ভবিষ্যতের বই: বাস্তবতা

ইজেল

06 February, 2021, 08:55 am
Last modified: 06 February, 2021, 03:59 pm
আগামীর বই এসে গেছে। এবং এটা পাল্টে চলেছে। আপনার হাতেই রয়েছে এটা। উত্তেজনাকর। একঘেয়ে। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু কিছু অলীক প্রত্যাশাকে ঘষামাজা করতে হবে...

ভাবা হয়েছিল, ভবিষ্যতের বই হবে মিথষ্ক্রিয়, সজীব এবং প্রাণবন্ত। ভাবা হয়েছিল, এই বইয়ের পাতাগুলো হাজারো জিনিসে ভরে থাকবে, সাড়া দেবে, হবে বাস্তব। আপনার অবস্থান, অনুভূতির উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতের বই পাল্টে যাবে। আপনারই চারপাশের পরিবেশ গল্পে আত্মস্থ করে নেবে। ভবিষ্যতের বই হবে চতুর, খানিকটা ভীতিকরও হয়তো। তবে নিশ্চিতভাবেই প্রোগ্রাম করার উপযুক্ত। ইউলিসিস আপনার ইচ্ছামতো যেদিকে খুশি অন্তহীন বিস্তৃত হতে থাকবে। আপনি স্রেফ ট্যাপ করুন, ব্যস অনন্য, মনে ধন্ধ লাগানো মেশিনের রপ্ত করা জয়েসীয় সব শব্দ আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করবে।  

পেপার ব্যাক বইয়ের উপর প্রযুক্তির প্রভাব সম্পর্কিত একটা ভাবনা কয়েক শো বছর ধরেই চালু রয়েছে। প্রতিটি নতুন মাধ্যমই বইয়ের বিকৃতি সাধন কিংবা একে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে: ফোটোগ্রাফি, রেডিও, চলচিত্র, টেলিভিশন, ভিডিও গেমস, ইন্টারনেট। 

অনেকে আবার প্রযুক্তি এবং বইয়ের এই মোকাবিলাকে ঢের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়েছেন। ১৯৪৫ সালে ভ্যান্নেভার বুশ দ্য অ্যাটলান্টিকে লিখেছিলেন: 'সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারার মিশেল নিয়ে একেবারে নতুন ধরনের রেডিমেড বিশ্বকোষের আবির্ভাব ঘটবে।'

কাগজের বই শুধু স্মৃতি হয়ে যাবে

১৯৬৮ সালে গবেষক অ্যালান কেই ট্যাবলেট-সদৃশ একটা যন্ত্রের কার্ডবোর্ড প্রোটোটাইপ তৈরি করেন। তিনি এর নাম দেন 'ডাইনাবুক। 'মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াসকে আরও জোরালো করে তার চিন্তাকে চাগিয়ে তোলার নতুন ধরনের মাধ্যম সৃষ্টি করেছি আমরা,' বলেন তিনি। 'আমরা ভেবেছিলাম পাঁচ শো বছর আগে গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে এটা।'

১৯৯০ এর দশকে 'আগামীর বইমতবাদ' এক ধরনের দুর্দান্ত হুজুগে পরিণত হয়। যেন সত্যিকারের সময় দরজায় কড়া নাড়ছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রবার্ট কুভার ১৯৯২ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের 'দ্য এন্ড অভ বুক্স' শিরোনামের  উপসম্পাদকীয়তে আগামীদিনের লেখালেখি সম্পর্কে লেখেন: 'সাবলীলতা, অনিশ্চয়তা, অস্পষ্টতা, বহুত্ব, বিচ্ছিন্নতাই আসল জিনিস। দ্রুতই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে এসব, ঠিক যেমন অল্প আগেই আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আপেলের পতনকে প্রতিস্থাপিত করেছিল।' এবং তারপর আরও বিশদভাবে: 'মুদ্রণ মাধ্যম অবলুপ্ত, সেকেলে প্রযুক্তি, স্রেফ অচিরেই এখন লাইব্রেরি নামে পরিচিত ধূলিমলিন জাদুঘরে চালান হওয়ার যোগ্য, অতীতের কৌতূহলের বিষয় হয়ে যাবে।'

