প্রতি বিন্দু শ্বাস

ইজেল

সৈকত দে
08 May, 2021, 09:35 am
Last modified: 08 May, 2021, 04:52 pm
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে লাগলো দেশজুড়ে। আমরা যারা কিছুটা মাত্রায় সুবিধাভোগী, কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠাট্টা ইয়ার্কি করলাম। আমাদের দেশের কোনো কোনো বিচক্ষণ মানুষের সাথে করোনা ভাইরাসের সাথে দেখা হয়ে যেতে লাগলো এবং সেসব কথোপকথনের বিবরণ তিনি নানা সভায় দিতে থাকলেন। সেসব নিয়েও কিছুদিন আনন্দ করলাম। কিন্তু বিষয়টা আস্তে আস্তে ঠাট্টা ইয়ার্কির বিষয় থাকলো না। আমাদের দেশের হাসপাতাল, আইসিইউ মানুষের সমবেত আর্তনাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। চিকিৎসায় এখন জরুরি উপাদান হয়ে উঠেছে অক্সিজেন.

(আমার অগ্রজ বন্ধু কবি পার্থ বসুকে)

১. 
বিশ্ববিপ্লব নয় মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে অনিবার্য জিনিস অক্সিজেন । এই জিনিস বুক ভরে নিতে পারলে অতিমারি, দুর্ভিক্ষ, খরা, জলোচ্ছ্বাসেও মানুষ টিকে থাকে। তোমাকে না দেখলে, তোমাকে স্পর্শ করতে না পারলে কিংবা তোমার সাথে না থাকলে আমি বাঁচবো না- এসব কথা হচ্ছে প্রেমের মুহূর্তে প্রেমিক প্রেমিকাদের বলা কাঁচা মিথ্যে। পরস্পরের সাথে না থেকে, অন্য সম্পর্কে গিয়ে বা না গিয়ে মানুষ দিব্যি বেঁচে থাকে। অনেক দিন পর দূর থেকে দেখে পালস বিট মিস করলেও একেবারে মরে যায় না ৷ সত্তর বছর যদি কেউ বাঁচে তবে দুই বিলিয়নের কিছু বেশিবার ঐ স্পন্দনের সাথে সে বাস করে। দুই বিলিয়ন বার নিয়মিত স্পন্দনের মধ্যে অনিয়ম দেখা দিলেই বিপদ। সে বিপদের অন্যতম প্রধান কারণ শরীরে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দেওয়া।

কবিতার মধ্যে কবি লিখতে পারেন, মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ বিন্দু অক্সিজেনের মতো তোমাকে চাই৷ কিন্তু সত্যি বলতে, বিশুদ্ধ অক্সিজেনের চেয়ে জরুরি কিছুই এই পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি। আমাদের দেশে বিশ সালের মার্চের আগে আমরা ভালোই ছিলাম। আমাদের সামনে শত্রু মিত্র সবই ছিলো দৃশ্যমান। অনন্ত বৃষ্টির মধ্যে কোনোমতে অপুদুর্গার কচুরিপানার পাতায় মাথা বাঁচানোর মতো, শরীরের এক পাশ ভিজিয়ে হলেও আমরা নিজেদের রক্ষা করেছি। তারপর প্রথম করোনা রোগী চিহ্নিত হলো। আমাদের চেনা পৃথিবী পাল্টাতে থাকলো চিরতরে ৷ প্রতিদিনকার সংক্রমণ, মৃত্যু আর  সুস্থতার পরিসংখ্যানে ভরে উঠলো আমাদের জীবন।

