পেঁয়াজের অতীতগাথা
When the Devil's left foot touched soil outside the Garden of
Eden, garlic sprang up, and his right gave rise to onions.
-আরব প্রবাদ
১.
মধ্য এশিয়ার পর্বতমালা থেকেই পেঁয়াজ এবং এ জাতীয় অন্যান্য উদ্ভিদ দ্রুত প্রাচীন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। উৎপাদন এবং গুদামজাতের কাজটা সহজ ছিল বলে বহু সভ্যতায় এগুলো রোজকার খাবার হিসাবে জায়গা করে নেয়।
পেঁয়াজ এবং সভ্যতার কাহিনীর শুরু দজলা ও ফোরাত নদীর মাঝের সভ্যতার সুতিকাগার হিসাবে পরিচিত প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া অঞ্চলে। আক্কাদীয়, ব্যাবিলোনীয় এবং আসিরীয় রাজ্যের অবস্থান ছিল এখানেই। বিশ্বের এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকাল উত্তপ্ত থাকায় এবং বছরের বেশির ভাগ সময় বৃষ্টিপাত বিরল হওয়ায় এ দুটি নদীর জমে ওঠা পলিমাটির সুবাদে মাটি অত্যন্ত উর্বর। কৃষির বিকাশ ঘটার সাথে তাল মিলিয়ে এই তথাকথিত ফার্টাইল ক্রিসেন্ট শস্য, গবাদিপশু, খেজুর, ফলফলাদি এবং সব্জির বিশাল ভান্ডারে পরিণত হয়।
প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার খাদ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা যতদূর জানি তার বেশিরভাগই খাবার কি আসছে আর কি যাচ্ছে তার বয়ান ধরে রেখে পণ্য হিসাবে উল্লেখ করেছে। কুনিফর্ম ফলকগুলো বিক্রি, চালান এবং গুদামজাত যোগ্য শস্য জাতীয় পণ্যের তথ্য যোগায়। প্রায়ই বাণিজ্যের চেয়ে বরং ব্যবহারের লক্ষ্যে বাড়িতে উৎপাদন করার কারণে টাটকা সব্জির উল্লেখ কম। এ কারণে সবসময় রিসিট বা সাংসারিক হিসাবে এগুলো উল্লেখ দেখা যায় না। তবে প্রাচীন কিছু রেসিপির অমূল্য নথি উদ্ধার হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ শতকের ইয়েল ব্যাবিলন ট্যাবলেট নামে পরিচিত তিনটি কুনিফর্ম ফলক প্রাচীন মোসোপোটেমিয়ার প্রায় চল্লিশটি রেসিপির উল্লেখ করেছে। এইসব রেসিপিতে সামিদু, সুবুতিন্নু এবং আন্দাবসুর জাতীয় রহস্যময় সজ্বির মতো পেঁয়াজ, পলাণ্ডু এবং রসুনও প্রবলভাবে হাজির রয়েছে। এগুলো আসলে কি ছিল ঠিক না জানলেও সম্ভবত পেঁয়াজ পরিবারেরই সদস্য হয়ে থাকবে। ইতিহাসবিদ জাঁ বোত্তেরো উল্লেখ করছেন:
'মনে হতে পারে যে এইসব গাছে প্রাচীন খাবারগুলো বাড়তি স্বাদের সুবাদে সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিল। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় এগুলোর উল্লেখ করা হতো(রসুন এবং পলাণ্ডু একসাথে),...এইসব বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'অলৌকিক,' বা 'জাদুকরী' বা ধর্মীয় প্রভাবে বিশ্বাস থাকার জোরালো প্রমাণ নেই: সন্দেহ নেই মূলত স্বাদের ব্যাপার ছিল এটা।'
প্রথম ফলকে স্যূপের ২৫টি, গোশত জাতীয় খাবারের ২১ টি এবং সব্জি জাতীয় খাবারের ৪ টি রেসিপি রয়েছে। সবগুলোতেই কোনও না কোনও ধরনের পেঁয়াজ রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগেই রসুন আর পলাণ্ডু বেঁটে এক ধরনের ব্রথে সুবাসিত করার কাজে লাগানো হতো। পরে তাতে গোশত বা সব্জি রান্না করা হতো, ঠিক আমরা যেভাবে আজকের দিনে কাটা পেঁয়াজ এবং রসুন নরম করে গোশত এবং স্যুপ মেশাই।
খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে রোমান ইতিহাসবিদ হোরোডটাস জানাচ্ছেন, মিশরের দরিদ্রতর শ্রেণীর লোকেরা দুপুরের খাবারে রুটি, কাঁচা পেঁয়াজ এবং বিয়ার খেতো। কার্নাকের আতেন মন্দির প্রাচীরে (শসা ছাড়াও) এই খাবার গ্রহণরত একজন শ্রমিকের ছবি আঁকা হয়েছে। হোরোডটাস তাঁর হিস্ট্রি-তে গিযার গ্রেট পিরামিড হিসাবে পরিচিত চিওপসের পিরামিডের গায়ে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫৫০ সালের দিকে পিরামিড নির্মাণের সময় শ্রমিকদের জন্যে ঢেঁড়শ, পেঁয়াজ এবং পলাণ্ডুর পেছনে ব্যয়িত টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা একটি খোদাই কর্মের কথাও বলেছেন: রূপার ১,৬০০ ট্যালেন্ট। এক মিশরীয় ট্যালেন্ট প্রায় ২৭ কেজির (৬০ পাউন্ড) সমান ছিল। তার মানে ৪৩,২০০ কেজির এক বিশাল পরিমাণ, আজকের দিনে আপনাকে প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলারের মালিক বানিয়ে দেবে। মিশরীয় ভাষায় পলাণ্ডুর প্রতিশব্দ সকল সব্জির বেলায়ও ব্যবহার করা হতো। এ থেকে সবুজ এই সব্জিটি কতটা সর্বগামী হয়ে উঠেছিল বোঝা যায়। ইতিহাসবিদ জন পি. আলকক মিশরীয় টেক্সটে পেঁয়াজকে 'সুন্দর শাদা দাঁত' বোঝাতে ব্যবহার করা হতো বলে উল্লেখ করেছেন। অনুমানযোগ্যভাবেই এগুলো আজকের দিনে আমাদের চেনা আপেল আকৃতির কন্দ নয়, বরং ছোট আকারের এবং শাদা ছিল।
মিশরে পেঁয়াজের অন্য অর্থও ছিল: মিশরীয়রা স্বর্গ, নরক এবং পৃথিবীর সাথে সমকেন্দ্রিক বৃত্তের আকারে বিশ্বজগত সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্বাস করত, তাই অসংখ্য পল্লার পেঁয়াজ একে প্রতিকায়িত করে মনে করা হতো। পেঁয়াজ কাটার সময় চাঁদের আকৃতি পায় ভেবে একে প্রকৃতির পৃষ্ঠপোষক দেবী আইসিসের নামে উৎসর্গ করা হতো। রোমান ইতিহাসবিদ প্লিনি দ্য এল্ডার তার ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে মিশরীয়দের পেঁয়াজ ও রসুনকে অনেকটা রাজার প্রতীকের মতো ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেছেন। মনে করা হয়ে যে, শপথ নেওয়ার সময় রাজার ডান হাতে পেঁয়াজ ধরা থাকতো। তবে মিশরীয় কোনও প্রতিবেদনে এই রীতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি। সুতরাং প্লিনি হয়তো স্রেফ বিদেশীদের পরিহাসের লক্ষ্যে চালু গুজব পুনরাবৃত্তি করছিলেন। অবশ্য, বিভিন্ন সমাধি এবং মমির আস্তরণের পেঁয়াজ পাওয়া গেছে। প্রায়ই মমির বগলতলায় বা কুঁচকিতে দেওয়া হতো এগুলো। পেঁয়াজের ব্যাক্টেরিয়া প্রতিরোধের ক্ষমতায় বিশ্বাস কিংবা দুর্গন্ধ চাপা দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকতে পারে। পুরুতরা এসব খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।
বাইবেল এবং হিব্রু তোরাহরতে ইসারাইলিদের পয়গম্বর মূসার নেতৃত্বে প্রতিশ্রুত ভূমির খোঁজে মিশর ছাড়ার কাহিনির উল্লেখ আছে। চলার পথে 'মিশরে বিনে পয়সায় খাওয়া মাছ -- এবং শশা, তরমুজ, পেঁয়াজ এবং রসুন'-এর জন্যে আফসোস করছিল তারা। এসব সুস্বাদু, টাটকা খাবার মরুভূমিতে মিলবে না, বা চলার উপর থাকা জাতির পক্ষে উৎপাদন সম্ভব নয়।
২.
