There was no mercury, sulphur, or litharge,
No borax, ceruse, tartar, could discharge,
Nor ointment that could cleanse enough, or bite,
To free him of his boils and pimples white,
Nor of the bosses resting on his cheeks.
Well loved he garlic, onions, aye and leeks,
And drinking of strong wine as red as blood.
মধ্যযুগের মানুষের বিশ্বাস ছিল, পেঁয়াজ খেলে গায়ের রং নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণেই পেঁয়াজখেকো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাটির মুখে গোল গোল ব্রণ পড়ার কথা বলা হয়েছে।
পেঁয়াজ কিনতে পাওয়া যেত খুব সস্তায়। ফলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের খাদ্যতালিকায়ই থাকত এ উদ্ভিদ। সে কারণেই বোধহয় পেঁয়াজকে গেঁয়ো খাবার মনে করা হতো। আর সর্বস্তরে খাবারটির এমন সহজপ্রাপ্যতার কারণেই বোধহয় 'এগজিটার বুক'-এ (কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যের সংকলন) পেঁয়াজকে অভিহিত করা হয়েছে দশম শতাব্দীর রূঢ় ধাঁধা হিসেবে:
'আমি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি: নারীদের কাছে অতি প্রত্যাশিত আনন্দের বস্তু, তাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমার খুনি ছাড়া কখনও অন্য কোনো মানুষের ক্ষতি করি না আমি। আমার কাণ্ডটি লম্বা, খাড়া। …মাঝেমধ্যে গ্রামের কোনো সুরূপা মেয়ে মহা উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার ওপর। আমার লাল খোসা ছাড়িয়ে, ধারালো কোনো জিনিসের সাথে চেপে ধরে আমাকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলে। হানাদার মেয়েটিকে অবশ্য এর ফল ভোগ করার জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। আমার ওপর হামলার খানিকক্ষণের মধ্যেই ভিজে ওঠে তার দুই চোখ।'
ফরাসি ঐতিহাসিক ব্রুনো লরিয়ো-র মতে, খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদগুলো মাটির ওপরে কতখানি বেড়ে উঠতে পারে, তার ওপর ভিত্তি করে ক্রমানুসারে খাদ্যসামগ্রীগুলোর মর্যাদা নির্ধারিত হতো মধ্যযুগে। গাছে জন্মানো ফলগুলো ছিল সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পাওয়া খাবার। তালিকায় এর পরেই ছিল ঝোপেঝাড়ে হওয়া ফলমূল। তার খানিক নিচে ঠাঁই হয়েছিল কাণ্ডে জন্মানো খাবার (মটর)। মর্যাদায় এর পরের স্থানটি দখল করেছিল মূল থেকে পাওয়া খাবারগুলোর (পালংশাক-জাতীয় শাক)। এর পরে ছিল শুধু মূল (গাজর, শালগম)। মর্যাদার পিরামিডে সবচেয়ে নিচের স্থানটি বরাদ্দ ছিল পেঁয়াজ-রসুনের মতো কন্দজাতীয় খাবারের জন্য। ফলে পেঁয়াজ-রসুনকে মনে করা হতো সবচেয়ে নীচু শ্রেণির সবজি। কৃষকদের খাওয়ার উপযোগী মনে করা হতো এগুলোকে। (ঘটনাক্রমে মাংসও এই শ্রেণিভুক্ত ছিল। আর পাখির ঠাঁই হয়েছিল শুকরের ওপরে)।
তাই বলে মধ্যযুগে পেঁয়াজ কিন্তু শুধু গরিবদের খাবার ছিল না। গির্জা থেকে বছরের বেশ অনেকগুলো দিনকেই উপবাস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বুধ, শুক্র, এমনকি কখনও কখনও শনিবারেও উপোষ করার হুকুম ছিল গির্জার পক্ষ থেকে। উপবাস করতে হতো যিশুর আবির্ভাবের দিন এবং খ্রিষ্টানদের চল্লিশ দিন ব্যাপী উৎসবের সময়ও। কাজেই অভিজাত ও উঁচু মহলের পাদ্রিদের দায়িত্ব ছিল রাঁধুনিদের মাংসবিহীন সুস্বাদু খাবার রান্নার উপায় বাতলে দেওয়া। তরুণী গৃহবধূদের জন্য লেখা 'লা মেনাজিয়ের ডু প্যারিস'-এ 'মৎস্য দিবসে' শুয়োরের মাংস না রেঁধে পেঁয়াজ মটর রাঁধতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মাংসহীন খাবারগুলোকে পয়সাঅলা ধার্মিকদের জিভে জল এনে দেওয়ার মতো সুস্বাদু করে রান্না করতে হতো। ১৩৯০ সালের পাণ্ডুলিপি, 'দ্য ফর্ম অফ কারি'-তে দ্বিতীয় রিচার্ডের রাঁধুনিরা পাই-য়ে পেঁয়াজ ও পনির মিশিয়ে দিতে বলেছে।
