নৈঃশব্দ্যের সংলাপ: লেখকদের সৃষ্টি রহস্যের একান্তকথা

ইজেল

16 January, 2021, 10:00 am
Last modified: 16 January, 2021, 12:02 pm
সাধারণভাবে বলতে গেলে, স্মৃতিই হচ্ছে সেই বিশেষ বিন্দু, যা থেকে আমার লেখাটির যাত্রা শুরু হয়। আমার স্থির বিশ্বাস এপর্যন্ত যতগুলো গল্প আমি লিখেছি সবগুলোই এমন সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে, যে-অভিজ্ঞতাগুলো আমার স্মৃতিতে চিরন্তন, লেখায় এইসব স্মৃতি এক-একটি ছবি হয়ে ওঠে।

লেখকদের এমন কিছু কথা থাকে যা পাঠককে করে অভিভূত, ঘোরগ্রস্থ। আত্মকথা দিয়ে লেখক এক সংযোগ তৈরি করে নেন তার পাঠকের সঙ্গে, জন্ম নেয় নৈঃশব্দ্যের জ্যোতির্ময় সংলাপ, সংলাপ থেকে দ্বিরালাপ; এভাবে অবিরাম লেখকজীবন ভাঙে, গড়ে। লেখকজীবনের রহস্যকথাকে পাঠক তাই সানন্দে গ্রহণ করেন। কথায় কথায় পাঠকের সঙ্গে লেখকের এই যে আলাপ, এই যে অদৃশ্য সংযোগ, সেখানে দীর্ঘ লেখক-জীবনের অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞাকথাই তো প্রকাশ পায় শব্দ ও বাক্যের সুগন্ধে। এই যে এক অদ্ভুত সংযোগ, এই সংযোগে ভর করে কখনও ভাষার সীমানা পেরিয়ে আমরা, পাঠকরা ক্রমাগত প্রিয় লেখকদের কাছে পৌঁছাই। লেখকদের সৃষ্টিরহস্যের একান্তকথায় আমাদের পাঠ পূর্ণ হয়- কবি মণীন্দ্র গুপ্তের 'অক্ষয় মালবেরি'র প্রতিটি শব্দ যেমন আমাদের আত্মায় গেঁথে যায়! এখানে, বিশ্বখ্যাত এমন কয়েকজন লেখকের একান্তকথা অনূদিত হল, তা পাঠককে যেমন মুগ্ধ করবে তেমনি লেখকদেরকেও দেবে ধ্যানের মন্ত্র, লিখতেও প্রেরণা জোগাবে। 

হারুকি মুরাকামি

বিশ্বখ্যাত জাপানি ঔপন্যাসিক

আপনি যদি তীব্রভাবে জীবনের আটপৌরে দিনগুলিকে যাপন করেন, তাহলে আপনার কল্পনাশক্তিও তীব্র হবে। কল্পনার যে-শক্তি আমরা আমাদের জীবনে বহন করে চলি, সেই শক্তিটুকু কার্যকর থাকবে। তাই আমি প্রতিদিন ভোরে জেগে উঠি, প্রতিটি দিন, তারপর আমি আমার লেখার টেবিলে বসে পড়ি, লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। লেখাকে মনে করুন অন্ধকার কক্ষে যাওয়ার মতো কিছু। আমি সেই অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করলাম, কক্ষের দরোজাটি খুলে ফেললাম, সেখানে কেবল অন্ধকার, আর অন্ধকার। বিপুল সে অন্ধকারে অবশ্যই কিছু দেখলাম আমি, কোনো কিছু স্পর্শও করলাম, তারপর ফিরে এলাম আলোয়, পৃথিবীতে, ফিরে লেখার টেবিলে বসে পড়লাম।

এমন অনেকেই আছেন, যারা অন্যের কোনো কথাই মন দিয়ে শোনেন না। অন্যদের কোনো কথাই আমরা মন দিয়ে শুনি না, মনে করি তারা বিরক্তিকর, কিন্তু আমরা যদি কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনতাম, বুঝতে পারতাম গল্পগুলো কত আকর্ষণীয়।

হারুকি মুরাকামি

আমার আরাধ্য লেখক দস্তয়েভ্‌স্কি। অধিকাংশ লেখক বয়সের ভারে ভেঙে পড়েন, লিখতে পারেন না, কিন্তু দস্তয়েভ্‌স্কি ভেঙে-পড়া লেখক ছিলেন না। বয়সের সঙ্গে তিনি বেড়েছেন, আরও উঁচু হয়েছেন, মহান কথাকারে পরিণত হয়েছেন; ৬০-এর কাছাকাছি পৌঁছে লিখেছেন 'ব্রাদার্স কারামাজভ'। উপন্যাসটি অসাধারণ এবং মহৎ।

একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করলে, শেষ হতে হতে আমার এক থেকে দু-বছর সময় লেগে যায়। এই সময়টায় আমি দিনের পর দিন লিখি, লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি... স্বাস্থ্যকর বাতাসের তৃষ্ণায় তখন ঘরের জানালাগুলো খুলে দিই। তারপর গল্পের আরও একটি লাইন লিখি, আনন্দের জন্য। তখন মনে হয় পাঠকরাও ঠিক আমার মতো এই জায়গাটা পড়লে আনন্দ পাবেন। আমি উত্তম পুরুষেই লিখি, আর তাই আমাকে গল্পের স্টোরিলাইনের জন্য (প্লট, ন্যারেটিভ) কিছু জিনিসের দরকার হয়—অক্ষর, অথবা কারও জীবনের গল্প। যখন লিখতে শুরু করি, লেখা শুরুর মুহূর্তে কোনো ধারণাই থাকে না ঠিক 'কোথায় যাচ্ছি, সামনে কী আছে' সে সম্পর্কে। জানি না কখন কী হবে! যেমন, 'দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল' লিখতে শুরু করে যে-অভিজ্ঞতা হল, তা বিস্ময়কর। লিখতে বসে প্রথমেই আমি পাখির ডাক শুনতে পেয়েছিলাম, কারণ আমার ঘরের পেছনের উঠোনে সত্যিকারের পাখিটি ডাকছিল। মনে হয়েছিল, এই প্রথমবার আমি এধরনের শব্দ শুনতে পেলাম, আগে আর কখনও এমন শুনিনি। আমি অনুভব করলাম, পাখিটি কিছু একটা বলছে, হয়তো কোনো ভবিষ্যতবাণী করছে! তখন আমি এই বিষয়টিকেই লিখতে চাইলাম। তারপর আসুন, স্প্যাগেটি রান্না প্রসঙ্গে। এখন যা যা ঘটবে তার সঙ্গে আমি জড়িয়ে যাব। তখন স্প্যাগেটি রান্না করছিলাম, হঠাৎ কেউ আমাকে ডাক দিয়েছিল, নাম ধরেই ডেকেছিল। আমিও উপন্যাসের শুরুতে এই দুটি ঘটনা নিয়ে এসেছি। বইটি আমি দু-বছর ধরে লিখেছিলাম। পুরো সময়টা আমার জন্য একটা মজার খেলার মতো ছিল—আমি জানতাম না এরপর কী ঘটবে, তারও পর কী ঘটছে! এভাবে দিনের পর দিন কী এক উত্তেজনা! প্রতিদিন নতুন বিস্ময়। নতুন কিছুর মুখোমুখি। ঘুম থেকে উঠলাম, লেখার টেবিলে গেলাম, কম্পিউটারে স্যুইচ অন করলাম ইত্যাদি সবই ছিল সেই অদ্ভুত উত্তেজনাপূর্ণ খেলার এক-একটি টুকরো, আর নিজেকে অবিরাম বলা—আজ কী ঘটতে চলেছে? আমার কল্পনাশক্তি বিশেষ এক ধরনের প্রাণির মতো। আমি যা কিছু ভাবি, আমার 'কল্পনা' তার সবই জীবন্ত করে রাখে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে আছি সেই কুয়োর কথা ভেবে, এবং সেই হাতি, সেই রেফ্রিজারেটর, বিড়াল, কাপড় ইস্ত্রি... সব... আমি আর কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারব না।

লেখার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। আমি যখন উপন্যাসটি লিখতে থাকি, তখন আমার এমন কিছুর দরকার হয় যেখানে সুর আছে। তখন গান যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমার কাছে আসে। গান থেকে আমি বহুকিছু গ্রহণ করি, শিখি—সংগতি, ঐকতান, তাল, লয়, টঙ্কার ইত্যাদি। ছন্দময়তা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসে নিয়মিত প্রবাহের ব্যাপারটা এখান থেকে বুঝেছি। পাঠককে ধরে রাখতে হলে সংগীতের মতো লেখাতেও তাল, লয় থাকতে হয়। সাধারণত আমি তখনই গান শুনি, যখন লিখতে বসি। আর আমার বইয়ের ভেতরে সংগীতের যে টঙ্কারটা থাকে, ঐকতান থাকে তা কিন্তু এভাবেই আসে। লিখতে গেলেই আমার সংগীতের দরকার হয়। 

লেখালেখির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক আত্মবিশ্বাস। গল্পটি বলার শক্তি, জলের বুকে তীব্র আলোড়ন আর পাজলের এলোমেলো টুকরোগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে দেবার তীক্ষ্ণতা আপনার থাকতে হবে। এই আস্থা ছাড়া আপনি এক লাইনও এগোতে পারবেন না। লেখালেখি ব্যাপারটা মুষ্টিযুদ্ধের মতো। একবার যদি রিঙের মধ্যে ঢুকে পড়েন, তাহলে আর ফিরতে পারবেন না, ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে লড়ে যেতে হবে।