গ্রিক ও রোমানরা পেঁয়াজের দারুণ ভক্ত ছিল। নেচারাল হিস্ট্রি-তে প্লিনি দ্য এল্ডার গ্রিকদের কাছে পেঁয়াজের সহজলভ্য বিভিন্ন জাতের কথা বলছেন:
গ্রিকদের কাছে পেঁয়াজের নানা জাত ছিল: সার্দিনীয় পেঁয়াজ, আলসিদেনীয়, সেতানীয়, শিস্তানীয় এবং জুদিয়ার শহর আস্কালনের নামানুসারে আস্কালোনীয় (শালোত)। সবগুলোরই এক ধরনের ঝাঁঝাল গন্ধ রয়েছে, বিশেষ করে সাইপ্রেসের জাত চোখ থেকে পানি ঝরায়; সিনোদের জাতের কম ঝাঁঝ।
শাদার চেয়ে গোলাকার পেঁয়াজ বেশি সুবাসিত হওয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
মহাকবি হোমার ইলিয়াডে আর্সিনুসের বন্দী কন্যা হেকামিদের রাজা নেস্টরকে খাবারের সাথে পামানীয় মদের আরক পরিবেশন করার কথা বলেছেন: 'প্রথমে সায়ানাসের পায়াঅলা চমৎকার পলিশ করা টোয়াইনের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। একটা তামার ঝুড়ি রাখলেন সেখানে। ওটার সাথে একটা পেঁয়াজ, পানীয়র জন্যে সুবাস, ফিকে মধু এবং পবিত্র বার্লি গুড়ো খাবার।' অনেকটা আমরা যেভাবে জলপাই খাই, প্রায়ই পানীয়র সাথে পেঁয়াজ খাওয়া হতো। তবে লড়াইয়ে নামার আগে চাঙা করে তুলতেও এসব পরিবেশন করা হয়ে থাকতে পারে। ইলিয়াডের মোটামুটি ৪০০ বছর পর আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০ সালে যেনোফোনের সিম্পোজিয়ামে কিঞ্চিৎ রসিকতার ছলে দুই ধরনের রীতির কথাই বলেছেন সক্রেটিস:
'ভদ্রমহোদয়গণ,' বললেন শারমিদস, 'নিসেরেতাসকে কেউ চুমু খায়নি স্ত্রীকে এটা বিশ্বাস করাতে সে মুখে পেঁয়াজের গন্ধ নিয়ে ঘরে ফিরতে চাইছে।'
'নিঃসন্দেহে,' বললেন সক্রেটিস। 'কিন্তু তাতে ভিন্ন ধরনের বদনামের ভাগীদার হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে... কেবল খাবার নয় পানীয়কেও উপভোগ্য করায় পেঁয়াজকে সত্যিকার অর্থে সুবাস ভাবা হলেও শুধু খাবারের সাথে নয়, পরেও এটা খেলে চলে, তাই কেউ যেন বলে না যে সেলিয়াসের বাড়িতে বেড়াতে না খেয়ে স্রেফ ক্ষিদেই বাড়িয়েছি আমরা।'
'ঈশ্বর রক্ষা করুন, সক্রেটিস!' জবাব এলো। 'মানছি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেঁয়াজে কামড় বসানোই ভালো, অনেকে যেমন লড়াকু মোরগ রিংয়ে নামানোর আগে রসুন খাওয়ায়। অবশ্য এখানে আমাদের পরিকল্পনা যুদ্ধের চেয়ে বরং কারও চুমু খাওয়ার বিষয় গোপন করার জন্যেই নিতে হচ্ছে।'
প্লেটোর বর্ণনায় সক্রেটিসের ভয়াল এবং কঠোর প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের ভূট্টা, বার্লি এবং গম খাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে। এই সংলাপে সক্রেটিসকে লক্ষণীয়ভাবে কিছুটা বিদুষকের মতো তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু তাকে সোফা, কেক, এবং সৌরভের মতো বিলাসিতার ব্যাপারে কঠোর মনে হলেও এবং সঙ্গীত এবং কবিতাকে তিনি নিশ্চিতভাবে অপরাধ ভাবলেও জনগণের খাবার কেবল নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারে সীমাবদ্ধ নয়: 'অবশ্যই সুবাস পাবে ওরা -- লবন এবং জলপাই, পনির এবং পেঁয়াজ। প্রাচীন গ্রিসে পেঁয়াজকে স্পষ্টই স্বাদু ভাবা হতো, তবে সেভাবে মন্দ ভাবা হতো না। সবার কাছে এই জিনিস ছিল। অষ্টম শতকের শেষদিকে রচিত অডিসিতে হোমারের আরও কাব্যিক ব্যবহারের বিষয় হয়েছে পেঁয়াজ। নায়ক অডিসিয়াসের উর্দির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, 'শুকনো পেঁয়াজের ছিলকার মতো ঝকমক করছে, এতটাই কোমল সেটা।'
