বিজ্ঞান কল্পকাহিনির জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবী জুড়ে!

ইজেল

30 September, 2021, 01:30 pm
Last modified: 30 September, 2021, 01:35 pm
ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগের কয়েক দশক এবং বিংশ শতকের গোড়ার দিকে, নানা মত, আদর্শ ও ঘরানার লেখকরাই প্রকাশ করতে শুরু করেন এমন সব গল্প-উপন্যাস, যেগুলোকে আজকের দিনে আমরা অভিহিত করি ক্লাইমেট ফিকশন বা ‘ক্লাই-ফাই’ হিসেবে। 

মেরু অঞ্চলের বরফ গলা, জিওইঞ্জিনিয়ারিং স্কিম কিংবা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ- বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে এসব শব্দগুচ্ছ তো আজকাল আমাদের কানে অতি পরিচিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হবেন, শত বছরের বেশি সময় আগেই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে স্থান পেতে শুরু করেছিল মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কাহিনি। 

ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগের কয়েক দশক এবং বিংশ শতকের গোড়ার দিকে, নানা মত, আদর্শ ও ঘরানার লেখকরাই প্রকাশ করতে শুরু করেন এমন সব গল্প-উপন্যাস, যেগুলোকে আজকের দিনে আমরা অভিহিত করি ক্লাইমেট ফিকশন বা 'ক্লাই-ফাই' হিসেবে। 

এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রেই আসবে যাঁর নাম, তিনি হলেন বিশ্বনন্দিত ফরাসি লেখক জুল ভার্ন। অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ৮০ ডেজ কিংবা টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি-খ্যাত এই লেখক ১৮৮৯ সালে রচনা করেন দ্য পারচেজ অব দ্য নর্থ পোল নামের একটি উপন্যাস। সেই উপন্যাসে দেখা যায় একজন পুঁজিবাদী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আর্কটিককে উত্তপ্ত করছে, যাতে করে তিনি সেখানে মজুতকৃত কয়লা উত্তোলন করতে পারে। 

এদিকে কম যান না আরেক বিশ্ব কাঁপানো মার্কিনি লেখক মার্ক টোয়েইনও। তিনি তাঁর ১৮৯২ সালের উপন্যাস দ্য আমেরিকান ক্লেইমেন্টে যুক্ত করেন উষ্ণ জলবায়ু বিক্রির একটি সাবপ্লট।

সম্প্রতি, সাহিত্যবিষয়ক প-িত স্টিভ অ্যাসেলিন পুনর্নিরীক্ষা করে দেখেছেন, এই দুটিসহ গোড়ার দিককার আরও ডজনখানেক ক্লাই-ফাই কাহিনি। এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সেগুলোতে তিনি এমন সব থিম খুঁজে পেয়েছেন, যা আমাদের আজকের দিনের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ধারণার সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক ও সাদৃশ্যপূর্ণ।

এক জায়গায় অ্যাসেলিন লিখেছেন, ভার্ন কিংবা টোয়েইনদের মতো রচয়িতারা তাঁদের ব্যঙ্গধর্মী লেখায় যেসব আইডিয়া নিয়ে কাজ করেছেন, সেগুলো মূলত মানবজাতি কর্তৃক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানব-ঔদ্ধত্যের অতিরঞ্জিত নিদর্শন হিসেবে কাজ করে।

তবে সেগুলোতে, অবশ্যই, সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় বর্তমান সময়ের জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকৃতিকারীদের দেওয়া যুক্তির। এসব মানুষেরা বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, বলে যে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কোনো যোগসাজশ নেই। 

এ ছাড়া ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ বা বিংশ শতকের শুরুর দিকের সাহিত্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ থিমও পরিলক্ষিত হয়, যেটি আমাদেরকে বলে স্বেচ্ছাকৃত জলবায়ু পরিবর্তনের অনিচ্ছাকৃত পরিণতি সম্পর্কে। 

অ্যাসেলিনের মতে, বেশ কয়েকটি কাহিনিতে (যেমন লুই পি গ্রেটাকাপের দ্য এভাকুয়েশন অব ইংল্যান্ড : দ্য টুইস্ট ইন দ্য গালফ স্ট্রিম এবং জর্জ গ্রিফিথের আ কর্নার ইন লাইটনিং) দেখা যায়, উন্মাদ বা বাতিকগ্রস্ত প্রোটাগনিস্টরা পৃথিবীর জলবায়ুকে ঠিক করতে সক্ষম হচ্ছে, কিন্তু তার ফলে সমাজের ওপর অনাকাক্সিক্ষত (এবং অনেক ক্ষেত্রে সর্বনাশা) রিপল ইফেক্ট পড়ছে।