ওরহান পামুক
তুরস্কের নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক

সত্যিকার অর্থে শ্রেষ্ঠ বই বলতে সবসময়ই আমি উপন্যাসকে বুঝি, 'আনা কারেনিনা', 'দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ', 'দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন' এইসব... আর এখন ফেরদৌসি-র 'শাহনামা'; জীবনের বিভিন্ন সময়পর্বে আমি এই বইগুলোকে উলটেপালটে দেখে বারবার উপলব্ধি করতে চেয়েছি—মহৎ সাহিত্যকর্ম কীভাবে আমাদের অন্তর্গত রক্তে খেলা করে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গেলেও আমাকে বইগুলো বারবার পড়তে হয়।  

যেভাবে ভালো উপন্যাসগুলো আমাদেরকে বেঁচে থাকার আনন্দ দেয়, তেমনি নিকৃষ্ট উপন্যাস কেমন জানি বিষাদগ্রস্ত করে ফেলে আর সেই বিষাদজনিত অনুভূতিটি প্রকট হয়ে ওঠে ঠিক যে পৃষ্ঠাটিতে গিয়ে পড়াটা থেমে যায়, সেখান থেকে। জীবনটা ছোটো, তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি প্রত্যেকের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত।

ওরহান পামুক

    
যে-আমি লেখক হয়ে 'ইস্তানবুল' নামক স্মৃতিকথা এবং 'দ্য ইনোসেন্স অব অবজেক্টস' বইটি লিখেছি, সেই আমিই তো একদিন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলাম! ২৩ বছর বয়সে মাথার ভেতরের একটি রহস্যময় প্যাঁচ শিথিল হয়ে গিয়েছিল, তখন ছবি আঁকবার চিন্তা বাদ দিয়ে রাতের ইস্তানবুল দেখতে দেখতে ঘরে এসেই উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু রঙের কাজ আমি এখনও ছাড়িনি। যখন কিছু আঁকতে যাই নিজেকে তখনই খুব সুখী ভাবতে পারি। যখন লিখতে বসি তখন আমি যেন পুরো পৃথিবীর সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি! হ্যাঁ, চিত্রকলা আর সাহিত্য হচ্ছে শিল্পের দুই বোন। উপন্যাস আমাদের কাছে মৌখিক (দস্তইয়েভস্কি) এবং দৃষ্টিনির্ভর (প্রুস্ত, নবোকভ) কল্পনাশক্তিকে বিশিষ্ট করে তুলে ধরে। দস্তইয়েভস্কির উপন্যাসগুলোয় বহু অবিস্মরণীয় দৃশ্য আছে, হ্যাঁ, দৃশ্যগুলোকে হয়তো ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিন্তু সেসব দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড, ল্যান্ডস্কেপ কিংবা অবজেক্ট-কে আমরা খুব কমই মনে রাখার চেষ্টা করি। একজন পাঠক মাঝে মাঝেই তার পড়তে থাকা উপন্যাসটি বন্ধ করে ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, এই তাকানোর মানে হচ্ছে তিনি তখন বাক্যে বাক্যে, অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে লেখক যে-ছবিগুলো এঁকেছেন, যে-দৃশ্যগুলো তৈরি করেছেন তিনি সেগুলো দেখতে পাচ্ছেন।

হুলিও কোর্তাসার
প্রখ্যাত লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক

গল্প বা উপন্যাস শুরু হয়ে যেতে পারে যে-কোনো একটি জায়গা থেকে। যখনই আমি লেখাটা লিখতে শুরু করলাম, তখন, গল্পটা দীর্ঘ সময় ধরে আমার ভিতরে পাক খেতে শুরু করে, দীর্ঘ সময় ধরে একটা ঘূর্ণন আমার ভেতর সেই গল্পের; মাঝে মাঝে পুরো সপ্তাহ কেটে যায় এই ঘোরে, কিন্তু তাই বলে গল্পটা যে আমার কাছে আদ্যোপান্ত জানা হয়ে গিয়েছে, আমি সমস্তটা দেখে ফেলেছি, তা নয়; দিনে দিনে তখন গল্পটি সম্পর্কে খুব সাধারণ একটা ধারণা পাওয়া যায়। সম্ভবত গল্পের ওই বাড়িটির একটা কোনায় কিছু লালরঙের চারাগাছ আছে, আর, আমি শুধু আর-একটি বিষয় জানি, সেখানে আছেন বয়োবৃদ্ধ এক ব্যক্তি যিনি বাড়িটির সর্বত্র ঘুরে বেড়ান—ব্যস, এইটুকুই আমি জানতে পেরেছি। গল্পের অবিরাম ঘূর্ণনের ফলে এরকম কিছু ঘটে থাকে, গল্পটা এখান থেকেই শুরু হয়ে যায়, তারপর আর যা কিছু করার বাকি থাকে তা হল- স্বপ্ন দেখা। আমার জন্য  এ-সময়টাই হল গর্ভধারণের সময়। এই সময়ের ভিতরে আমার স্বপ্নগুলো ভরা থাকে অজস্র সূত্র আর কিছু পরোক্ষ ইঙ্গিতে, ইশারায়, যা গল্পের ভেতর ঢুকে যেতে চলেছে। কখনও দেখা যায় পুরো গল্পটাই একটা স্বপ্নের ভিতর নিমজ্জমান। আমার প্রথম দিকের এবং খুবই পাঠকপ্রিয় গল্প 'অধিগৃহীত ঘর' হচ্ছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি, এক দুঃস্বপ্ন নিয়ে লেখা, যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আমি নিজে গিয়েছি। দুঃস্বপ্নের রেশ কাটতে না কাটতেই আমি দ্রুতই গল্পটি লিখে ফেলি। কিন্তু এরকম ব্যাপার সবসময় ঘটে না।