অতর্কিত ধর্ষণ, সড়ক  কিংবা জলপথের দুর্ঘটনায় সহনাগরিকের মৃত্যু, প্রতিহিংসাজনিত  হত্যা এসব আমাদের প্রতিবেশের সাথেই ছিলো এবং বেশিরভাগ ঘটনার বিচার না হওয়া আমরা একভাবে রক্তের সাথে মিশিয়ে সহ্য করে নিয়েছিলাম কেন না অগাধ সহ্য ক্ষমতা না থাকলে এই জনপদে বাঁচা মুশকিল । এমনকি একটা কুকুরও ব্যথা পেলে যে চিৎকার করে, সে চিৎকারটুকু গিলে ফেলেই এখানে প্রতিনিয়ত বাঁচতে হয়। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে শত্রু দৃশ্যমান। কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও খুন হয়ে যাওয়ার আগে খুনীকে দেখা যাচ্ছে। পরের পরিস্থিতি অদৃশ্য জীবাণুর হাতে জীবনের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে লাগলো দেশজুড়ে।

আমরা যারা কিছুটা মাত্রায় সুবিধাভোগী, কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠাট্টা ইয়ার্কি করলাম। আমাদের দেশের কোনো কোনো বিচক্ষণ মানুষের সাথে করোনা ভাইরাসের সাথে দেখা হয়ে যেতে লাগলো এবং সেসব কথোপকথনের বিবরণ তিনি নানা সভায় দিতে থাকলেন। সেসব নিয়েও আমরা কিছুদিন আনন্দ করলাম। আমাদের জীবনে সহজ জলের মতো, শিশুর উজ্জ্বল হাসির মতো আনন্দ বহুকাল হলো লুপ্ত তাই এসবে আমাদের হাসি পায়। বিষয়টা আস্তে আস্তে ঠাট্টা ইয়ার্কির বিষয় থাকলো না। আমাদের দেশের হাসপাতাল, আইসিইউ মানুষের সমবেত আর্তনাদে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।

করোনা চিকিৎসায় দেখা যাচ্ছে জরুরি উপাদান হয়ে উঠেছে অক্সিজেন ৷ শরীরের অক্সিজেন ঘাটতি তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে না পারলে মানুষটিকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনা যায় না। সাধারণ বেডে তো পনেরো লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়াই যায় কিন্তু তার বেশি প্রয়োজন দেখা দিলেই আমাদের আইসিইউ লাগে কারণ সেখানে ষাট লিটার পর্যন্ত হাই ফ্লো অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আমাদের দেশে আক্রান্ত মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় আইসিইউ কম।

করোনার দ্বিতীয় বছর আমরা অতিক্রম করছি। গত বছরের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে আসার পর আমরা কিছু সময় পেয়েছিলাম আমাদের স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজানোর কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কথায় কর্ণপাত না করে আমরা নিজেদের ব্যক্তিগত উদযাপনেই ব্যস্ত ছিলাম ফলে এবার অনেক গুণ বেশি শক্তি নিয়ে করোনা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ৷ মাস্ক পড়া থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সুরক্ষার  একেবারে প্রাথমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমরা নিইনি। আমরা অধিকাংশ ভেবেছি আমরা অমর, নিদেনপক্ষে পুরাণকথিত অমর মানুষদের তালিকায় আমাদের নাম নথিবদ্ধ আছে। ফলে মাস্ক পরিনি ৷ উচ্চ পর্যায়ের কেউ কেউ বলেছেন, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। ফলে মাস্ক আমাদের সুন্দর, কিউট থুতনিতে চির অবস্থান নিয়েছেন। নাকের ফুটো দুটি উন্মুক্ত রেখে আমরা রীতিমত আমন্ত্রণ জানিয়েছি করোনা জীবাণুকে আমাদের শরীরে ঘর সংসার পেতে বসবার। ফলে, যা ঘটবার তাই ঘটেছে। অসংখ্য মানুষের স্মৃতি আর  বর্তমান চিরতরে বদলে যাচ্ছে ৷ অক্সিজেন আর  আইসিইউ সংকটে মূল্যবান প্রাণ ঝরে পড়ছে ৷