এসব সতর্কবার্তা আজকের দিনে এসে নতুন অর্থ লাভ করেছে। জিওইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে জলবায়ুকে প্রভাবিত করে ধীরগতির করে দেওয়া বা বৈশ্বিক উষ্ণতার উল্টোটা ঘটানোর মতো প্রস্তাবনাগুলো ভবিষ্যৎ জলবায়ু নীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। 

জলবায়ুর 'টিপিং পয়েন্ট' পার হয়ে যাওয়া কিংবা জলবায়ুর এমন ধারার পরিবর্তন ঘটানো, যেখান থেকে আর পেছনে ফিরে আসা অসম্ভব- এ ধরনের বিষয়বস্তু আজকাল অনেক বিজ্ঞানীরই চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিভিন্ন জনপ্রিয় ও আধুনিক ক্লাই-ফাইতে আমরা এ ধরনের প্লট দেখে থাকি। ২০০৪ সালের চলচ্চিত্র দ্য ডে আফটার টুমরোতেও প্রায় একই প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটেছিল। 

অ্যাসেলিন তাঁর বিশ্লেষণ শেষ করেছেন এই বিষয়টির ওপর ফোকাস করে যে কীভাবে ক্লাই-ফাই লেখকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবকে তুলে ধরেছেন। 

বেশ কয়েকজন পুঁজিবাদবিরোধী লেখক বাজারনির্ভর পুঁজিবাদী ঔদ্ধত্যের গোমর ফাঁস করতে চেয়েছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, বায়ু কিংবা স্বয়ং জলবায়ুকে বেচে দিতে চাওয়া হলে, তার পরিণাম কতটা বীভৎস ও ভয়ংকর হতে পারে। এমনকি যেসব লেখকের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা ছিল না, তাঁদের ভূরাজনৈতিক ধারাভাষ্যও প্রায় অভিন্নই ছিল। 

শত বছর পূর্বের লেখকেরা তাঁদের কল্পকাহিনির মাধ্যমে বলতে চাইতেন যে জলবায়ু বিপণনের ফলে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য ও অসমতা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং সমাপতনের বিষয় এই যে বর্তমানে সেগুলোকে বড়ই বাস্তবসম্মত বলে মনে হচ্ছে। 

ভার্নের উপন্যাসে দেখা গিয়েছিল, লোভী পুঁজিবাদীদের জলবায়ু নিয়ে বাণিজ্যের ফলে অনেক জনগোষ্ঠী ও জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, মহাবিপর্যয় নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। অ্যাসেলিনও সেই সূত্র ধরে বলেন, ধনী রাষ্ট্রগুলো এসব বিপর্যয়কে ততক্ষণ অবধি মুখ বুজে সহ্য করতে রাজি থাকে, যতক্ষণ না তারা নিজেরা সেই বিপর্যয়ে আক্রান্ত হয়, বরং ভুক্তভোগীর তালিকায় ঠাঁই হয় কেবলই আদিবাসী কিংবা অপশ্চিমা রাষ্ট্রের মানুষদের। 

সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে ভীত পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা আবার মনে করেন, শতবর্ষী এসব কল্পকাহিনি যোগসূত্র স্থাপন করে জলবায়ু নীতিমালার কাছে, যেখানে ব্যক্তিগত ও জাতীয় স্বাধীনতা হার মানে। এই ব্যাপারটি আধুনিক রক্ষণশীলদের জলবায়ুর ব্যাপারে সন্ধিগ্ধতার প্রায় সমান্তরাল। 

মোদ্দা কথা, ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো আজ জ্বাজল্যমান বাস্তব হয়ে আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে, আর সেগুলোর পরিণাম আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন শুধু এটুকুই আশা করতে পারি যে একবিংশ শতকের অধিকাংশ ক্লাই-ফাইয়ে ডিস্টোপিয়ান বা অ্যাপোক্যালিপ্টিক যেসব প্লটলাইন দেখানো হয়, এক শ বছর পরের সমাজগুলোকেও যেন আবার সেগুলোর বাস্তব মঞ্চায়ন 'উপভোগ' করতে না হয়।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.