হুলিও কোর্তাসার

আমার ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়—স্বপ্ন থেকে লেখার উপকরণ যা যা পাই, তা হল, কিছু সূত্র, গল্পের ভাঙা কিছু টুকরো। তো, এভাবে যা কিছু পাই, তাতেই আমার অবচেতনে একটা বিশেষ কর্মপ্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে থাকে, আর আমাকে দিয়ে গল্পটি লিখিয়ে নেয়। গল্পটিকে অবলম্বন করে যখন স্বপ্নটা দেখতে থাকি, ঠিক তখন থেকেই ভিতরে লেখাটাও চলতে থাকে। সুতরাং, আমি যখন বলি, আমি শুরু করি যে-কোনো একটি জায়গা থেকে, এর মানে হল, আমি আসলে জানিই না শুরুটা কীভাবে হল, এটা কি শুরুর জায়গা, না সমাপ্তির? যখন আমি লেখাটা লিখতে শুরু করি, যেভাবে শুরু করি, সে জায়গাটাই হয়তো তার প্রবেশমুখ। তবে আমি আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকি না যে গল্পটা ঠিক এভাবেই শুরু করব। খুব মামুলি ঘটনার মতো লেখাটা শুরু হয়ে যায় এবং নিয়মিত গতিতে সামনে এগোয়। আর, প্রায় সময়ই গল্পের সমাপ্তি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকে না; আমি জানিই না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটতে চলেছে। ধীরে ধীরে, একমাত্র যখন গল্পটা এগিয়ে যেতে থাকে, তখন বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ঘন কুয়াশার ভেতর অস্পষ্ট কিছুর মতো অপ্রত্যাশিতভাবে গল্পের শেষটুকু আমি দেখে ফেলি! ব্যাপারটা জ্যাজ সংগীতের তাৎক্ষণিক সুর সৃষ্টির মতই, অনেকটা। 

উমবের্তো একো
ইতালির প্রখ্যাত দার্শনিক-ঔপন্যাসিক এবং চিহ্নবিজ্ঞানী

পাঠের ক্ষেত্রে আমি বিশেষ কোনো নিয়ম মেনে চলি না, অর্থাৎ আমি পদ্ধতির অনুগামী নই৷ বেশ কয়েক দশকের চেষ্টায় নিজের ভেতরে আমি এক ধরনের 'নৈতিক অবমুক্তি' অর্জন করতে পেরেছি, সেজন্য আমার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে৷ উপন্যাস পড়ার জন্য রাতে ঘুমানোর আগের সময়টাকে বেছে নিচ্ছি। উপন্যাস পড়ার পক্ষে দিন আমার জন্য উপযুক্ত নয়। দিনে পড়ার সময় মনে হয় কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে আর সেসব ফেলে আমি উপন্যাস পড়ছি! সময় কত দ্রুতই না চলে যাচ্ছে! তবে সবসময় এমনটা করি না, মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমও হয়, যেমন—দু-বছর আগে, অসুস্থ হয়ে পুরো এক সপ্তাহ বিছানায় পড়েছিলাম, সেসময় দ্বিতিয়বারের মতো পড়েছি টমাস মান-এর 'ম্যাজিক মাউন্টেন'; উপন্যাসখানি প্রতিদিন বিকেলে পড়তাম। নিউমোনিয়ায় কাবু হয়ে বছরখানেক আগে একবার হাসপাতালে ভরতি হতে হয়েছিল। নিউমোনিয়ার সেই দিনগুলিতে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' পুনর্পাঠ করেছি... তবুও... আমার বদ্ধমূল ধারণা দিনে উপন্যাস পড়লে অসুস্থ হয়ে পড়ব! 