২. 
আমার ছেলেবেলায় আমি যে দলের সাথে যুক্ত ছিলাম তার ভারি সুন্দর এক  লাইব্রেরি ছিলো এলাকায় ৷ ক্ষুদিরামের নামে চিহ্নিত সে পাঠাগারের ঘরে ঢুকতে হতো এডভোকেট মোহাম্মদ কবির চৌধুরীর চেম্বার পেরিয়ে। তাঁর ছেলেদের দুজন পার্টিতে যোগ দিয়েছিলো, আমাদের নেতা ছিলেন তাঁরা। পুত্র আর  পুত্রের কমরেডেরা যে প্রকরণের রাজনীতি করে তা হলো তাঁর ধরণের রাজনীতি সমূলে উচ্ছেদ করা। কিন্তু তিনি কোনোদিন অবাধ যাতায়াতে বাধা দেন নাই।

প্রতিবার দেখা হলে স্মিত হেসে চেনা দিয়েছেন। গত বছর জুনের দুই তারিখ করোনা তাঁকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। তার ছেলে আমাদের বড় ভাই, কমরেড আবিদ একটি হৃদয়সংবেদী প্রতিবেদন লেখেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাতে আমরা দেখি, অক্সিজেন স্যাচুরেশন বিরানব্বইয়ের নিচে গেলে রোগীকে অক্সিজেন দিতে হয়। তিন হাজার টাকায় অক্সিমিটার কেনার দরকার হয় নিয়মিত অক্সিজেন মাপের জন্য  যার স্বাভাবিক মূল্য দুই হাজার থেকে বাইশ শো টাকার মধ্যে। তিনি করোনা সাসপেক্ট থাকায় কোনো হাসপাতাল তাঁকে নিতে চায়নি। এদিকে সরকারি জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্যে আইসিইউ মাত্র দশটি।

বিশিষ্ট এই আইনজীবীর সাথে মোবাইল থাকায় তিনি খবর পান, এডভোকেট আবুল কাসেম চৌধুরী শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুরেছেন ক্লিনিকের দ্বারে। শেষ পর্যন্ত সিট পেয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের একটি ওয়ার্ডের ফ্লোরে। শ্বাসকষ্টেই সেখানে সেদিন মারা যান। সেদিন রাতে তিনি ঘুমোতে পারেননি। ছেলের লেখা থেকে একটু পড়ি :

"আইনপেশায় চসিকের একুশে পদক পাওয়া আইনজীবী, চট্টগ্রাম বারের সাবেক সভাপতি, বার কাউন্সিলের মেম্বার ছিলেন, তাঁর অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী-তাঁর জন্য অনেকে চেষ্টা করছেন, তার ক্ষেত্রে এ অবস্থা হলে, অন্যান্য সাধারণ রোগীদের কি পরিস্থিতি?

২৯ মে টেস্টের জন্য বাবাকে নিয়ে জেনারেল হাসপাতালে এলাম। একতলায় কয়েকশত মানুষের ভীড়। প্রস্থে ৮-১০ ফুট একটি লম্বা প্যাসেজের মধ্যে একটি রুমের সামনে লাইন, একজনের গায়ের উপর আরেকজন। কেউ হাঁচি দিচ্ছে, কেউ কাশছে, কেউ দুই  প্যাসেজের মাঝখানের ছোট খোলা জায়গাটাতে থুতু ফেলছে। আরেকজনের গা বাঁচিয়ে হাঁটার রাস্তা নেই। সে রুমে প্রথমে স্ক্রিনিং হবে, কার পরীক্ষা দরকার। জ্বর, কাশি, সর্দি না থাকলে, পরীক্ষা করা হবে না। আরেকটি রুমে যাদের টেস্ট করা হবে, তাদের ফর্ম জমা নেয়া হচ্ছে, সেখানেও একই চিত্র।