স্বাভাবিক বই? একঘেয়ে। আগামীর বই? দুর্দান্ত--অনিশ্চিত--তবে আমরা প্রায় তার কাছাকাছি এসে পড়েছি! ১৯৯২ সালে ভয়েজার কোম্পানি ম্যাকওয়ার্ল্ডে তিনটি বই প্রকাশের ভেতর দিয়ে 'এক্সপান্ডেড বুক্স' প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করে। মাইক্রোসফট সিডি-রমে সূচনা করে এনকার্টার।  

কিন্তু...২০০০ দশকের মাঝামাঝি নাগাদ বাস্তবিক অর্থে ডিজিটাল বইয়ের দেখা মেলেনি। রকেট ই-বুক ছিল বড্ড ছোট, কিঞ্চিৎ আগেভাগে বেরিয়ে গিয়েছিল। ২০০৪ সালে সনি এইঙ্ক ভিত্তিক লাইব্রাই প্ল্যাটফর্ম চালু করলেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মিথস্ক্রিয় সিডি-রম উধাও হয়ে গেছে। আমাদের হাতে উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ এবং ইন্টারনেট রয়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু কিংবদন্তীর ভবিষ্যতের বই এখনও বাস্তব রূপ পায়নি। টাইম-এর প্রযুক্তি প্রধান পিটার মেয়ার্স 'শেষতক কোনো এক ধরনের যন্ত্র দেখা দেবে!' বলে জুৎ মতোই বাজি ধরেন। 

এবং সেটাই ঘটেছে। সত্যি বলতে বেশ কয়েক ধরনের যন্ত্রই তৈরি হয়েছে।  ২০০৭ সালের জুন মাসে চালু হয় আই-ফোন. নভেম্বরে কিন্ডল; এরপর ২০১০ সালে হাজির হয় আই-প্যাড। সহসাই সবার হাতে কিংবা ব্যাগে হাই-রিজ্যুলুশন পর্দা দেখা দিয়েছিল। ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে সংক্ষিপ্ত একটা মুহূর্তের জন্যে মনে হচ্ছিল অবশেষে হয়তো আসল জিনিসের আবির্ভাব ঘটেছে: মহান আগামীর বই। 

কিনডেলের পাতা, রহস্য উপন্যাস পাঠ

বুনোভূমিতে হাহাকার

এবার ২০১৮ সালে চলে আসা যাক। ডেনিস জনসনের ছোট গল্প 'ট্রায়াম্ফ ওভার দ্য গ্রেভ'-এর শেষের দিকে তিনি লিখেছেন, 'কিছু এসে যায় না। দুনিয়াটা পাক খেয়ে যাচ্ছে। আমি এটা লেখার মুহূর্তে আপনার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার। আমি এখনও মরিনি। কিন্তু আপনার পড়ার মুহূর্তে হয়তো মারা গেছি।'

কথাগুলো পাঠক হিসেবে একেবারে আঁতে ঘা দেয়, তার কারণ তিনি মারা গেছেন।পাঠক না। ২০১৭ সালেই বিদায় নিয়েছেন তিনি। কিন্ডল হাতে কোথাও যাওয়ার মানে নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতের একটা বোধ জাগা। ছোটখটো একটা বইয়ের চেয়েও কম ওজনদার একটা যন্ত্রের ভেতরই আস্ত একটা লাইব্রেরি। খুব কমই একে রিচার্জ করতে হয়। 

আজকের দিনের বাস্তব বইয়ের চেহারা গত শতকের বইয়ের মতোই। আবার আজকের দিনের ডিজিটাল বুকের চেহারা, বোধ এবং কাজ প্রায় ১০ বছর আগের ডিজিটাল বুকের মতো, যখন কিন্ডলের সূচনা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হচ্ছে অ্যামাজনের বহু প্রতিযোগিই পটল তুলেছে বা প্রাসঙ্গিতা হারিয়েছে। ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে দেখা দেওয়া ডিজিটাল পাঠ এবং ডিজিটাল বুকের নতুন ব্যবস্থা তুচ্ছ হয়ে গেছে।  