উমবের্তো একো

এই যে আমি নিজেও ঔপন্যাসিক তা দিয়ে কিন্তু এমন বিশেষ কিছু বোঝায় না, কথাটা বলেছি এজন্য—আমি যখন 'নের্ভাল' অনুবাদ করছি কিংবা জয়েস সম্বন্ধে কিছু একটা লিখছি, তখন কিন্তু দিনরাত খেটেখুটেই লেখাটা লিখছি। আবার, দিনের বেলা যখন কোনো বই পড়ছি, তখন আমি এমন কিছু কথা, এমন কিছু শব্দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি, শব্দের শক্তিকে অনুভব করছি, শব্দটিকে ভাঙছি, বিস্তৃত করে দেখতে চাইছি, আরও ব্যাপকভাবে বোঝার জন্য হয়তো আরও কিছু বইয়ের সাহায্য নিচ্ছি। এভাবে বইটি পড়ছি। নানাভাবে শব্দের পরম অর্থটি বোঝার চেষ্টা করছি। এখন আপনি যদি উপন্যাস পড়তে গিয়েও শব্দের অর্থ অনুসন্ধানে নেমে পড়েন, একপাতা উপন্যাস পড়ে দশপাতা রেফারেন্স দেখতে হয়, তাহলে আপনি উপন্যাস পাঠের আনন্দ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবেন। উপন্যাসে আপনি আখ্যানপ্রবাহের সাথে নিজেকে প্রবাহিত করার সম্ভাবনা তৈরি করেন। উপন্যাসকে আপনি সমুদ্রসৈকতেও পড়তে পারবেন না কারণ আপনাকে বিরক্ত করে তুলতে কেউ না কেউ সেখানে থাকবে। উপন্যাসের জন্য দরকার রাত, একাকিত্ব, খাটের পাশে জ্বলতে থাকা বাতি আর কোনোরকম বিরতি না দিয়ে একটানা পড়ে যাওয়া।   

গোলি তারাঘি
নির্বাসিত ইরানি লেখিকা

জীবনের বেশিরভাগ সময়ই আমি দুটি বিশ্বে থেকেছি; ৭৯-তে ইরান ছেড়েছিলাম, ইসলামি বিপ্লবের একেবারে গোড়ার দিকে। তখন থেকেই আমার জীবনে প্যারিস আর তেহরানের মধ্যে অবিরাম ছুটে চলা শুরু হল, ধারাবাহিক একটা যাত্রা, এক বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতায়, আর খুব স্বাভাবিকভাবেই এই দ্বৈত অস্তিত্ব আমার সাহিত্যকে একটা বিশেষ মাত্রা দিয়ে দিল। 

কিন্তু তেহরানে আমাকে বারবারই ফিরে যেতে হয়েছিল, কারণ লেখালেখির সমস্ত প্রেরণা ছিল আমার স্বদেশ। ইরান হচ্ছে পরস্পরবিরোধিতা আর মতানৈক্যের এক মহাসমুদ্র, এমন এক দুনিয়া যা হাস্যকরুণরসাত্মক অসংখ্য চরিত্র, কিম্ভূতকিমাকার ঘটনা আর পরাবাস্তব পরিস্থিতিতে ভরপুর। প্যারিসের কোথায় আমি বেদানাওলা সেই নারীকে খুঁজে পাব? দিলবারকে খুঁজে পাব? প্যারিসের কোথায় আছে গল্পের সেই চোর?

একই সঙ্গে আমার কাছে প্যারিস হচ্ছে নিজেকে ঋদ্ধ করবার এক স্থান। নিজেকে সমৃদ্ধ করবার তীব্র এক অভিজ্ঞতা। প্যারিসের মুক্ত হাওয়া আমাকে লেখালেখির অদম্য শক্তিটা জোগাল। প্যারিস, রোম কিংবা নিউইয়র্কের উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, ফরাসি কিংবা আমেরিকান লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয়, সেখানকার মানুষের জীবনচর্চার ধারণাগুলো আমার চেতন-জগতটাকে উদ্দীপিত করেছিল, যেখানে ইরানে তা অধিকতর জান্তব, রক্তমাংসের ব্যাপার; শক্তিটা যেন একেবারে অস্থিমজ্জা থেকে উঠে আসছে; অস্তিত্বটাই যেন লেখকের প্রেরণা হয়ে উঠছে, ইরানে। আমার মতো একজন ইমিগ্রান্ট যে প্যারিসে বাস করছে, যার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আরও বহুসংখ্যক নির্বাসিত ইরানি'র সঙ্গে, যারা আর কখনও ইরানে ফিরতে পারবে না। তাদের দেশে ফিরবার আকাঙ্ক্ষা আর জীবন নিয়ে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তাবোধ আমার বহু গল্পের বিষয় হয়ে এসেছে। 'নির্বাসন' এমন এক মানবিক পরিস্থিতি তৈরি করে, সে স্বয়ং এমন একটি ফেনোমেনন, যাকে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। 