দোতলায় স্পেশাল টেস্ট হবে, সেখানে ভীড় কম, প্রধানতঃ পুলিশ সদস্য ও প্রশাসনের লোকজনের জন্য। সেখানে ঘন্টা তিনেক অপেক্ষা করার পরও ডাক এলো না। এদিকে দোতলায় স্পেশাল যে টেস্ট চলছিল পুলিশদের, তাও শেষ। জিজ্ঞেস করাতে বললো, নীচতলাতেই সবার সাথে টেস্ট করাতে হবে। সংশ্লিষ্টদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বাবার যে বয়স, আলাদা টেস্ট করা যায় কি না। লাভ হলো না। ওদেরও দোষ দিই কিভাবে, অল্প কয়েকজন মানুষ উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে এতগুলো মানুষের টেস্ট করছে, কতদিকে খেয়াল রাখবে। শেষ পর্যন্ত সেই ভীড়েই আমি ও আমার বড় ভাই বাবাকে নিয়ে গিয়ে টেস্টটা করালাম।

"জ্বর বেড়ে যাওয়ায়, স্যাচুরেশন কমায়, চৌদ্দ হাজার টাকার অক্সিজেন কিনতে হলো সাড়ে আঠারো হাজার টাকায়। সিলিন্ডারের মুখে লাগানোর যে সেটের দাম ছিল ৩ হাজার টাকা, তার দাম হয়ে গিয়েছে ৭ হাজার টাকা। তাকে ধরে রাখা যায়নি। আমরা একজন মানুষকে কেন্দ্রে রেখে পরিস্থিতি বুঝতে চাইছি। তার বয়স হয়েছিলো এবং নানারকম শারিরীক জটিলতা ছিলো। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন হাই অক্সিজেন ফ্লোযুক্ত আইসিইউ থাকলে হয়তো তাকে আরও কিছুদিন নিজেদের কাছে রাখা যেতো।

আমাদের হাসপাতালগুলোতে দরকার ছিলো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম৷ অন্য অনেক স্থাপনা এ দেড় বছরে আমরা মনোযোগ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি। স্বাস্থ্যখাতের এই গুরুতর বিষয়গুলোতে আমাদের অমনোযোগই রয়ে গেছে। ফলে আমাদের নিজেদের আত্মীয়স্বজন চেনা পরিচিতেরা আমাদের স্মৃতি হয়ে গেছেন।

৩. 
শেষ কৈশোরে প্রথম যে বড়োপত্রিকায় গল্প ছাপা হয়েছিলো তার সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। একাধিক লেখার সুবাদে তার সাথে একরকমের পরিচয়বোধ গড়ে উঠেছিলো আমার। তিনি যখন চলে গেলেন কষ্ট পেয়েছিলাম, বেঙ্গল মিউজিক ফেস্টে প্রায় প্রতি বছর যখন যেতাম, দেখা হলে চেনা দিতেন। সৌমিত্র যখন প্রয়াত হলেন মনে হলো সিনেমা দেখবার চিরায়ত অভ্যাসে একটি পূর্ণচ্ছেদ পড়লো, অন্তত কিছুকালের জন্য।

মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ানি মানে যেমন ফেলিনি, তোশিরো মিফুনে মানে যেমন কুরোশাওয়া, তেমনি সৌমিত্র বললে বললে মনে পড়ে সত্যজিতের কথা। সে-ই যে তরুণ সৌমিত্র নাচছেন 'কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি', যদিও পরে সমালোচনা হয়েছিলো নকশাল পিরিয়ডে পরিচালক কেন 'আসল কি নকল সোনা' চিনতে পারছেন না! অপু চরিত্রের সৌমিত্র অবিস্মরণীয়।

অপু চরিত্রের সৌমিত্র অবিস্মরণীয়

ধূমপায়ী বাঙালি সমাজের প্রতি সত্যজিৎ কর্তৃক রোমান্সমাখা দৃশ্যে সাবধানবাণী নির্মাণ, 'খাওয়ার পর একটা করে কথা দিয়েছো। অজর শর্মিলা ঠাকুর! সৌমিত্রস্মরণে প্রকাশিত হলো নানা পত্রিকার একাধিক সংখ্যা। একটিতে সুধীর চক্রবর্তী লিখলেন, তার বন্ধু কৃষ্ণনাগরিক পুলুকে নিয়ে। তাঁরা দুজনেই কৃষ্ণনগরে ছিলেন আর সৌমিত্রের ডাক নাম পুলু। সেই সুধীর চক্রবর্তী, 'গভীর নির্জন পথেৎ'-র সুধীর চক্রবর্তীও লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার অল্প কয়েকদিন পরে প্রয়াত হলেন।

'খাওয়ার পর একটা করে কথা দিয়েছো। অজর শর্মিলা ঠাকুর!