জিতে গেছে অ্যামাজন; সত্যি বলতে শোচনীয়ভাবে সবাইকে পরাস্ত করেছে। ২০১৭ সালের শেষদিকে সকল মুদ্রিত বই বিক্রির প্রায় ৪৫ শতাংশ (২০১৫ সালের ৩৭ শতাংশ থেকে বেশি) এবং ই-বুকের ৮৩ শতাংশ বিক্রিই অ্যামাজনের বিভিন্ন চ্যানেল মারফত ঘটেছে। বিশেষ করে ডিজিটাল বইয়ের ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ মানসিকতা বা বাজার অংশীদারীর অল্প কিছু বিকল্পই আছে।  

বই ব্যবসায় অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে অ্যামাজন

কিন্তু তবু অবাক করার মতো একটা ব্যাপার রয়ে গেছে: আমরা আসলে ভুল জায়গায় ভবিষ্যতের বইয়ের খোঁজ করছি। এমন নয় যে আকারই পাল্টাতে হবে। আমরা মনে হয় একটা ব্যাপারে একমত হতে পারি যে, সীমাহীন বিচ্যুতির যুগে একক, স্থায়ী, বিচ্যুতিহীন, প্রীতিকর অননুকরণীয় কণ্ঠস্বরই বই হিসাবে 'বই'-এর অন্যতম শক্তিশালী সম্পদ। কিন্তু সেজায়গায় প্রযুক্তি বইকে নীরব বিপ্লব ঘটানোয় সক্ষম করে তোলা সবকিছুই পাল্টে দিয়েছে। তহবিল যোগানো, মুদ্রণ, পূর্ণাঙ্গতা এবং সমাজ গঠন--বইকে পরিণত ও সফল করে তোলা সবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাল্টে গেছে, আধার যদি নাও পাল্টে থাকে। পর্দা কাগজের মতোই স্থায়ী এবং সস্তা হয়ে ওঠায় আমরা যাকে 'আদর্শ বই' মনে করি তার ধরন এবং মিথষ্ক্রিয়া ভবিষ্যতে বদলে যাবে। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের হাতের ডিজিটাল কি মুদ্রিত বইটিই আগামীর বই, যতই একে অভবিষ্যৎসুলভ এবং অসাড় ঠেকুক।  

প্রকাশনা বিপ্লব
বছর বিশেক আগে একটা বইকে নিজের করে পাওয়ার জন্যে কি করতে হতো? নিশ্চিতভাবে অসংখ্য শব্দের একটা স্তূপের প্রয়োজন পড়তো। কিন্তু এক কাড়ি টাকারও দরকার ছিল। কিন্তু হাতে  নগদ টাকা থাকলেও--ধরুন লেখা সম্পাদনা, নকশা করা, প্রুফ দেখানো এবং ছাপার জন্যে প্রয়োজনীয় লাখ খানেক টাকা--প্রিন্টার ছিল অতি জরুরি। তারপর বই ছাপা গেলেও সেগুলো রাখার জন্যে দরকার ছিল গুদাম ঘরের। তারপর ছিল সেসব চালানের ব্যাপার। বইগুলোকে বার্নস এন্ড নোবেলের মতো দোকানে পৌঁছে দিতে দরকার ছিল ডিস্ট্রিবিউটরের। এবং সবশেষে সেসবকে সামনের কাতারে রাখার জন্যে বিপণন বাজেটও দরকার হতো। 

আজকের দিনে ডিজিটাল বই বের করতেও শব্দের দরকার আছে বটে, কিন্তু অন্য অনেকগুলো ধাপ এড়িয়ে যেতে পারেন। পেজেস বা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ডক্যুমেন্ট থেকে ই-পাবে ফাইল চালান করতে পারেন--এটাই ডিজিটাল বইয়ের পরিষ্কার মানদণ্ড। অ্যামাজন এবং আই-বুক অ্যাকাউন্ট খুলুন, ফাইল আপলোড করুন, ব্যস, সহসা ডিজিটাল বইয়ের বাজারের ৯২ শতাংশ অংশের ভাগীদার হয়ে যাবেন। 