রোমানরা পেঁয়াজ পছন্দ করতো এবং বিভিন্ন খাবারে গন্ধ যোগানোর জন্যে ব্যবহারের পাশপাশি সফরের সময় উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। কেপা পেঁয়াজের লাতিন প্রতিশব্দ হলেও, রোমানরা একে বলত ইউনিওনেম (এ থেকেই আমাদের আধুনিক অনিয়িন শব্দটি এসেছে) এবং বুলবাস। প্রথম শতকে কৃষকে পরিণত হওয়া কলিউমেলা নামের জনৈক রোমান সৈনিক পেঁয়াজের আঁচারের রেসিপি দিচ্ছেন:
প্রথমে রোদে পেঁয়াজ শুকিয়ে নিন, তারপর ছায়ায় রেখে ঠাণ্ডা করুন। এবার সুগন্ধি গুল্ম বা মার্জোরামের উপর বিছিয়ে দিন। এরপর তিনভাগের এক ভাগ সিরকা এবং এক ভাগ লবন জল মেশানো তরল ঢেলে উপরে এক গোছা মার্জোরাম দিন।...সমস্ত তরল শুষে নেওয়ার পর পাত্রটি আবার একই রকম তরলে ভরে দিন।
চার বা পাঁচ শতকের দিকে বিখ্যাত ভোজন রসিক মার্কাস গাবিয়াস এপিকাসের নামে রচিত রোমান রেসিপির সঙ্কলনে পেঁয়াজ, রসুনের ছড়াছড়ি। এগুলো সালাদে মচমচে ভাব এবং সসে সুবাস যোগ করে, মাছের মসলা তৈরি করে অথবা স্ট্যু হিসাবে রান্না এবং খাওয়া হয়।
আরেকটি রোমানরা রেসিপি, পেঁয়াজ দিয়ে মাছের তরকারি
যেকোনও ধরনের মাছ পরিষ্কার করে কাটা শুকনো অ্যাস্কোলোনীয় পেয়াঁজ (শালোত) অথবা অন্য যেকোনও পেঁয়াজঅলা সসপ্যানে রাখুন। মাছ যেন উপরে থাকে। তাতে সুবাস এবং তেল দিয়ে রাঁধুন। রান্না শেষ হলে মাঝখানে ঝলসানো শুয়োরের গোশত দিন। খাবারের সাথে সিরকা মিশিয়ে কুচিকুচি করে কাটা পেঁয়াজ যোগ করুন।
রোমান ও গ্রিকদের বেলায় এলিয়াম পরিবারের সত্যিকারের তারকা পেঁয়াজেই। এটা এতটাই প্রিয় ছিল যে গ্রিক এবং লাতিন দুই ভাষাতেই এর নাম রাখা হয়েছিল প্রাসিনোস, প্রাসিনাস বা সবুজ। অনেক সময় একে বলা হতো 'সবুজ পলাণ্ডু। ফ্যাকাশে সবুজ বা ক্লোরোন থেকে একেবারেই ভিন্ন। এক ধরনের সবুজ কোয়ার্টয 'ক্রিসোপ্রাসে', এর অর্থ 'পলান্ডুর রসের রঙ'। রোমানরা অন্যান্য দেশ দখল করার সময় পেঁয়াজ তাদের সাথী হয়েছিল, তাদের পক্ষে এত স্বাদু জিনিস ফেলে যাওয়ার উপায় ছিল না। যেকোনও নতুন দেশে থিতু হওয়ার জন্যে পেঁয়াজ কেয়ারি তৈরি ছিল অবশ্য কর্তব্যের মতো। ফ্রান্স, ব্রিটেন, এবং জার্মানিতে বিভিন্ন রোমান প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পেঁয়াজের বীজ পাওয়া গেছে।
এপিসিয়াস পানি ও তেলের মিশেলে পেঁয়াজ সেদ্ধ করে তেলে ভাজার পরামর্শ দিচ্ছেন, তাহলেই 'সেরা স্ট্যু তৈরি হয়ে যাবে'। অন্যান্য সব্জি রান্নার রেসিপিতেও পেঁয়াজের উল্লেখ রয়েছে। তার ভেতর একটা আবার কোষ্ঠকাঠিণ্য দূর করার জন্যে।