একটা কবিতা পড়াই আপনাদের। 

তার আগে বলি, 'দিদিমণি শূন্য দিন' সিরিজে আটটি কবিতায় আমরা পরিচয় হই একটি কিশোরী ও তার শিক্ষিকা দিদিমণির সাথে। সেখানে কিশোরী নানারকম পাঠ্যপুস্তক বহির্ভূত প্রশ্নের জবাব দেয় কিন্তু উত্তরগুলো দর্শনে, কবিতায় জারিত। তেমন এক কবিতা :

'পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীটির নাম লেখ
প্রশ্নের উত্তরে
ক্লাস নাইনের মেয়ে লিখেছে - কোরান।
গল্পটি শোনাল মেয়ে
গ্রামের স্কুলের দিদিমণি,
মেয়েটিও তার ছাত্রী,
নদীজপমালাধৃত প্রান্তরের মেয়ে
সে কি করে টের পেল
তৃষ্ণার্ত আরবে, ঊষর মরুর বুকে
নদীর উৎসার
যা এখন আবিশ্ব বহতা।
যা এখন গঙ্গা ও মেকং...
দিদিমণি নিরুপায়
সঙ্গতভাবেই তাকে শূন্য দিয়েছেন।
এই প্রথম হাত কেঁপে গেল!
(দিদিমণি শূন্য দিন/৮: 'দিদিমণি শূন্য দিন ও ঢ্যামনা কবিতাগুচ্ছ' বই থেকে: পার্থ বসু)

পার্থ বসুর এই গুচ্ছটি আমি পড়েছিলাম 'দেশের আগামীকাল' বলে এক  অধুনালুপ্ত পত্রিকায়। আমার কলকাতানিবাসী বন্ধু সম্বিত বসুকে মুগ্ধতার কথা জানাই, কবি কোথায় থাকেন জানতে চাই। সে উত্তর দেয়, তিনি আমাদের এই ভবনেই থাকেন। আমি ভাবলাম প্রতিবেশী হবেন ভদ্রলোক। খানিক গম্ভীর থেকে সম্বিত উত্তর দেয়, ঘটনাচক্রে ভদ্রলোক আমার বাবা। দুই বন্ধুর অট্টহাসিতে ফেটে পড়া মনে পড়ে। তিনিও করোনায় চলে গেলেন গেলো বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে।

কোনারক যৌবন মন্দির বইটা দুর্ভাগ্যক্রমে পড়েছিলাম কোনারকে ঘুরে আসার পর, প্রাককরোনাকালে প্রয়াত নিজাম ভাইয়ের বাসায়৷ প্রতিক্ষণের এই বিশেষ সাইজের বইগুলোকে বলা হতো লম্বু বই। বাংলাদেশের লেখাপত্র সীমান্তের অন্য পারের বাঙালিদের কাছে পরিচিত করবার ক্ষেত্রে তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ বিষ্ণু দে-কে নিয়ে তাঁর একাধিক কাজ এখন বিষ্ণুচর্চায় আমাদের পাথেয়। সদ্যপ্রয়াত শঙ্খ ঘোষের শেষ দিকের অনুলিখিত গদ্যপ্রবাহের একটি প্রকাশিত হয়েছিলো শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত 'কবিসম্মেলন' পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। দেবেশ রায় চলে যাওয়ার কথা লিখেছিলেন তিনি। আহা সেই দেবেশ যিনি গল্পে উপন্যাসে প্রবন্ধে এক অন্যতর গদ্যবিভূতি নির্মাণ করেছেন। বাঙালি শিক্ষিত অনুসন্ধিৎসু মধ্যবিত্ত পাঠক মাত্রেই বাঘারু চরিত্রের সাথে পরিচিত। বাঘারু এতোই প্রভাবশালী, অনেক সময় তরুণতর কবিও প্রথম কবিতা বইতে বেছে নিতে পারেন এই চরিত্রনাম। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ কেমন করে করছেন শঙ্খ? 