ভবিষ্যতের বই প্রকাশের ধরনও পাল্টে যাবে

মুদ্রিত বইয়ের বেলায় নতুন অর্থ যোগান, উৎপাদন এবং বিলির কায়দাকানুন বাস্তব একটা জিনিসের বিক্রি অপেক্ষাকৃত সহজ করে তোলে। ব্লার্ব, অ্যামাজন, লাইটনিং সোর্স এবং ইনগ্রাম স্পার্ক  সবার নাগালের ভেতর থাকা অল্প কটি প্রিন্ট-অন-ডিমান্ড প্রতিষ্ঠান। 

নতুন প্রযুক্তি এবং সেবার এই বিস্তার লেখকের অর্থনীতি পাল্টে দিয়েছে। আজকের দিনে লেখকের আয়ের প্রায় অর্ধেকই আসছে স্বাধীনভাবে প্রকাশিত বই থেকে। স্বাধীনভাবে প্রকাশিত বই জনপ্রিয় বইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, কিন্তু এখানে সম্মানির হার অনেক বেশি--মোটামুাটিভাবে ৭০ শতাংশ বনাম ২৫ শতাংশ। প্রথম বারের মতো--সম্ভবত ছাপাখানা আবিষ্কারের পর প্রথম--লেখক এবং ছোটখাটো ছাপাখানাগুলো প্রচলিত প্রকাশনার কায়দার বাইরে স্বাধীন পথের খোঁজ পেয়েছে। 

জাপানের এক ইনডিপেনডেন্ট লেখকের বই

একজন লেখকের পক্ষে জরুরি কৌশল: ইমেইল

২০১৪ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের ইমেইল নিউজলেটারের গ্রাহক ছিল ৬.৫ মিলিয়ন। ২০১৭ সালের দিকে এই সংখ্যা দ্বিগুন হয়। মেইলচিম্পের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় দুই দশক ধরে নিউজলেটার সেবা দিয়ে আসছ্, কিন্তু কখনওই আজকের মতো জনপ্রিয় ছিল না। ২০১৮ সালে ব্যবহারকারীরা মেইলচিম্প মারফত ২০১৩ সালের তুলনায় পাঁচ গুন বেশি  প্রায় ১ বিলিয়ন ইমেইল পাঠিয়েছে, তখন দিনে মাত্র ২০০,০০০ ইমেইল সামাল দিত প্রতিষ্ঠানটি। 

ইমেইলের এমনি বিস্ফোরণে সাড়া দিয়ে ২০১৭ সালে নিউজলেটার প্রকাশনা ও মুদ্রণ প্ল্যাটফর্ম স্টার্টআপ সাবট্যাক সূচিত হয়। বেশির ভাগ নিউজলেটার প্ল্যাটফর্ম এবং পেমেন্ট সিস্টেম মসৃণ বা অর্থপূর্ণভাবে সমন্বিত নয়। প্রবেশাধিকারের জন্যে অর্থ আদায় কষ্টকর কাজ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য সাবট্যাক সিস্টেম মারফত একজন প্রকাশক অনায়াসে গ্রাহক চাঁদার জন্যে নিউজলেটারের মিটার সংযুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করতে পারেন। অক্টোবর নাগাদ সাবট্যাক বিভিন্ন নিউজলেটারের ২৫ হাজারেরও বেশি গ্রাহকের গর্বিত বাহক হয়ে বছরে গড়ে ৮০ ডলার মিটিয়েছে। রোলিং স্টোনের সাংবাদিক ম্যাট টাইব্বি সম্প্রতি তার উপন্যাস দ্য বিজনেস সিক্রেটস অভ ড্রাগ ডিলিং সাবট্যাকে সিরিয়াল হিসাবে বের করেছেন। জুড লেগামের পপুলার ইনফর্মেশনও সাবট্যাক মারফত বেরিয়েছে। 

আমার চেনা প্রায় সমস্ত লেখক বা শিল্পীরই একটা করে নিউজলেটার আছে। এই জোয়ারের কারণ বোঝার একটা উপায় হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উন্মুক্ত ওয়েবের বিশাল অংশ ছিনিয়ে নিয়ে মনোযোগ কেড়ে নেওয়ায় এককালে ব্লগিংয়ে খরচ করা শক্তি ইমেইলে স্থানান্তরিত হয়েছে। 