গোলি তারাঘি

এখন আসছি আমার চলমান দ্বৈত অস্তিত্ব সম্পর্কিত আপনার প্রশ্নটিতে, যা আমাকে সুযোগ করে দেবে আমার সাহিত্যকর্মের দ্বিখণ্ডিত শৈলীটি নিয়ে কিছু বলতে! নিজের আইডিয়াগুলোকে যখনই আমি লেখায় রূপ দিতে গেছি, প্রিয় শব্দগুলো দিয়ে বাক্যের পর বাক্য লিখেছি, তাঁর আগমুহূর্তেই সেন্সরশিপ ডিপার্টমেন্টের সেই লোকটির মুখ আমার সামনে ভেসে উঠেছে। বহুবার সে তার ধারালো তরোয়াল নিয়ে আমার লেখার নির্দিষ্ট কিছু শব্দ, বাক্য, এমনকি প্যারার পর প্যারাকে কেটে ফেলে দিয়েছে। আমি বরফের মতো জমাট বেঁধে গেছি, পরিণত হয়েছি হতাশাগ্রস্ত, সীমিত পরিসরের ক্ষুদ্র এক লেখকে—এমন এক লেখক, যাঁর কল্পনাগুলো শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয়েছে ক্রমাগত ভয়ভীতি প্রদর্শনের কাছে। সেন্সরশিপ ডিপার্টমেন্টের লোকটির জন্য নিজেই আমি নিজের লেখাকে সেন্সর করেছি, সেই লেখার আর-একটি সংস্করণ লিখেছি নিজের জন্য। যদিও পরবর্তীকালে আমি এক মুক্ত লেখকে পরিণত হতে পেরেছিলাম; স্বাধীন ইচ্ছায় বেছে নিতে পেরেছিলাম আমার বিষয়, দৃশ্য আর শব্দগুলোকে। আমি আমার ভাবনা নিয়ে অসীম আকাশে উড়াল দিতে পেরেছিলাম; আমার অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষাগুলোকে সমুদ্রপৃষ্ঠে ভাসতে দিয়েছিলাম! 

আমার বিশ্বাস যেদিন মায়ের জঠর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, সেদিন থেকেই লিখছি। বাইরের দুনিয়া দেখে চিৎকার করে কেঁদে আগমনী সংবাদ জানান দিয়েছিলাম, সেই চিৎকারটিই ছিল আমার প্রথম গল্পের প্রথম বাক্য, যে-গল্পটিকে ভবিষ্যতে কোনো একদিন লিখব। বাবা ছিলেন লেখক। দুটি সাপ্তাহিক জার্নালেরও এডিটর ছিলেন তিনি। আমি দেখতাম কালির পটে তিনি তাঁর কলমটিকে বারবার চুবিয়ে খুদে খুদে সব অদ্ভুত পিঁপড়ে, মাছি আর দুনিয়ার সমস্ত প্রাণির ছবি আঁকতেন, তারপর আমাকে সেই ছবিগুলো দেখিয়ে বলতেন, দ্যাখো তাকিয়ে, তাদেরকে যখনই তুমি একসাথে আঁকবে তখনই তারা মিলেমিশে কখনও চকোলেট, কখনও বড়ো একটি ক্রিমকেক হয়ে যাবে, অথবা তারা তোমার নাম বলবে। আমি তো ম্যাজিক দেখে হতবাক! সবকিছু তাহলে কালির বোতলের ভেতর লুকিয়ে আছে! যতগুলো গল্প আমি লিখতে চেয়েছিলাম...সব!?  

বাবা যেদিন বাইরে যেতেন, সেদিন তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকতাম। কোনোমতে চেয়ারের ওপর উঠে—আমার বয়স তখন মাত্রই চার বছর—কালির বোতলে আঙুল ঢুকিয়ে দিতাম, তারপর আমার আঙুল আর বাবার কলম দিয়ে পিঁপড়ে ও মাছি আঁকতে আঁকতে গল্প লিখতে শুরু করে দিতাম। একসময় হাতের আঙুলগুলো আর চোখমুখ, গায়ের সাদা জামা সব কালিতে ভরে যেত। আসলে তখন স্বর্গেই ছিলাম। বাবার ঘরে তখন পুরোদস্তুর এক লেখক; আচমকা পেছনে মা-র রাগী চিৎকার: কী জঘন্য আর নোংরা তুমি, যাও এখুনি, জামাকাপড় বদলে হাত ধুয়ে এসো। 

কেউই জানতে পারল না—এটাই ছিল আমার লেখা প্রথম কোনো গল্প এবং সম্ভবত সবচেয়ে ভালো গল্প; এত বছর পরও এরকম আর-একটি গল্প আমি লিখে উঠতে পারিনি। গল্পটি ধুয়ে মুছে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য; এবং আমি এখানে বলতে চাই, এটাই আমার জীবনে সেন্সরশিপের প্রথম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা!