পেঁয়াজ কণ্ঠস্বরকে আরও ভরাট করে বলে ধারণা ছিল। সম্রাট নিরো (৩৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ) তাই পোরোফ্যাগাস বা পেঁয়াজখেকো নামে পরিচিত ছিলেন। হয়তো পেঁয়াজের প্রতি সত্যি তার দুর্বলতা ছিল, তবে প্রতি মাসে দুই দিন অন্তত পেঁয়াজ ছাড়া আর কিছুই না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের কণ্ঠস্বর বা সুর ঠিক করার চেষ্টা সম্পর্কে যে কথা চালু ছিল, তা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্লিনি দ্য এল্ডার ক্ষীণ দৃষ্টি, কুকুরের কামড়, নিদ্রাহীনতা, যৌন রোগ, দাঁত ব্যথা, পেটের পীড়া এবং লাম্বাগোর মতো অন্তত শ খানেক স্বাস্থ্য সমস্যার নিরাময়ের কথা প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করেছেন।
৩.
কনফুসীয় টেক্সট ক্লাসিক অভ রাইটস (লি জি, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সাল) বিয়ে, বিসর্জন, শোকাচার এবং ভোজ উৎসবের মতো জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত পর্বের বর্ণনা দিয়েছে। এইসব অনুষ্ঠান সঠিক ও যথাযথভাবে আয়োজনের সযত্ন নির্দেশনার পাশাপাশি সমাজের পণ্ডিত এবং অন্যান্য সদস্যের আচরণ সম্পর্কিত পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। এই টেক্সটেই আমরা এলিয়াম বা পেঁয়াজের আজকের চীনের খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে পাই। কনফুসীয় টেক্সট ক্লাসিক অভ রাইটস একটি ভোজ আয়োজনের বর্ণনা দিচ্ছে:
আপ্যায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন খাবার আনার বিধান এইরকম: হাড়ের উপর রান্না করা গোশত বামে রাখা হবে। টুকরো করা গোশত থাকবে ডানে। মাদুরের উপর বিভিন্ন দলের বামে ভাত রাখতে হবে। স্যুপ থাকবে তাদের ডানে। কিমা ও ঝলসানো গোশত থাকবে (কোপানো ও টুকরো করা গোশতের) বাইরের দিকে, এবং আচার ও সস থাকবে ভেতরে। পেঁয়াজ, সেদ্ধ পেঁয়াজ থাকবে এগুলোর পর। এবং পানীয় ও সিরাপ থাকবে ডানে।
টেক্সট নানা বিসর্জনে পেঁয়াজ ব্যবহারের বর্ণনা দিয়েছে। পেঁয়াজ টুকরো করে তেলের সাথে মেশানোর পর প্রসাদ হিসাবে অর্পণের আগে তাতে গোশতের টুকরো সংরক্ষণ করা হয়। এই টেক্সট মৌসুমী খাবার এবং বিভিন্ন ধরনের গোশত রান্নায় বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজ ব্যবহারের রীতিরও বর্ণনা দিয়েছে।
স্পষ্টতই পেঁয়াজ এই সময় চীনা খাবারের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য চার শতকের তাওবাদীরা 'প্রবল গন্ধঅলা পাঁচটি সব্জির' ব্যবহার নিষিদ্ধ করে, তাতে পেঁয়াজও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিশেষ করে ফুসফুসের পক্ষে ক্ষতিকর এবং আগ্রাসী স্বভাব এবং যৌন ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় বলে বৌদ্ধরা এখনও পেঁয়াজ বা রসুন খায় না। হান রাজবংশের (২০৬- ২২০ খ্রিস্টাব্দ) আমলে পোকামকড় তাড়াতে পেঁয়াজ এবং রসুন লাল ফিতেয় বেঁধে দরজায় ঝুলিয়ে রাখা হতো।
সূত্র: ওনিয়ন অ্যান্ড গারলিক: গ্লোবাল হিস্ট্রি