আজকের মতো মধ্যযুগেও জাফরান ছিল ভীষণ দামি। বিট গাছ থেকে চিনি তৈরি হতে শুরু করার আগে চিনির দামও ছিল অত্যন্ত চড়া। পেঁয়াজও অবশ্য সে সময় মিষ্টির উৎস ছিল। খাবার টেবিলে মাংস থাকুক আর না-ই থাকুক, পেঁয়াজ, পনির ও মাখনের তৈরি পাই থাকতই।
প্রাচীন ইংরেজি শব্দ লিয়াকটুন (leac-tun) অর্থ সবজি বাগান, এবং লিয়াকওয়ার্ড (leac-ward) অর্থ মালি। 'লিক' (leek)—যা কিনা পেঁয়াজের আরেকটি প্রজাতি—অর্থ 'সবজি'। এ থেকেই পেঁয়াজের জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। মধ্যযুগে পেঁয়াজের সাদা অংশটুকুই বেশি খেতে চাইত সবাই, কারণ সবার বিশ্বাস ছিল ওই অংশটুকু স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে কম ক্ষতিকর। আর সে সময় বেশিরভাগ শাকসবজিই দারুণ সুস্বাদু করে রান্না করা হতো। আজকের যুগের রান্নাও বোধহয় সেই রান্নার সাথে পাল্লা দিতে পারত না। সালাদ খাওয়ার চলও ছিল সে যুগে।
ওয়েলসে লিক জাতের পেঁয়াজটি খাওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। ওয়েলসের প্রতাপশালী রাজা হাইওয়েল ডা ওরফে হাওয়েল দ্য গুড-এর (৮৮০-৯৫০) আইনে মাত্র দুটো সবজির নাম ছিল। সেই দুই সবজির একটি এই লিক। অপর সবজিটি ছিল বাঁধাকপি। মধ্যযুগের চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক বই 'ফিজিশিয়ানস অফ মিডফেই'-এ বলা হয়েছে, যেসব মা সন্তানের খাওয়ার রুচি বাড়াতে চান, তারা লিক খাওয়ালে ভালো ফল পাবেন। ওয়েলসের প্রতীক লিক। দেশটির প্রধান সন্ত, সেইন্ট ডেভিডের স্মরণে যে উৎসবের আয়োজন হয় তাতেও সবাই এ সবজি পরে মাথায়। কিংবদন্তি অনুসারে, ষষ্ঠ শতকে স্যাক্সনদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে গুয়াইনিডের রাজা ক্যাডওয়াল্ডার তার সৈন্যদেরকে শিরস্ত্রাণের ওপর লিক পরতে বলেছিলেন। যুদ্ধটি হয়েছিল একটা লিক খেতে।
শেকস্পিয়ারের যুগেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। সে প্রমাণ পাওয়া যায় শেকস্পিয়ারের 'হেনরি দ্য ফিফথ' নাটকে। ১৪১৫ সালের অ্যাগিনকোর্ট যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে রচিত এই নাটক। এতে দেখা যায়, ওয়েলশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ফ্লুয়েলেন বলছে যে পিস্টিল নামের এক সহযোদ্ধা তাকে অপমান করেছে। সেইন্ট ডেভিড উৎসবে ফ্লুয়েলেনকে টুপিতে পিস্টল তাকে রুটি ও লবণ এনে দিয়ে পেঁয়াজটি খেয়ে ফেলতে বলে। উৎসব শেষ হতেই তার ওপর প্রতিশোধ নেয় ফ্লুয়েলেন। নিজের টুপিতে পরা পেঁয়াজটি খেতে বাধ্য করে সে পিস্টলকে। অনেক কাকুতি-মিনতি করেও রেহাই পায় না পিস্টল। সে পেঁয়াজ খাওয়ার পরও রাগ কমে না ফ্লুয়েলেনের। আরেকজন সৈনিক তাকে বলে যে, এমন একটি প্রাচীন, সম্মানজনক প্রথা নিয়ে মশকরা করে সে ভীষণ অন্যায় করেছে।
আজও ওয়েলসের জাতীয় প্রতীক লিক। ওয়েলশ পাউন্ড ও ব্রিটিশ আর্মির ওয়েলশ গার্ডস রেজিমেন্টের ক্যাপ ব্যাজে এ প্রতীকের ছবি থাকে। তবে যুক্তরাজ্যে যে কেবল ওয়েলসের সাথেই পেঁয়াজ পরিবারের বিশেষ সম্পর্ক, তা নয়। দক্ষিণ স্কটল্যান্ডের ক্লাসিক খাবার 'কক-আ-লিকি' স্যুপের উদ্ভবও মধ্যযুগে। এই মুরগির স্যুপটি রান্না করা হয় লিক দিয়ে। স্কচ মাংসের ঝোল, ব্রথেও লিক দেওয়া হয়। সবজিটির নাম রাখা হয়েছে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের শহর লিক-এর নামে।
মধ্যযুগীয় ওষুধ: হিউমার