হোসে সারামাগো
নোবেলজয়ী পর্তুগিজ উপন্যাসিক 

লেখাটিতে, সেটা উপন্যাস হোক বা অন্য কিছু, আমি যখন পুরোপুরি ডুবে যাই, তখন দরকার  নিরবচ্ছিন্নতা। অবিরাম লিখতে থাকার দরকার হয় যখন, তখন প্রতিদিনই লিখি। বাড়ির কিছু কাজ মাঝে মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কোথাও যাওয়ার থাকলেও কাজে বাধা পড়ে, তখন আর অবিরাম লেখা যায় না; এসব বাদ দিলে আমি প্রতিদিন-লিখতে-বসা-লেখক, আবার আমি কিছু নিয়ম-মেনে-চলা-লেখকও। প্রতিদিন নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা লিখতেই হবে বলে নিজেকে জোর করে লেখায় বসাই না; একদিনে দুই পৃষ্ঠা—সাধারণত এই পরিমাণ লিখতে পারলেই আমার হয়ে যায়। আজ হয়তো নতুন একটি উপন্যাসের দুই পৃষ্ঠা লিখলাম, আগামীকাল লিখব আরও দুই পৃষ্ঠা। আপনার মনে হবে দিনে মাত্র দুই পৃষ্ঠা খুব বেশি তো নয়, সামান্য; কিন্তু আমাকে তো অন্য লেখাও লিখতে হবে; কিছু গদ্য, চিঠিপত্রের উত্তর; হিসেব করে দেখুন প্রতিদিন দুই পৃষ্ঠা করে লিখতে লিখতে বছরে আটশো পাতার মতো লেখা আপনার টেবিলে জমা হচ্ছে। কম কথা!   

হোসে সারামাগো

এ ছাড়া আমি খুবই সাদামাটা, তেমন বিশেষত্ব কিছু নেই, তবে আমার কোনো বাজে অভ্যাস নেই, নাটকীয়তাও নেই, মোটের ওপর লেখার কাজটিকে কোনোভাবেই আমি কল্পনার রং মিশিয়ে অতিরঞ্জিত করি না। সৃষ্টির কাজে মগ্ন হয়ে আমি যে বিপন্নতার মুখোমুখি হই, যে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করি, সে সম্পর্কে কথা বলতে চাই না। লেখার টেবিলে পড়ে থাকা না-লেখা কাগজটিকে আমি কখনও ভয় পাই না। এমনকি যে রাইটার্স ব্লকের কথা সবাই বলে, আরও যেসব সমস্যার কথা লেখকদের মুখে প্রায়ই শুনি, এসবের কোনো ভয় আমার ভেতর ক্রিয়া করে না। এসব সমস্যা আমাকে পীড়িতও করতে পারে না। কিন্তু অন্য কোনো কাজ করতে গেলেই বিপত্তি বাধে। কাজটিকে আমি যেভাবে সম্পন্ন করতে চাই তেমন সুচারুভাবে হয় না, কখনও কাজটি আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কাজটিকে আমি ঠিক যেভাবে করতে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবে না হলে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হই।   
 
আইজ্যাক বাশেভিস সিঙ্গার 
পোল্যান্ডের নোবেলজয়ী ঈদ্দিশভাষী কথাসাহিত্যিক

গল্পের খোঁজে আমি কখনও বের হই না। হ্যাঁ, নোট তো নিতেই হয় কিন্তু সেটা ঠিক রিপোর্টারের নোট না। আমার সমস্ত গল্পের ভিত্তি সেই বিষয়গুলো যা আমার জীবনে পরপর ঘটেছে, তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য আমাকে বাইরে বের হতে হয় না, তবে আমি নোট নিই, তা হচ্ছে গল্পের আইডিয়ার নোট। আমি সে অর্থে সাহিত্যে প্রতিদিনকার জীবন-অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি বর্ণনাকারী লেখক না। আমার কাছে যখনই একটি বিশেষ আইডিয়া আসে, ছোট্ট নোটবুকে সেই আইডিয়াটিকে টুকে ফেলি, নোটবুকটি সব সময়ই আমার পকেটে থাকে। একেবারে চূড়ান্ত সময়ে গল্পটি যখন লিখিত হবার দাবি করতে থাকে, কেবল তখনই আমি লিখতে শুরু করি!