এভাবে ভাবুন: আমাদের কাছে মেইলের ঠিকানা আছে মনে করি। এগুলো বহনযোগ্য, মুদ্রণযোগ্য, নিরাপদে সংরক্ষণ করা সম্ভব। অজানা কারিগরিতে নিয়ন্ত্রিত নয়। দশ হাজারেরও বেশি গ্রাহক নিয়ে অনেকের ইমেইল নিউজলেটার আছে। এটা শ্রোতাদের সাথে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ, আন্তরিক, এবং মূল্যবান সংযোগ। প্রথম রেবেল গার্লস বইয়ের জন্য ইমেইল গিয়েছিল ২৫ জন গ্রাহকের কাছে। পরের ছয় মাসে এই তালিকা আকার ও উত্তেজনার বিচারে বিশাল হয়ে দাঁড়ায়। কোনও প্রকল্পকে সাহায্য করার সময় বন্ধুদের কাছে প্রচার করে এক ধরনের নেটওয়ার্কের মতো অবস্থা তৈরি হয়। নেটওয়ার্ক যত বড় হবে, প্রভাবও হবে তত প্রবল। 

বই হিসাবে নিউজলেটার

কোনটা বই আর কোনটা নয়, তার অটল সংজ্ঞার বেলায় মুশকিল হলো অনেক সময় বইয়ের মতো না হলেও সেটা আসলে বইয়ের মতোই। 

তাইওয়ান ভিত্তিক বেন টম্পসন স্ট্র্যাটচেরি নামে একটা নিউজলেটার বের করে। বার্ষিক ১০০ ডলারের বিনিময়ে সপ্তাহে চারবার আপনি প্রযুক্তি এবং স্টার্টআপ সম্পর্কিত বিভিন্ন চিন্তাভাবনার খবর পাবেন এতে। আপনি তার বিশ্লেষণের দিকে মনোযোগ দিলে সম্ভবত টাকাপয়সা কামাতে পরবেন। প্রকাশিত বিবরণী অনুযায়ী ২০১৪ সালে তার ১,০০০ এরও বেশি গ্রাহক ছিল, বছরে ১০০ ডলার হারে চাঁদা দিয়েছে তারা। পরে ২০১৪ সালের তুলনায় তার গ্রাহকরা ১০০ গুণ বেশি চাঁদা দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। এ কি সম্ভব? বেন টম্পসন তাহলে নিউজলেটার মারফতই বছরে ১০ মিলিয়ন ডলার কামাচ্ছেন? ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে বলেছিলাম তাকে। তিনি লিখেছেন, 'আমি ভীষণ সফল, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ১০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নয়!' তবু দশ হাজারের কম গ্রাহক থাকার কথা কল্পনা করা কঠিন। 

২০০৮ সালে ওয়্যার্ড-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রযুক্তিবিদ কেভিন কেলি ইন্টারনেট এবং ইমেইল লেখকদের কিভাবে স্বাধীনতা দেবে সে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। একে বাজার গঠনের ১,০০০ সত্যিকারের ভক্ত তত্ত¡ বলছেন তিনি। 

বেন টম্পসনের মতো মানুষগুলো আসলে কিন্তু বই লিখছেন। তার এক বছরের নিবন্ধগুলো একসাথে করে সম্পাদনা করুন, ব্যস প্রযুক্তির এক বছর নামে দুর্দান্ত একটা সংস্করণ পেয়ে যাবেন। সুতরাং বিচিত্র কায়দায় স্ট্র্যাটচেরি নিউজলেটার আকারে বাঁধানো কিন্ডল বইয়ের মতোই ভবিষ্যতের বই। 

এটা উল্লেখের দাবি রাখে, টম্পসনের অবস্থান সুরক্ষিত। বাইরের কেউই তার গ্রাহকদের ছিনিায়ে নিতে বা তাদের সাথে যোগাযোগ ব্যহত করতে পারবে না। ইমেইল একঘেয়ে, সরল পুরোনো প্রযুক্তি। ১৯৭১ সালে রে টমলিনসন প্রথম ইমেইল পাঠিয়েছিলেন। সামাজিক মাধ্যমের গ্রাহকদের বিপরীতে ইমেইল এখনও আলগোরিদমের করায়ত্ত হয়নি। এটা অনুমানযোগ্য বিপণন চ্যানেল। 