প্রাচীন গ্রিকরা মানবদেহ নিয়ে এমন এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিল যা গোটা মধ্যযুগে ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এ তত্ত্ব অনুসারে মানুষ চারটি মৌলিক 'হিউমার'-এর অধিকারী—অর্থাৎ চার ধরনের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আছে পৃথিবীতে। হিউমার চারটি হলো—স্যাঙ্গুইন, ফ্লেগম্যাটিক, কোলেরিক ও মেলানকোলি। কিছু দেহরসের সাথেও এ হিউমারগুলোর সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করা হতো। শরীরে এসব রসের ভারসাম্য বজায় থাকলে স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। আর শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্য নির্দিষ্ট কিছু খাবার খাওয়া উচিত, কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এ কারণে মধ্যযুগের রান্নার বই পড়তে প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ্যবইয়ের মতো লাগে। রন্ধনপ্রণালীর সাথে কোন্ খাবারটি কখন কীভাবে রান্না করা উচিত কিংবা উচিত নয়, এরকম সদুপদেশে ভর্তি এসব বই। সে যুগে লোকে বিশ্বাস করত, একজন মানুষের জন্য কোন্ খাবার ভালো হবে সেটা নির্ভর করে তার বয়স, জীবনধারা ও মৌসুমের ওপর। অলস শুয়ে-বসে দিন কাটানো একজন অভিজাত লোকের আর খামারে কাজ করা শ্রমিকের খাবারের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা হবে।
মধ্যযুগে ধারণা করা হতো, লিক আর পেঁয়াজ খুব 'গরম' ও 'ভেজা' জিনিস। সেজন্য স্যাঙ্গুইন হিউমারের অধিকারী যারা, পেঁয়াজ-জাতীয় খাবার খাওয়া খুব তাদের জন্য বিপজ্জনক বলে বিশ্বাস করা হতো। কেননা স্যাঙ্গুইনরা এমনিতেই গরম ও নরম মেজাজের মানুষ। তারা পেঁয়াজ খেলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। তবে মেলানকোলিকদের জন্য পেঁয়াজ-জাতীয় খাবার খুব ভালো। কারণ মেলানকোলিকরা শুষ্ক, ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। খাবারের মেন্যু ঠিক করার সময় ঋতুর কথাও মাথায় রাখা হতো। কেননা ঋতুগুলোতেও হিউমারের উপাদান আছে। শরৎকাল বেশ ঠান্ডা আর শুষ্ক। কাজেই এ সময় লিক খাওয়া ভালো। কিন্তু বসন্তের রাতে পেঁয়াজের স্যুপ খেলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অবশ্য ইউরোপে পেঁয়াজ ফলানো হয় শেষ গ্রীষ্ম আর শরতেই। কাজেই সবজিটি ওখানে শুকনো মৌসুমেই খাওয়া হয়।
স্যাঙ্গুইনদের অবশ্য পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা প্রিয় খাবার চাখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হতো না। সঙ্গে অন্যান্য উপাদান দিয়ে খাবারের ভারসাম্য ঠিক রাখা হতো। লোকের বিশ্বাস ছিল, তরিতরকারি যত ছোট ছোট করে কাটা হবে, দুটো বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উপাদান মিশে গিয়ে পরস্পরের প্রভাব প্রশমিত করাও তত সহজ হয়ে যাবে। এ কারণে ভুল খাদ্যের বিপদ কমানোর জন্য ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন ধরনের সস। খুব সম্ভব এ কারণেই সস এত জনপ্রিয় ছিল। অভিজাত সমাজের খাবার তালিকায় অত্যন্ত উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল সস। অনেক রাজপরিবারের তো নিজস্ব সস তৈরির জন্য আলাদা কামরাই থাকত। রান্নাঘরের পাশের বিশেষ এই অফিসে একজন পেশাদার সস প্রস্তুতকারক কাজ করত। এসব সসে রসুনে ব্যাপক ব্যবহার ছিল।
নানা কৌশলে রান্না করে সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করা হতো। যেমন, বিপজ্জনক আর্দ্রতা দূর করবার জন্য পেঁয়াজ ভেজে নেওয়া হতো। মধ্যযুগে রান্নাবান্নার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল নানা ধরনের মশলা। মশলা যেহেতু গরম ও শুকনো, তাই পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা খাবারের ঝুঁকি দূর করবার জন্য তাতে মশলা দেওয়া হতো।
তথ্যসূত্র:
১। অনিয়ন্স অ্যান্ড গার্লিক: আ গ্লোবাল হিস্ট্রি
২। ফুড অ্যান্ড ড্রিঙ্ক ইন ব্রিটেন ফ্রম দ্য স্টোন এজ টু রিসেন্ট টাইমস—সি. অ্যান উইলসন