'এখানে কবুল করা দরকার, ব্যক্তিগতভাবে মানবের কাছে আমারও ঋণের কোনো শেষ নেই। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় একটা আলগারকম বামপন্থার ঝোঁক আমাদের অনেকেরই ছিল।  কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষাদীক্ষা থেকে অনেকেই আমরা - অন্তত আমি - মুক্ত হতে পারিনি তখনও।'... আর  মানব প্রায় তখন থেকেই ক্রমাগত আমাদের জানিয়ে যাচ্ছে, শিখিয়ে যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের অস্তিত্বটাকে। আমাদের কারো কারো মনে পড়বে, মানবেন্দ্র প্রকল্পিত ভারতীয় ভাষার গল্পের পাঁচটি খন্ডের কথা কিংবা দেশভাগ নিয়ে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধীতা নিয়ে তাঁর প্রকল্পিত গল্প সংকলনগুলোর কথা। আবারো শঙ্খে ফিরি, 'আজ এই অতিপ্রচারের যুগে যখন লেখকের কোনো নেপথ্যভূমি নেই প্রায় কোথাও, যখন সচিত্র সাময়িকপত্র কিংবা দূরদর্শন কিংবা বইমেলা বা হাতে হাতে মুঠোফোন আর তার ফেসবুক বা ইউটিউব যে-কোনো মুহূর্তে সবকিছু উদ্ঘাটন করে দেখায়, তখন লেখক-পাঠকের সম্পর্কের মধ্যে কোনো রহস্যময়তা থাকে না আর। আমাদের প্রথম যৌবন ছিল সেই অপরিসীম রহস্যময় দূরত্বে রাখা এক সম্পর্ক' - হায়! করোনা আমাদের সেই অপরিসীম রহস্যময় দূরত্ব অনন্ত রহস্যময়তায় বিলীন করে দিলো। 

৪. 
এখন আমরা সাম্প্রতিক এক  প্রতিবেদনে চোখ রাখি৷ দেখি, সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কায় প্রতিদিন অক্সিজেনের সর্বোচ্চ চাহিদা হয়েছিলো ১৫০- ১৬০ টন। আক্রান্ত কিছু কমায় ১৪০-১৫০ টন লাগছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ১০০- ১২০ টন লাগে, তা  দেশের  উৎপাদনেই পাওয়া যায়। তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা দেখছি যারা প্রধানত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করে।

সরকারি হাসপাতালে লিন্ডে বাংলাদেশ নব্বই টন, স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড বিশ থেকে ত্রিশ টন অক্সিজেন দেয়। বেসরকারি হাসপাতালে  অক্সিজেন সরবরাহ করে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড নামে এক প্রতিষ্ঠান। করোনা চিকিৎসার জন্যে রাজধানীতে ঊনিশ আর  দেশের আট বিভাগে আরও চৌষট্টি হাসপাতাল বাছাই করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

সেসব নির্ধারিত হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে তিন হাজার একশোটি, প্রয়োজন আরো তিন হাজার পয়তাল্লিশটি। অক্সিজেন মাস্ক, ফ্লোমিটার, চাবি, ট্রলি ইত্যাদি আনুষাঙ্গিক আছে দুই হাজার সাতশো ঊনচল্লিশ সেট, দরকার আরো তিন হাজার একশো ঊননব্বই সেট। একুশে এপ্রিল আমদানি বন্ধের পূর্ব পর্যন্ত বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে পাঁচশো মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন আমদানি হয়েছিলো চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। 