আইজ্যাক বাশেসিভস সিঙ্গার

লেখকরা যদি ভালো লেখক না হন, তাহলে এই আশঙ্কা তো সত্যে পরিণত হবেই- মনোযোগের কেন্দ্রে আসতে সাহিত্য ব্যর্থ। তবে আশার কথা এই, গল্প বলার শক্তি আছে, এরকম লোকের কিন্তু অভাব নেই আমাদের, এবং তাদের পাঠকও আছে। আমি তো এমনটা ভাবতেই পারি না যে মানুষের স্বভাবে এমন আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটেছে, যার কারণে 'ওয়ার্ক অব ইমাজিনেশন'-এর প্রতি সে তার  আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে! সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়, গল্প যে-সত্য অবলম্বনে নির্মিত হয়, তা সব সময়ই আগ্রহোদ্দীপক। দেখুন, নন-ফিকশন আজ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে এসেছে... কী ঘটেছে, কী ঘটতে চলেছে—এ ব্যাপারে লোকের আগ্রহ এখন চরম। মানুষ যদি চাঁদে যায়, তাহলে তার যাওয়া নিয়ে সাংবাদিকরা লিখে জানাবেন, এ নিয়ে ফিল্ম তৈরি হবে। চাঁদে লোকে কী করছে, কী কী ঘটছে সেখানে—এসব গল্প কিন্তু আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসবে সব কিছুকে ছাপিয়ে, একজন ফিকশন রাইটার যখন সেই কথাগুলো লিখবেন, ঠিক তখন। খবরের কাগজ, ফিল্ম তখন চাপা পড়ে যাবে। কথা হচ্ছে, ভালো লেখকের জায়গাটি এখনও হারিয়ে যায়নি। কোনো যন্ত্র, কোনো সংবাদ প্রতিবেদন, আর কোনো ফিল্মের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না একজন টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, গোগোল যা করেছেন, তা করতে পারা। তবে এটা সত্য, আমাদের কালের কবিতার যাত্রা যেন বিস্মৃতির দিকে... কিন্তু এর জন্য টেলিভিশন কিংবা অন্য কোনো কারণ নয়, বলতে হবে কবিতা নিজেই খারাপ হয়ে গেছে, দুর্বল কবিতা রচিত হচ্ছে। আমাদের যদি প্রচুর সংখ্যক খারাপ উপন্যাস থাকে আর খারাপ উপন্যাসিকরা একজন আর-একজনকে অনবরত অনুকরণ করতে থাকেন, তাহলে তাঁরা যা লিখবেন, তা না হবে আগ্রহোদ্দীপক, না কেউ সেগুলো পড়বে। এভাবেই হয়তো একটা বিশেষ সময়ের উপন্যাসকে মেরে ফেলা হচ্ছে। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের প্রযুক্তিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। 

প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে, ততই মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠবে যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া মানুষের মন নতুন কী সৃষ্টি করছে, তা জানার জন্য।

মারিও বার্গাস ইয়োসা
প্রখ্যাত লাতিন আমেরিকান লেখক 
 
সাধারণভাবে বলতে গেলে, স্মৃতিই হচ্ছে সেই বিশেষ বিন্দু, যা থেকে আমার লেখাটির যাত্রা শুরু হয়। আমার স্থির বিশ্বাস এপর্যন্ত যতগুলো গল্প আমি লিখেছি সবগুলোই এমন সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে, যে-অভিজ্ঞতাগুলো আমার স্মৃতিতে চিরন্তন, লেখায় এইসব স্মৃতি এক-একটি ছবি হয়ে ওঠে, সেই ছবিকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে একটি কাঠামো, সে-কাঠামোকে কল্পনার জন্য দরকার হয় ভাবনার উর্বর মাটি। আবার এটাও তো সত্য যে, গল্প লিখতে গিয়ে সবসময়ই আমি একটি রূপরেখা অনুসরণ করেছি, একেবারে প্রথম গল্পটি থেকেই, সেজন্য আমাকে অসংখ্য নোট নিতে হয়েছে, ইনডেক্স কার্ড তৈরি করেছি, লিখতে বসার আগে প্লটগুলোর স্কেচ পর্যন্ত করেছি। লেখাটা শুরু করতে সক্ষম হওয়ার জন্য আমার একটি কাঠামো (স্ট্রাকচার) প্রয়োজন হয়, হয়তো অতি সাধারণ এক কাঠামো, গল্পটিকে এই কাঠামো দিয়ে ধরতে হয়।

মারিও বার্গাস ইয়োসা

কাঠামো হয়ে গেলেই লেখাটা আমি শুরু করতে পারি। প্রথমেই আমি একটি খসড়া তৈরি করি; প্রথম খসড়াটিই কাজের সবচেয়ে জরুরি অংশ যাকে আমার কাছে লেখার সবচেয়ে কঠিন দিক বলে মনে হয়। যখনই প্রথম খসড়াটি হয়ে যায়, লেখাটি তখন থেকেই আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে থাকে, তখন আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় কয়েক গুণ; মনেও শক্তি আসে, নির্ভার লাগে, কারণ আমি তখন জানি গল্পটা কোথায় কী অবস্থায় আছে। আমার সমস্ত লেখালেখির পেছনে এসবই অনড় নিয়ম, যেন এক ধ্রুব সত্য রচিত হচ্ছে—থিম, সিচুয়েশন ও টাইম পিরিয়ডকে ধরে ধরে, গল্পটি যে-সময়কে আশ্রয় করে বেড়ে উঠছে। 

  • সূত্র- নৈঃশব্দ্যের সংলাপ : বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার, অনুবাদ- এমদাদ রহমান, প্রকাশক- জলধি; নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান বুক ক্লাব আলোচনাচক্র; জন ফ্রিম্যান-এর সাক্ষাৎকার- হাউ টু রিড এ নভেলিস্ট'; ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডার্স।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.