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনুমানযোগ্য নয়। অ্যালগোরিদম এবং পণ্য কার্যকারিতার প্রবহমান লাভার মতোই স্থিতিশীলতা। তার মানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনিয়োগ কয়েক বছরের মধ্যেই লালবাতি জ্বালতে পারে। 

তবে কোনও প্রকাশক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মারফত ইমেইলকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে ইন্সটাগ্রামই সবচেয়ে জুৎসই বলে মনে হয়। বই স্বভাবগতভাবেই দৃশ্যমান। প্রচ্ছদের নকশা এই মুহূর্তে অ্যালিসন ফরনার, গ্রে ৩১৮, রদরিগো করাল, সুজান ডীন এবং আরও অনেকের অনন্য ছবির কল্যাণে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে। 

অডিও প্রচার
লাইব্রেরি অভ কংগ্রেস ১৯৬৯ সালে ক্যাসেটের মাধ্যমে বই বিলি শুরু করে। কিন্তু কেবল সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই অডিও বুক উল্লেখযোগ্য বাজার অংশ পেয়েছে। এখন প্রায় ডিজিটাল এবং অদৃশ্য অডিও বুক ২০১৭ সালে ২.৫ বিলিয়ন আয় করেছে, এই পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি। 

স্মার্টফোন ডিজিটাল বই পড়ার সেরা যন্ত্র নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে অডিওবুক প্লেয়ার হিসাবে অসাধারণ। চলাফেরার সময় অনায়াসে পকেটে রাখা যায়। 

গত কয়েক বছরে সহসা অডিও বুককে দারুণ অভিজ্ঞতায় পরিণত করা কারিগরি উন্নতি ঘটেছে। উন্নত মান, দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি এবং অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল ব্লুটুথে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। সংযোগ এবং একাধিক যন্ত্রের সমন্বয় এখন সর্বব্যাপী। 

ক্রাউড ফান্ডিং, প্রকাশনার নতুন সংযোজন ভয়েজারের গোল্ডেন রেকর্ড বের হয়েছে টাকা সংগ্রহ করেই

পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ
আমরা অল্প অল্প করে এককালের কাল্পনিক আগামীর বইয়ের কাছে এসে গেছি

চলমান ছবিকে প্রায়শই আগামীর বইয়ের মৌলিক অংশ ভাবা হয়েছে। আই-বুক বা কিন্ডল বইয়ে বিরল ক্ষেত্রে পাওয়া গেলেও এখন তা হাজির হয়েছে। আপনি গিটার বাজানো শিখতে চাইলে অ্যামাজনে শিক্ষামূলক বই খুঁজতে হবে না। সোজা ইউটিউবে গিয়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা তালিম নিন, যখন ইচ্ছা থামুন, প্রয়োজনে ফের শুনুন। আপনার মনমতো শিখুন। 

দ্য বুক অভ স্যান্ড-এ বোর্হেস একটা অসীম বইয়ের কথা লিখেছেন: এবং তারপর আগন্তুক আমাকে বলল: "ভালো করে পৃষ্ঠাটা পড়ো। এটা আর দেখতে পাবে না।" আজকের দিনে ইন্টারনেট ব্রাউজ কিংবা ট্ইুটারে নজর বোলাতে গেলে এমনই মনে হয়। 

আমাদের আগামীর বই তৈরি হয়েছে ইমেইল, টুইট, ইউটিউব ভিডিও, মেইলিং লিস্ট, যৌথ অর্থযোগানোর প্রচারণা, পিডিএফ থেকে শুরু করে অ্যামাজন অয়্যারহাউস এবং হং কংয়ের মতো জায়গায় ভীষণ সুলভ অফসেট প্রিন্টারের জোয়ার দিয়ে। 

আগামীর বই এসে গেছে। এবং এটা পাল্টে চলেছে। আপনার হাতেই রয়েছে এটা। উত্তেজনাকর। একঘেয়ে। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

কিন্তু কিছু কিছু অলীক প্রত্যাশাকে ঘষামাজা করুন। নানাদিক থেকে এটা এখনও সেই আলুই রয়ে গেছে।

সূত্র: ওয়্যার্ড 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.