বাতাসে প্রচুর অক্সিজেন আছে। বৃক্ষরাজি আমাদের অক্সিজেন দেয়। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুন্দরবন রক্ষার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, দেশের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ বনাঞ্চল আমাদের সুরক্ষিত রাখতে হবে কিন্তু আমরা তাঁর কথা শুনিনি। অতি সম্প্রতি রেস্টুরেন্ট নির্মাণের জন্যে গাছ কাটা হচ্ছে। গাছ অক্সিজেন ভাণ্ডার, সেই গাছ কেটে ফেলা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবেশ বিপর্যয়ের চরম রূপটি দেখতে বাধ্য৷ আমরা তার নমুনা দেখছি কিন্তু নিয়মিত৷ 

অসহ্য গরম, নিয়মে বৃষ্টিপাত না হওয়া৷ অক্সিজেন প্ল্যান্ট প্রকৃতির অক্সিজেন আলাদা করে বোতলজাত করে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের দরকার জেলায় জেলায় একাধিক সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহযুক্ত হাসপাতাল যাতে পর্যাপ্ত আইসোলেশন বেড আছে, আই  সি ইউ আছে। পাশের দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যে পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে, এমনকি তারা অন্যান্য রাজ্যে অক্সিজেন পাঠাচ্ছে। কেরালা রাজ্য সরকার শুরু থেকেই জনস্বাস্থ্যকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ায় তারা সফল। তারা প্রমাণ করেছে সফল করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অসম্ভব কিছু নয়। সদিচ্ছা দরকার এর জন্যে, জনবান্ধব সরকার তার নাগরিকের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারে।

আমাদের দেশে চিকিৎসকরা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। তাদের জন্যে পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রীর ঘাটতি সবসময়েই ছিলো। তবু অপ্রতুল অস্ত্র নিয়েই তারা এই অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তবে দু একটি 'ঘটনা'-ও ঘটছে। যেমন, একজন ভুক্তভোগীর বন্ধু মারফত জেনেছি, বিশেষ এক হাসপাতালের আইসিইউ কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করেন৷ ভুক্তভোগী মেয়েটি তার বাবার জন্যে কোথাও আইসিইউ না পেয়ে ঐ হাসপাতালে যান ও ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরে ত্রিশ হাজার টাকায় আইসিইউ বেড কেনেন কিন্তু আরো বেশি টাকার জন্য ঐ ডাক্তার আরেকজনকে বেডটি দিয়ে দেয়। এই সময়ের মধ্যে ভুল চিকিৎসায় মেয়েটির বাবা মারা যান। আমাদের কারো কারো আপাদমস্তক লোভ, দুর্নীতিসর্বস্ব মন এমন এক অসামান্য পেশার সবাইকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

আইসিইউ

পাশের দেশে, রেড ভলান্টিয়ার্স নামে এক সংগঠন সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা মানুষের বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ঔষধ আর খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। যেমন আমাদের দেশে বিদ্যানন্দ অনেকদিন ধরেই বিপন্ন মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিদ্যানন্দের কর্মীদল দিনের পর দিন নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে নিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

শেষ করবার আগে, একটা সুসংবাদ দিয়ে শেষ করি। বুয়েটের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডক্টর তওফিক হাসান এবং তার টিম তৈরি করেছেন 'অক্সিজেট' নামে এক যন্ত্র। এটি সাধারণ বেডের পনেরো লিটার অক্সিজেন ফ্লোর সাথে যুক্ত করলে ষাট লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারে৷ এটি বিদ্যুৎ ছাড়াই চলে। বানাতেও খুব বেশি পয়সা লাগে না। দুটি ট্রায়ালের পর তৃতীয় ট্রায়াল চলছে। বেশ ভালো তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে। যদি দুর্নীতিমুক্ত, জনগণবান্ধব থেকে অক্সিজেটের বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশের করোনা চিকিৎসায় আইসিইউর ভয়াবহ সংকট থেকে হয়তো আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। বিশুদ্ধ বাতাসের জন্যে ফুসফুসের প্রাণান্ত আন্দোলন প্রশমনের ক্ষেত্রে অক্সিজেট ভালো ফল বয়ে আনুক। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.